আমি এক যাযাবর-২০/শৌভিক কুন্ডা
আমি এক যাযাবর (বিংশতি পর্ব)
শৌভিক কুন্ডা
জিশান অল্প কিছুদিনের জন্য দেশে ফিরেছে, শ্যালিকাপুত্র। জোনাক, আমার মেয়েও ফিরে যাবে মুম্বইতে কাজের জায়গায় ক'দিন পর, এই দুজনের জন্যেই বলা যায় এবারের চারখোল যাত্রা (আমার পায়ের তলার আবহমান চাকাতে তেল দেওয়ার ভালো এক্সকিউজ)!
বাপি গাড়ি ছোটালো এমন পথে, যেদিকে আমি আগে কখনো যাই নি। অর্থাৎ, দোমহানি তেমাথা থেকে বাঁ হাতে! রাস্তা খুব একটা ভালো না অন্তত কিলোমিটার দশেক। একমাত্র পাওনা একঝলক পদ্মপুকুর, চলার পাশে। বাগানবাড়ি মোড়, তারঘেরা রেঞ্জ পেরিয়ে ওদলাবাড়িতে ওঠার পর চোখ চেনা পথে ফিরলো। গাড়ি চায়ের জন্য যেখানেই একটু মানুষজন দেখে দাঁড়ায়, সেখানে সেখানে মহার্ঘ্য বস্তুটি অমিল! শেষ পর্যন্ত মংপং পৌঁছে তৃষ্ণার শান্তি। পথের ধারের ছোট্ট দোকান, চায়ের সাথে নোনতা বিস্কিটও এমন কি মিলে গেল, ঠিক যেমনটা পেলে এ ধরনের ছোট্ট ছুটগুলোর সত্যিকার মজা পাওয়া যায়! কালিঝোরা বাংলো পেরিয়ে ডানদিকে জলবিদ্যুৎ প্রকল্প চত্বরে ঢোকা, চেকপোস্টে গাড়িবৃত্তান্ত নথিভুক্ত করিয়ে। আমার এই প্রথম। এই প্রকল্প তৈরির কাজ দেখতে দেখতেই তো সোজা পথে ছুটতাম বরাবর, জোনাক যে দশটা বছর কালিম্পংয়ে থাকতো। সে-ও তো কত বছর আগের কথা। ডাইনা মুড় এবারেই প্রথম। জিশান-জোনাক মোবাইল ক্যামেরা অন করতেই বাপির হুঁশিয়ারিতে থেমে গেল। এ তল্লাটে ছবি তোলা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। গাড়ি ওপরের দিকে চলতে চলতে আবার চেকিং। এর পর আর নজরদারি নেই। পানবু ছাড়িয়ে সামথার। মন উসখুস করছে বুঝতে পেরে বাপি বললো, "ফেরার পথে স্যার, যেখানে থামতে বলবেন, সেখানেই দাঁড়াবো।"
তথাস্তু।
লামাদাড়ার ঝাঁকিদর্শন। বাপি বেশ খানিক আগেই গাড়ির এসি বন্ধ করে দিয়েছিলো, ওপরমুখী গাড়ি টানতে সুবিধে হবে বলে। চারখোল ঢুকতে ঢুকতে সে যান্ত্রিক অভাব মুছতে লাগলো আর আমরা ঢুকে পড়লাম শান্ত শীতলপাটির ক্যানভাসে। হোমস্টে পৌঁছাতে পৌঁছাতে চোখ, মন, শরীর জুড়িয়ে গেল।
এরপর লজ্জিত হতে হ'ল আমাকে। ছবি দেখে হোমস্টে বেছে নিয়েছিলাম আমিই (বরাবরই অবশ্য এ দায়িত্ব আমারই থাকে)। সেই মতো রাস্তা থেকেই ঢুকে যাওয়ার কথা। সুশীলদার শারীরিক অবস্থার কথা মাথায় রেখেই বরাবর "গৃহ প্রবেশে" মসৃণতা বেছে নিই। কিন্তু ফেসবুকের ছবি বিশ্বাসঘাতকতা করলো। প্রায় একমানুষ সিঁড়ি নেমে ফের দোতলায় উঠতে হবে। আর নামাটা আরও কষ্টকর, সুশীল দার পক্ষে অসম্ভব! প্রায় নিঃশব্দে এসে প্রেম সুশীলদাকে পিঠে তুলে নিয়ে সোজা দোতলায়! আমরাও, একে একে। তিনটে ঘরে ব্যবস্থা ছ জনের। ঘরে ঢুকতে গিয়ে দরজায় সাঁটা অনুরোধে হোঁচট খেলাম! বাইরের জুতো খুলে ঢুকতে হবে! ভেতরে ঢুকে কারণটা বোঝা গেল। আর খেয়ালও হ'ল, এই যে কিছুটা পথ সিঁড়ি আর বারান্দা পেরোলাম, এতটা পরিষ্কার রাফ-ঢালাই আগে কখনো দেখেছি কি! ঘরে পা রাখতেই নরম, ধূসর কার্পেট। ওয়াশরুমের সামনে চপ্পলজোড়া, ভেতরে নীল তোয়ালের ভাঁজ, ঘরের কিংসাইজ বিছানায় বেডশিট থেকে ব্ল্যাংকেট, পিলোকভার টু অ্যাশট্রে, সবকিছুই এতটা ঝকঝকে, যেন এইমাত্র কেউ ঝেড়ে মুছে রেখে গ্যাছে!
অনেকক্ষণ থেকেই একটানা একটা উচ্চারণ কানে এসে পড়ছিলো, স্বাগত-চায়ে চুমুক দিয়ে সে শব্দের উৎস খুঁজতে ঘর থেকে বের হলাম। বারান্দার এ বাঁক সে বাঁক মোচড় দিয়ে হঠাৎ দেখি চিলেকোঠার সিঁড়ি! আর সেখান থেকেই আওয়াজটা আসছে। একটানা, কিছুটা একঘেয়েই, ছন্দিল চলনের পুনরাবৃত্তি। আর তার সাথে সাথে গং গং গং ঘন্টাবাদ্যি।
সিঁড়ি ভাঙলাম, একচিলতে স্পেস, সেখানে টেবলের ওপর আয়তাকারে সারি সারি প্রদীপ। একজন মহিলা দাঁড়িয়ে ছিলেন। যেন আমি আসব একথা জানাই ছিলো। ঈঙ্গিতে প্রদীপ জ্বালাতে বললেন। জ্বলন্ত ধূপকাঠি এগিয়ে দিলেন, তার গোড়ায় আবার ফুলের বাঁধন। সেই দিয়ে প্রজ্জ্বলন। তারপর আবার ইশারা অনুসারে একটি দরজা পেরোতেই কন্ঠ, যন্ত্র সব শব্দ কয়েক গুণ বেড়ে ঝাঁপিয়ে এলো। বেশ বুড়ো একজন হেসে স্বাগত জানালেন। ঘুপচি ঘর, চিলেকোঠারই মাপে। সেখানেই চলছে পুজো। এঁরা বৌদ্ধ, বুঝতে পারছি। বৃদ্ধ মানুষটি ইশারায় প্রণাম করতে বললেন। আমি স্বভাবমতো দায়সারাভাবে এদিক ওদিক দেখতে দেখতেই বুকের কাছে দুটো হাত জোড়া করে আনলাম। সাদা ভ্রূ জোড়া কুঁচকে গেল বোধহয়। নিজে হাঁটু গেড়ে দু হাতে ভর রেখে মাথাটা নামিয়ে মাটিতে ঠেকালেন। বুঝলাম, একেই বলে প্রণত হওয়া! কেন যে আবারও লজ্জা পেলাম!
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴