স্মৃতি দিয়ে ঘেরা/পর্ব : ১৯
রণজিৎ কুমার মিত্র
^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^
উত্তরবঙ্গ
বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে স্মৃতিকথাতে মাঝে মাঝে নিজের কথাও এসে যাচ্ছে। তবে
এটুকু হলফ করে বলতে পারি, বিশ্ববিদ্যালয় দেখা পরিচিত নানা বর্গের
মানুষজনদের নিরপেক্ষভাবে দেখবার চেষ্টা করেছি। “স্মৃতি দিয়ে ঘেরা”তে যাদের
কথা বলেছি তাদের সম্পর্কে আমার নিজের ধারনার চেয়েও, আরও অনেকের ধারণাকে
বেশি গুরুত্ব দিয়েছি। নিজের ধারণার সাথে মিল-অমিলগুলোকে খুঁজে বের করবার
চেষ্টা করেছি। সবসময় যে মিলেছে এমন নয়। একই মানুষ বিভিন্ন জনের স্মৃতিকথায়
বিভিন্নভাবে দেখা দিতেই পারেন। চেষ্টা করেছি এই বহু কৌণিক দেখার সাথে নিজের
দেখাকে মেলাতে। প্রত্যক্দর্শীদের সাক্ষ্য ও অভিমতকে সবসময় গুরুত্ব
দিয়েছি। “স্মৃতি দিয়ে ঘেরা”তে এমন স্বীকারোক্তি অত্যন্ত জরুরি বলে আমার
মনে হয়েছে। এই স্বীকারোক্তি কতখানি অকপট ও অসঙ্কোচ তা নিয়ে কেউ কেউ প্রশ্ন
তুলতেই পারেন, তবে অনেক সময় এই স্বাভাবিক মত প্রকাশের ক্ষেত্রে নিজস্ব
অভিরুচিও কখনো অন্তরায় হয়ে ওঠে। তাই কোথাও ভুল বোঝার অবকাশ ঘটলে মার্জনা
চেয়ে নিচ্ছি।
ল্যাটি
-ইংরেজিতে “ Phillia” আর “Phobia” দুটো শব্দের অর্থ আলাদা। গত পর্বে ডঃ
দিলীপ কুমার সরকারের সাথে জলপাইগুড়ির সম্পর্ক সূচিত করতে গিয়ে আমার
একান্তই অনবধানতার কারণে ভুল প্রয়োগ ঘটেছিল। প্রকৃত অর্থে হবে
“জলপাইগুড়ি-ফিলিয়া”। ডঃ দিলীপ কুমার সরকার তাঁর একান্ত অনুরাগে ও আন্তরিক
প্রীতিতে জলপাইগুড়ি তথা জলপাইগুড়িবাসিদের সঙ্গে জড়িয়ে আছেন। এর মধ্যে কোন
ফোবিয়া বা আতঙ্ক নেই । “স্মৃতি দিয়ে ঘেরা”র মতন সাধারন আটপৌড়ে লেখাও যিনি
পড়েন তা জেনে এই লেখাকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য যথেষ্ট অনুপ্রাণিত
হয়েছি।
সব স্মৃতিকথাতেই
বোধহয় আতঙ্ক ও অনুরাগের প্রসঙ্গ সমান্তরালে চলে, তবে আমার অভিজ্ঞতায়
অনুরাগের অংশই বেশি। আতঙ্কের স্মৃতিগুলোকে দূরে সরিয়ে রাখতে চেয়েছি।
উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের বিকল্প হিসেবে যে, এই স্মৃতিকথাকে
গ্রহণ করা যাবে না তা আমি শুরু থেকেই বলে আসছি। এসব ব্যাখ্যান কোন ইতিহাস
বা ঘটনা পরম্পরার দাবি করা যাবে না। এক অর্থে আমার কাছে যা পুরনো অতীত
তাকে আবার সজীব নতুন করে দেখার চেষ্টা মাত্র।
বিশ্ববিদ্যালয়ের
উপাচার্য-এর সঙ্গে আমাদের মত সাধারণ শিক্ষাকর্মীদের কোনো যোগসূত্র
থাকে না। তাঁকে সব সময়ই মনে হত রক্তকরবীর রাজার মতো, বিশ্ববিদ্যালয়
একাদেমিক ও এডমিনিস্টেটিভ, প্রশাসনের পিরামিডের সবার শীর্ষে তাঁর
অবস্থান। আমরা একেবারেই বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের সংখ্যা মাত্র, বরং
রেজিস্ট্রারকেই মনে হত আমাদের কাছের মানুষ। বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে
রাজা-মহারাজাদের উত্থান-পতনের মতোই চলতে থাকে উপাচার্যদের প্রবেশ ও
প্রস্থান। তাঁদের স্থিতি নির্দিষ্ট কয়েকটি বৎসরের জন্য। উপাচার্যের তুলনায়
রেজিস্ট্রারের অবস্থিতি অনেক বেশি সময়ের জন্য হয়। উত্তবঙ্গ
বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের মধ্যে থেকেই রেজিস্ট্রার হওয়ার প্রথা শুরু
হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠার সুচনা লগ্ন থেকেই। প্রথম রেজিস্ট্রার
বিমল কুমার বাজপেয়ী ছিলেন রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক। দ্বিতীয়
রেজিস্ট্রার ডঃ তাপস কুমার চট্টোপাধ্যায় ছিলেন রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক,
তৃতীয় ডঃ দিলীপ কুমার সরকার প্রথমে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনের কলেজের
অধ্যাপক, পরে অধ্যক্ষ। এরপরেই বিশ্ববিদ্যালয়ের কন্ট্রোলার অফ এক্সামিনেসন
পদে তার পরেই রেজিস্ট্রার । এই রেজিস্ট্রার পদ থেকেই সম্প্রতি তিনি অবসর
গ্রহণ করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের আধিকারিক সমিতির সভাপতি যখন নির্বাচিত হলাম
তখন মাঝে মধ্যে তৎকালিন উপাচার্য ও রেজিস্ট্রারের মুখোমুখি হয়েছি, সবসময় যে
আধিকারিক সমিতির কাজে তা নয়, নিজের বিভাগের প্রয়োজনে ও সৌজন্যমূলক
সাক্ষাৎকারও হয়েছে ।
বিশ্ববিদ্যালয়ের
ছাত্র হিসেবে যখন প্রবেশ করেছিলাম তখন উপাচার্য ছিলেন অধ্যাপক অম্লান
দত্ত, রেজিস্ট্রার ছিলেন বিমল কুমার বাজপেয়ী। অনেক পরে যখন গ্রন্থাগারের
আধিকারিক হলাম, তখন উপাচার্য অধ্যাপক পীযূষ কান্তি সাহা ও রেজিস্ট্রার তাপস
কুমার চট্টোপাধ্যায়। আমার এক রসিক অধ্যাপক বন্ধু বলতেন, উত্তরবঙ্গ
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা বাগডোগরা এয়ারপোর্টে নেমে, বিশ্ববিদ্যালয়ের
গাড়ি চেপে এক নম্বর গেট দিয়ে যখন তার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রদত্ত বাসভবনে
আসেন, তার কিছু কাল পরেই স্থানীয় আবহাওয়ার গুনে তিনি আর ভাইস চ্যান্সেলর
থাকেন না, ভাইসরয় হয়ে যান! আমার বহুদর্শী অধ্যাপক বন্ধুটির উপাচার্য
পীযূষবাবুকে দেখেই এমন ধারণা হয়েছিল। উপাচার্য পীযূষবাবুর আমলেই বহু ঘটনা ও
দুর্ঘটনা হয়েছিল যা কিছুতেই ভোলবার নয়। অনেক বিষবৃক্ষের চারাও রোপিত
হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে। আমার নিজস্ব একটি অভিজ্ঞতার কথা তো কিছুতেই ভোলবার
নয়। উপাচার্য পীযূষ কান্তি সাহা সদ্য অবসর নিয়েছেন, উপাচার্য হয়ে এসেছেন
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অরুনাভ বসু মজুমদার, সেবারের সমাবর্তনে
অধ্যাপক উপাচার্য বসু মজুমদার, সদ্য প্রাক্তন হয়ে যাওয়া উপাচার্য পীযূষ
কান্তি সাহাকে সমাবর্তনে অতিথি হিসেবে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। উনি এলেন,
সমাবর্তনও ভালমন্দে কাটল, পরে গেস্ট-হাউসে নৈশাহারের পরে দুই উপাচার্য
বচসায় জড়িয়ে পড়ে পারস্পরিক আক্রমনে যে দৃশ্যের অবতারনা করলেন তাতে মনে
হয়েছিল ধরণী দ্বিধা হও। শুধু মনে হয়েছিল এভাবে উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় ও
তার উপাচার্যের পদটিকে কলঙ্কিত করবার ইতিহাসে তাঁরা নাম তুলে ফেললেন।
পশ্চিমবঙ্গের
শিক্ষাবিস্তারের গণতন্ত্রে স্বাধীনতার পর থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্তৃত্ব
করেছে দলতন্ত্র, শাসকতন্ত্র, যখন যে দলের সরকার তাদের পছন্দেই কলকাতা থেকে
উপাচার্যরা এসেছেন উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে, এই প্রান্তিক
বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজস্ব পরিচালন সমিতির প্রার্থনা বা আবেদন নিবেদন কলকাতার
শীর্ষ নীতিপ্রনেতা বা নীতি-আয়োগদের কাছে পাত্তা পায়নি। উপাচার্য অরুনাভ বসু
মজুমদারকে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে ও তৎকালিন শাসকদলের স্থানীয় ও
রাজ্য কমিটির মধ্যে কোন সমন্বয় ছিল না। বিরোধ যখন তুঙ্গে সেই সময় দেখলাম
কিভাবে আধিকারিক সমিতিকে দুর্বল করার জন্য দুভাগ করে দিতে উদ্যত হল একটি
স্বার্থান্বেষী চক্র। আমার অবস্থা তখন ঢাল নেই তরোয়াল নেই নিধিরাম সর্দারের
মতো। আধিকারিক সমিতির নির্বাচনে যখন দু-পক্ষের ভোট সমান সমান, তখন যে কোনো
পক্ষকে জিতিয়ে দেবার জন্য একটি ভোটই নির্বাচনের ফলকে চূড়ান্ত করতে
পারত। কিন্তু সেই ভয়ঙ্কর দিনটিতে আমার নিজস্ব ভোটটি আমি প্রয়োগ করিনি। আমি
চেয়েছিলাম আধিকারিক সমিতির নিরপেক্ষতা বজায় থাকুক। পরবর্তীকালে শুধু
আধিকারিক সমিতির নয়, কর্মচারী সমিতিকেও ভেঙে টুকরো টুকরো হতে দেখেছি, আর
দেখেছি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের টিকটিকিরা কিভাবে ডাইনোসোরাস হয়ে গেল।
নর্থ
বেঙ্গল ইউনিভার্সিটি অ্যাক্ট ১৯৮১ অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়য়ের অধ্যাপক,
আধিকারিক, গ্রন্থাগারিক, শিক্ষাকর্মী, ছাত্র, গবেষক, রেজিস্ট্রার,
গ্রাজুয়েট ইত্যাদি নিয়ে গঠিত হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয় পরিবার। প্রতিটি
গোষ্ঠীর জন্য স্বতন্ত্র নির্বাচকমণ্ডলী গঠন করে প্রতিনিধি নির্বাচনের
ব্যাবস্থা ছিল। নামেই নির্বাচিত বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালন সমিতি, সেখানেও
লড়াই বেঁধে যেতে দেখেছি নিজেদের মধ্যে। কুৎসিত পোস্টারে ছেয়ে যেতে দেখেছি
প্রশাসনিক ভবনের দেয়াল, দৈনিক সংবাদপত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের খবর প্রকাশিত হত
প্রথম পাতায়। সকলেরই প্রশ্ন - তুমি কোন দলে? আমি নীরবে নিরপেক্ষভাবে
শুধুই বলতে চেয়েছিলাম, আমি শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের দলে। এই
বিশ্ববিদ্যালয়য়ের সূচনালগ্নে প্রতিশ্রুতি ছিল – উত্তরবঙ্গে আধুনিকতা ও
প্রগতি ভাবনার একটা ভিত তৈরি করে দেবে এই বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু সেই সময়ে
বিশ্ববিদ্যালয়ের যুযুধান দুই পক্ষ বিশ্ববিদ্যালয়র ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিল
যেভাবে, তার সাথে শিক্ষা বা গবেষণার কোন সম্পর্ক ছিল না।
পশ্চিমবঙ্গে
শিক্ষাকেন্দ্রকে রাজনীতির স্বার্থে ব্যাবহার করা একটা পুরনো ট্র্যাডিশন,
কিন্তু সেই সময় রাজনীতির স্বার্থের অনুগত হয়ে দুই স্বার্থান্বেষী
গোষ্ঠীর বিশ্ববিদ্যালয়ের খবরদারি নিয়ে দাঙ্গা-হাঙ্গামা এমন পর্যায়ে
গিয়েছিল যে তাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসমাজও বলতে লজ্জা বোধ করতেন তাঁরা এই
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী।
পরাধীন ভারতবর্ষে
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়য়ের ইংরেজ শাসকদের চাপানো সমস্ত অন্যায় বিধিনিষেধের
চাপে পড়ে স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়কে চিৎকার করে বলতে হয়েছিল “ freedom
first, freedom second and freedom forever! “, এই স্বাধীনতার প্রত্যয়
যেখানে সঠিক অর্থে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ই আজ স্বাধীনতার পঁচাত্তর বর্ষেও
প্রতিষ্ঠা হয়নি, সেখানে কলকাতা থেকে কয়েকশো মাইল দূরে প্রান্তিক
উত্তরবঙ্গের এই বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বাধীনতার এই প্রত্যয়–আকাঙ্খা বোধহয়
একান্তই অলীক অবাস্তব মাত্র ।