বাংড়ি তিতি হাউড়ি শেষে ...
পর্ব : ২
মিশা ঘোষাল
++++++++++++++++++
টোটোপাড়ার লাইফ-লাইন : বাংড়ির নদী-পথ
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টোটোপাড়ায়
ঢোকার লাইফ-লাইন হল বাংড়ির নদী-পথ। এখানে কোনো ব্রিজ নেই। প্রতিবছরই
বর্ষার মরসুমে ভেঙে যায় টোটোপাড়ায় যাবার এই একমাত্র যানবাহন চলাকালের
রাস্তাটি। এবারও তাই হয়েছে ।প্রবল বর্ষায় ভূটান পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নেমে আসে
ডলোমাইট ধোয়া বর্ষার জল। বালি আর পাথরও সঙ্গে করে নিয়ে আসে প্রবল স্রোতের
এই জলোচ্ছ্বাস । সঙ্গে বড় বড় গাছপালা শিকড় সমেত বয়ে নিয়ে আসে বাংড়ির এই
স্রোত। এ পথের যাতায়াত বন্ধ হয়ে যায়। যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকলে টোটোরা তথা
টোটোপাড়ার মানুষ-জন বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন লোকালয় থেকে। কাছের মাদারীহাট থেকে
অত্যাবশ্যকীয় পণ্য, খাদ্যসামগ্রী না পৌঁছতে পারলে চরম দুর্বিপাকে পড়তে
হয় টোটোদের তথা এই অঞ্চলে বসবাসকারী অন্যান্য জনজাতিদের। যানবাহন চলাচলের
রাস্তাটি বন্ধ থাকলে টোটোপাড়ার একমাত্র বাজারটিও বন্ধ হয়ে যায়। প্রতি
মঙ্গলবার এই একদিনই টোটোপাড়ায় বাজার বসে। প্রবল বর্ষণের পর এই বাংড়ির
রাস্তা ভেঙে গিয়ে পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। ব্লক ডেভেলপমেন্ট অথরিটি এসে
রাস্তা মেরামত করে দিলে টোটোপাড়ায় যাবার বাংড়ির এই নদীপথের রাস্তাটি আবার
সচল হয়।
এই বাংড়ি নদীর
কাহিনি একটু অন্যরকম। এই নদীর বালি, পাথর তুলে জীবন-জীবিকা নির্বাহ হয় আর
এক আদিবাসী সম্প্রদায়ের শ্রমিকদের। বাংড়ির পাড়ে যে বস্তি এলাকা আছে সেখানে
রয়েছে "হান্টাপাড়া টি গার্ডেন"। এই চা বাগানের শ্রমিকরা হল আদিবাসী
সম্প্রদায়ের মানুষ। লাকড়া, ওঁরাও, কুজুর, লোহার প্রভৃতি আদিবাসী
সম্প্রদায়ের মানুষজন সেই ইংরাজ আমল থেকেই এখানে বসবাস করছেন। মূলত
বাগিচাশ্রমিক হিসেবে কাজ করতেই তারা এখানে বসতি স্থাপন করে। ইংরেজরা চলে
যাবার পর এখানকার ধুমচিপাড়া, রামঝোরা, হান্টাপাড়ার চা বাগিচাগুলির অবস্থা
প্রায় রুগ্ন। এই চা বাগানের শ্রমিকরা কাজের অভাবে পেটের দায়ে ভিন রাজ্যে
চলে যাচ্ছে রুজি-রোজগারের জন্য, তাদের ছোটো ছোটো পুত্র-কন্যারা এই বাংড়ি
নদীতে বসে পাথর কুড়িয়ে একত্রিত করে। তপ্ত রোদে পাথর ভাঙে। এমনকি আমাদের এই
ভাঙা রাস্তা মেরামত করতেও এগিয়ে আসে ক্ষুদে এই আদিবাসী বাচ্চাগুলো। আমাদের
গাড়ি আটকে দিয়ে একটু সাহায্য চায়। হাতে দশ-বিশ টাকা দিলে আমাদের
গাড়িগুলোকে যাবার মতো উপায় করে দেয়। কোদাল, শাবল নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে ওরা।
গাড়ি নদীপথ পার হতে গিয়ে ফেঁসে গেলে, পাথর ফেলে ফেলে নদীর মধ্যে নতুন
রাস্তা তৈরি করে। বালি, মাটিও জড়ো করে। তারপর ঐ নতুন পথে যাবার জন্য গাড়ি
ঠেলে দেয় পিছন থেকে। আমরাও অসহায়, সামান্য পয়সার বিনিময়ে ওদের ঐ ক্ষুদ্র
হাতের তৈরি করা বাংড়ি নদীর রাস্তা পার হই আমরা। আর পাড় বাঁধ ভেঙে গেলে তো
কোনো উপায় থাকে না এই পথে যাবার। ব্লক ডেভেলপমেন্ট অথরিটির ইঞ্জিনিয়াররা
এসে ভিজিট করে গেলে মাননীয় বিডিও-র তৎপরতায় আবার এই রাস্তা মেরামত হয়।
পাড়-বাঁধ তৈরিও হয়ে যায়। চলে কিছুদিন, আবার হড়পা বান এলে ভেঙে যায় এই বাঁধ।
ভেসে যায় রাস্তা, ভূমিক্ষয় করে এই বাংড়ি নদী পাশের চা-বাগানেরও কিছু অংশ
উপড়ে নিয়ে যায় স্রোতে। অরণ্যের ভূমি ক্ষয় করে শিকড় সমেত ছোটো-বড়ো গাছও
উপড়ে নিয়ে আসে বাংড়ি ও তার জলস্রোতে। আটকে দেয় পথ।
সৃষ্টি
হয় নতুন বালির চর। এই চর থেকে ট্রাক ভর্তি করে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় বালি,
তুলে নেওয়া হয় পাথরও। নদী পথ আরও গভীর হয়। বড় বড় গর্তের উপর দিয়ে ঝাকুনি
খেতে খেতে চলতে হয় টোটোদের তথা আমাদের মতো এই পথের যাত্রীদের।
এখন
থেকে রোজগারের বিনিময়ে পাথর ভাঙে আদিবাসী চা শ্রমিকরা। মেয়ে, বৌ সকলেই।
নদীর জল শুকিয়ে গেলে তপ্ত বালির আঁচে তামাটে হয়ে ওঠে ওদের গায়ের রঙ। নদীর
মাঝখানে পাথর কুড়িয়ে জমাতে থাকে ওরা। তারপর গরম বালির তপ্ত বুকের বসে
হাতুড়ির আঘাতে ভাঙতে থাকে পাথরগুলি। টাকার অঙ্কে ট্রাকে তুলে দেয়। এখানকার
শ্রমিকদের পেট বাঁচে এভাবেই ।
এই
পাথর, বালি দিয়েই সড়ক-পথ নির্মিত হয়, নির্মিত হয় হাইওয়ে। গড়ে ওঠে বড় বড়
অট্টালিকা,ইমারত এই বাঙড়ীর মতো এরকম আরও অনেক নদীর বালি,পাথরেই । ক্ষয় হয়
নদীর বুক, চা বাগান, অরণ্য । গড়ে ওঠে শহর। গড়ে ওঠে বড়ো বড়ো রাস্তা,
ঘর-বাড়ি। বাংড়ি নদীর এই কাহিনি অনেক দিনের পুরোনো ।
তবুও
সময়ের সন্তোষে বেঁচে থাকে নদী, বস্তি, চায়ের বাগান, আদিবাসী সম্প্রদায়ের
মানুষ, বাগানের শ্রমিকরা। বাঁচুক অরণ্য, বেঁচে থাক গাছ-গাছালি । সবুজের ঘন
বনই তো অক্সিজেন প্লান্ট-
ভরপুর বেঁচে থাকার রসদ !
বেঁচে থাক শহর, বন্দর, নদী,অরণ্য । প্রত্যেকেই প্রত্যেকের পরিপূরক। উভয়ের নির্ভরতায় স্থিতিশীল হয় গ্রাম ও শহর।
কে যেন গেয়ে যায়...
শূন্যতার বুক জুড়ে তার আকূল নিঃশ্বাস!
বাংড়িও সুর মেলায় ...
দূর থেকে ভেসে তার সুর,
"এ কূল ভাঙে,ও কূল গড়ে এই তো নদীর খেলা"...