নানারঙের গানগুলি/২
শৌভিক কুন্ডা
^^^^^^^^^^^^^^^^^
তারপর
থেকে বর্ষাই কাল হয়ে ওঠে! আকাশ মানেই যেন প্রিয় তিস্তার ঘোলাটে উচ্ছ্বাস
স্থিরচিত্রে। সমাজ সংসার মিছে সব, মিছে এ জীবনের কলরব...... আদিগন্ত একটি
কালোমেঘচাপাপড়া মাঠ পেরিয়ে হাঁটছি আমি। কোনো মতে অবশেষে প্রান্ত খুঁজে
পাওয়া সে মাঠের কোণটিতে একটি কুটির। তার দাওয়ায় বসে আছে যে, মেঘের 'পরে মেঘ
জমা আঁধারে যার আঁচল উদাসীন উড়ছে ঝোড়ো বাতাসে, আমার চোখে চোখ মিশতেই
যেন গেয়ে উঠবে,
"কাজের দিনে নানা কাজে
থাকি নানান লোকের মাঝে
আজ আমি যে বসে আছি
তোমারই
আশ্বাসে......"! সে ছবিও কখন জলে ভিজে, রোদে পুড়ে ঝাপসা হয়ে ওঠে। তবে তার
জায়গা নিতে পারে পাতায় পাতায় বিন্দু বিন্দু ঝরা জল! আমি শুনতে পাই বুকের
ভেতর গুমরে ওঠা অলীক একটি স্বর,
" তোমারো সে উদাসীনতা
সত্য কিনা, জানি না,
জানি না।"
কেবল
এইটুকু জানতে পারি, কেউ বুঝি ঘাসে ঘাসে তার চঞ্চল চরণ ফেলে এসেছিলো।
এসেছিলো, একই সাথে আসে যে নি, সে কথাও জানিয়ে গেছে। আমি তাকিয়ে থাকি বাড়ির
পেছনচত্বরে গার্হস্থ্য গাছ গাছালির দলবদ্ধতাকে শ্যামল বনান্তভূমির ছলোছল
ধরে নিয়ে। তখন সদ্য মাধ্যমিক দেবো। রবি ঠাকুর আমায় ঘাড় ধরে ডেঁপো করে
দিয়েছেন।
মনে আরও আসে
তখনও মানে বুঝতে না-পারা বাড়ির বাইরের বারান্দাটির কিছু গান। কখনো আমার
প্রয়াত মামীমা বৃষ্টিভেজা কামিনী গাছদুটোর দিকে বন্ধ চোখ আর চিবুকের
আঁচিলটি রেখে দিয়ে,
"আজি ঝরোঝরো মুখর
বাদলদিনে......"
কখনো তাঁরই ছাত্রী, পরবর্তীতে অধ্যাপিকা, সুলেখিকা প্রতিভা সরকার, আমার ডাকে ঝিকিদিদি,
"পাগলা হাওয়ার বাদলদিনে
পাগল আমার মন মেতে ওঠে"...... আমি পৌঁছে যেতে থাকি ভিজে চুপচুপ, অকারণ, চেনাশোনার কোন বাইরে, যেখানে পথ হারিয়ে যায়।
এই সময় দিয়ে আমার অবগাহন হয় একটি স্বর্গীয় কন্ঠস্বরে। যিনি একবার গেয়েছিলেন,
" ক্যারে হ্যারায় আমারে
গাইবার দিলো না,
আমি গাইতাম পারলাম না
হেই কথাডা ত
ব্যাবাগের আসে জানা
জাইন্যা হুইন্যাও কেউ কুনো
রাও কাড়ে না........"
হ্যাঁ,
আমার পরিচয় ঘটে ব্রাত্যজনের রুদ্ধসংগীতের সাথে। আমার একলা জাগা রাতে
ভাঙাচোরা ক্যাসেট রেকর্ডার থেকে তাঁর অলীক কন্ঠস্বর শোনাতে থাকে,
"বেজে ওঠে পঞ্চমে স্বর
কেঁপে ওঠে বন্ধ এ ঘর
বাহির হতেভদুয়ারে কর
কেউ তো হানে না!"
আমি ডুবে যেতে থাকি কোন সকালের অপেক্ষায়, কাউকে না জানিয়ে যে সকাল আমারই জন্য বয়ে নিয়ে আসবে একটি ডাক।
আবার সেই তিনিই, দেবব্রত বিশ্বাস, কখনো আমার হয়ে কনফেশনে থাকেন,
"এই দীনতা ক্ষমা ক'র, প্রভু
পিছনপানে তাকাই যদি কভু
দিনের তাপে রৌদ্রজ্বালায়
শুকায় মালা পূজার থালায়
সেই ম্লানতা ক্ষমা ক'র....!"
প্রভু
তাঁকে ক্ষমা করবেন, জানি। আমি পারি নি। এই ঈশ্বরকন্ঠের কাছে যাওয়ার কয়েক
মুহুর্তের সুযোগ নিয়ে অটোগ্রাফের খাতা বাড়িয়ে দিয়েছিলাম সুদূরের পিয়াসী
হয়ে, আর তিনি মুচকি হেসে আমার খাতায় লিখে দিলেন, "দম মারো দম!" অনন্য
কিশোরগঞ্জীয় প্রকরণে সে অনুষ্ঠানের শ্রোতাদের জিজ্ঞেস করেছিলেন, "কি? রাত
তো অনেক হইলো, আরও শুনবাইন?" এক মায়াকন্ঠ গায়ক নিজের পরিচারকের পরিচয়
জানালেন 'হতকুৎসিত' নামে! নিজেই ব্যাখ্যা করলেন, "আসলে হইসে কি, হগগলেই না
জানে, যে আমি কুৎসিত। আড়ালে কইয়াও বেড়ায়। তা মালিক হইয়া অর থিক্যা তো
কিসুডা উপরে থাকবার চাই, হের লাইগ্যা আমিই অর নাম দিসি 'হতকুৎসিত'!
গল্পটুকু সেরেই শুরু করলেন,
" সুনীল সাগরের
শ্যামল কিনারে
দেখেছি পথে যেতে
তুলনাহীনারে, তুলনাহীনারে.....!