আমি এক যাযাবর-২/শৌভিক কুন্ডা
আমি এক যাযাবর
২য় পর্ব
শৌভিক কুন্ডা
আজকের এই যোগাযোগবিস্ফোরনের মাটিতে দাঁড়িয়ে আমার এই অভিজ্ঞতাটিকে ঠিক বোঝা যাবে না হয়ত। এ স্বাদের ভাগ পেতে গেলে পেছোতে হবে, ধর বছর চল্লিশ! সদ্য কলেজ পেরিয়ে ইউনিভার্সিটিতে পা আমার। সেলফোন আসে নি। ল্যান্ডলাইন আরো অনেকেরই মতো, আমাদের বাড়িতেও ছিল না। দাদার চিঠি এল। বাবলু'দা, দাদার ভায়রাভাই, তখন রাঁচীতে। দাদা-বৌদি যাচ্ছে, আমি চাইলে গিয়ে জুটতে পারি। আমার তো ওই হাতছানিটিরই অপেক্ষা কেবল, রুকস্যাক গোছানোই প্রায়! দাদারা যেদিন পৌঁছবে, হিসেব কষে তার পরদিন আমি CCL office-এ গিয়ে কড়া নাড়লেই হল!
সেই কড়ারেই জলপাইগুড়ি থেকে কলকাতা হয়ে জামশেদপুর। এ পর্যন্ত গল্প নেই কোনও। প্রথম ধাক্কা জামশেদপুরে, ট্রেন থেকে নেমেই। হরতাল! নানারকম সুলুকসন্ধান শেষে এক কাগজ অফিসের গাড়িতে ঠাঁই নিলাম। সে জীপ আমাকে রাঁচীতে CCL অফিসেই নামিয়ে দিল। বর্ণনা মত দোতলায় উঠে গেলাম গটগট করে। তারপর-ই বজ্রপাত। বাবলু'দা, Mr.P.C.Mukherji, "has been transferred to Daakra, and he has shifted there only the day before!" And Daakra,
সেটি কোথায়? জলের চেয়েও তরল জবাব মিলল, রাঁচী বাসস্ট্যান্ডেই ডাকরার বাস পেয়ে যাব, রা-বাছরা-খালারি, ব্যস্, তারপর-ই ডাকরা! চেপে বসা তো গেল, কিন্তু বাস ছাড়তে ছাড়তে বিকেল গড়াল। নিয়ম করে সন্ধ্যেও এল একসময়। তার-ও বয়স হল। মাঝে মাঝে আমার দৌড় যতটা, সেমত হিন্দিতে শুধোই, কন্ডাকটর তাপউত্তাপহীন, গাড়ির গতির মতই। কেবলই বলে, "আগে হ্যায়!" অন্য যাত্রায় হয়ত প্রাকৃতিক শোভাটোভা দেখার চেষ্টা করতাম, কিন্তু তখন মনের যা অবস্থা, পাখি বলতে হাঁড়িচাচা, আর ফুল বলতে ঘেঁটু ছাড়া আর কিছু মাথায় আসত না নিশ্চিত! এমনি করে কতক্ষন, ভুলে গেছি, হঠাৎ কন্ডাক্টরের অমৃতহুংকার, "ডাকরা, ডাকরা, উতারিয়ে।" আমি তখন লালমোহন বাবু, "উৎরোবো?" প্রায় ধাক্কা দিয়েই আমাকে নামিয়ে বাস ছুটল। হ্যাঁ, ছুটলই, এতক্ষনে হয়ত তাদেরও বাড়ি ফেরার তাড়া জেগেছে!
বাসের টেইল লাইট মিলিয়ে যাওয়ার পর সম্বিৎ ফিরল। কালো, কঠিন অন্ধকার ছাড়া আর কিছু অনুভব করতে পারছি না! কোনদিকে যাবো, জানি না। একটা কুপিও জ্বলছে না কোথাও। যা আছে কপালে ভেবে নিয়ে রওনা হলাম বাস যে মুখে গ্যাছে, সে পথেই। অনেকটা হাঁটার পর সে দিক থেকে একখানা আলোর বিন্দু। বড় হতে হতে আমাকে পেরিয়ে দাঁড়াল। বাইক। হিন্দি ইংরেজি মিলিয়ে কথা যা হল,তা এইরকম: আমি বস্তুত দাঁড়িয়ে আছি কয়লামাটিতে। খুব কাছের জনবসতিটিও "at least 5 km away!" Emergency হেতু ভদ্রলোক "cite-এ" যাচ্ছেন, নতুবা হয়ত.......
তখনও যেখান দিয়ে হাঁটছি সেটাও খাদান এলাকাই! কালই হয়তো এখানে ব্লাস্ট করানো হতে পারে, তখন আর এ রাস্তাটি 'রাস্তা' হয়ে থাকবে না। তবে, ভদ্রলোক একটা আশার বাণীও শোনালেন। কিলোমিটার দেড়েকের মধ্যে একটা বাংলো পড়বে পথে! এতরাতে তার কেয়ারটেকার কে যদি খুঁজে পাই এবং যদি রাজি করাতে পারি তবে রাত কাটানোর উপায় একটা হতেও পারে! অতএব আবার গুপী চললো ব..হু..দূ..র! যখন ভাবছি, চুলোয় যাক বাংলো, এবার রাস্তা(!)তেই বসে পড়ি, তখনই আবার আলো দূর থেকে, এবার এক জোড়া, হাত তুলে দাঁড়িয়ে পড়লাম। জীপ।আমাকে ছাড়ালো, তারপর-ই একসাথে কর্কশ
ব্রেক আর দাদামনির হারানিধি ফিরে পাওয়ার চীৎকার, "রাজু!"
হ্যাঁ, বাবলু'দা, Mr. P. C. Mukherjee, Quality Control Offier, CCL, Dakraa, তিনিও অফিস থেকে জরুরী ডাক পেয়ে খনিতে ছুটছেন। ছোট ভায়রা, সেদিনই এসে পৌঁছনো আমার দাদাটিকে, গাড়িতে তুলে নিয়েছেন রাতের কোলিয়ারি দেখাবেন ব'লে। ভাগ্যিস! কারণ, তার আগে বাবলু'দার সাথে আমার কখনো সাক্ষাৎ হয়নি!
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴