সহজ উঠোন

রেজিস্টার / লগইন করুন।

সব কিছু পড়তে, দেখতে অথবা শুনতে লগইন করুন।

Sahaj Uthon
22-November,2022 - Tuesday ✍️ By- অমিত কুমার দে 473

প্যাট্রিসিয়ার বাসায়

প্যাট্রিসিয়ার বাসায়   
অমিত কুমার দে
^^^^^^^^^^^^^^^^^

ক.
এক প্যাট্রিসিয়ার জন্যই বারবার যাওয়া যায় পাহাড়িয়া গ্রামে!
প্যাট্রিসিয়া একটি মেয়ে। প্যাট্রিসিয়া নিজেই যেন এক ছোট্ট পাহাড়, যাকে কোনো ম্লান ছোঁয়নি। সে নিজেকে ছুঁতে দেয়নি, কিন্তু আমাকে ছুঁয়েছে কত গভীরে। 
উইন্ড ভ্যালি হোম স্টে-তে অফুরন্ত বাতাস লনে পাতা চেয়ারগুলোয় এসে দিব্যি বসে থাকে। তাদের আঙুল নাড়ানোতে লালপাতির লাল পাতাগুলো তির-তির দুলতে থাকে। সব গাছ একসঙ্গে ডেকে ওঠে – “প্যাট্রিসিয়া...”!
গাড়ি থেকে নেমেই আমি বাতাসদের বলি – “ডোকলামকে পরিষ্কার হতে বল গিয়ে। আমি একটু চেয়ারে বসি! রচেলাকেও ফুটে উঠতে বল!”  
তখনি গ্র্যান্ড লেডি প্যাট্রিসিয়া পাহাড়িয়া বালায় সাজানো হাত তোলে, তুলতুলে গালে লালপাতির প্রতিবিম্ব, নরম আঙুল লাল ঠোঁটে লাগিয়ে মিষ্টি করে হেসে বলতে চায় – “হামরো ঘর মা আউনু (আমাদের বাসায় এসো)।”

খ.
গোদক নিয়ে লিখেছিলেন শুভজিত। নাগরাকাটার শুভজিত দত্ত। কুমাইয়ের রামপ্রসাদও বলেছিলেন – এই পাহাড়ি গ্রাম শুদ্ধতায় মোড়া। শুভজিতের সূত্রে পরে আলাপ হল ঝালংয়ের প্রণয় বরাইলির সঙ্গে। তিনি নিমেষে উইন্ড ভ্যালির আতিথ্যে ডেকে নিলেন! 
মাঝ-ডিসেম্বরের শীত-সকালে লুকসানে গরম চায়ে রুটি ভিজিয়ে কামড় দিতে দিতে  মিমিকে বললাম – “গোদকে কোনো নেটওয়ার্ক পাবো না। দারুণ হবে বল!” মুখ মেঘলা হতে গিয়েও খুশি উপচে উঠল! বুঝলাম – ও ভাবছে – বেশ হয়েছে, দুটো দিন অনলাইন ক্লাসের ঝঞ্ঝাট নেই! 
চাপড়ামারির গাছগুলো তখন সকালি রোদ নিয়ে লোফালোফি করছে। গাছছায়ারা গড়াগড়ি খাচ্ছে অরণ্যসড়কে।
কফিবাগানকে ডানদিকে রেখে তিনটি ময়ূর বেপরোয়াভাবে পাকা রাস্তায় উঠে এসে আমাদের গাড়ি দেখে থমকে দাঁড়াল। বাপ্পা,আমাদের চার চাকার মালিক, এক মনে তখন আমলকি কুড়িয়ে চলেছে। আমরা ঝালং-এর কাছাকাছি তখন। 

গ.
আরো প্রায় সাত কিলোমিটার খাড়াই উঠতে উঠতে, ডানদিকে জলঢাকা নদী ... ল্যান্ডস্কেপের মতো পাহাড়িয়া গ্রাম ... ঝুমচাষ ... বিস্তর পাহাড়িয়া ফুল দেখতে দেখতে একটা নিষ্পাপ গাঁয়ে পৌঁছে গেলাম। গোদক। কালিম্পং জেলার গরুবাথান ব্লকের তোদে-তাংতা গ্রাম পঞ্চায়েতের অন্তর্গত। চৌষট্টি বছরের কাহারমন রাই-এর স্বপ্ননির্মাণ – উইন্ড ভ্যালি হোম স্টে। নিজেদের থাকবার জন্য কী যত্ন করে পাহাড়ের ঢালে স্বপ্নের মতোই পাকা বাড়ি তৈরি করেছিলেন। নিজেরা এখন পুরোনো আধাকাঁচা ঘরে থেকে স্বপ্নের বাসাটা পর্যটকদের জন্য রঙে আভিজাত্যে সাজিয়ে তুলেছেন। কাহারমনের দুই পুত্র প্রমোদ ও ইন্দ্রজিত তাদের হাসিমুখে, আত্মীয়তায় ভরিয়ে রাখতে সবসময় তৈরি। 
প্রমোদ বলছিল তাদের জীবনযুদ্ধের কথা। শুনে অবাক লাগে, এও আমাদের ভারতবর্ষ। স্মার্ট আধুনিক ছেলেটি কেন গ্র্যাজুয়েশন করেনি জানতে চাইলে জানায় – সে তো গোদকের মতো পাহাড়ি গ্রামের ছেলেমেয়েদের কাছে প্রায় কল্পনাতীত। সারা বছরের সামান্য উপার্জন – বড় এলাচ, আদা আর ঝাড়ুর উপাদান বেচা। সবচেয়ে কাছের কলেজ মালবাজারে, গিয়ে ক্লাস করে ফিরে আসা অসম্ভব। আবাসিক হিসেবে থাকবার খরচ জোগানোও কঠিন। তাই চিশাং-এ উচ্চ মাধ্যমিক করার পরেই পড়াশুনায় ইতি। 
প্রমোদ বলছিল তার স্কুলদিনের কথা। ভোরবেলা উঠে এলাচ-আদা পরিচর্যার কাজ, তারপর বন থেকে জ্বালানির কাঠ সংগ্রহ, তারপর স্নান-খাওয়া সেরে দুর্গম হাঁটাপথে চিশাং হাই স্কুলের দিকে যাত্রা। সঙ্গে বস্তা আর কাঁচি, ফেরার সময় ঘাস কেটে আনতে হবে গবাদিদের জন্য। বর্ষায় এখানের জীবনযাত্রা আরো আরো কঠিন। তাই বৃষ্টিদিনের রসদ জ্বালানি সংগ্রহ করে রাখতেই বছরের অর্ধেকটা ব্যস্ত থাকতে হয়। আমরা বসে থাকতে থাকতেই দেখলাম কাহারমনের সহধর্মিনী চন্দ্রমায়া রাই পিঠের ঝুড়িতে লাকড়ি বোঝাই করে এবড়ো-খেবড়ো পাহাড়ি ঢাল ধরে নেমে আসছেন ঘরের দিকে। তখন তাকে দেখে কে বলবে – এই ঝা-চকচকে হোম-স্টে-র মালকিন তিনি!

ঘ.
কাহারমনের বাবা চুরানব্বই বছরের তহলসিং রাই। যেন পাহাড়িয়া গ্রামের জীবন্ত ইতিহাস। বয়সরেখায় ভরা মুখে সব সময় লেগে আছে পবিত্র হাসি। তার পায়ের কাছে বসে জেনে নিই অতীতকথা। এই জায়গাটির আসল নাম “স্কুলডারা”, ব্রিটিশদের সময় এখানে একটি স্কুল ছিল। ইংরেজ আধিকারিকরা ঘোড়ার পিঠে চড়ে আসতেন। তহলসিং-এর চোখে এখনো সেই ছবি ধরা আছে। তিনি বলছিলেন পাহাড়ি ভালুকের কথা। তারা সব কোথায় উধাও হয়ে গেল তার হদিশ তিনি কিছুতেই পান না! কীভাবে কত কষ্ট করে পাহাড় কেটে বড় এলাচের চাষ শুরু হল, কীভাবে প্রকৃতিই তাদের চিনিয়ে দিল ঝাড়ু তৈরির উপকরণ, কী অমানুষিক পরিশ্রমে ঘর বাঁধলেন ... শুনতে শুনতে মনে হয় রূপকথার গল্প শুনছি!

ঙ.
লাঞ্চ হতেই প্রমোদ ও তার জামাইবাবু বলল – চলুন ট্রেকিংয়ে! কমলাবাগান দেখিয়ে আনি!
আমরা পাহাড়ের গা বেয়ে পাহাড়ি রাস্তা ধরে নামছি। কোনো মানুষজন নেই। গাড়ি বাইক তো এ পথে চলেই না। ওরা আমাদের চিনিয়ে চলেছে ওষধি গাছগাছড়া। কিছুকাল আগে পর্যন্তও এখানে কোনো চিকিৎসাব্যবস্থা ছিল না।  যেন প্রকৃতিই তাদের বাঁচিয়ে রেখেছে যুগের পর যুগ, বছরের পর বছর। তারা দেখাচ্ছিল - কেটে গেলে কোন পাতা হাতে ডলে লাগালেই ম্যাজিকের মতো কাজ দেবে, কোন পাতা চিবোলে খাবার হজম হয়ে যায়...! মাটি ও পাথর খুঁড়ে একটা গোল ফল হাতে দিয়ে বলল – “খেয়ে দেখুন, প্রাকৃতিক জলে তেষ্টা মিটে যাবে। আমরা যখন কাঠ সংগ্রহে অনেক দূরে যাই, ক্ষেতে কাজ করি, যখন খুব তেষ্টা পায়, তখন এই গ্রাউন্ড আমলা আমরা খাই। শুধু কি তেষ্টা মেটায়, শরীরে আরো কত উপকার করে!”  
বহুদূর নেমেও কমলাবাগান নজরে মিলল না। জানা গেল যতটা নেমেছি, আরো ততদূর যেতে হবে। দুর্ঘটনায় প্রায় নড়বড়ে পা আর দিচ্ছিল না, ভেতরের প্লেটটা খচখচ করছিল। নিজেরই মনে হল – বাড়াবাড়ি করে ফেলছি। ইতিমধ্যেই অনেকটা পথ নেমেছি, আবার উঠতে হবে তো, বিকেল ঘনিয়ে আসছে। তাই বাধ্য হয়ে অন্যদের এগোতে বলে আমি একটা পাথর খুঁজে বসে পড়লাম। 
ওরা এগোতেই নির্জনতা ঘিরে ধরল আমাকে। গুটিকতক পাখির ডাক ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। একা একা কবিতা বলতে লাগলাম গলা ছেড়ে। যা যা মনে আছে। কেউ শোনার নেই, অথচ এক প্রশান্তি ঘিরে ধরেছে আমাকে।

চ.
রাতে বড় করে আগুন জ্বালিয়ে দিল প্রমোদ। কী ঠাণ্ডা! গুটিসুটি মেরে বসে থাকা আমরা যেন নতুন জীবন পেলাম। মিমি গেয়ে উঠল অরিজিত সিং। আমরাও একে একে গলা মেলালাম নিজের নিজের পছন্দের গানে। আমাদের শুনতে শুনতে গান এল প্রমোদের গলায়। সে নিজের মাতৃভাষায় গেয়ে উঠল। তার প্রায়-কিশোরী সুন্দরী বৌ প্যাট্রিসিয়াকে কোলে করে এসে দাঁড়াল আগুনের পাশে। আরো অগ্নিভ হয়ে উঠল তার গাল। ছোট্ট প্যাট্রিসিয়া তালি দিয়ে ছন্দ মেলাবার চেষ্টা করতে লাগল!

ছ.
মাঝরাতে একবার হোম-স্টে-র প্রাঙ্গনে দাঁড়ালাম। চারদিকের পাহাড়েরা আলোর মিটমিট জ্বালিয়ে কী এক  রহস্য তৈরি করেছে। ভালো লাগা, আবার বুক ছমছম। 
ভোরে উঠে হোম-স্টে-র নিজস্ব সানরাইজ ভিউ পয়েন্টে দাঁড়ালাম। পাহাড় ডিঙিয়ে সূর্যের উঠতে একটু দেরিই হল যেন! চারিদিকের পাহাড়েরা নানান রঙে, রঙের শেডে অপরূপ হয়ে উঠল। আলো পড়ল চুপচাপ গীর্জাটায়। চারদিক চূড়ান্ততম পবিত্র হয়ে উঠল, তার অংশীদার যেন আমিও।
বের হলাম প্রভাতী হাঁটায়। গ্রাম জেগে উঠছে। এক নেপালি দিদি কেবল দরজা খুলেছেন। নির্দ্বিধায় বায়না ধরলাম – “চা খাব!” তার বাড়ির সামনেই একটা পুচকি চায়ের স্টল। হাসিমুখে চা চাপালেন তিনি। সবসময় যা হয়, এখানেও তার ব্যতিক্রম হয়নি, দুটি পাহাড়ি কুকুর পরমাত্মীয়ের মতো গোটা পথ জুড়ে সঙ্গ দিয়ে চলেছে। রাস্তার ওপর ওদের দুহাতে ছুঁলাম!

জ.
জেগে উঠেছে ডোকলাম। চীনা সীমানা। পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে রচেলা। রোদ পোহাচ্ছেন তহলসিং রাই। একটা পাহাড়চূড়ার দিকে তাকিয়ে মনে হল এক বৃদ্ধ শুয়ে আছেন। তহলসিং-এর দিকে একবার তাকাই, একবার সেই চূড়ার দিকে। মনে মনে তার নাম দিলাম ‘গ্র্যান্ডফাদার পিক’! 
প্রমোদ বলল – “থেকে যান দুটো দিন। ট্রেকিংয়ে নিয়ে যাব গুরদুম আর টংলঙ্গে। ওখানে পাহাড়ের গায়ে গর্তে শব্দের প্রতিধ্বনি হয়। ফিরে এসে যাবেন তোদে, সেখান থেকে ক্যারামটার হয়ে তাংতা, সেখানে রয়েছে প্রাচীন বৌদ্ধগুম্ফা। The last monastery of India”, প্রমোদ শোনাল দাবাখোলার কথা, কাছেই রয়েছে তা। এর লাল জলে স্নান করলে নাকি সব রোগ সেরে যায়। 

ঝ.
ইচ্ছে না থাকলেও কাজের তাড়ায় বের হতে হল। সারা পরিবার গীর্জার প্রাঙ্গনে দাঁড়িয়ে হাত নাড়ছেন। তার আগে যত্ন করে ‘খাদা’ পরিয়ে শুভেচ্ছা দিয়েছেন সপুত্র কাহারমন। 
তোদের শতাব্দিপ্রাচীন গীর্জায় গিয়ে মন শান্তি পেল। পাহাড়িয়া বাজার ঘুরে আরো একটি চার্চে পৌঁছলাম আমরা। মিমি আপন মনে ঘন্টা বাজিয়ে চলেছে। দুপুরের ঘুম ভেঙে গেল বুঝি নেপালি-বউয়ের। ছেলেকে পাঠিয়ে মানা করলেন ঘন্টা বাজাতে।
আমরা নামতে লাগলাম। বিন্দুর রাস্তায় গিয়ে পেলাম আপেলের মতো একটা বিশাল পাথর। একটা ছোট নদী তাকে ছুঁয়ে চলেছে তিরতির ছিপছিপে জল নিয়ে। প্রায় জলের ওপরই একটা রেস্তোরাঁ। জলের আওয়াজ শুনতে শুনতে খেয়ে নিলাম দুপুরের খাবার। 
তারপর আবার ঝালং। জলঢাকা এখানে যেন নিজেকে পুরো মেলে ধরেছে। নদীর গান শুনতে শুনতে বেলা ঢলে পড়তে লাগল! 
-------------------------------------------------------------
উইন্ড ভ্যালি হোম স্টে-তে যেতে হলে যোগাযোগ : প্রমোদ রাই – ৯৪৭৪১২৮৫৪৯/৯৭৫১৬৯১৩০৪১/৮৯০০৬১০৫৪৭

আপনাদের মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴
software development company in siliguri,best
                            software development company in siliguri,no 1 software
                            development company in siliguri,website designing company
                            in Siliguri, website designing in Siliguri, website design
                            in Siliguri website design company in Siliguri, web
                            development company in Siliguri