শাল সিঁড়ি ২
বিমল দেবনাথ
--------------------
অপূর্ব মাধুরীকে বলে, গাড়ির চাবিটা দাও তো। গাড়িটা অনেক দিন চালানো হয়নি। দেখি স্টার্ট নেয় কিনা। মাধুরী চাবিটা বের করে দেয়। অপূর্ব বলে - ভাবছি একবার বিকাশকে ফোন করব। মাধুরীর চোখ আনন্দে চিক্ চিক্ করে উঠল। বিকাশের কথা শুনলে মাধুরীর এই রকমই হয়। মাধুরীর বেড়ে ওঠা, বড় হওয়া সব বিকাশের সামনেই হয়েছে। আবার বিকাশের প্রথম গোঁফ রেখা, ঠোঁটে সিগারেটের গন্ধ মাধুরীই প্রথম টের পেয়েছিল। মাধুরীর বুকে বিকাশ কখন কিভাবে আশ্রয় নিয়েছিল তা মাধুরী কোনদিন বুঝতে পারেনি। কিন্তু যেদিন মাধুরী বুঝতে পেরেছিল তত দিন অনেক দেরি হয়ে গেছে। মাধুরী তখন অপূর্বর উষ্ণতায় বশীভূত। তবুও বিকাশের নাম শুনলে মাধুরীর রোমাঞ্চ অনুভব হয়। বুকের ভেতর আলাদা আরামের এক উষ্ণতার অনুভূতি হয়। মন এক নিষ্পাপ আনন্দে আন্দোলিত হয়। এই এক অদ্ভুত প্রেম। সাগর তীরে বসে সাগর দেখার মতো। ঢেউয়ের পর ঢেউ ভালোবাসার পর ভালোবাসা.. অফুরান...ধরা যায় না পাওয়া যায় না; শুধু অনন্ত অসীম দেখা। সে কী যে আনন্দ যার এই সম্পদ আছে সেই বুঝতে পারে। তবে সব পুরুষই তার প্রেমিকার অন্তর দেখতে পায়। বুঝতে পারে। অপূর্ব বলে - কি হল! বিকাশের কথা শুনতেই তোমার গাল লাল হয়ে গেল। মাধুরীর হেসে বলে - তাই বুঝি। বেশ হয়েছে। লাভ তো তোমারই হল। বৌ'র প্রেমসিক্ত বদন দেখতে পেলে। অপূর্ব এক গাল হাসি দিয়ে বেরিয়ে গেল গাড়ি সার্ভিসিং করতে।
দুপুরে খাবার টেবিলে অপূর্ব বলে - মাধুরী, বিকাশকে ফোন করেছিলাম। ও বলল সব ব্যবস্থা করে দেবে। ময়ূখ উৎসাহিত হয়ে বলল - বাপি, বনকাকুর কাছে যাবে? মাধুরী বলে - তুমি যেতে চাও?
- হ্যাঁ মা, চল না। কত দিন যাই না।
মাধুরী বলে - ঠিক আছে বাবা, ঠিক আছে। অপূর্ব, চল একবার কিছুক্ষণের জন্য ঘুরে আসি। কত দিন তো যাওয়া হয় না। ময়ূখ এত করে বলছে।
অপূর্ব ময়ূখের অগোচরে একটা দুষ্ট হাসি দিয়ে বলল - তাই তো, ময়ূখ কত করে বলছে!
মাধুরী এক ঢোক জল খেল । যেন সব রস অন্তঃস্থ করে রাখল। মাধুরী জানে সব রোমান্টিক পুরুষ রসসিক্ত নারী আর উড়ন্ত পাখি ভালোবাসে। বলে - তাই তো। দেখলে না ময়ূখ গতকাল কত কান্নাকাটি করল।
অপূর্ব বলল - ঠিক আছে ঠিক আছে, সে হবে খন। ময়ূখ তাড়াতাড়ি খেয়ে নিল। বলল - মা, আমি উঠলাম। একটু পরে তবলার মাষ্টারমশাই আসবেন। আমি যাই।
ধা ধিন্ ধিন্ ধা। ধা ধিন্ ধিন্ ধা। না তিন্ তিন্ তা। তেটে ধিন্ ধিন্ ধা।। ধা...
তবলার মাষ্টারমশাই চোখ বন্ধ করে ময়ূখের বাজনা শুনছেন আর পা দিয়ে মাটিতে তাল মেলাতে মেলাতে মোহিত হয়ে পড়েছেন। এই দৃশ্য পর্দার আড়াল থেকে দেখে মাধুরীর চোখে জল এসে গেল। মাধুরী ভাবছে এই মাষ্টারমশাই-ই গতকাল বলেছিলেন ময়ূখের মনের স্বাস্থ্য ঠিক নেই। আর আজ ওর বাজনার তালে মোহিত হয়ে পড়েছেন! চাপা স্বরে অপূর্বকে ডাকে - অপূর্ব দেখে যাও। অপূর্ব-মাধুরী ময়ূখের তালের লহরীতে অবাক হয়ে যায়। ওদের ছেলের বাজনার ছন্দে হৃদয়ে কম্পন ওঠে। অপূর্ব মাধুরীর হাত চেপে ধরে। বলে - মধু...হানি.. তুমি আমাকে এই ভাবে ভিজিয়ে রেখো। সব সময়। এই বলে ওরা ময়ূখের মিউজিক রুমে ঢুকল। মাষ্টারমশাই তখন চোখ বুজে আছেন। ময়ূখ বাজনা থামিয়ে উৎসাহিত হয়ে বলে উঠল - মা-বাপি তোমরা আমার বাজনা শুনতে এসেছ! এস এস। মাষ্টারমশাই চোখ খুলে যেন এক স্বপ্নের জগৎ থেকে ফিরে এলেন। বললেন - আজ আমি ময়ূখের জন্য গর্ব বোধ করছি। ও একদিন অসাধারণ মিউজিসিয়ান হবে। তবে ওর যে মাঝে মধ্যে কী হয়! একটু দেখিয়ে নেবেন। অপূর্ব বলে - ঠিক আছে মাষ্টারমশাই আমরা ব্যপারটি দেখে নিচ্ছি। আপনি ওকে একটু ভালো করে দেখবেন।
- ঠিক আছে দাদা। আমি আজ তাহলে আসি।
মাষ্টারমশাই চলে গেলেন। ময়ূখ পৃথিবীর সব জড়তা কাটিয়ে ওর বাবাকে জড়িয়ে ধরল। বলল - বাপি, কালকে যাবে বিকাশকাকুর কাছে?
...হ্যাঁ বাবা।
ময়ূখের রাতে ঘুম আসে না। ক্লাস এইট ফাইনাল পরীক্ষা দিয়ে ও প্রথম বিকাশ কাকুর কাছে যায়। বিকাশ তখন সদ্য বদলি হয়ে ওদের জেলায় এসেছে। ওদের জেলার বিখ্যাত বনের আধিকারিক। ময়ূখের বাবার বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু। প্রথম দেখায় ময়ূখের বিকাশকে ভালো লাগে। মানুষটি কী সুন্দর হাসি খুশি। ময়ূখের মনে হয় বিকাশ ময়ূখের মত সহজ সরল। বাবা মা এবং ও যখন বিকাশকাকুর কোয়ার্টারে পৌঁছায়, বিকাশকাকু ওদের খুব আন্তরিকভাবে গ্রহণ করেন। ওদেরকে একটি জিপসি ভাড়া করে দেন। সেই জিপসিতে করে ওরা বন ঘুরে দেখে। ময়ূখ চারদিকে শুধু গাছ আর গাছ দেখে। কত লম্বা লম্বা গাছ। কত ঘন বন। কিছু দেখা যায় না। বন এত ঘন যে সূর্যালোক মাটিতে পড়ছে না। মাঝে মধ্যে দিনকে রাত মনে হয় ময়ূখের। চারদিক সবুজ আর সবুজ। সবুজের কত ধরণ। এর আগে ময়ূখ সবুজের এত বিভিন্ন ধরণ দেখেনি। কিন্তু কোন বন্যপ্রাণী দেখতে পায়নি। ওরা আবার বিকাশকাকুর কোয়ার্টারে ফিরে আসে। বনে বিকাশকাকু একা থাকেন। কাকিমা ছেলেকে নিয়ে শহরে থাকে, ছেলের পড়াশুনার জন্য। মাধুরী বলে - বিকাশ চা খাবে তো?
বিকাশ অবাক হয়ে বলে - সেকি তুমি আমার ঘরে এসে আমাকে চায়ের নিমন্ত্রণ করছ! দাঁড়াও চায়ের কথা বলছি।
মাধুরী বলে - বিকাশ, সব সময় বাবুর্চির করা চা খাও। আজ না হয় আমার তৈরি চা খাও। মাধুরী চা করেন। ওরা বেশ মজা করে চা খায়। ময়ূখ বিস্কুট ইত্যাদি খায়। ময়ূখের বিকাশকাকুকে খুব ভালো লাগে। বাবা মায়ের সাথে কত বন্ধুত্ব। ময়ূখ ভাবে ওর তো এই রকম বন্ধু নেই। মনে মনে ভাবে বড় হলে হয়তো ওরও এই রকম ভালো বন্ধু হবে। বিকাশ বলে - অপূর্ব তোরা তো কোন বন্যপ্রাণ দেখতে পাসনি। পাশের যে নজর মিনারটি আছে সেখানে যা, ওখানে অনেক বন্যপ্রাণ আসে। কপাল ভালো থাকলে দেখতে পারিস।
অপূর্ব বলে - ঠিক বলেছিস, দেখি কপাল খেঁচিয়ে ...
মাধুরী বলে - অপূর্ব, তুমি না যা তা... ময়ূখ চল।
ময়ূখ বলে – মা, তুমি আর বাপি যাও, আমি কাকুর সাথে গল্প করব...
মাধুরী অপূর্ব ওয়া্চ্ টাওয়ারে আসে। ওয়াচ্ টাওয়ারের সামনের সল্ট পিট, বন্যপ্রাণ শূন্য। ওরা কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকে। ভাবে এই বুঝি কোন বন্যপ্রাণ আসবে। কিন্তু না কোন বন্যপ্রাণের দেখা নেই। মাধুরী বলে – অপূর্ব, চল ফিরে যাই; আজ আর বন্যপ্রাণ দেখা ভাগ্যে নেই। অপূর্ব রাজি হয় না। আরও কিছুক্ষণ বসতে চায়। মাধুরী বলে - তাহলে আমি যাই, দেখি ময়ূখ কী করছে। অপূর্ব বলে - সেই ভালো, যাও গিয়ে বিকাশ ও ময়ূখকে নিয়ে এস। আমার ভাগ্যে তো বন্যপ্রাণ নেই; যদি বিকাশের ভাগ্যে আসে। অপূর্ব কটাক্ষ করে। মাধুরী বলে - ভাগ্যে যেটা জুটেছে সেটা নিয়ে সন্তুষ্ট থাক। বুঝলেন মহাশয়... আমি চললাম।
মাধুরী বিকাশের অফিসে আসে। বিকাশ অফিসে কাজ করছে আর বনের গল্প বলছে, ময়ূখ এক মনে সে সব শুনছে। মাধুরীকে দেখে ময়ূখ বলে – মা। তুমি এসেছ, বস বস, কাকু কী সুন্দর সুন্দর বনের গল্প বলছে। বিকাশও মাধুরীকে বসতে বলে। মাধুরী বসার পর ওদের গল্প আবার শুরু হয়...
ময়ূখ বলে - কাকু বনে যে লম্বা লম্বা গাছগুলো দেখলাম ওগুলোর কী নাম?
- শাল।
- গাছগুলো কত লম্বা! আর গাছের তলায় কত আরো নানা ধরণের গাছ। কত ঘন। কিছুই দেখা যায় না। কোথাও কোথাও তো সূর্যের আলোও ঢুকতে পারে না।
- বাঃ ময়ূখ তূমি তো খুব সুন্দরভাবে বনকে দেখেছ। কত মানুষ বনে আসে, বন্যপ্রাণকে বন্য জন্তু বলে, বন্যপ্রাণ দেখতে না পেয়ে বনে কিস্যু নাই কিস্যু নাই বলে চলে যায়। অথচ বনের কথা শুনতে পায় না।
- কাকু আমাকে বনের কথা বল, আমি শুনব।
- শোন শাল গাছ হল এই এলাকায় সমতলের বনে গাছেদের রাজা। এক একটি শাল গাছের কথা তিনশ (৩০০) বছর চলতে থাকে। অনেকটা মোঘল সাম্রাজ্যের মত। শালেরও তিন-শ' সাল।
- সেটা কেমন কাকু?
- আদর্শ পরিস্থিতিতে একটি শাল গাছ জন্মে থেকে বাড়তে থাকে একশ বছর, বেঁচে থাকে একশ বছর আর মরে গেলে পচতে লাগে আরো একশ বছর। শুধু তিনশ বছর কেন - ভারতবর্ষের সিমলিপাল বাঘবনে সাড়ে তিনশ বছরের জীবিত শাল গাছ এখনও আছে। তাই শাল গাছের কথা খুব মজাদার।
শাল গাছের জন্ম হয় হাওয়ায় উড়তে উড়তে হাতিদের পিঠে চড়ে।
ময়ূখ খিল খিল করে হেসে উঠে। বলে- কাকু কী বল, শাল গাছ হাতির পিঠে চড়ে!
- হ্যাঁ, চড়ে তো। ও যে বনে গাছেদের রাজা।
শাল গাছ আলোর মুকুট মাথায় পরে, সিঁড়ি ভাঙা অঙ্কের মত আলোর সিঁড়ি ভাঙে, রাজার মতো যুদ্ধ করে। শাল সিঁড়ি তৈরি করে ঐ উঁচু নীল আকাশ ছুঁতে উপরে আরো উপরে উঠতে থাকে... এই সব ভাবতে ভাবতে ময়ূখ কখন ঘুমিয়ে পড়ে বুঝতে পারেনি। ঘুম ভাঙে মায়ের ডাকে। ময়ূখ...ও ময়ূখ, ওঠ... বনকাকুর কাছে যাবি না?
ছবিঋণ : শিশির রায়নাথ