গঞ্জহাটের আখ্যান/২
গঞ্জহাটের আখ্যান/২
সুবীর সরকার
--------------------------
৬.
তখন রেডিওতে বাজতে থাকে - ‘হাতি মার্কা কেরাসিন’ এর গান। দুপুর জুড়ে ভেজা বাতাসের ঘের। বা ঘোর।গান গড়িয়ে নামে। গান ঘুর ঘুর ঘুর উড়ানী কইতরের মতন দিক ও দিগরের দিকে চলে যায়।আমি দেখি মিঠুদির আঙুলে হেমন্ত বিকেলের রোদ।কাঠের বারান্দা জুড়ে দেশকালের গল্প বেশ জমে ওঠে।ক্রমে জীবনের রকমটা বদলে বদলে যায়।মাঠ পাথারে খুব জমে ওঠে অতিশয় ছোট পাখিদের মজলিস।
আমি দেখি, নদী থেকে সরে আসা নদীকেই! নদী জুড়ে গান। গানের ভেতর হাই তুলছে গাঙের ঢেউ।সোমবারের হাট ঘুরে আবার অপেক্ষা আরো একটা বুধবারের হাটের। আর বাঁশবাড়ি লাইনের অগ্নু ওরাও একা একা চলে যেতে থাকে জার্মান রাভার ঘরবসতির দিকে। অগ্নু বারবার মুখ মোছে ঘাড়ের গামছায়। এদিকে শিকারি লাইন ধরে হাঁটতে থাকে চিলাপাতার হাতিরা।
নদীভাঙ্গনের গল্পের পাশে আমরা সাজিয়ে রাখি ধামসা মাদল আর ঢোল দোতরা। গানের ঘরানা আর বাহিরানায় লিপ্ত হতে হতে দূরাগত হয়ে ওঠা আমাদের!
আমাদের সকলের জীবনেই কিন্তু একটা জাতীয় সড়ক থাকে! থাকে ভাঙা ঘুমের এলিজি।
৭.
বাতাস লিলুয়া হলে একাব্বরের মহিষের বাথান জুড়ে জন্ম ও জন্মান্তরের গান বাজে। বাজতেই থাকে।মহিষের গলার ‘ঘান্টির ডাঙ’ চুরমার করে দিতে থাকে যাবতীয় পরিসর। বাথান বাথান ঘুরে একাব্বর তার জমানো গল্পগুলি ছুঁড়ে দিতে থাকে, বিছিয়ে দিতে থাকে, কিংবা গুছিয়ে দিতে থাকে। আর কিভাবে বুঝি আমরা শুনে ফেলি বাথান থেকে হারিয়ে যাওয়া সেই শ্বেতবর্ণ ঘোড়াটির কথা। এতসব ঘটে, কিন্তু কোন যুক্তিপরম্পরা থাকে না!
থাকে অনন্তের এক তীব্র হাহাকার। হাহাকারের খুব নিচ দিয়ে বইতে থাকে বাউকুমটা বাতাস। আমরা রেডিও খুলি আর ঝাপিয়ে নামে গান - ’বাউকুমটা বাতাস যেমন ঘুরিয়া ঘুরিয়া পড়ে’।
জীবন আসলে তো লুকিয়ে থাকে অদ্ভূত এক বহুস্বরের ভেতর।আমরা তা বুঝি না।
আর উদাসীন বিকেলে দেখে ফেলি হেমন্তের নদীর পাড়ে পাড়ে খুব খীপ্র হয়ে ওঠা শেয়ালদের। এত এত দেখা থাকে মানুষের জীবনে!আর দেখা গুলিকে আঁঠায় আটকে আটকে একধরনের দেখাসমগ্র নির্মিত হয়ে ওঠে। আর লুপ্ত পৃথিবীর খুব অন্দর থেকে হাসতে হাসতে এগিয়ে আসেন আমাদের সোনাদি।আমাদের মিঠুদি। আমাদের বুড়িদি, নতুন নতুন গল্প নিয়ে, বাল্যকালের ম্যাজিক নিয়ে।
আর চরাচরে বাজতে থাকে হাতি মার্কা কেরাসিনের গান।
৮.
'ধওলি রে মোর মাই
সুন্দরী মোর মাই
দোনো জনে যুক্তি করি চল পলেয়া যাই'
গঙ্গাধরের পাড়ে পাড়ে চরে চরে সেই কত কত যুগ ধরে গোয়ালপাড়ার মেয়েরা এই গান তাদের কণ্ঠে তুলে নিয়ে কি এক হাহাকারের সুরে সুরে তাদের শরীরে নাচ জাগাতে জাগাতে জীবনের আবহমান এক আর্তি ছড়িয়ে দেয়।
দূরের মাঠ প্রান্তরে তখন বিকেলশেষের মায়া। মায়ায় মায়ায় বুঝি আস্ত এক জীবনের ঘোর।গানের দেশে নাচের দেশে হেমন্তের হিমের দেশে গানভরা এক জীবনের গল্প প্রখরতার উত্তাপ ছড়াতে থাকলে আবার ঘুরে ঘুরে গান নেমে আসে মরণ ও জন্মের এই দুনিয়াদারির ভিতর -
'নাল টিয়া নাল টিয়া রে তোর ভাসা নলের আগালে/বিনা বাতাসে ভাসা ঢোলে রে'
৯.
এইসব চলতে থাকে।ভরা হাটের ভেতর থেকে এক পেশীবহুল দীর্ঘ শরীর নিয়ে বেরিয়ে আসে নাজিমুদ্দিন ওস্তাদ।
সে তার জীবনের গল্পের দিকে একপর্বে আমাদেরকে প্রবল টেনে আনবে।আমরা নতুন করে শুনে নেব চর দখলের লড়াই আর হাতিক্যাম্পের গল্প।বিষ্ময় নিয়ে শুনতে থাকব কিভাবে গান আর বাজনা আর নাচ দিয়ে বুনো হাতিদের পোষ মানানো হত কুমার সাহেবের জঙ্গলবাড়ির সেই ক্যাম্পে।
নাজিমুদ্দিন তখন গাবুর বয়সের চেংড়া। আব্বার সাথে রূপসীর জমিদারের লেঠেল বাহিনীর হুকাতামাকের দায়িত্ব তার উপর। পাশাপাশি মুন্সি চাচার কাছে লাঠি চালনার তালিম নিচ্ছে।আর ফাঁক পেলেই গঙ্গাধরের কাছারে কাছারে জল ভরতে আসা সুন্দরী কইন্যাদের সাথে রঙ্গরস করা আর খোসা নাচের মত গেয়েও ওঠা_
‘আন্ধারে ধান্দারে নাচবা নাকি দুলাভাই
দুলা তুই হ্যাজাকের বায়না দে'
এইসব দেখে জরিনা আবেদা হাসিনা ফুলেশ্বরীদের কি খলখল হেসে ওঠা। তারাও কখনো গানে গানে প্রতি উত্তর দিত-
'ফাতেরা রে ফাতেরা
বগরিবাড়ির ফাতেরা
এত্তি ক্যানে আসিলু
চেংরির পাছে নাগিলু'
কি অন্যেরকম জীবন ছিল তখন।আলো ছিল। স্বপ্নের ভেতর খেলে বেড়াতো হলখল মরিচের খেত। আর সেই নদীপাড়ের জীবন থেকেই তো সে তার জীবনে টেনে এনেছিল জরিনাকে।
হায়রে জীবন!সে বারবার তাকে ডুবিয়েই মারলো এই ধানপাটকামলাকিষান আর ভরা সব হাটপাঁচালির ভিতর!
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴