স্মৃতি দিয়ে ঘেরা
দ্বিতীয় পর্ব
রণজিৎ কুমার মিত্র
!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!
উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় উদ্বোধনের দিনই বন্ধ হয়ে যাবার নির্দেশে সবাই একটু হতাশ হয়ে পড়েছিলেন, রাজা রামমোহনপুর ক্যাম্পাসে সবে কিছু ঘরবাড়ি তৈরি হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ চালাবার জন্য। দেশের সেই দুর্যোগের মুহূর্তে, চীন-ভারত যুদ্ধের ভয়ঙ্কর দুঃসময়ে সেনাবাহিনীর হাতে ছেড়ে দিতে হল উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজা রামমোহনপুর ক্যাম্পাস। সেনাবাহিনীর অস্থায়ী শিবির হবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে। উদ্বোধনের দিনই যে এরকম বিপত্তি হতে পারে তা কেউ ভাবেননি । অবশেষে বিপদের মেঘ সরে গেল, সেই উদ্বোধনের দিনেই , অর্থাৎ পহেলা নভেম্বর ১৯৬২র বিশেষ লগ্নে, উপাচার্য বিনয়েন্দ্র দাশগুপ্ত আরেকটি নির্দেশ নামায় জানিয়ে দিলেন উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের পঠন-পাঠন শুরু হবে ৫ই নভেম্বর ১৯৬২ থেকে, তবে রাজা রামমোহনপুর ক্যাম্পাসে নয়, শুরু হবে শিলিগুড়ি কলেজের নবনির্মিত ছাত্রাবাস ভবনে। শিলিগুড়ি কলেজ সেদিন এক ঐতিহাসিক দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করেছিল। শিলিগুড়ি কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ দুর্গাকিংকর চট্টোপাধ্যায় কলেজের দরজা খুলে দিয়েছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য।
বিশ্ববিদ্যালয় উদ্বোধনের দিনই বন্ধ হয়ে যাবার নির্দেশ পেয়ে প্রাথমিকভাবে সবাই হতাশ হয়েছিলেন। এই নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ে সদ্য যোগদানকারী শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীরা ভাবছিলেন যে যার নিজের গৃহে ফিরে যাবেন কিনা ! উপাচার্যের নতুন নির্দেশে তাঁরা উৎফুল্ল হয়ে উঠলেন। বিশ্ববিদ্যালয় নতুন কর্মপ্রেরণার আহবানে সকালবেলার ভৈরবীতে বেজে উঠল "চলো শিলিগুড়ি কলেজ চলো," সেখানেই হবে নতুন বিশ্ববিদ্যালয় , উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের পঠন-পাঠনের শুভ সূচনা।
সেদিন ৯ জন শিক্ষক আর ১৭ জন শিক্ষাকর্মী নিয়ে পথচলা শুরু হয়েছিল উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের, মাত্র ১৬টি কলেজ তখন উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে গড়ে উঠেছে। সমগ্র উত্তরবঙ্গের কলেজগুলিতে স্নাতক শ্রেণির ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা ছিল মোট ৮০০০ । উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজা রামমোহনপুর ক্যাম্পাসে সেদিন যেসব বিভাগগুলি খোলা হয়েছিল ,- ইংরেজি ,অর্থনীতি , রাষ্ট্রবিজ্ঞান, ভূগোল ,পদার্থবিদ্যা ও অংক মাত্র ৬ বিভাগ। ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা সব মিলিয়ে ৪৫ জন । (সূত্র : The early period of North Bengal University : Professor Manas Dasgupta)
পশ্চিমবঙ্গের রূপকার প্রথম মুখ্যমন্ত্রী ডঃ বিধানচন্দ্র রায়ের স্বপ্ন ছিল - উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় শুধুমাত্র একটি উচ্চ শিক্ষাকেন্দ্র নয়, উত্তরবঙ্গের সমাজ-শিক্ষা-অর্থনীতির উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেবে। উত্তরবঙ্গ ইতিহাসের দিক থেকে কিংবা রাজনৈতিক বিভাজনে কোন পৃথক অঞ্চল নয়, কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী, প্রাণকেন্দ্র কলকাতা থেকে দূরত্ব, যোগাযোগের ব্যবস্থা ও অপরিচয় ক্রমশ উত্তরবঙ্গের ছটি জেলার মানুষের মনে অনস্তিত্বের যে হতাশা সঞ্চার করেছিল, সেখানে উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা অনেক আশা স্বপ্ন আর উজ্জ্বল ভবিষ্যতের প্রতিশ্রুতি বহন করেছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম আলো নিয়ে সেদিন যেসব শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীরা এসেছিলেন তাঁরাও উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন-এর ইতিহাসের অংশ হয়ে রইলেন । বিশ্ববিদ্যালয় মানে তো শুধুমাত্র সিমেন্ট-লোহা- ইট দিয়ে গাঁথা সুরম্য অট্টালিকা নয়, তার ভেতরে রয়েছে এক সজীব প্রাণপ্রবাহ, শিক্ষক-ছাত্র-গবেষক-শিক্ষাকর্মী সকলের মধ্য দিয়ে সেই প্রাণ প্রবাহের পরম্পরা আজও বয়ে চলেছে একটুও থেমে নেই । বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠালগ্নে যেসব শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীরা প্রথম আলো ছড়িয়ে দিয়েছিলেন, তাঁদের নামগুলো শ্রদ্ধার সাথে উচ্চারণ করি।
শিক্ষকদের নাম:
১) ডঃ সত্যপ্রসাদ সেনগুপ্ত
২) ডঃ সুধাংশু চন্দ্র ভট্টাচার্য
৩) ডঃ শান্তিরঞ্জন দাসগুপ্ত
৪) ডঃ মহাদেব দত্ত
৫) ডঃ সুজন বান্ধব চট্টোপাধ্যায়
৬) মৃণাল কান্তি দত্ত
৭) অনিন্দ্য পাল
৮) বিমল কুমার বাজপেয়ি
৯) তরুণ মুখোপাধ্যায়
শিক্ষাকর্মীদের নাম :
১) অমর নাথ মুখার্জী
২) অজিত কুমার ঘোষ
৩) পি এন ব্যানার্জি
৪) হরিপদ দে
৫) মুকুল মজুমদার
৬) রণবীর দাশ
৭) দেবব্রত বসু
৮) প্রশান্ত সেন
৯) মনোজ চক্রবর্তী
১০) অমিতাভ চৌধুরী
১১) গোবিন্দ বন্ধু অধিকারী
১২) শান্তি কুমার মন্ডল
১৩) অপূর্ব কুমার চট্টোপাধ্যায়
১৪) নৃপেন্দ্র কুমার সেনগুপ্ত
১৫) রমাপতি ঘোষ
১৬) রেখা মিশ্র
১৭) কার্তিক চন্দ্র রায় কর্মকার
(সূত্র: Reflection : Golden jubilee celebration 1962 — 2011, University of North Bengal)
উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্মেষ পর্বের এইসব শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীদের অনেককেই দেখেছি এবং তাঁদের সান্নিধ্যে আসবার সুযোগ পেয়ে ধন্য হয়েছি।
উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবনে সেদিন যাঁরা এসেছিলেন তাঁদের মধ্যে অনেকেই উত্তরবঙ্গের বাইরে থেকে আসা মানুষজন ছিলেন, কিন্তু সময়ের সাথে সাথে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে থেকে ভালোবেসে তাঁরা একান্তই উত্তরবঙ্গের মানুষ হয়ে গিয়েছিলেন । এঁদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে রবীন্দ্রনাথের কবিতা থেকে কয়েকটি লাইন নিবেদন করতে পারি। এঁদের কল্লোল, ছাত্র-ছাত্রীদের কলরব নিয়েই আবির্ভূত হয়েছিল উত্তরবঙ্গের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়।
' হে মোর অতিথি যত! তোমরা এসেছ এ জীবনে
কেহ প্রাতে, কেহ রাতে ,বসন্তে ,শ্রাবণবরিষনে।
কারো হাতে বীণা ছিল, কেহ-বা কম্পিত দীপশিখা
এনেছিলে মোর ঘরে; দ্বার খুলে দুরন্ত ঝটিকা
বার বার এনেছ প্রাঙ্গণে ।যখন গিয়েছ চলে
দেবতার পদচিহ্ন রেখে গেছ মোর গৃহতলে ।
আমার দেবতা নিল তোমাদের সকলের নাম;
রহিল পূজায় মোর তোমাদের সবারে প্রণাম।।'
("সঞ্চয়িতা" : পৃষ্ঠা ৫৩১)