তিস্তাবাথান-২
তিস্তা বাথান
পর্ব: দুই
নীলাঞ্জন মিস্ত্রী
"""""""""""""""""""""""
‘তিস্তা আর তিস্তা নাই। তিস্তাটা ডাঙ্গা হয়ে গেল। মহিষের জমিনগুলা দখল হয়ে গেল।' বড় আক্ষেপ করে বলছিল সানিয়াদা । সুযোগ বুঝে প্রশ্ন করলাম- ‘আচ্ছা সানিয়াদা কামরূপ, গোয়ালপাড়া থেকে যে মৈষাল বন্ধুরা তিস্তার ভাটি থেকে উজানে আসতেন তাঁদের সাথে তোমাদের দেখা হত?' ‘আরে ওরা তো বার্ণিশ করতে আসত।' আমার মুখের কথা টেনে নিয়ে সাথে সাথেই উত্তর দেয় আমির হোসেন। ‘কেমন ছিল সম্পর্ক তোমাদের?' একটু থেমে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস। তারপর বললেন- ‘তখনকার দিন ? কি আর বলি ? দিনে-রাতে আমাদের আমোদ-প্রমোদ চলত। চলত গান-বাজনা। মহিষের কোনো খাঁটুনী ছিল না। খাটুনি ছিল না আমাদেরও। মৈষালের তখন এলাহি ব্যাপার। আনন্দ-ফূর্তিতে ভরে থাকত সব বাথান।'
আমিরদা’র মুখে ‘বার্ণিশ’ শব্দটি শুনে আমি চমকে গিয়েছিলাম। বার্ণিশ নামে তো একটা বিখ্যাত ঘাট ছিল; বর্তমান কিংসাহেব ঘাটের ঠিক উল্টো পাশেই। বার্নস সাহেব ও মোলার সাহেবের ঘর ছিল বর্তমান জলপাইগুড়ি শহরের সার্কিট হাউসের ওখানেই। তাঁরা পাটের ব্যবসা করতেন। কিংসাহেবের ঘাট থেকে নৌকা নিয়ে যেতেন ওপারের ঘাটটিতে। জমিও ছিল তাদের ওপাশে। যতদূর জানি এই বার্নস সাহেবের নাম অনুসারেই ঘাটের নাম হয়েছিল বার্নস সাহেবের ঘাট। এই ঘাট ঘেষেই ছিল ডুয়ার্সের সব থেকে বড় বাজার। ঘাট ও বাজার তখন ধ্বনিত হত ব্যস্ততার কোলাহলে। তখন ময়নাগুড়ির নাম জামেরকোট হিসেবে পরিচিত ছিল। জামেরকোট ছিল পশ্চিম ডুয়ার্সের সদর দপ্তর। ঘাটের নামের সাথে মিলিয়ে বাজারের নামটিও হয় বার্ণিশ বাজার। লোকমুখে বার্নস প্রচারিত হতে হতেই ঘষে-মেজে হয়ে যায় বার্ণিশ।
মাথায় কিন্তু ঘুরপাক খাচ্ছিল একটাই প্রশ্ন, তবে কি এই ঘাটের নামকরণের অন্য কোনো ইতিহাস আছে ? কথাবার্তা শুরু করলাম বর্তমান মৈষাল বন্ধুদের সাথে। তাদের সাথে সুদীর্ঘ আলোচনার পর বুঝতে পারি বাণিজ্য শব্দটিকেই তারা বার্ণিশ বলে উল্লেখ করছেন। আরো প্রশ্ন জাগে- তবে কিসের এই বাণিজ্য ? পঁয়ত্রিশ-চল্লিশ বছর আগেও নিম্ন আসাম, গোয়ালপাড়া এমনকি বিহার থেকেও মৈষাল বন্ধুরা আসতেন ভাটি থেকে উজানের তিস্তার কিছু নির্দিষ্ট চরে। তখন বাথান বাঁধার জন্য উপযুক্ত ছিল গোলাবাড়ির চর, খটখটির চর (বর্তমান নাম টাকিমারির চর), পাথরঘাটার চর, দুধিয়ার চর, বুড়ির চর, রংধামালীর চর, বোদাগঞ্জের চর, বাউয়ালির চর , ঠাকুরের চর, মরিচবাড়ির চর, বোয়ালমারির চর আর বাকালির চর । এই চরগুলি মুখরিত হত হাজার মহিষের গলার ‘ঘণ্টির বাজন’-এ। বাথান নিয়ে এর আগে কিছু গল্প হয়েছে, কিছু কাহিনী রয়েছে , হয়েছে উপন্যাসও। স্থানীয় রাজবংশী জনসমাজের ভাওয়াইয়া সংগীতের যে বিখ্যাত মৈষালী সুর তার সৃষ্টির মূলে তো এই মৈষাল বন্ধুরাই। বর্তমানে মৈষালী গান রয়েছে, বাথান নিয়ে আবেগ রয়েছে, মৈষাল বন্ধুদের প্রতি দরদ রয়েছে। কিন্তু সবকিছু থাকা সত্বেও কফিনের শেষ পেরেকের মতো মাত্র পাঁচটি বাথান ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
কত আবেগ-অনুভূতির জোয়ার এসে ক্ষণিকের জন্য ভিজিয়ে দিয়ে যায় আমাদের। তিস্তাবক্ষের পুবালি বাতাস, দক্ষিণা হাওয়া, উত্তরা বাতাস আর পশ্চিমা হাওয়া আজও বয়ে চলে তিস্তার ওপর দিয়ে। চৈত্র-বৈশাখের দূনের আতঙ্কে আজও প্রহর গোনে মৈষাল বন্ধুরা। হঠাৎ আসা দুন (কালবৈশাখী) প্রতিবছর উড়িয়ে নিয়ে যায় বাথানের কুঁড়ে ঘরগুলিকে। গুঁড়িয়ে দেয় মৈষাল বন্ধুদের মনোবল। কিন্তু প্রকৃতির অপার ভালোবাসায় আর তিস্তাবুড়ির মায়ায় আবার পলি-বালি-জলের মাঝ থেকে উঠে আসেন মৈষালেরা। ঘর বাঁধেন, স্বপ্ন দেখেন, আশায় বুক বাঁধেন সুদিনের। আমাদের মননে তাদের অস্তিত্বের জানান দেন। কিন্তু আর মাত্র বছর পাঁচেক। তারপর অকাল ‘দুন’ এসে খুঁজেও পাবে না তার খেলার এই প্রিয় সাথীদের। দূনের দাপটে হয়তো তিস্তার বালি উড়বে, পরিযায়ী পাখিরাও উড়ে যাবে কিন্তু বাথানের চাল আর উড়ে গিয়ে ভাসবে না তিস্তা মায়ের বুকের ওপর।
গল্প তার লক্ষ্য ছাড়িয়ে এলোমেলো হতে শুরু করেছে। তবে এখানে লক্ষ্যে থাকাটাই সমীচীন হবে। যে বাণিজ্যের কথা সানিয়া-আমির ভাইরা বলছিলেন, মনে রাখতে হবে সেই বাণিজ্য কিন্তু মহিষের দুধের নয়। বাণিজ্য হতো মহিষের দুধ থেকে তৈরি দই ও ঘি-এর । তখন এক কিলোগ্রাম আসল ঘি’র দাম ছিল কুড়ি থেকে পঁচিশ টাকা; আর এক পাতিল (এক থেকে দেড় কিলো) দই’র দাম ছিল ষাট থেকে পঁচাত্তর পয়সা। বর্ষা শেষ থেকে বর্ষা শুরু প্রায় ছয় মাসের জন্য তিস্তার উজানের চরে চরে মৈষালেরা বাথান বাঁধতেন। বাথানের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ও রসদ কিন্তু আসত নদীপথে নৌকা করে। তখন তিস্তা ছিল ‘সদানীর’। সারাবছর নদীতে জল থাকার কারণেই এমন নামকরণ। তবে মৈষালেরা আসতেন মহিষের দল নিয়ে পায়ে হেঁটে। এক একটি বাথানে ন্যূনতম তিনজন মৈষাল থাকা ছিল আবশ্যক। কোনো কোনো বাথানে চারজন করে মৈষাল থাকতেন। দু’জন অথবা তিনজন মহিষের দেখভালের জন্য আর একজন বাথানের রান্নাবান্না ও মহিষ শাবকদের (পরু) যত্নের জন্য। শুধুমাত্র মৈষাল বন্ধু নয়, প্রতিটি বাথানে একজন করে বাথান মালিক অথবা তার প্রতিনিধিও থাকতেন। তারা থাকতেন মূলত দুধ ঘি’র ব্যবসা দেখভালের জন্য। ছয় মাসের রসদ একসাথে নৌকাপথে বয়ে নিয়ে আসা অসম্ভব ব্যাপার ছিল । তবে তাতেও সমস্যা কিছু হত না। চর পেরিয়ে ডাঙ্গায় অথবা ‘কাইমে’ উঠলেই মিলে যেত অনেক বাজার। যে বাজারগুলি আজও রয়েছে সেই একই নামে। চ্যাংড়াবান্ধা বাজার, পুঁটিমারি বাজার, হেলাপাকরি বাজার, রাজারহাট বাজার, ঢোলডোরডাঙ্গা বাজার, বাকালির বাজার, পদমতির বাজার, মণ্ডলঘাট বাজার, কাদোবাড়ির বাজার, কচুয়া-বোয়ালমারীর বাজার, দিনবাজার, কালিয়াগঞ্জের বাজার, রংধামালির বাজার, বোদাগঞ্জের বাজার। এসব বাজার থেকেই বাথান মালিক ও মৈষাল বন্ধুরা তাঁদের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সংগ্রহ করে নিয়ে যেতেন বাথানে। তখন তিস্তাবক্ষ থেকে নৌকা ছাড়া এসব বাজারে পৌঁছানো সম্ভবপর হত না। দই-ঘিএর ব্যবসা হত নদীপথেই।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴