অন্তহীন আকাশের নীচে/২
অন্তহীন আকাশের নীচে
পর্ব ২
দেবপ্রিয়া সরকার
-হ্যাঁ হ্যাঁ ঠিক। এই জায়গাটাতেই দাঁড়া। এখান থেকে ভিউটা সুন্দর আসছে। অল সেট? চল, শুরু কর।
ভিক্টরের বলা কথাগুলো শুনে গলায় ঝোলানো স্কার্ফটা ঠিক করে নিল স্বয়ংদ্যুতি। তারপর থামস্ আপ দেখালো ভিক্টরকে। ভিক্টর তার ক্লাসমেট এবং খুব ভাল বন্ধু। ক্লাসের অন্য ছেলেমেয়েরা বলে ভিক্টর নাকি স্বয়ংদ্যুতিকে পাগলের মতো ভালবাসে। কিন্তু স্বয়ংদ্যুতির কখনও তাকে দেখে তেমন কোনও অনুভূতি হয় না। তারা একে অপরের সঙ্গে প্রচুর সময় কাটায়। আজ পর্যন্ত ভিক্টরের ব্যবহারে সন্দেহজনক কিছু পায়নি।
আরও একবার ভেসে এল ভিক্টরের গলার শব্দ, ক্যামেরা অন করছি। অ্যাকশন!
-হ্যালো বন্ধুরা! ওয়েল কাম ব্যাক টু মাই চ্যানেল! আপনারা দেখছেন স্বয়ংদ্যুতিস্ ড্রিম ওয়ার্ল্ড। তো লাস্ট দু’দিন ধরে আমরা আছি ওড়িশায়। এর আগে আপনাদের পুরীর সী বিচ্ এবং জগন্নাথ মন্দির দেখিয়েছি আর আজ আমরা চলে এসেছি কোনার্কের সান টেম্পলে। এই দেখুন আমাদের পেছনে কোনার্কের বিখ্যাত সূর্য মন্দির। থার্টিনথ্ সেঞ্চুরিতে কলিঙ্গরাজ প্রথম নরসিংহদেব এই মন্দির তৈরি করেছিলেন। সম্পূর্ণ রথের আদলে বানানো পাথরের এই মন্দিরের গায়ে দুর্দান্ত কিছু কারুকাজ করা রয়েছে যা আমাদের ভারতবর্ষের প্রাচীন শিল্প-কলার নিদর্শন। যদিও সময়ের আঘাতে আজ কোনার্ক মন্দিরের বিপন্ন অবস্থা তবুও যতটুকু বেঁচে আছে সেটাই ভারতের কালচারাল হেরিটেজকে রিপ্রেজেন্ট করার জন্য যথেষ্ট...
টানা কুড়ি মিনিট ধরে বিরামহীন সূর্য মন্দিরের মাহাত্ম্য বর্ণনা করে অবশেষে থামল স্বয়ংদ্যুতি। ভিক্টর ওর হাতে মোবাইলটা ফেরত দিয়ে বলল, কীভাবে যে এতো বকবক করতে পারিস কে জানে!
স্বয়ংদ্যুতি একটা ফিচেল হাসি হেসে বলল, আমাদের ইংলিশ টিচার গুপ্তাস্যার কী বলতেন জানিস? “মানি, মানি, মানি ইজ সুইটার দ্যন হানি...ফর হোয়াট সোলজারস্ আর ডায়িং অ্যান্ড পোয়েটস্ আর ক্রাইং...” টাকার জন্যে মানুষ কতকিছু করে, আমি নাহয় একটু বকবকই করলাম।
-কত টাকা পাস তুই এসব ভ্লগ ট্লগ বানিয়ে?
-এখনও তেমন কিছু পাইনি। একবার ওয়ান মিলিয়ন সাবস্ক্রাইবার হতে দে তাহলেই গোল্ডেন প্লে বাটন হাতে পেয়ে যাব, তখন দেখিস। আপাতত আর কিছু সাবস্ক্রাইবার জোগাড় করতে পারলেই কব্জা করব সিলভার বাটনটা।
-গোল্ডেন বাটন, সিলভার বাটন! এগুলো আবার কী জিনিস?
-এই বাটনগুলো হল একেকটা ক্রিয়েটার অ্যাওয়ার্ড। সাবস্ক্রাইবার, ভিউয়ারদের সংখ্যা বিচার করে ইউটিউব তার চ্যানেল হোল্ডারদের দেয়। যার যত দর্শক তার তত দামী পুরস্কার। অ্যাজ সিম্পল অ্যাজ দ্যাট!
-পারিসও তোরা! ইউটিউব ফিউটিউবের চক্করে না পড়ে পড়াশুনাটা ঠিক মতো কর, কাজে দেবে।
-হয়েছে হয়েছে, আর জ্ঞান দিতে হবে না। এসব তোর মতো পড়াকু ছাত্রদের মাথায় ঢুকবে না। এখন তাড়াতাড়ি পা চালা অনির্বাণ স্যার আমাদের বাসে দেখতে না পেলে চেঁচামেচি জুড়ে দেবেন।
বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস ডিপার্টমেন্টের ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে প্রফেসর অনির্বাণ সিনহা এবং প্রফেসর রেবতী মোহান্তি এসেছেন উড়িষ্যায় শিক্ষামূলক ভ্রমণে। সাকুল্যে তিরিশ জনের টিম। ভুবনেশ্বরকে সেন্টার করে তারা ঘুরে দেখছে প্রাচীন কলিঙ্গ স্থাপত্যের বিভিন্ন নিদর্শন। কোনার্ক ছেড়ে তাদের বাস রওনা দিয়েছে ধবলগিরির পথে।
এই রাজ্যের ছেলেমেয়েরা ছাড়াও অন্য প্রদেশের বহু ছাত্রছাত্রী পড়তে আসে শান্তিনিকেতনে। স্বয়ংদ্যুতি দেব তাদেরই একজন। লখনউয়ের প্রবাসী বাঙালি, যদিও তার বাবা-মা জন্মসূত্রে উত্তরবঙ্গের মানুষ। তার বাবা রাধাকান্ত দেবের কর্মজীবন কেটেছে লখনউয়ে। ছোটবেলায় বেশ কয়েকবার বাবা-মায়ের সঙ্গে স্বয়ংদ্যুতি দেশেরবাড়ি গিয়েছে। কিন্তু অনেকবছর আর যাওয়া হয় না। রাধাকান্তর আত্মীয়-স্বজন তেমন কেউই আর দেশের বাড়িতে নেই। তাই চাকরি থেকে অবসর নিয়ে তিনি পাকাপাকিভাবে লখনউতেই থাকবেন বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। স্বয়ংদ্যুতির মায়ের পিতৃকুলও একই জায়গার বাসিন্দা। তাঁর বয়স ষাট পেরিয়েছে। আজকাল আর জার্নি টার্নি বিশেষ করতে চান না।
স্বয়ংদ্যুতিরা দুই বোন। দিদি অরুন্ধতী পেশায় সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। এক সহকর্মীকে বিয়ে করে নিউইয়র্কে সেটেল্ড। স্বয়ংদ্যুতির সামনেও অনেক ব্যতিক্রমী কেরিয়ার গড়ার সুযোগ ছিল। কিন্তু ছোটবেলা থেকে লখনউ জুড়ে ছড়িয়ে থাকা অজস্র পুরনো অট্টালিকা, বড়া ইমামবাড়া, ছোটা ইমামবাড়া, জামা মসজিদ, মোতি মহল, কাইজারবাগ প্যালেসের মতো স্থাপত্য চোখের সামনে দেখে দেখে তার ঘাড়ে ভর করেছে ইতিহাসের ভূত। তাই ভর্তি হয়েছে শান্তিনিকেতনের হিস্ট্রি ডিপার্টমেন্টে। স্বয়ংদ্যূতির বাবা-মাও তেমন আপত্তি করেননি। একমেয়ে বিদেশবাসী আর একজন কাছেপিঠে থাকুক সেটাই চেয়েছিলেন রাধাকান্তরা।
আপাতত পড়াশোনার পাশাপাশি স্বয়ংদ্যুতির মন মোজেছে ইউটিউবে। দামী ক্যামেরা আর মোবাইল ফোন নিয়ে সে দিনরাত খুঁজে বেড়াচ্ছে কনটেন্ট। বানাচ্ছে একের পর এক ভিডিও। নিত্যনতুন ভ্লগ আপলোড করে চমকে দিচ্ছে ভিউয়ারদের। তবু হাজার চেষ্টা করেও কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছতে পারছে না স্বয়ংদ্যুতি। তার পরিচিত কয়েকজন ইউটিউবারের সাবস্ক্রাইবার সংখ্যা হু হু করে বাড়ছে। তুলনায় অনেকটাই পিছিয়ে পড়ছে স্বয়ংদ্যুতি। সেই নিয়ে কিছুটা চাপে আছে সে। ভিক্টর আন্দাজ করেছে তার টেনশনটা।
ধবলগিরিতে ভিডিও শ্যুট শেষ করে স্বয়ংদ্যুতি রেলিং ধরে একলা দাঁড়িয়ে ছিল। নীচে ছবির মতো শহর। পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে দয়া নদী। ভিক্টর পাশে এসে দাঁড়াতেই অস্ফুটে স্বয়ংদ্যুতি বলল, ভাবা যায়? রক্তের নদী! হাজার হাজার মানুষ মারা গিয়েছিলেন কলিঙ্গ যুদ্ধে আর তাঁদের রক্তধারা বহন করেছিল এই অভিশপ্ত নদী!
ভিক্টর মাথা ঝাঁকিয়ে উত্তর দিল, হুম এতটাই ভয়াবহ ছিল যুদ্ধশেষের দৃশ্য যে মন পরিবর্তন হয়ে গিয়েছিল নৃশংস সম্রাট অশোকেরও। চণ্ডাশোক শেষে কিনা ধর্মাশোকে পরিণত হয়েছিলেন!
-হিউম্যান মাইন্ড ইজ সো আনপ্রেডিক্টেবল, তাই না?
নীচু স্বরে বলল স্বয়ংদ্যুতি। তার হাতে আলতো করে আঙুল ছুঁয়ে ভিক্টর বলে উঠল, সে তো বটেই। এই যেমন তুই। কখনও লাফাচ্ছিস ঝাঁপাচ্ছিস আবার একটু পরেই কেমন ফিলসফারের মতো মুখ করে জ্ঞানের কথা আওড়াচ্ছিস। তুইও কি কম আনপ্রেডিক্টেবল?
-আমরা সকলেই বোধ হয় কম বেশি তাই। যাক গে, ভিডিওটা মন্দ হয়নি, কী বলিস? দেখি আপলোড করার পর কতজন দেখে।
ভিক্টর একটা তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল, ধুর ধুর! উড়িষ্যার এই জায়গাগুলো খুব পপুলার। বিশেষ করে বাংলার মানুষের তো গুলে খাওয়া। পুরীকে বাঙালিরা বলে সেকেন্ড হোম। তাই এই কনটেন্টের ওপর বাংলায় ভ্লগ বানিয়ে খুব একটা লাভ হবে বলে আমার মনে হয় না। তার থেকে নতুন টপিক খোঁজ। একদম আনকোরা। যেটা আগে সেভাবে কেউ দেখায়নি। এমন কোনও গল্প তোর ভ্লগের মাধ্যমে শোনা যার ভেতর রোম্যান্স, ড্রামা, সাসপেন্স, ইমোশনের মতো সব মশলাই মজুত থাকবে। এমন কিছু যা আম-বাঙালির সেন্টিমেন্টকে সুড়সুড়ি দেবে আবার ইন্টারেস্টিঙও হবে। বুঝলি?
-তাতো বুঝলাম। কিন্তু এমন কনটেন্ট পাবো কোথায়? আমি তো ইতিহাসের ওপর বেস করেই ভ্লগ বানানোর চেষ্টা করি। কিন্তু মুশকিলটা হল সবকিছুই যেন বড় বেশি রিপিটেড মনে হয়। ইতিহাস তো একটাই। একে তো আর আমি নতুনভাবে লিখতে পারব না?
স্বয়ংদ্যুতির কথা শুনে খানিক মাথা চুলকাল ভিক্টর। বলল, সেটা ঠিক, ইতিহাসের ঘটনা নির্দিষ্ট। ইচ্ছে করলেই এর মধ্যে নতুন কিছু যোগ করা সম্ভব নয়। কিন্তু ভেবে দেখ সাধারণ মানুষ ইতিহাস বলতে ঠিক ততটাই জানে যতটা তাদের জানান হয়। এর বাইরেও তো আমাদের দেশে এমন অনেক কাহিনি আছে যেগুলোকে বইয়ের পাতায় তুলে আনা হয়নি। কত ছোটখাটো রাজ্য বা রাজারাজরার গল্প আছে যেগুলো হয়তো সেখানকার স্থানীয় মানুষ ছাড়া বৃহত্তর সমাজের সেভাবে জানাই নেই। এই যেমন ধর বিষ্ণুপুরের মল্লরাজাদের ইতিহাস কতটুকু জেনেছি আমরা? বা মনে কর প্রাগজ্যোতিষপুরের কাহিনি। ক’পাতা পড়েছি এই বিষয়ে? এরকম অজস্র কাহিনি একটু খুঁজলেই পাওয়া যাবে। নিজেকে ভিড়ের থেকে আলাদা করতে হলে খাটুনি তো করতেই হবে ম্যাডাম। মানুষকে রোজ রোজ নতুন বোতলে একই মদ ভরে গেলালে সে তোমার চাতুরী একদিন না একদিন ঠিক ধরে ফেলবে।
-কথাটা মন্দ বলিসনি। ভাবতে হবে এ’নিয়ে।
-ভাবো বাঙালি ভাবো, ভাবা প্র্যাকটিস করো।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴