মায়াপথের মীড়-২/সৌগত ভট্টাচার্য
মায়াপথের মীড়
সৌগত ভট্টাচার্য
পর্ব: দুই
ছবিটা ছিল অনেকটা এরকম, একটা গাঢ় নীল রঙের নদী, একটা সবুজ রঙের পাহাড়, আকাশি রঙের আকাশ আর লাল রঙের মন্দির আর একটা গাছ একটা কালো রাস্তা। ড্রইং খাতায় মোম রং দিয়ে আঁকা। সব রংই ভীষণ উজ্জল।
সম্ভবত পড়ার থেকে পিকনিক গেছিলাম, পিকনিক স্পট ছিল কুর্তি নদীর ধারে। আমার শুধু মনে আছে চা সবুজ বাগানের ভেতরে একটা নির্জন গাছতলা আর তার নিচে একটা লাল রঙের মন্দির। মন্দিরের পাশেই নিচু হয়ে আসা খাদ। মন্দিরের পেছনে প্রাচীরের মত দাঁড়িয়ে নীলচে সবুজ ভূটান পাহাড়! ব্যাস এটুকুই স্মৃতি!।মনে আছে, বাড়ি ফিরে ড্রয়িং খাতায় ছবি এঁকেছিলাম, যে ছবি কৈশোর শেষ হওয়ার অনেক আগেই হারিয়ে গেছে।
সেই ছবিকে খোঁজা যাবে না, যায় না। কিন্তু জায়গাটা যাওয়া যেতে পারে, রাস্তাটা খোঁজা যেতে পারে। রাস্তায় অনেকবার বৃষ্টি নেমেছে, থেমেছে। কখনও মুসল ধারায় বৃষ্টি কখনও ঝিরঝির বৃষ্টি। আমি যাচ্ছি নাগরাকাটা থেকে কুর্তি নদীর পাড়ে। যে জলধারা পাহাড় থেকে গড়িয়ে নদী হয়ে নামে, তার নাম কুর্তি। চা গাছগুলো বৃষ্টির জলে ধুয়ে যাচ্ছে, যেন সবুজ জল টুপটাপ গড়িয়ে পড়ছে পাতা থেকে। প্রতিটা সেড ট্রি যেন আকাশের দিকে হাত বাড়িয়ে মেঘ ছোঁয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। আমি বাইক নিয়ে মোম রঙে আঁকা চা বাগানের ভুলভুলাইয়ায় ঘুরছি।
বৃষ্টি থেমেছে কিছুক্ষণ হল, জারুল রাধাচূড়া আমলতাসের পাপড়ি হাওয়ায় উড়ে ভেজা রাস্তায় পড়ছে। পাহাড়ের গায়ে বৃষ্টি ভেজা জংলাগন্ধ ঈশ্বরের ভিটা খোঁজার পথকে করে তুলেছে নৈসর্গিক!
অনেকক্ষণ গোলক ধাঁধায় ঘুরে মন্দিরের খুব কাছাকাছি কোথাও একটা জায়গায় এসে শুনি, হ্যাঁ মন্দির আছে বটে কিন্তু সে রাস্তা বন্ধ…
বন্ধ পথের দিকে সোজা তাকিয়ে দেখি পাহাড়ের নিচে একটা আমার মতোই কাক ভেজা জারুল গাছের ডালে বাসা বেঁধেছেন ফুল হয়ে।
বাইক স্টার্ট করেছি। সারাদিন বৃষ্টিতে ভিজে ঠাণ্ডা লাগছে … ঈশ্বরের ভিটা খোঁজা শেষ হলে গৃহী মানুষের খিদে পায়। খাওয়ার দোকান তখন দূর দ্বীপ। বাইক চালাচ্ছি, দেখছি চারপাশ যেন আমার ছোট বেলার ড্রইং খাতা হয়ে আছে।
হঠাৎ রাস্তার পাশে দেখি এক টুকরো সবুজ ঘাসের ছোট্ট মাঠ। মাঠ জুড়ে কিছুটা রঙিন একটা সামিয়ানা টাঙানো, বাকিটা খোলা। কিছুক্ষণ আগে বৃষ্টির পর রোদ উঠেছে। আকাশের নিচে পাহাড়ি রাস্তার বাঁকে আয়োজন করা হয়েছে বুদ্ধ পূর্ণিমা তিথির উৎসবের! এসব দেখে দাঁড়িয়ে পড়ি। ভেতরে যাব কী যাব না ভাবছি। আমার সামনে এসে একজন আমাকে বললেন, আসুন। আমিও তার পিছে পিছে গেলাম সামিয়ানার তলায়।
শুনলাম সূর্য ওঠার আগে থেকে রঙিন সাজগোজ করা মানুষের দল আশেপাশের গ্রাম থেকে এসেছে বুদ্ধদেবের জন্মদিন উদযাপনে! মাঠ জুড়ে ধূপের গন্ধ, মন্দ্র স্বরে স্ত্রোত্র উচ্চারণে চলছে, বাজছে বাজনা। ঈশ্বরের জন্মদিনের উৎসবে নিজেকে অনাহুত মনে না হলেও, খুব একটা স্বচ্ছন্দ বোধ করছিলাম এমন না। খিদে আর ভেজা শরীরে ঠাণ্ডা লাগছিল।
এমন সময় লোকটি আমার হাতে দেয় ধোঁয়া ওঠা খিচুড়ির আর সবজির থালা।। অন্য দিকে কোন এক সুজাতার হাতে তৈরি পাগল করা পায়েসের গন্ধ ! বৃষ্টির পর নীল আকাশের নীচে লাল প্লাস্টিকের চেয়ারে লোকটি বসিয়ে দেয় আমাকে। তিনি যেন আমার জন্য এসেছেন লুম্বিনী থেকে হাজার আলোকবর্ষ পায়ে হেঁটে। ফু দেওয়ায় গরম খিচুড়ির চাইতেও অনেক বেশি উষ্ণ লোকটির অভ্যর্থনা। বিনা মন্ত্রে যা আমাদের মৌন করে দিয়েছে। বিস্মিত হয়ে অনুভব করেছি প্রতিটি খাদ্যের দানার মধ্যে কতটা খিদে সঞ্চিত থাকতে পারে…
খাওয়া শেষে বিদায় জানানোর পালা। তিনি বললেন, সামনের বার যেন আবার আসি।ফিরে আসছি, একটু একটু বৃষ্টি পড়ছে। বৃষ্টি পথে, পাহাড়ের বাঁকে, রাস্তার ভেজা ঘাসে এত আমন্ত্রণ, এত আতিথেয়তা, এত যত্ন পড়েছিল -- এই নশ্বর জীবনের জন্য! লোকটিকে মনে হচ্ছে কোন আদিম পূর্বাশ্রমের পরিচিত কেউ !
বাড়ি ফিরছি। বৃষ্টি ভেজা পথের প্রতিটা বাঁক যেন সেই ছোট বেলার ড্রয়িং খাতার একেকটা পৃষ্ঠা। একটি করে বাঁক পেরোচ্ছি একটা করে পৃষ্ঠা উল্টে যাচ্ছে। কোনো পৃষ্ঠায় প্রান্তরের ঈশ্বর দাঁড়িয়ে আছেন কুর্তি নদীর ধারে, আবার কোনো পৃষ্ঠায় জারুল গাছের ফাঁক দিয়ে তিনি উঁকি দিচ্ছেন, আবার কখনো নীল পাহাড়ে থেকে বা চা বাগানের পথের বাঁকে পরমান্নের শালপাতা হাতে দাঁড়িয়ে, বৃষ্টি ভেজা পথিকের জন্য!
একটা ড্রয়িং খাতার ভেতর মোম রঙে আঁকা কত জীবন যে লুকিয়ে থাকে, পথের বাঁকই সে কথা জানে।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴