বাগানিয়া জার্নাল-২
বাগানিয়া জার্নাল-২
শিশির রায়নাথ
--------------------------
চা গাছ-এর বৈজ্ঞানিক নাম ক্যামেলিয়া সাইনেনসিস (Camellia sinensis)।দার্জিলিং-এর পাহাড়ে পাহাড়ে আমরা যে ক্যামেলিয়া ফুলের গাছ দেখি তাদেরই তুতো ভাই বা বোন এই চা গাছ।আমাদের
চারপাশে্র বাগানগুলোর চা গাছ কোমর সমান উঁচু। তা আসলে বছর বছর কেটে ছোট
করে রাখা গাছ - যাতে পাতা তুলতে সুবিধা হয়; ঠিকমতো বাড়তে দিলে তা লম্বা হয়
প্রায় দশ বারো ফুট।প্রথমে
চা পাতা সংগ্রহ করা হত জঙ্গলের দুর্গম অঞ্চলে পাহাড়ের ঢালে ঢালে প্রাকৃতিক
ভাবে জন্মানো গাছ থেকে। অত উঁচু গাছ থেকে কী করে পাতা তোলা হত তা নিয়ে বেশ
একটা মজার গল্প চালু আছে। গ্রামবাসীরা নাকি গাছতলায় গিয়ে ওপরে বসে থাকা
বানরদের খুব গালাগালি দিত। তাতে বানরেরা ক্ষেপে গিয়ে মুঠো মুঠো পাতা ছুঁড়ে
মারত।আর তারা মনের আনন্দে সেসব কুড়িয়ে নিয়ে আসতো ঘরে।(ছবিঃ১)#সিংফোদের
‘ফালাপ’ যে আদতে ‘চা’-এরই দেশী রকমফের –এটা বোঝার পরেই চায়ের ওপর চিনের
একচেটিয়াত্ব ভাঙার জন্য ইংরাজরা উঠে পড়ে লাগল চা-চাষের জন্য। ১৮৩৫ সালে
সিংফোদের কাছ থেকে চারা এনে প্রথমে লাগানো হল ডিব্রু আর ব্রহ্মপুত্রের
সঙ্গম অঞ্চলে।কিন্তু সে সব গাছ বাড়লো না এবং শেষমেশ মরেই গেল।১৮৩৬
সালে আবার চারা এনে, আগের জায়গা থেকে সরে এসে, লাগানো হল মণিরাম দেওয়ানের
এক অন্য জমিতে।এবার গাছগুলো বেঁচেবর্তে বড় হয়ে উঠতে লাগল তরতর করে। ১৮৩৮
সালে সেই গাছের পাতা থেকে প্রথম বারো পেটি চা বানিয়ে পাঠানো হল লন্ডনে।
সেটা ছিল এক ঐতিহাসিক ঘটনা। এরপরেই পৃথিবীর চায়ের ইতিহাসে ঢুকে পড়ল ইংরাজরা
তথা আসাম।ঘটল বাণিজ্যিকভাবে ভারতীয় চা-শিল্পের সূত্রপাত।প্রথম
চা এখানেই বোনা হয়েছিল বলে সেই থেকে জায়গাটার নাম হয়ে গেল ‘চা বোয়া –CHAH
BOWA’। স্থানীয় ভাষায় ‘বোয়া’ মানে বোনা/রোপন করা। লোকমুখে তা ক্রমে হল
‘চাবুয়া (Chabua)।আর ভারতের প্রথম চা বাগান হল ওপর-আসামের তিনসুকিয়ার
Chubwa Tea Estate।প্রথম সাফল্যের পরেই চা চাষের যেন ধূম পড়ে গেল। আসামের নানা জায়গায় গজিয়ে উঠতে লাগল একের পর এক চা বাগান।কিন্তু
এত চা বাগানে কাজ করার জন্য যে চাই প্রচুর শ্রমিক। জঙ্গল কাটতে হবে,
পরিষ্কার করতে হবে, মাটি সমান করতে হবে, ছ ফুট দূরে দূরে গর্ত খুঁড়তে হবে ,
সেখানে একটা একটা করে চায়ের চারা বসাতে হবে...তারপর তার পাতা তোলা,
শুকানো...কত রকমের কাজ... স্থানীয়
লোকজন দিয়ে এত কাজ করানো যাবে না।একে তো তাদের জীবনযাত্রা ভীষণ ঢিলেমিতে
ভরা।নড়তে চড়তে চায় না সহজে। অভ্যস্থ জীবন যাত্রার বাইরে তারা আসতেই চায় না।
গ্রাম ছেড়ে দূরে গিয়ে কাজ করতে বড়ই অনীহা। বেশী পয়সার লোভ দেখিয়ে দু-একজন
যা-ও বা পাওয়া যায় - তাদের দিয়ে বেশী কাজ করানো যায় না। জোর করে বেশী কাজ
করাতে গেলে নানা রকম সমস্যা তৈরি হতে পারে। গোলমাল হতে পারে।বিদ্রোহ হতে
পারে। অতীতে যেখানে যেখানে নানারকম প্ল্যান্টেশানের কাজ হয়েছে সেখান থেকে
এসব অভিজ্ঞতা বৃটিশদের আগেই হয়েছে।তা ছাড়া
স্থানীয়ভাবে যত শ্রমিক পাওয়া যাবে লাগবে যে তার থেকে অনেক বেশী। কিছু
কাছারি, কিছু নাগা শ্রমিক যাও বা পাওয়া গেল তাও এত কাজের তুলনায় নগন্য।ফলে শ্রমিক যোগানোর জন্য ইংরাজরা নির্ভর করতে শুরু করল ‘আড়কাঠি’-দের (Contract-Labour Supplier/recruiter) ওপর।আড়কাঠিরা
নানা জায়গা থেকে, মূলত ছোটনাগপুর, মানভূম, সিংভূম, ওড়িষ্যা, বিহারের
দুর্দশাগ্রস্থ অঞ্চল থেকে প্রায় হা-ঘরে মানুষদের নানা প্রলোভন দেখিয়ে,
ভুলিয়ে ভালিয়ে নিয়ে আসতে লাগল আসামের চা বাগানগুলোতে। এতে ইংরাজদের সুবিধা
হল যে সেই সব লোকজন না বোঝে স্থানীয় মানুষজনের ভাষা – না স্থানীয় মানুসষজন
বোঝে তাদের। ফলে দুদল মিলে যে কোন গোলমাল পাকাবে সে সম্ভাবনা ক্ষীণ।ফলে ইংরাজরা তাদের বাড়ি ফেরার পথ বন্ধ করে, জোর করে, নানারকম অত্যাচার করে তাদের দিয়ে বাগানের কঠোর কাজ করাতে শুরু করল। এ
থেকেই সেই বিখ্যাত গান – চল মিনি আসাম যাব/দেশে বড় দুখ রে...সর্দার বলে
কাম কাম/বাবু বলে ধইরে আন/সাহেব বলে লিব পিঠের চাম/ ও যদুরাম/ফাঁকি দিয়া
পাঠাইলি আসাম...শ্রমিক
ধরে আনার সময় আড়কাঠিরা লোকজনদের ধরে ধরে একটা এগ্রিমেন্ট করিয়ে নিত। করিয়ে
নিত মানে সেটা একতরফা ব্যাপার। অনক্ষর মানুষগুলোকে দিয়ে একটা ছাপানো কাগজে
টিপছাপ নেওয়া – যাতে লেখা থাকত সে স্বেচ্ছায় এই কাজ করতে আগ্রহী ইত্যাদি
ইত্যাদি। আইন বাঁচানোর চালাকি । এই এগ্রিমেন্টের কারণে লোকমুখে এই শ্রমিকরা
হয়ে গেল ‘গিরমিটিয়া লেবার’। এখনও অনেক বাগানেই ‘গিরমিট লাইন’ বা
‘গিরমিটিয়া লাইন’ সেই স্মৃতি ধরে রেখেছে। তবে এসব ঘটনা একটু পরের দিকের । শুরুতে স্থানীয় মানুষদের দিয়ে সেসব কাজ করানোর চেষ্টা হয়েছিল।কিন্তু
মুশকিল হল কী ভাবে চা চাষ হয় সে সম্পর্কে ইংরাজদের নিজেদেরই কোন পরিষ্কার
ধারণা নেই – তারা অন্যদের দিয়ে কী ভাবে কী কাজ করাবে। তারা তাই চিনদেশ থেকে
চা চাষে অভিজ্ঞ কিছু মানুষজনকে বেশী কিছু পাইয়ে দেবার লোভ দেখিয়ে ভাঙিয়ে
আনল আসামে।কিন্তু সমস্যা
রইল তখনও। চিনাদের ভাষা না বোঝে ইংরাজরা না বোঝে স্থানীয় মানুষজন। কাজ হবে
কী করে? দু-একজন দোভাষী দিয়ে এত বড় কাজ ওঠানো সম্ভব নয়। কাজ চলছিল
আকারে-ইঙ্গিতে অর্থাৎ সাইন ল্যাঙ্গোয়েজে। ফলে কাজ চলছিল অত্যন্ত ঢিমে
তালে। তখন ইংরাজরা, চিনাদের সঙ্গে টক্কর দেবার
লক্ষ্যে, এক সঙ্গে চাইল চা-তৈরি করার দক্ষ চিনা-বিশেষজ্ঞ আর চা-সংক্রান্ত
বিভিন্ন কাজের জন্য দক্ষ ও অদক্ষ চিনা চা-শ্রমিক। তাই ইংরাজরা এবার পাকড়াও
করল সেইসব আড়কাঠিদের যারা চিনদেশ থেকে শ্রমিক যোগান দেয়। #সামন্ততান্ত্রিক
চিন তখন ইংরাজদের জোগান দেওয়া ভারতীয় আফিমে বুঁদ। তা কাটাবার জন্য চীন সবে
নড়েচড়ে উঠেছে। গ্রামগুলোর অবস্থা ভীষণ খারাপ। দুর্ভিক্ষে আর মহামারীতে
গ্রামকে গ্রাম তছনছ। এক বস্তা চালের জন্য ঘরের ছোট ছোট মেয়েদের বিক্রী করে
দিতে বাধ্য হচ্ছে বাবা-মা। ছেলেদের রেখে আসছে শহরে কোন দোকানে কাজ করার
জন্য।ফলে সেখানে তখন ঘুরে বেড়াচ্ছে আড়কাঠিরা। কোথাও
বড়মানুষদের আমোদের জন্য ছোট মেয়েদের তোলার চক্করে; কোথাও টিনের খনি, তামার
খনির জন্য শ্রমিকের খোঁজে। সেই একই টোপ - সুখী জীবন, অনেক টাকাপয়সা। লোভ
দেখিয়ে জাহাজে তুলে দেওয়া। তারপর তাদের ভাগ্যে যা আছে তাই হবে...বৃটিশদের
শ্রমিক-চাহিদায় সাড়া দিয়ে এবার তাই আড়কাঠিরা তাদের পাঠাতে লাগল কলকাতায় –
খিদিরপুর ডকে। ১৮৩৯ সালে সেখান থেকে প্রথম পনেরজন চিনা মানুষকে পাঠানো হল
আসামের চা বাগানের কাজে।তারপর কলকাতার আশপাশ থেকে আরো কিছু। সেইসঙ্গে মালয়,
সিঙ্গাপুর, পেনাং থেকে।সেই
সময়ে,১৮৪৮ থেকে ১৮৭০, চিনের ম্যাকাও দাসব্যবসায়ের অন্যতম বন্দর হিসেবে
কুখ্যাত ছিল। মূলত গুয়ান্ডং(Guandong) প্রদেশ থেকে মানুষদের কিডন্যাপ করে
জাহাজে উঠিয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হত কিউবা, পেরু এবং অন্যান্য দক্ষিণ আমেরিকার
দেশগুলোতে – সেখানকার প্ল্যান্টেশান বা খনিতে কাজ করানোর জন্য।ইংরাজরা চা-বাগানের জন্য সেখান থেকেও শ্রমিক আনাতে লাগল।এইসব
চিনা শ্রমিকদের সঙ্গে কথাবার্তা চালানোর জন্য তারা কলকাতার এক চিনা-ওষধি
বিশেষজ্ঞ লাম কোয়া (Lum Kwa)-কেও আসামে পাঠিয়ে দিল। লাম কোয়া তার সঙ্গে
আঠারোজন চিনা মানুষকে নিয়ে ১৮৪০ সালে এল আসামে।আর
এভাবেই ভারতীয় চা-শিল্পের সূচনা লগ্নেই প্রবেশ ঘটল বেশ কিছু চিনা
মানুষজনের যাদের কারো না কারো বংশধরই আমাদের বাগানের লিওং কং (Leong Kong)
পরিবার।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴