পইলা সাঞ্ঝির কথা/২
পইলা সাঞ্ঝির কথা
পর্ব - ২
শুক্লা রায়
÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷
পানিকফালা
~~~~~~~
পাকা বেলের মতো চেহারা লোকটার। ফর্সা গোল মুখটায় দাড়ি-গোঁফ কিছুই নেই। মাথাটাও প্রায় পরিস্কার। যাকে বলে বিস্তীর্ণ টাক। পান খাওয়া মুখ, অনর্গল কথা বলে যাচ্ছে আর মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে হাসছে। কান্তেশ্বর অত জোরে না হাসলেও মুখে একটা স্মিত ভাব ঝুলিয়ে রেখেছে, বসমতী বুঝতে পারে না কী এত কথা থাকতে পারে লোকের। পরে অবশ্য শুনেছে জমির সীমানা নিয়ে ঝামেলায় আছে, কান্তেশ্বরের কাছে এসেছে কিছু পরামর্শের জন্য। চা করে দিয়ে আপন মনে কাজ করে যাচ্ছে বসমতী। কিন্তু খুব মাথাটা টিকটিক করছে সমানে। মাঝে মাঝে ঘোরাচ্ছেও। প্রেসারটা বাড়ল কিনা কে জানে! পানের বাটায় পান সুপারী রেখে রসবালার বাড়ির দিকে পা বাড়ালো, হাতে শালিমারের টিনের কৌটো। প্রেসার বাড়লে অতো ডাক্তার কবিরাজের বাড়ি ছুটতে ইচ্ছে করে না। পর পর কয়েকদিন ছেকা খায়। এবার অনেক 'ধুলা' বানিয়ে রেখেছে। আজকেও একটু ছেকা রান্না করবে মনে মনে ভেবে রাখল। উঠোনে পা দিয়ে দেখে রসবালার সাথে কলার পাইকার সোপিয়ারের খুব কথা-বার্তা চলছে। গলা শোনা গেলেও রসবালাকে কোথাও দেখতে পায় না বসমতী। সেজন্য হাঁক পাড়ে 'কইনা, কইনা মাই?' রসবালা চটজলদি উত্তর দিল, 'এটে দি, গোয়ালী ঘরোৎ। চাইট্টা শিন্ডা নিগাং। পানিকফালা আন্দোং।' 'কইনা' মানে কনে হলেও রসবালাকে কোনোমতেই নতুন বউ বলা যায় না। কিন্তু বসমতী যে পাড়াতুতো সম্পর্কে রসবালার ননাস হয়। বসমতী সারাজীবন রসবালাকে এইভাবেই ডাকবে। বাড়ির পুরুষরা পান্তা খেয়ে যে যার মতো কাজে গেছে। রসবালার জন্য কুলায়নি। সেজন্য পানিকফালার আয়োজন। বসমতীকে দেখে সহজ সরল রসবালা খুব খুশি হল। শিন্ডা, মানে পাটকাঠিগুলো, উনুনের কাছে রেখে বসমতীকে পিঁড়ি পেতে দিয়ে নিজে একটা আধভাঙা, কোমর ব্যাঁকা মোড়া টেনে বসল। একটা ছোট কাপে একটু জলও নিল। কলের পাড়ে একটা বড় কলার কাঁদি নেমেছে রসবালাদের। সোপিয়ারের সঙ্গে সেটারই দামাদামি চলছিল। কিন্তু দামে কিছুতেই বনছে না। বসমতীকে দেখে সোপিয়ার এবার সাক্ষী মানে, "দ্যাখ তো দি, একিনা কলার পির উমরা আরো কয় টাকা বায়রাত বেচাবে? অল্প অল্প করি খুচরা বেচের পাবে?" শেষে আরো কুড়ি টাকা বেশি দিতে চেয়ে একটা রফায় আসার চেষ্টা করে সোপিয়ার। রসবালার মনঃপুত না হলেও মেনে নেয়, তবু চেঁচিয়ে বলে "মড়াটা মোরে সাথে মরেছে, অইন্যঠে আরো বেশি দাম দিলেক হয়।" সোপিয়ার হা হা করে ওঠে, "না হয় মাই, না হয় মাই, এইলার এলা এই মতোনে দাম।" কলার কাঁদিটা নামিয়ে এনে যাওয়ার উদ্যোগ করলে রসবালা আগের ঝগড়া সম্পূর্ণ ভুলে গিয়ে টাকা নিতে নিতে আতিথেয়তা মিশিয়ে নরম গলায় সোপিয়ারকে বলে, "বইস বোনু, চা খায়া যা।" সোপিয়ার অবশ্য বসে না। কার বাড়িতে আর একটা কলার কাঁদি দেখে এসেছে, সেখানে যাবে। রসবালা সঙ্গে সঙ্গে বলে "ওঠে এলা যায়া মরিবু হেনা? চা নাখাইস তে পান খায়া যা, হালুয়া আসি এলায় কবে মোক।" সোপিয়ার সাইকেলের পেছনে কলার কাঁদিটাকে শক্ত করে বেঁধে নিয়ে যেতে যেতে বসমতীর দিকে তাকিয়ে বলে "তোর বোদায় পেসার বাইচ্চে দি, ছেকা খা, মাইকে ক আন্দি দিবে এলায়।" রসবালা সঙ্গে সঙ্গে চেঁচিয়ে ওঠে, "বইস মোরা, তোকে আন্দি দিম এলায়।"
কিন্তু সোপিয়ার আর দাঁড়ায়নি, তাকে যেতে হবে আর এক পাড়া সাইকেল ঠেলে ঠেলে। বসমতী কৃত্রিম রাগ দেখিয়ে বলে, "তুই এখেরে বেইন্নায় ঝগড়া করিস মাই"! রসবালা হেসে বলে "বোনু হয় যে দিদি, ওই জইন্যে ঝগড়া করং, এমনি রাগ না হয় তো!" "অত দূরকার মানষিটা আরো ক্যাং করি তোর বোইনা হইল?" বসমতীর প্রশ্ন শুনে কথাটা এবার খুলেই বলে রসবালা, "খগেন বোনুর বন্দু হয় যে দিদি, উয়াও না কোলার পাইকার। ওই তানে সোপিয়ার বোনুও মোক শালী বুলি মানে। আস্তায় ঘাটে দেকা হইলে খিব আদর করে। চা খোয়াবে, বড় বড় বনগিলা, এখেরে ছাড়িবেকে না, খা মাই, খা মাই।"
তারপর হাসিমুখে আবার মোড়াটায় বসে তেলেজলে মিশিয়ে বসমতীর মাথায় দু হাতে সহনীয় মাপে থাপড় মেরে মেরে তেলটা মাথায় ম্যাসাজ করে দিল। আরামে বসমতীর প্রায় ঘুম চলে এসেছে। মাথায় 'তেল বসানো' হয়ে গেলে রসবালা আস্তে আস্তে ডেকে তুলল বসমতীকে। যেতে দিল না কিছুতেই। পিঁড়িটা তুলে রান্নাঘরে পেতে দিল। ঝটপট উনুন ধরিয়েই কড়াই বসিয়ে দিল। বসমতী গল্প করতে করতে ওর কাজ দেখছিল। পানিকফালা বসমতীরও খুব প্রিয়। রসবালা চাল ভেজে নামিয়েই খুব সামান্য তেল দিল কড়াইয়ে। তারপর একটা শুকনো লঙ্কা, সামান্য পাঁচফোড়ন, কেটে রাখা পেঁয়াজ, রসুন দিয়ে একটু নেড়ে ভাজা ভাজা হয়ে এলে জল ঢেলে দিল। জল ফুটে উঠলে গরম চালভাজাগুলো ঢেলে দিল। তারপর একটু নুন দিল। খুব বেশি নরম করে সেদ্ধ করল না। একটু শক্তমতো নামিয়ে ঠ্যাঙাটা বসিয়ে দিল উনুনের উপর। চা হবে। তিনটে লোহার শিক দিয়ে বানানো ঠ্যাঙার মাঝে একটা আংটা। আংটায় কেটলিটা বসিয়ে চায়ের জল চড়িয়ে দিল। তারপর একটু সংকোচ নিয়ে বলল, "দুধ নাই, নাল চা খা দি। অল্পকোনেক চিনি আছে।" বসমতী মাথা নাড়ল। তারপর বলল "পানিকফালা দিয়া নাল চায়ে ভাল।"
রসবালা কাজে কম্মে খুব চটপটা। একটা দস্তার বড় বাটিতে পানিকফালাগুলো ঢালল। তারপর দস্তারই একটা সামান্য ছোট বাটিতে অর্ধেক পানিকফালা ঢেলে বসমতীকে এগিয়ে দিতে দিতে বলল, "তুই খোরাটাৎ খা দি।" বসমতী পরিমাণ দেখে আঁৎকে উঠল। জোর করে কিছুটা কমাল। বাড়িতে চা চিড়ে খেয়েছে অনেকটা। তবে চালভাজা দিয়ে বানানো পানিকফালাটা বসমতীর খুব প্রিয়। সুন্দর গন্ধটাই আকর্ষণ করে মনকে। কেউ খেতে বললে না করতে পারে না। রসবালা খেতে গেতে আন্তরিকভাবে জিজ্ঞেস করল "মাথা ঘুরানীটা কমিল দি?" বসমতীর খুব আরাম হয়েছিল। বলল, "কমিল অনেকখেনায়। দ্যাক তো, তুই না থাকিলে এইটা মাথা ধরিয়া কোটে গেলুং হয়।" রসবালা খুশি হল। মুখে বলল, "কতো মানসি আছে তোক দেকিবার।" তারপর জল খেয়ে গ্লাসে হাত ডুবিয়ে একটু জল নিয়ে মুখের বাইরেটা আলগোছে মুছে নিয়ে বলল, "ভাটিবেলা বাড়িৎ নইস, আর এক ঠোলা ত্যাল বসে দিম এলায়।" এজন্যই বসমতীর রসবালাকে খুব ভালো লাগে। নিজে থেকেই এটা সেটা করে দেবার জন্য ব্যস্ত। কয়জনে পরের জন্য এত করে দেয়? বসমতী জানে রসবালা বিকেলে ঠিক আসবে ওর কাছে মাথায় আর একটু তেল বসিয়ে দিতে।
------------------------------------------------------------
শব্দ পরিচিতি - ধুলা - কলার গাছ পুড়িয়ে তৈরী ছাই যা দিয়ে ক্ষারের কাজ করে। শিন্ডা - পাটকাঠি। মোরা - ঘাটের মড়া ধরণের শব্দ, ব্যবহারও একই। বোনু বা বইনা - জামাইবাবু। বেইন্নায় - খুব। খোরাটাৎ - খোরা বা খুরি হল বাটি, খোরাটাৎ অর্থ বাটিটায়। ভাটিবেলা - বিকেলবেলা। ঠোলা - হাতের তালুতে যতটা তেল আঁটে, রূপক অর্থেই বেশি ব্যবহৃত হয়।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴