ভাস্কর্যের আঁতুরঘর/২
ভাস্কর্যের আঁতুড় ঘর/পর্ব-২
মৈনাক ভট্টাচার্য
---------------------------------
[আঁতুড়ঘর বলতেই চোখের সামনে অবচেতনেই হয়ত উঠে আসবে কিছু সামাজিক আচারের নস্টালজিয়া, উঠে আসবে কিছু শব্দ যেমন-দাইবুড়ি, পাঁচ উঠানি, সূতিকাষষ্ঠী, আটকড়াই, নন্তা এই সব। পুরানো রেওয়াজে প্রচলিত এই সংস্কার বা আচারে আঁতুড় অবস্থায় সৃষ্টি এবং স্রষ্টা(নবজাতক এবং মা)কে এই ‘আঁতুড় ঘর’ নামক ঘরটিতেই বাস করতে হত। এই ভিটেতে তাই আজীবন লেগে থাকত জন্মের এক ঘ্রাণকথা। মহান ভাস্কর্যের আঁতুড় ঘরে হাত দিলেও এই সব আচারের মত প্রায়শই দেখা যাবে কখনও কিছু রহস্য রোমাঞ্চ কখনও ট্র্যাজেডি কখনও বা তীব্র প্রসব যন্ত্রণার পর সৃষ্টির এক মধুর স্মৃতিমেদুরতার সূতিকাষষ্ঠী বা আটকড়াই-। দেখা যাবে ভরপুর শিল্পী জীবনের স্বরবর্ণের কথামালা। সৃষ্টি অমর হয়ে উঠলেও এই প্রসব পর্ব কথকতার মত কিছু দিন কিছু মানুষের মনে উড়ে বেড়ালেও অনেকটাই অদ্ভুত আঁধারের ভেতর থেকে যায়। এই সব আঁতুড় কথা নিয়ে মানুষের আগ্রহও তাই চিরকালীন। এবারের পর্ব রামকিঙ্কর বেইজের ভাস্কর্য ‘সাঁওতাল পরিবার’ ]
শান্তিনিকেতনের ইতিহাসে ১৯৩৫-এ সঙ্গীত ভবনের সামনে রামকিঙ্করের হাতে প্রথম আধুনিকতাবাদী ভাস্কর্য হয়ে প্রাণ পেল ‘সুজাতা’। গুরুদেব স্বয়ং কিঙ্করকে ডেকে শান্তিনিকেতন সাজাতে বলে দিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ বুঝেছিলেন শান্তিনিকেতনে থেকে স্বশিক্ষার ব্যক্তিগত প্রতিভা আর মননের জোরে ও-ই পারবে আধুনিকতার একটা নুতন মাত্রা সংযোজন করতে। কিঙ্করেরও তো ছোটবেলা থেকেই সাধ-‘যেখান দিয়ে যাব, যেখানে থাকব- মাঠে রাস্তার ধারে মূর্তি রচনা করে চলব। সেই মূর্তিতে সূর্য আর চাঁদের আলো লাগবে প্রকৃতির নিয়মে, শীত গ্রীষ্ম বর্ষায় প্রকৃতির খেয়ালে নিজেকে নিজের মত করে বদলে নেবে সেই মূর্তি।’ কিঙ্কর যে স্বভাব বাউল। বিধাতাই যেন এই বাউলকে গুরুদেব আর নন্দলাল বসুর সাথে মিলিয়ে দিয়েছিলেন। জাত শিল্পীর যেমন হয় জটপাকানো ভাবনাগুলো অনেক দিন থেকেই মাথার ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছে। এবার তো আর পেছন ফিরে দেখার নেই। গুরুদেবের কথা রাখতে হবে, এমন ভাবে সাজাতে হবে শান্তিনিকেতনকে যেন পরিবেশ প্রকৃতি জীবন সব এক হয়ে যায়। পাশেই পিয়ার্সন পল্লী। সাঁওতালদের বাস। তাঁরা প্রতিদিন সকালে কাজে বের হয়, অদ্ভুত এক ছন্দবদ্ধ লয়ে ফিরে আসে সন্ধ্যায়। খুব মনে ধরেছিল ওদের চলন বলন। ভাবতে ভাবতেই একদিন মাথায় খেলে গেল ওরাও তো গাছেরই মত সরল ঋজু। আচ্ছা সাঁওতালদের নিয়েই তো একটা কম্পোজিশন হতে পারে। তৈরিই করে ফেললেন ‘সাঁওতাল পরিবার’। ভাস্কর্যটিতে বাঁক কাঁধে পুরুষ সাঁওতাল; এক বাঁকে মালপত্তর আর অন্য বাঁকে এক শিশু বসা। সাথে সাঁওতাল রমণী, সেও ছুটছে। সাঁওতাল দম্পতি হাতে হাত ধরাধরি করে চলেছে। বাঁকের ঝুলন্ত ঝুড়িতে ছোট্ট শিশু বিস্ময়ে মাথা উঁচু করে যেন দেখছে পৃথিবীর অন্তহীন রূপ। তাদের সঙ্গে ছুটছে তাদের নিত্যসঙ্গী অনুগত এক কুকুরও। এক লহমায় উঠে আসা বেঁচে থাকার এক মুঠো সম্পূর্ণতা। আহা, প্রাণবন্ত এই ভাস্কর্য দেখে মনে হয় যেন চলমান এক দৃশ্য। ক্লান্ত পদে ঘরে ফেরার সেই বিলম্বিত লয়ে সঙ্গীতের মতই এর চলন। ভাস্কর্যে এটাই রামকিঙ্করের অনন্য বৈশিষ্ট্য। স্থবিরতায় তিনি তো কোন দিনই বিশ্বাসী ছিলেন না। এই ভাস্কর্যটি দর্শককে পথের এক অন্য চলমান দৃশ্যের কথাই তো মনে করিয়ে দেয়। নিজের চোখে দেখা একদম সাধারণ আর নিত্যদিনকার জীবনটাকেই পাশ্চাত্যের ধাঁচে মিশিয়ে গড়া ভাস্কর্য। একেবারে সেই মিকেলঅ্যাঞ্জেলোর ‘মোজেস’ এর ছন্দের আবেগ। জায়গাটাও বেছে নিয়েছিলেন কলাভবনের সামনে রাস্তার ঠিক পাশে। প্রকৃতির মতোই বর্ষায় ভিজে আর রোদে শুকিয়ে যেন এক টুকরো প্রাণহীন, তবু জীবন্ত কিছু সেখানটায় দাঁড়িয়ে আছে। রামকিঙ্করের কথায় অনেক সময় নিয়েছে এই কাজটা। এত সময় নিয়ে শান্তিনিকেতনে আর কোন কাজ তাকে করতে হয়নি। প্রথমে বাঁশের ফ্রেম বা আর্মেচার করে খড় দিয়ে ব্যানা বেঁধে তাতে সিমেন্ট লাগিয়ে কাজটা শুরু করেছিলেন। ঠিক যেভাবে ‘সুজাতা’ করেছিলেন। কিন্তু সাড়ে দশ ফুট উচ্চতার সাঁওতাল পরিবারের বিস্তারের ভার বাঁশের ফ্রেম নিতে পারেনি। সব ভেঙেচুরে একেবারে একসার। পরে লোহার আর্মেচারে কাজটা আবার নুতন করে করতে হয়েছে। তাতে খরচও যেমন বেড়েছে, সময়ও নষ্ট হয়ে গেছে অনেকটাই। এই কাজে তাঁর সহকারী তখন বাগাল নয়, ছিল কাশী। সে বাগালেরও আগের কথা, সালটা ১৯৩৮। এই কাজ করতে গিয়ে একটা তাঁবু বানিয়ে ফেলতে হল কাজটার কাছে। সমস্ত দিনরাত এক করে কাজ করছেন। নাওয়া খাওয়াও ওই তাঁবুতেই। কাজ করেন আর আই লেভেল, লো আই লেভেল, আকাশের দিকে তাকিয়ে কাজটা দেখেন। ভাস্কররা যেভাবে কাজ করার সময় একটা কাজকে বিভিন্ন ভাবে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখেন। মন ভরে না, আবার কাজ করেন। আলোর ব্যাবস্থাও নেই। রাতে শুনশান, নিঝুম আশ্রম রাস্তা ঘাট সব। এক লন্ঠনই ভরসা, সাথে শুধু কাশী। কাশী লন্ঠন ধরে থাকে আর কিঙ্কর ছেনি হাতুড়ি নিয়ে কাজ করেন। কাশীর ঘুম পায়, ঝিমুনি আসে; কিঙ্করের ছেনি হাতুড়ি চলতেই থাকে। কিন্তু এই নিঝুম নিস্তব্ধতায় আঁধারের ভেতর হঠাৎ হঠাৎ যেন সামনে কি নড়েও ওঠে। আগেও কখনও কখনও খেয়াল হয়েছে মনে হয়েছে কোন অশরীরী আত্মা যেন দাঁড়িয়ে আছে। কিঙ্কর বরাবরেরই ডানপিটে মানুষ, আমল দেয়নি ব্যাপারটায়। এ তো একদা ভুবন ডাকাতেরই জায়গা, কত মানুষ খুন হয়েছে কে জানে। একটু পরে মনে হল যেন সেই ছায়ার মত লোকটা নড়ছে। অসীম সাহসী মানুষটার শরীরও এবার যেন ভয়ে ভেতর থেকে হিম হয়ে আসে। তবু সাহসে ভর করে মাচা থেকে নেমে আসেন। কাছে যেতেই অবাক, এ যে তাঁর মাষ্টারমশাই নন্দলাল। উনিই দাঁড়িয়ে থাকেন, প্রায় প্রতিরাতে এসে দেখেন ছাত্রের সাধনা। আবার চুপচাপ ফিরেও যান, পাছে কিঙ্করের কাজের মননিবেশ নষ্ট হয়। কাজটা কিছুতেই শেষ করতে পারছিলেন না। মাষ্টারমশাই সাবধান করে দিলেন। তুমি স্রোতের ঘুর্নির মতো পাকে আটকে পড়েছ। কাজ শেষ করতে হবে, হাতে কি কারও অনন্ত সময় আছে? তোমাকে যে আরও অনেক কাজ করতে হবে। রামকিঙ্করের ভাষায়-‘ আটকেই তো গিয়েছিলাম। অভিমন্যুর মত ভেতরে ঢুকেছি বেরোবার পথ নেই। লোহা কাঁকর সিমেন্ট ছেনি হাতুড়ি সব ঘিরে ধরেছে। সেখান থেকে মাষ্টারমশাইয়ের পরামর্শেই তো বেরিয়ে আসা’। খোয়াই নদীর মোটা বালি কাঁকর ও পাথরকুচি দিয়ে তৈরি শান্তিনিকেতনের উন্মুক্ত জমিতে গলদঘর্ম শরীরে ক্লান্তিহীনভাবে রামকিঙ্কর এই বিশাল ভাস্কর্যটি নির্মাণ হতেই হৈ হৈ পড়ে গেল সমস্ত ভারতবর্ষের ভাস্কর্য মহলে। মানুষ অনুভব করল ভাস্কর্যের আধুনিকতায় ভারতীয় ঘরানার এক নুতন মাত্রা সংযোজনের ভাস্কর্য ‘সাঁওতাল পরিবার’। সেই প্রথম বিশেষজ্ঞ মহল রামকিঙ্করকে মেনে নিতে শুরু করল দেশের শ্রেষ্ঠ ভাস্করদের একজন হিসেবে।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴