ঢোলসানাই-২/সুবীর সরকার
ঢোলসানাই
পর্ব : দুই
সুবীর সরকার
÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷
৪।
জনমভরের দেখা দিয়ে যাপন কেটে যায় মানুষের।
ছোট ছোট দেখাগুলি জীবনের গল্প কুড়িয়ে আনে।
নদীর চরে ফাল্গুনের বিবাগী বাতাস।
বাওকুমটা বাতাসে গানের সুর ঘুরে ঘুরে মরে_
"আজি ছাড়িয়া না যাইস
বাচ্চা মৈশাল রে"
তখন ফজলু মিঞার বাড়ির খোলানে ধান ঝাড়তে থাকা মেয়ে বউরা দেশ গ্রামের গল্পে ডুবে যেতে থাকে।
এইভাবে একটা পরিসর তৈরি হতে থাকে।
রসুনখেতের পাশে নদী রেখে গেছে সরু জলরেখা।
দৌড়ে পালানোর আগে চকিত তাকিয়ে দেখে সন্ধের শেয়ালেরা।
জীবন বয়ে চলে প্রবাহিত জলস্রোতের মতো।
বুধবারের হাট থেকে সুবলসখা যখন বাড়ি ফিরতে থাকে তখন কেমন এক মায়া তাকে উন্মনা করে দেয়। সে কয়েক দণ্ড দাঁড়ায়।গতজনমের স্মৃতি তাকে তাড়িত করতে থাকলে সে তার স্মৃতিতে ফিরিয়ে আনতে থাকে গোয়ালপাড়ার কাঠি ঢোল।
সিতানন্দের সারিন্দা।
এভাবে জন্ম জন্ম জীবন কেটে যায়।
জোড়া মহিষের দেশে, সুপুরি গাছের পৃথিবীতে এভাবেই মায়া আর ম্যাজিক নিয়ে বয়ে যায় মস্ত মানবজীবন।
হাসি কান্না দুঃখ পুলক বাদ্য বাজনা ভরা জীবন কেবল ছড়িয়ে দেয় গান_
"কচু পাতের পানি যেমন রে
ও জীবন টলমল টলমল করে"
৫।
আমার একটা গঞ্জহাটের পৃথিবী আছে।আমার পৃথিবী জুড়ে অগণন সুপুরিগাছের সারি।আমার পৃথিবীতে ভরা নদীর ওপর ঝুঁকে পড়া মায়াবৃক্ষ। ভূমিলগ্ন আবহমানের সব চিরায়ত সোনার বরণ মানুষজন।আমার একটা নাচঘেরা বাজনাঘেরা অপরূপ লোকপুরাণের দেশ রয়েছে। সেখানে 'ভইসা গাড়ির' নীচে কালিমাখা লণ্ঠন দোলে। আর ধু ধু পাথারবাড়ির দিকে গান ছড়িয়ে পড়ে-
'ও হো রে, কুচবিহারত হামার বাড়ি
ঘাটাত দেখঙ ওরে ভইসা গাড়ি'
কিংবা-
'ও কি হায়রে হায়
আজি মনটায় মোর
পিঠা খাবার চায়'
মানুষ যেভাবে গল্পের পাকে পাকে জড়িয়ে যায়, জীবন যেভাবে গল্পের পাকে পাকে জড়িয়ে যায়, আমিও সেভাবে এই লোকমানুষের দিনদুনিয়ায় ডুবে গেছি।উত্তরের এই লোকজীবনের মায়া ও জাদু আমার চরম প্রাপ্তি।চরমতম শক্তি।
আমি যখনই অস্থির হয়ে পড়ি, আমি যখনই একা হয়ে যাই তখন এই লোকায়ত ভুবন, উত্তরের লোকগান আমাকে ফিরিয়ে আনে জীবনে। ফিরিয়ে আনে লড়াইয়ে। ফিরিয়ে আনে চূড়ান্ত স্বপ্নের ভেতর।
আমি আবার নুতন হয়ে উঠতে থাকি।আর গৌরীপুরের হাট থেকে মাধবডাঙ্গার গঞ্জ থেকে ঝাকুয়ার টারি থেকে দেখি ভেসে আসে হাতিমাহুতের অন্তহীন যত গান-
'ও মোর গণেশ হাতির মাহুত রে
ও মোর মাকনা হাতির মাহুত রে
মোক ছাড়িয়া কেমনে যাইবেন
তোমরা হস্তীর শিকারে'...
৬।
উত্তরের মাঠে মাঠে তখন বাওকুমটা বাতাস। কাদো পন্থে অনন্ত গাড়িয়াল।পাথার নদী গাছপালা জড়িয়ে দুঃখ সুখের বাদ্য বাজনার এক জীবন বয়ে চলে।আবহমান মানুষের মায়ায় ছায়ায় সেই ব্যপ্ত জীবনকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখা বারবার।
আমি মানুষ দেখি। জন্ম আর মরণের পাকে পাকে জড়িয়ে পড়া মানুষ বরাবরই আমার আগ্রহের বিষয়। এই যে বেঁচে থাকা,বেঁচে থাকতে থাকতে এক তীব্র জীবন মায়ার মতন তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়।
শালকুমারের হাটের দিকে হাঁটতে হাঁটতে কিংবা বসুনিয়াদের টাড়ি থেকে শেষ বিকেলে খট্টিমারির চরের দিকে চলে যেতে যেতে জালালউদ্দিন বয়াতি তখন রংপুরের গান গেয়ে উঠতে থাকে_
"তোমরা যাইবেন অংপুর মৈশাল ও
ও মৈশাল কিনিয়া আনিবেন কি"
এইভাবে সাজিয়ে রাখা জীবনের ওপর হাত রাখি আমরা।গঞ্জ হাট নদী গাছপালার ভেতর বেঁচে থাকতে থাকতে মানুষের জীবন শেষ পর্যন্ত ধরাছোঁয়ার এক গহিন খেলার মতো!
আমি জীবন জড়িয়ে বাঁচি।
আমি আমার লেখা পড়ার জীবন নিয়ে বেশ আছি।
বেঁচে বর্তে আছি।
এত এত দেখা, এত এত বর্ণময় ভূমিলগ্ন সোনার বরণ মানুষের যাপনের রংগুলো আঁকড়ে ধরে আমি বাদ্য বাজনা আর মেলা মহোৎসবের এক অলীক জীবনের কুহক কুয়াশায় বারংবার ডুবে মরি।
এই নিমজ্জন থেকে নতুন ভাবে জীবনে ফিরি আমি। তখন লালজি রাজার হাতিক্যাম্প থেকে ভেসে আসে সমবেত গানের সুর -
"আল্লাহ আল্লাহ বলো রে ভাই
হায় আল্লা রসূল"
আমি নিজের ব্যাক্তিগত থেকে বেরিয়ে আসতে থাকি। আর পড়ে থাকে চোখের জল,বেলাশেষের রোদ আর আব্বাসউদ্দীনের গান।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴