দাঁড়াবার জায়গা/পর্ব-দুই
সমর দেব
^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^
সময়টা
১৯৭১ সাল। পাড়ার সন্তান সংঘের মাঠে বাংলা ‘দ’ এর আকারে বেশ কয়েকটি গর্ত
খোঁড়া হয়েছে। সে গর্তের গভীরতা, যতদূর মনে পড়ছে, ফুট দুয়েক হবে। মাঠে
চারটে ক্যাম্বিসের তাঁবু। তখন ক্যাম্বিসের সঙ্গে পরিচয় সেভাবে গড়ে ওঠেনি।
ফলে, সেই তাঁবু ছিল আমাদের কাছে স্রেফ মোটা কাপড়ে তৈরি ঘর। মাঝামাঝি
জায়গায় দুপ্রান্তে দুটো লোহার খুঁটি আর সেই দুটো খুঁটির মাথায় একটা সোজা
লোহার পাইপ লাগানো। সেখান থেকে দুপাশে সমান ভাবে নামিয়ে দেওয়া হয়েছে মোটা
কাপড়। কাপড়ের প্রান্তগুলো আবার মাটির কাছাকাছি ছোট ছোট খুঁটিতে দড়ি দিয়ে
বাঁধা। অন্য দুদিকে ত্রিভূজাকৃতির জায়গায় পর্দার মতো নেমে এসেছে কাপড়।
তাতে ভেতরটা খানিকটা আড়ালে চলে গেছে। আমরা ছোটরা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সব
দেখছি। ভেতরে দুটো খাট। এরকম গোটা তিনেক তাঁবু। আর, এসবের মধ্যমণি জঙ্গলা
পোশাকের দীর্ঘদেহী সশস্ত্র কয়েকজন। তাদের মোটা গোঁফ খুব নজর কাড়া। আমরা
এসব দেখলেও কেউ বাধা দিচ্ছে না। বেশ মজা লাগছে। জীবনে সেই প্রথম তাঁবুর
সঙ্গে পরিচয়। কেমন ছবির মতো লাগছিল। তাঁবুর ভেতরে খাটিয়া পাতায় বেশ কয়েকজন
গুঁফো, ষণ্ডা মার্কা লোক বসে বসে গুলতানি করে। তাঁবুর বাইরে অন্য কয়েকজনের
সঙ্গে পাড়ার দু-একজন দাদা গোছের যুবক হেসে হেসে কথা বলছে। গুঁফোদের পরনে
অন্যরকম পোশাক, পরে জেনেছি সেটা সামরিক পোশাক। তাদের পায়ে ভারী জুতো। জুতোর
তলাটা এবড়ো খেবড়ো। খুব পুরু সোল। হাঁটলে তাদের পায়ের চাপে ভারী একটা
শব্দ হয়। লোকগুলো অনেক লম্বা, মজবুত শরীর। দেখলেই বোঝা যায় প্রবল শক্তিমান
তারা। তাঁবুর ভেতরে উঁকি দিয়ে দেখেছি ‘বন্দুক’! একদিন দেখি, একটা বেঞ্চিতে
দু-পা দুদিকে ছড়িয়ে একজন গুঁফো একটা ছোট কাঠের টুকরোর ওপরে সবজে রঙের কিছু
শুকিয়ে যাওয়া লতাপাতা যেন, একটা চাকু দিয়ে কুচি কুচি করে কাটছে। তার কাটা
আর শেষ হয় না, কেটেই চলেছে, ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কুচিয়ে কুচিয়ে। তাঁবুর ভেতর থেকে
আরেক গুঁফো বেরিয়ে এসে বেঞ্চের পাশে দাঁড়ালো। যে কাটছিলো সে কিছু একটা
বলতেই দাঁড়ানো লোকটা পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করল। বসে থাকা লোকটি
হাত বাড়িয়ে দিতেই সে প্যাকেট খুলে একটা সিগারেট বের করে তার হাতে দিল।
পাশে দাঁড়িয়ে দেখছি আমরা ছোট কয়েকজন। অবাক হবার পালা আমাদের। যে সিগারেটটা
বসে থাকার হতে দিলো দাঁড়ানো লোকটা, সেই সিগারেটের ভেতরটা ফাঁকা! আমরা
জুলজুলে চোখে দেখছি। লোকটা দারুণ কায়দায় ফাঁকা সিগারেটটা ডান হাতের দু
আঙুলে ধরে বাঁ-হাতের চেটো থেকে সবজে গুঁড়োগুলো একটু একটু করে ঢোকাতে থাকল।
এই প্রক্রিয়ায় সে মাঝে মাঝেই সিগারেটটা খাড়া করে ধরে বেঞ্চিতে ঠুকছিল।
আবার খানিকটা সবজে গুঁড়ো ঠুসে দিচ্ছিল সেই সিগারেটের ভেতরে। ফের ঠোকাঠুকি।
পরে, সেটা ঠোঁটে চেপে ধরে পকেট থেকে লাইটার বের করে আগুন ধরায় সে। তার
জোরালো টানে সিগারেটটা দপ করে জ্বলে ওঠে। তারপর সে ধোঁয়া ছাড়ে। দেখতে খুব
ভালো লাগছিলো পুরো ব্যাপারটা। একটা চমৎকার গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছিল। আমরা সকলে
বুক ভরে শ্বাস টানছিলাম। আমার পাশ থেকে উত্তম বলে, গাঁজা! এতক্ষণ গুঁফোরা
আমাদের বোধহয় দেখেইনি। এবারে আমাদের দিকে তাকিয়ে বসে থাকা লোকটা কর্কশ
ভঙ্গিতে বলে, ভাগো হিয়াসে। আমরা ভয় পেয়ে সরে আসি। কিন্তু চলে যাই না। সে
বলে, সালা, ভাগো, নেহি তো গোল্লি মার দুঙ্গা। আমরা দৌড়ে পালাই।
কয়েক
বছর পর শুনেছি, ওরা এসএসবি। তখন আকাশে মুহূর্মুহূ প্লেন উড়ে চলে। দিনের
বেলা যত প্লেন ওড়ে রাতের দিকে তার চেয়ে অনেক বেশি। সেসব প্লেনের গতি এতই
তীব্র যে, শব্দ অনুসরণ করে চোখ মেলে দেখতেই সেটা আকাশের অন্য প্রান্তে
মিলিয়ে যায়। আমরা শুনেছি পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের যুদ্ধ বেঁধেছে। এসব
প্লেন পাকিস্তানে বোমা ফেলতে যাচ্ছে। যুদ্ধটা ঠিক কী আমাদের কল্পনার বাইরে।
তবে, জব্বর মারামারি ধরনের কিছু একটা, সেটা বুঝি। যুদ্ধে যে বন্দুক থেকে
গুলি ছোঁড়া হয় সেটা জেনে গেছি ততদিনে। বড়রা সকাল সন্ধ্যায় যুদ্ধ নিয়ে
আলোচনা করে। অনেকেই ইন্দিরা গান্ধীর নামে স্লোগান দেয়। স্কুলে যাবার সময়
রাস্তার পাশের দোকানঘরের ঝাঁপে লেখা দেখেছি, এশিয়ার মুক্তিসূর্য ইন্দিরা
গান্ধী অমর রহে। পচার দোকানের কাছে একটা বন্ধ ঘরের দেওয়ালে দেখেছি, গাই
বাছুর চিহ্নে ভোট দিন। স্কুলের বেড়াতেও দেখেছি কাগজ সাঁটা আছে। সেটাকে
পোস্টার বলে। তাতে গাই-বাছুরের ছবি এবং সেখানে লেখা, গাই বাছুর চিহ্নে ভোট
দিন। এসব পোস্টার রীতিমতো রঙিন। দেখতে খুব সুন্দর। বিশেষ করে গরুর সঙ্গে
তার শাবকের নরম, কোমল চেহারাটা খুব ভালো লেগেছে। কোনো কোনো দেওয়ালে আলকাতরা
দিয়ে লেখা কথাও দেখেছি। একটি দেওয়ালে লেখা ছিল, এক কানু পড়েছে ধরা, হাজার
কানু দিয়েছে সাড়া। আরকটি জায়গায় লেখা ছিল, কালু বিশু মতি তর কংগ্রেসের
তিন চোর। তার নীচে ছোট করে লেখা ছিল সিপিআই (এম)। এসব লেখা আমরা সদ্য
সাক্ষর ছেলেমেয়েরা উচ্চস্বরে পড়তাম। আসলে পড়তে ভালো লাগত। যে কোনো
দোকানের সাইনবোর্ড বা বাড়িতে আসা ঠোঙার কাগজেও যেসব লেখা থাকতো সবই আমাদের
পড়ার ছিল। যেমন সন্তান সংঘের দুর্গা পুজোর আয়োজনে বিশাল একটা ব্যানার
রুপোলি রঙে লেখা হতো। সেটা আমাদের বাড়িতেই একটি কাঠের চৌকির ওপরে লাল শালু
কাপড় পেতে তার ওপরে লিখত মেজদা। তার ছবি আঁকার চমৎকার হাত ছিল। ব্যানারের
বাঁদিকে থাকতো দুর্গার মুখাবয়ব। সেই সঙ্গে লেখা থাকতো, সার্ব্বজনীন
দুর্গোৎসব। সন্তান সংঘ, কালীঘাট রোড। যেখানে যা কিছু লেখা নজরে পড়তো আমরা
সেসব উচ্চারণ করে করে পড়তাম। একটা ক্যালেন্ডার ছিল ঘরের বেড়ায়। মনে আছে,
মা ভবানী বিড়ি ফ্যাক্টরী। আমরা প্রায়ই উল্টো করে পড়তাম সেটা-‘রীক্টোফ্যা
ড়িবি নীবাভ মা’। এ ছিলো আমাদের খুব প্রিয় একটা খেলা। আরেকটা খেলা ছিল, কোড
ব্যবহারের মতো। ধরা যাক আমরা বলব কলম। তো আমরা বলতাম- ক কড়ি কদম কড়ি
মধ্যে করি ক, ক কড়ি কদম কড়ি মধ্যে করি ল, ক কড়ি কদম কড়ি মধ্যে করি
ম...। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস ছিলো, এই কোড ল্যাঙ্গুয়েজ অন্য কেউ বুঝবে না।
ফলে, খেলা সম্পর্কিত অনেক গোপন কথা পরস্পরকে এভাবে বলে ফেলতাম। বলাই
বাহুল্য কারো কিছু বুঝতে বাকি থাকতো না।
এদিকে,
দিনরাত আকাশে প্লেনের তুমুল ছোটাছুটি। সেসব প্লেন যুদ্ধ করতে যায়। রাতের
আকাশে দেখা যায়, দপ দপ করতে করতে তুমুল কান ফাটানো আওয়াজে লাল আলো এপ্রান্ত
থেকে ওপ্রান্তে ছুটে যাচ্ছে। তাদের গতি এত তীব্র যে মুহূর্তেই চোখের আড়াল
হয়ে যায়। দিনের বেলায় দেখেছি, অনেক ছুটন্ত প্লেনের পেছনে ঘন সাদা ধোঁয়ার
দীর্ঘ লেজ ক্রমশ লম্বা হতে হতে একসময় হারিয়ে যায়। আর তাদের কী ভীষণ আওয়াজ।
কানে তালা লেগে যাওয়ার অবস্থা। এখন স্কুলে যাবার সময় কত নতুন নতুন মানুষ
দেখি রাস্তার পাশে পাশে। আমাদের থেকেও ভয়ানক গরিব তারা। রাস্তার পাশে
কাঠকুটো জ্বেলে কালো কুচকুচে মাটির হাড়িতে তারা ভাত ফোটায়। আমাদের বয়সী
ছাড়াও আরও ছোট ছোট বাচ্চা মায়েদের কোলে কোলে। কতদিন তাদের পেট পুরে খাওয়া
হয়নি! বাচ্চা বুড়ো সকলের হাড় জিরজিরে চেহারা। কতদিন তাদের চুলে তেল জল
পড়েনি। চুলে চিরুনি পড়েনি বোধহয় কোনোদিন। ভয়ানক রুক্ষ চেহারা তাদের। একটু
দূরে দাঁড়িয়ে প্রায়ই তাদের দেখতাম প্রবল কৌতূহলে। তারা স্নানটান করতো না।
সেটা বুঝতাম তাদের নোংরা শরীর আর মলিন পোশাকে। তাছাড়া, একটা বোঁটকা গন্ধে
চারপাশ ম’ ম’ করতে। ভাবতাম, রাতে তারা কোথায় থাকে? একদিন ঘরে এসে মাকে
জিজ্ঞেস করি। মা চুপ করে থাকে, কোনো জবাব দেয় না। রাস্তায়, একেবারে খোলা
আকাশের নীচে, গাছের তলায় মানুষ থাকতে পারে সেটা ছিল কল্পনার অতীত। কারণ,
খোড়াঘর হলেও আমাদের মাথার ওপরে ছাদ ছিলো। রাস্তার পাশের এই মানুষগুলোর
আস্তানা গাছের তলা। রোজ দেখতাম, মাটির কালোকুলো হাড়িতে তারা ভাত রাঁধে।
হাড়ির ঢাকনা থাকতো না। আগুনের তাপে টগবগ করে ফুটতো ভাত। হাড়ির গা বেয়ে
নেমে আসতো ভাতের ফ্যান। গাছের শুকনো ডালপালা কুড়িয়ে এনে তারা ইট পেতে আগুন
জ্বালায়। ভাত ফুটিয়ে মাড় সহ নুন মাখিয়ে তারা খায়। তাদের অনেকেরই থালা
নেই। কলাগাছের পাতা কেটে এনে তাতেই তারা ফ্যানভাত খায়। খাওয়ার সময় লক্ষ্য
করেছি তাদের চোখ দুটো যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসছে। মায়ের কোলের শিশুরা করুণ
জুলজুলে চোখে ভাতের দিকে তাকিয়ে থাকে। এসব দৃশ্য দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে প্রায়ই
দেখি। প্রবল শীতের দুপুরে মানুষগুলো প্রায় আদুল গায়ে আগুন ঘিরে বসে থাকে।
তখন আমাদের অবস্থাও তাদের চেয়ে খুব কিছু ভালো ছিল না বলেই তাদের এই জীবন
তেমন আলোড়িত করেনি। স্কুলে যাবার সময় বা ঘরে ফেরার পথে প্রায়ই দেখতাম কোনো
পরিবারের সবচেয়ে বয়স্ক মানুষটি বা সবচেয়ে ছোট বাচ্চাটা মরে গেছে। মৃতদেহ
ঘিরে ছোট্ট জটলা। দু-একজন হয়ত কাঁদছে। বাচ্চা মারা গেলে তাকে বুকে জড়িয়ে
মায়ের বুকফাটা আর্তনাদ আকাশবাতাস মুখরিত করে তুলতো। এত বেশি মৃত্যু দেখতে
দেখতে আমাদেরও কেমন গা সওয়া হয়ে গিয়েছিল।
তারা
দীর্ঘকাল তাঁবুতেই ছিল। অনেক পরে এই পরিবারগুলো একটু একটু করে কোথায় যেন
হারিয়ে গিয়েছিলো। তখন প্রতিদিন সকালে দলে দলে ভিখিরি আসত বাড়িতে। তারা এসে
করুণ মুখে ‘ভিক্ষা দেবেন গো’, বলে উঠোনের প্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকতো। চরম
দারিদ্রের মধ্যও সবাইকেই এক মুঠো করে চাল দেওয়া হত। ওইটুকুতেই সন্তুষ্ট হয়ে
তারা চলে যেত। কেউ কেউ কাজ চাইত, যে-কোনো একটা কাজ। এমনভাবে প্রতিদিন আসতে
আসতে কেউ কেউ খুব পরিচিত হয়ে গিয়েছিল। এদের কারও কারও সঙ্গে যেন একটা
আত্মীয়তার সম্পর্ক হয়ে গিয়েছিল আমাদের। তারা অনেকেই নানা গল্প করত। সেসব
গল্পে অনেক সময় উঠে আসত তাদের স্বভূমির কথা। থাকত, গ্রামের পর গ্রাম উজাড়
হয়ে যাবার কথা। অনেকের কাহিনি ছিল ভয়ানক মর্মান্তিক। কেউ কেউ পরিবার-পরিজন
হারিয়ে এই বিশাল আকাশের নীচে এসে দাঁড়িয়েছিল একলা হয়ে।