সরস্বতীপুর চা বাগান-২/গৌতম চক্রবর্তী
সরস্বতীপুর চা বাগান
দ্বিতীয় পর্ব
গৌতম চক্রবর্তী
^^^^^^^^^^^^^^^^^
‘হামরি বেটিয়া দেশ কে লিয়ে চুনে গ্যয়ে, হাম চাহতে হ্যায় কি ইয়ে দো বেটিয়া জান পে জান দেকে খেলে অউর দেশ কা অউর হামারে চায়ে বাগান কি নাম হর কোণে কোণে মে রোশন করে’। কথাটা যার সে লখীমণি ওঁরাও। চন্দ্রার মা। পাশে দাঁড়ানো শান্তি ওঁরাও স্বপ্নার মা। চা বাগিচার দিন আনি দিন খাই মজদুর। একজন মহিলা শ্রমিক। সম্পূর্ণ আনপড়। কোনরকমে নামসই করতে পারে। কিন্তু চোখে সে তার মেয়েকে নিয়ে একরাশ স্বপ্ন দেখে। এই মেয়ে দুটি স্বপ্না আর চন্দ্রা। স্বপ্না আমার স্কুলের অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র দীপেশ ওঁরাও এর দিদি। নিশ্চয় কৌতূহল হচ্ছে কে এই স্বপ্না আর চন্দ্রা? এরা দুজন হল সরস্বতীপুর চা-বাগিচার অবহেলিত শ্রমিক পরিবারের লড়াকু দুই কিশোরী। স্বপ্নার বাবা মনু ওঁরাও এবং চন্দ্রার বাবা সুরেন ওঁরাও সরস্বতীপুর চা-বাগানে মাসিক ৪৮০০ টাকার শ্রমিকের চাকরি করেন। তাদের এই সামান্য আয় দিয়েই সংসার চালাতে নুন আনতে পান্তা ফুরানোর অবস্থা। মেয়েদের খেলার জন্য যে ধরনের ভাল খাবার প্রয়োজন তা তাঁরা দিতে পারেন না। অথচ সরস্বতীপুর চা-বাগানের স্বপ্না এবং চন্দ্রা জাতীয় রাগবি দলে নির্বাচিত হয়ে বহুদিন ধরে দেশের জন্য খেলছে। খেলছে আন্তর্জাতিক স্তরেও। এমনকি রাজ্য রাগবি দলে যে খেলোয়াড়েরা রয়েছে তারা অধিকাংশই সরস্বতীপুর চা-বাগানের। আগের সপ্তাহেই বলেছিলাম, শুধু পর্যটনেই নয়, বিশ্বব্যাপী এবার রাগবিতেও নিজের পরিচিতি পেয়ে গেছে গজলডোবার নতুন প্রজন্ম। গজলডোবার পাশেই সরস্বতীপুর চা-বাগানের মত ছোট একটি গ্রামে আমেরিকার জনপ্রিয় খেলা রাগবিতে মজে রয়েছে সরস্বতীপুর চা বাগিচার ছেলেমেয়েরা। রাগবি খেলাই সরস্বতীপুরকে আলো দেখিয়েছে। গুদাম লাইনের মাঠে ও নদীর পারে প্রায় ৫০০ জন কিশোর কিশোরী খেলার পাঠ নিচ্ছে। এদেরই প্রতিনিধি স্বপ্না, চন্দ্রা সহ আরো অনেকের লড়াইয়ের কাহিনী নিয়েই এবারের “সহজ উঠোনের বাগিচা সফর”।
সরস্বতীপুর গ্রামটা এমনিতে আর পাঁচটা সাদামাঠা গ্রামের মতোই। জঙ্গল-ঘেরা এক প্রত্যন্ত চা-বাগান এই সরস্বতীপুর। বৃহৎ এলাকা জুড়ে থাকা এই বাগানের জনসংখ্যা প্রায় ছ'হাজার। বাসিন্দাদের সিংহভাগই চা শ্রমিক। বন্য হাতি, চিতা বাঘের হানা প্রায় নিত্যদিনের ঘটনা। এই আধুনিক যুগে যেমন এখানে যোগাযোগ ব্যবস্থার অসুবিধা, তেমনই মোবাইলের নেটওয়ার্কও পাওয়া যায় না। কাঁচা এবড়োখেবড়ো পথ পায়ে হেঁটে যাতায়াত করতে হয়। চা বাগান লাগোয়া গ্রাম। তাই চা শ্রমিকদের ছেলেমেয়েতেই ভর্তি। কেউ বাংলায় কথা বলে, কেউ হিন্দি, কেউ নেপালি, কেউ আবার দেহাতি বিহারী ভাষায়। সব মিলিয়ে রীতিমত জগা খিচুড়ি ভাষার একটি গ্রাম। এখানে মেয়েদের পড়াশোনা নিয়ে কেউ কখনও মাথাই ঘামায় না। চা বাগানের সারাদিনের হাড়ভাঙা খাটুনি। রোজগার খুবই কম। তাও যদি কাজ থাকে। অথচ ওটাই ওদের গোটা পৃথিবী, বাইরের জনজীবনের সঙ্গে মুখ দেখাদেখি নেই। কর্মহীন, বেকারত্ব কাঁটার মতো বিঁধে থাকে। অশিক্ষা, নেশা, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, বিশুদ্ধ পানীয় জলের অভাব, চা বাগান মালিকদের শোষণ, হিংস্র জন্তুর হানা—সব মিলিয়ে প্রকৃতির কোলে অভিশপ্ত জীবন এই গ্রামে। কিন্তু একটা খেলা যার চল ভারতে কোনও কালেই ছিল না সেখানে রাগবি খেলায় ভর করে জলপাইগুড়ির সবুজের আড়ালে লুকিয়ে থাকা একটি গ্রাম আলোচনার শিরোনামে উঠে এসেছে। দীর্ঘদিন ধরেই উত্তরবঙ্গের মুখ্য শিল্প চা-শিল্পের শোচনীয় অবস্থা। বেশ কয়েকটি বাগান যেমন বন্ধ হয়ে পড়ে রয়েছে, তেমনই অনেক বাগানের অবস্থা রুগণ। এইসব বন্ধ ও রুগণ চা-বাগানগুলো থেকে বহু চা শ্রমিক অন্যত্র জীবিকার টানে চলে যাচ্ছেন। মানব পাচারের মতো ঘটনাও ঘটে চলেছে এইসব বাগান থেকে। অনাহারে-অর্ধাহারে থাকা অনেক চা শ্রমিকের মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে। এককথায়, উত্তরের চা-শিল্পে ভয়ংকর পরিস্থিতি চলছে আজ। সেখানে জলপাইগুড়ি জেলার রাজগঞ্জ ব্লকের সরস্বতীপুর চা-বাগান এক আলাদা নজির তৈরি করেছে।
আমার স্কুল ধাপগঞ্জ আশ্রম টাইপ হাইস্কুলে পড়ত সরস্বতীপুর বাগানের আলিম ওঁরাও, মনোজ ওঁরাও, আশ্রিত ওঁরাও, দীপেশ ওঁরাওরা। পাশ করে গেছে সকলেই। আলিম ওঁরাও জাতীয় স্তরের রাগবি প্লেয়ার। অষ্টম শ্রেণিতে পাঠরত দীপেশ ওঁরাও, মনোজ ওঁরাওরা আমাদের বিদ্যালয়ের মাঠে রীতিমত রাগবি অনুশীলন করত। তাই আমার সবিশেষ কৌতূহল ছিলই যে কীভাবে এবং কার সহযোগিতায় রাগবি অনুশীলন করে ওরা? তখন জেনেছিলাম দীপেশের দিদি জাতীয় স্তরের রাগবি প্লেয়ার। দীপেশকে কথা দিয়েছিলাম ওর দিদির কথা সময় সুযোগ পেলে লিখব। সেই সুযোগ করে দিল সহজ উঠোনের বাগিচা সফর। একরাশ কৃতজ্ঞতা জানাই “সহজ উঠোনকে”। বলা ছিল ওদেরকে আমি আসব। ফলে ওদের চন্দ্রাদিদির কাছে পৌঁছাতে আমার বেগ পেতে হল না। সেখানেই জানলাম বাগিচা কন্যাদের লড়াইয়ের ইতিহাস। অনূর্ধ্ব ১৮ রাগবি জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে বাংলা। আর এই বাংলা দলের ১২ জন মেয়ের মধ্যে সাত জন সরস্বতীপুর চা বাগানের। নাগপুরে আয়োজিত জাতীয় স্তরে অনূর্ধ্ব ১৮ আন্তঃ রাগবি প্রতিযোগিতায় দেশের মধ্যে দ্বিতীয় হয়েছে ওরা। ভারতের রাগবি ফেডারেশনের সভাপতি প্রমোদ খান্না, ভারতের রাগবি পুরুষ দলের অধিনায়ক নাসের হুসেনও নাগপুরের পুরস্কার বিতরণীর অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। তাঁরাও সরস্বতীপুরের মেয়েদের খেলা দেখে ওদের উৎসাহিত করেছেন। আদিবাসী পরিবারের এই মেয়েরাই সারা দেশে মহিলা রাগবির মশাল হয়ে উঠেছে। উজবেকিস্তানের তাসখন্দে সপ্তম এশিয়া ইন্টারন্যাশনাল রাগবি চ্যাম্পিয়নশিপে খেলেছে বেলাকোবার চা শ্রমিক পরিবারের দুই মেয়ে সোনালি ওরাওঁ ও নিকিতা ওরাওঁ। দুজনেই রাজগঞ্জ ব্লকের মান্তাদারি গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রত্যন্ত সরস্বতীপুর চা বাগানের বাসিন্দা। রাগবির রাজ্য মহিলা দলের কোচ রোশন খাঁখাঁর কাছ থেকে জানলাম ভারতীয় রাগবি দলে মোট ১৪ জন রাগবি চ্যাম্পিয়নশিপে ভারতের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করবেন। বাংলা থেকে সোনালি ও নিকিতা প্রতিনিধিত্ব করবেন। প্রথমবার দেশের হয়ে আন্তর্জাতিক রাগবি প্রতিযোগিতায় প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ পেয়ে সোনালী ও নিকিতা খুবই খুশি এবং উচ্ছ্বসিত। বাংলা দলের ক্যাপ্টেন রুশমিতা ওঁরাও সরস্বতীপুর চা বাগানের মেয়ে। মেয়েদের রাগবিতে অত্যন্ত প্রতিশ্রুতিমান খেলোয়াড় রুশ্মিতা।
২০১৩ সালে এই সরস্বতীপুর বাগানে “জাঙ্গল ক্রো ফাউন্ডেশন” নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার উদ্যোগে আসে “খেলো রাগবি ক্যাম্পেইন”। উদ্দেশ্য খেলার ছলে চা বাগানের আদিবাসীদের জীবনযাত্রায় অন্য মাত্রা যোগ করা। সরস্বতীপুরে পা রেখেই ‘খেলো রাগবি’ প্রথম যে কাজটা করে সেটা হল রাগবিকে মেয়েদের খেলা বলে প্রচার করে দেয় যাতে বাবা মায়েরা তাদের মেয়েদের খেলতে দিতে কোনও আপত্তি জানাতে না পারে। ছোট্ট এবং প্রায় অনামী গ্রামের কৃপা ওরাঁও, সঞ্জনা ওরাঁও, সন্ধ্যা রাই, পুনম ওরাঁও- গাজোলডোবা হাইস্কুলের এই চার ছাত্রীকে ‘জাঙ্গল ক্রো ফাউন্ডেশন’ এর ফাদার জর্জ ম্যাথু ‘খেলো রাগবি’তে নিয়ে আসেন। প্রথম প্রথম আপত্তি এসেছিল। কিন্তু ফাদাররা গ্রামের মানুষকে বুঝিয়েছেন খেলার মাধ্যমে গ্রামের বাইরে লোকজনের সঙ্গে পরিচিতি বাড়বে, তাদের কাছ থেকে অনেক কিছু শেখা যাবে। কলকাতার জাঙ্গল ক্রো সংগঠনের হাত ধরে গজলডোবা এবং সরস্বতীপুর চা বাগানে রাগবি খেলা শুরু হয়। ইংল্যান্ডের বায়ু সেনা রাগবি দলের সদস্য খেলোয়াড়েরা সরস্বতীপুরে এসেও খুদে খেলোয়াড়দের প্রশিক্ষন দিয়ে যান। দু’বছরে ওরা রাগবির খুঁটিনাটিও আত্মস্থ করে ফেলে। দেরি না করে দ্রুত ভারতীয় স্তরের আন্তঃ ক্লাব প্রতিযোগিতায় ওদের পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন কলকাতার জঙ্গল ক্রো ক্লাবের কর্মকর্তারা। সাফল্য মেলে হাতেনাতে। খেলায় নেতৃত্ব দিয়েছিল নবম শ্রেণির ছাত্রী সন্ধ্যা ওঁরাও। জলপাইগুড়ির হতদরিদ্র জনজাতির মেয়ে রুশ্মিতার কাছে রাগবিই হয়ে উঠেছিল মুক্তির ঠিকানা। ক্ষিপ্রতা, গতিবেগ, ফোকাস, সব মিলিয়েই রাগবিতে দ্রুত নিজের জায়গা করে নিয়েছে ছিপছিপে এই কিশোরী। তার বাবা অ্যাম্বুলেন্স চালক আর মা চা বাগানে কাজ করে। প্রাক্তন ব্রিটিশ কূটনীতিবিদ পল ওয়ালশের মাধ্যমে ২০১৩ সালে রাগবিতে হাতেখড়ি হয় রুশ্মিতার। ওয়ালশের প্রতিষ্ঠিত জাঙ্গল ক্রোস টিমেরও সদস্য রুশ্মিতা। জাঙ্গল ক্রোস রুশ্মিতার পড়াশোনার সব খরচ দেয়। ওরা রুশ্মিতাকে একটা সাইকেলও দিয়েছে। সরস্বতীপুর চা বাগানের বাড়ি থেকে সাত কিলোমিটার দূরে স্কুল যেতে ওই সাইকেলটাই ভরসা রুশ্মিতার। রাগবি না থাকলে সে লেখাপড়াটাও চালিয়ে যেতে পারত না বলে রুশ্মিতার দাবি।
২০১৪ সালের পর থেকে উত্তরবঙ্গের বন্ধ চা-বাগানের অভুক্ত শ্রমিকদের একের পর এক মৃত্যুর ঘটনা সরস্বতীপুর চা-বাগানের স্বপ্না, চন্দাদের সাফল্য এনে দিতে আরও বেশি করে জেদি করে তুলেছিল। অত্যন্ত অভাবের মধ্যেই চা-বাগিচার এই মেয়েরা রাগবির প্রশিক্ষণ নিচ্ছে কোচ রোশনের কাছে। টিউশনের টাকা দেবার ক্ষমতা নেই এই মেয়েদের। বাগানের মেয়ে রাগবি দলের ম্যানেজার কৃপা ওঁরাওয়ের সঙ্গে যখন কথা বলেছিলাম তখন কৃপার মা অসুস্থ। বাবার সামান্য রোজগারে মায়ের চিকিৎসা প্রায় হয় না বললেই চলে। খেলার জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ প্রোটিন জাতীয় খাবার প্রয়োজন থাকলেও টাকা না থাকায় সেগুলি জোটে না। রাগবি খেলা শুরুর পথে হাজারো বাধার গল্প বলছিল কৃপা। “একেই গ্রাম। তার ওপর রাগবি খেলা। সহজ ছিল না মোটেও। বাড়ির আপত্তি, প্রতিবেশীর বাঁকা চোখ এত কিছুকে পাশ কাটিয়ে মাঠে নামা চ্যালেঞ্জ ছিল। মাঠেও ছেলেরা নিজেদের দাপট দেখাতে গোটা মাঠের দখল নিয়ে নিত। কখনও মাঠের মাঝখানে ভলিবলের পোস্ট পুঁতে রাখত যাতে প্র্যাকটিসের জায়গা ছোট হয়ে যায়। শুধু তাই নয়, মেয়েদের জিতে আনা পুরস্কারও সন্দেহের চোখে দেখত গ্রামের অনেকেই”। কিন্তু রাগবি মেয়েদের চোখ খুলে দিয়েছে। “পাত্তা দিইনি। নিজেদের কাজ করে গিয়েছি” সঞ্জনার অভিব্যাক্তি। “আমাদের সমাজে মানুষ বুঝতে চায় না বাইরের জগৎটাকে চেনা কতটা জরুরি। এখানে ছেলে—মেয়ের ভেদাভেদ আছে। অনেকেই ভাবে মেয়েরা খেলতে পারে না। কিন্তু দেখিয়ে দিয়েছি মেয়েরাও খেলতে পারে”। প্রত্যন্ত বাগিচার মেয়েরা যে সংসারের হাজারো অভাব অনটনের মধ্যেও এই সাফল্যের কৃতিত্ব অর্জন করেছে তা অত্যন্ত প্রশংসনীয়। স্বপ্নার কথাতে, “প্রথম যে দিন রাগবি খেলা শুরু করি, সে দিন অনেকেই ভয় দেখিয়েছিল। কিন্তু আজ আমাদের দেখে তাঁরা নিশ্চয়ই মত পাল্টাবেন।” নিকিতা ওরাও, সুচিতা ওরাও, রাধিকা ওরাও, অনিশা ওরাও, সোনাম ওরাও ও বর্ষা ওরাও রা ভবিষ্যতে জাতীয় দলে খেলার জন্য মুখিয়ে রয়েছে। কিন্তু এদের প্রধান বাধা অর্থ।
আসলে চা বাগিচা সার্ভে করতে এসেছি কিছু অভিযোগ পেয়ে। এখানেও সেই বঞ্চনা এবং বৈষম্যের অভিযোগ। যা শুনে আমি চুপ করে বসে থাকতে পারি নি, পারিও না। সামাজিক দায়বদ্ধতার নিরিখে বেড়িয়ে পড়েছি ওদের বঞ্চনার কথা তুলে আনতে। এ ছাড়া আমার আর কোন ক্ষমতা নেই যে। আমার মসীই অসি। সরস্বতীপুর চা বাগানের শ্রমিক পরিবারের মেয়েরা আন্তর্জাতিক স্তরে রাগবি খেলে দেশের মুখ উজ্জ্বল করেছে। রাগবি খেলায় জাতীয় দলের হয়ে আন্তর্জাতিক প্রাইজ নিয়ে আসা সত্ত্বেও চা বাগান কর্তৃপক্ষ বা রাজ্য সরকার কোনও তরফ থেকে কোনও সহযোগিতা, স্বীকৃতি আসেনি বলে অভিযোগ করেছে জাতীয় প্লেয়ার সঞ্জু ওরাওঁ, লছমি ওরাওঁ, বাগিচা ও রাজ্য মহিলা রাগবি কোচ রোশন খাঁখাঁরা। এটা অত্যন্ত লজ্জার এবং দুঃখের। সরস্বতীপুরে এসে দেখলাম বাগানের মেয়েরাই পশ্চিমবঙ্গের খেলোয়াড় হিসাবে জাতীয় স্তরে সাফল্য পেয়েছে। অথচ স্পোর্টস কোটায় একজনেরও চাকরি হয়নি। ওড়িশা সরকার কিন্তু মহিলা রাগবি খেলোয়াড়দের স্পোর্টস কোটায় চাকরি দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছে। সরস্বতীপুর চা বাগানের মালিক কৃষ্ণকুমার কল্যাণী তাঁর বাগানে মহিলা রাগবি খেলোয়াড়দের বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করছেন বলে দাবি করেছেন। তাঁর দাবি ক্লাবের জন্য জমি দেওয়া হয়েছে। কোচদের থাকার ব্যবস্থাও আছে। রাগবি দলের কোচ রোশন খাঁখাঁ একরাশ ক্ষোভ উগরে দিয়ে বলেন, খেলাধুলার জন্য যখন কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ করা হচ্ছে তখন প্রত্যন্ত এই চা বাগানের শ্রমিক পরিবারের মেয়েরা অপুষ্টিতে ভুগছে। দেশের মুখ উজ্জ্বল করা এই মেয়েদের জন্য জুটছে না ভালো খাবার। আর সেজন্যই দেড় বছর আগে জাতীয় দলে খেলা সুমন ওরাও, স্বপ্না ওরাও এবং পুনম ওরাও এবার জাতীয় দলে খেলার সুযোগ পাননি। না পাওয়ার কারণ খেলার মান নয়, অন্যতম কারণ হল প্রয়োজনের তুলনায় তাদের শারীরিক ওজন কম। শারীরিক ওজন কম হওয়ার কারণে তারা এবার জাতীয় দলে সুযোগ পাননি। তিনি বলেন, এ থেকেই একটা কথা স্পষ্ট হয়ে বেরিয়ে আসছে যে জাতীয় দলে খেলার পরেও রাগবি দলের এই মেয়েদের পুষ্টিকর খাবার জুটছে না। তা সত্ত্বেও শুধুমাত্র মনের জোরে রাগবি কে ভালবেসে বাংলা তথা দেশের মুখ উজ্জ্বল করতে জীবন বাজি রেখে লড়াই করে চলেছে সরস্বতীপুর বাগানের এই মেয়েরা।
চরম দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করে মেয়ে যে শেষ পর্যন্ত জাতীয় দলে খেলার সুযোগ পেয়েছে সেটা যেন সোনালির মা স্বপ্না ওরাওঁ বা নিকিতার মা সুমিতা ওরাওঁ কেউই বিশ্বাস করতে পারছেন না। স্বপ্না ও সুমিতা দুজনই পেশায় বাগান শ্রমিক। দুজনই জানান, অনেক কষ্ট করে মেয়েদের খেলা চালিয়ে যেতে উত্সাহ জুগিয়ে এসেছেন। কারও কাছ থেকে কোনওরকম সাহায্য পাননি। এর আগে এই চা বাগান থেকে সন্ধ্যা রাই, সঞ্জু ওরাওঁ, লক্ষ্মী ওরাওঁ, পুনম ওরাওঁ, তনুজা ওরাওঁ প্রমুখ দেশের হয়ে আন্তর্জাতিক একাধিক খেলায় সুনাম অর্জন করেছে। রোশন খাঁখাঁর কথায়, সরস্বতীপুর চা বাগানের একাধিক মহিলা প্রতিযোগী রাগবি প্রতিযোগিতায় দেশকে সম্মান এনে দিয়েছে। গর্বিত কৃপা তাই বলে “রাগবি আর পড়াশোনা পাশাপাশি চালিয়ে যেতে পারলে জীবনে উন্নতি হবে। আদব কায়দা শিখেছি। বড়দের সঙ্গে কীভাবে কথা বলতে হয়, ছোটদের কী বলব স্যারেরা সব শেখাচ্ছেন। সরস্বতীপুরের বাকি ছেলেমেয়েদেরও উৎসাহিত করতে চাই। আমার বাবা—মা আমাকে নিয়ে বেশ খুশি। আমি যাতে অন্যদের সাহায্যে এগিয়ে যাই তার জন্য তাঁরাই আমাকে উৎসাহিত করেন”। সঞ্জনা ভালো রাগবি খেলোয়াড় হতে চায়। সঙ্গে পড়াশোনা চালিয়ে অন্তত স্নাতক হওয়ার ইচ্ছে আছে। পুনম আবার চায় স্নাতক শেষ করে রাগবি কোচ হতে। তারপর চাকরি নিয়ে গ্রামের বাইরে চলে যাওয়ার ইচ্ছে। সন্ধ্যা শুধু খেলাতেই মন দিতে চায়। রাগবিতে বাংলার হয়ে প্রতিনিধিত্ব করার স্বপ্ন দেখত। সেই স্বপ্ন সদ্য পূরণ হয়েছে জাতীয় টুর্নামেন্টে। এবার লক্ষ্য জাতীয় দলে জায়গা করে নেওয়া। কৃপা এদের মধ্যে সবচেয়ে বয়সে বড়। ভালো খেলোয়াড় হতে চায়। প্রথমে পড়া শেষ করাই লক্ষ্যই। তারপর কাজ করে পরিবারে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে চায় সে। সামান্য আদব কায়দাও জানত না যে মেয়েগুলি তারাই এখন অর্গানাইজার। ১১ অক্টোবর রাষ্ট্রসঙ্ঘের শিশুকন্যা দিবস পালন উপলক্ষ্যে ময়দানে অনূর্ধ্ব ১৪ রাগবি ফেস্টিভ্যালের অয়োজন করল কৃপারাই। পরিকল্পনা থেকে বাস্তবায়ন। মেয়েরাই সব করল। তবে কোথাও একটা ভয়ও আছে। এখনও অনেকটা পথ বাকি, সেটা ভেবেই ভয় পায় আদিবাসি মেয়েগুলি।সব দেখে উচ্ছ্বসিত ‘জাঙ্গল ক্রোস’ এর প্রতিষ্ঠাতা পল ওয়ালস। যে স্বপ্ন নিয়ে ‘খেলো রাগবি’ পথচলা শুরু করেছিল সেই পথের এখনও অনেকটাই পেরোতে বাকি। তবু পিছিয়ে পড়া পরিবারগুলোর মেয়েদের মুখে তৃপ্তির ছাপ স্পষ্ট। সকলের দৃঢ়প্রতিজ্ঞা, সরস্বতীপুর চা বাগান থেকে এর আগেও যাঁরা আন্তর্জাতিক মানের প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে দেশের জন্য জয় এনে দিয়েছিলেন, তাঁরাও সেই সম্মান বজায় রাখতে আপ্রাণ চেষ্টা করবেন। এইটুকু যাত্রায় ‘খেলো রাগবি’র সেই পাওনাটাই বা কম কী?
(তথ্য সংগ্রহঃ খেলো রাগবি ওয়েবসাইট, আনন্দবাজার পত্রিকা, উত্তরবঙ্গ সংবাদ, চা বাগান ম্যানেজমেন্ট, রোশন খাঁখাঁ (রাগবি কোচ), রাগবি খেলোয়াড়েরা, জাঙ্গল ক্রোশ সংগঠক সহ আরো বেশ কিছু ডিজিটাল পত্রিকা
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴