সোনালি চা বাগিচা /গৌতম চক্রবর্তী
সোনালি চা বাগিচা
গৌতম চক্রবর্তী
^^^^^^^^^^^^
এলেনবাড়ি, বাগরাকোট, ওয়াশাবাড়ি, লিজ রিভার, সোনালি বা শওগাঁও পাশাপাশি। একটার পর একটা বাগান সার্ভে করতে করতে এসে পৌঁছেছি সোনালি টি এস্টেটে। লিজ রিভার থেকে সেনাবাহিনীর ব্যারাক পার হয়ে চলছি তো চলছিই। জনমানবহীন প্রান্তর, দু’দিকে রুখাশুখা সবুজ চা গাছ। দেখলেই বোঝা যায় অযত্নের ছাপ। একটু ভয় ভয়ই লাগছে। কারণ গাড়ির ড্রাইভার আগেই বলেছিল জায়গাটা খুব একটা সুবিধার নয়। সোনালি বাগানের দক্ষিণে তিস্তা নদী। পূব দিক দিয়ে প্রবাহিত ঘিস আর
পশ্চিম দিক দিয়ে লিস নদী। তিস্তা বাদে বাকি দুটি নামেই নদী। বর্ষাকালেই জলস্রোত। বছরের বাকি মাসগুলোতে শুকনো খটখটে। আসলে এই মুহূর্তে সোনালি বাগিচায় সার্ভে করতে এসে ইউরোপীয় রাজকর্মচারী তথা চা-কর বা বণিকদের পাশাপাশি বাঙালিরাও যে শাসক এবং শোষক হিসাবে কম দক্ষ ছিল না সে কথা ভাবতে গিয়েই উপরের প্রসঙ্গের অবতারণা। ইউরোপীয়দের পাশাপাশি দার্জিলিঙ এবং জলপাইগুড়ির চা বাগিচাতে বাঙালিদের একাংশের আগমনের প্রেক্ষিত বর্ণনা প্রসঙ্গে স্বাভাবিকভাবেই বারে বারে ইতিহাসকে ফিরে দেখতেই হয়। ডুয়ার্সে বাঙ্গালী মালিকানাতে চা বাগানের যখন পত্তন শুরু হল তখন জলপাইগুড়ি জেলায় এমন কোন মধ্যবিত্ত বাড়ি খুঁজে পাওয়া খুব মুশকিল ছিল যাদের ঘরে দুই পাঁচটা চা-বাগানের শেয়ার পাওয়া যেত না। এখানে কলকাতা বা মুম্বাইয়ের শেয়ার বাজারের মতো কোনো স্থায়ী প্রতিষ্ঠান ছিল না। তবুও সারা বছর ধরেই এখানকার মানুষের মধ্যে শেয়ার কেনাবেচা চলত। শেয়ার থেকে সাধারণ শেয়ার হোল্ডারদের বিরাট বড় কোন আয় যে হত তা নয়, তবে বাগানের শেয়ার যেন জলপাইগুড়ি জেলার মানুষের কাছে এক ধরনের পরিচয়পত্র হয়ে দাঁড়িয়েছিল। শহরে ছিল অনেক শেয়ার ব্রোকার যাদের উপার্জনের মূল উৎস ছিল এই শেয়ার কেনাবেচা।
আজকের সোনালি বা শওগাঁওকে যদি তুল্যমূল্য আলোচনা না করি তাহলে ক্ষেত্রসমীক্ষার নির্যাস নিছক তথ্য পরিসংখ্যান নির্ভর হয়েই থাকবে যা কাম্য নয়। তাই সোনালী চা বাগিচার ইতিহাস কিন্তু অনেক বড় যা একটি মাত্র পর্বে শেষ করে দিলে ইতিহাস আমাকে ক্ষমা করবে না। তাই বাঙ্গালীর ইতিহাস, বিশেষ করে জলপাইগুড়ির চা-করদের ইতিহাস খুঁজতে গেলে সোনালী বা শওগাঁও এর ইতিহাস জানতেই হবে এবং সেই সমকালকে জানতে হবে। ডুয়ার্সের বীরপাড়া এবং মাদারিহাটের মাঝামাঝি জায়গায় অবস্থিত দ্য গ্রেট গোপালপুর টি কোম্পানি লিমিটেড। জলপাইগুড়ি শহর তথা উত্তরবঙ্গে তিন পুরুষ ধরে চা শিল্পে নিয়োজিত ঘোষ পরিবারের আদি পুরুষ গোপাল চন্দ্র ঘোষ প্রতিষ্ঠিত প্রথম চা বাগানটির নাম গোপালপুর। জলপাইগুড়ি শহরে ওকালতি পড়তে এসে শেষ পর্যন্ত চা শিল্প এবং বাণিজ্যে মনপ্রাণ ঢেলে দিয়ে “গোপালপুর হাউস” প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে কোম্পানির সদর দপ্তর স্থাপিত হলো। শুরু হল বাগিচা শিল্পে জলপাইগুড়ির ঘোষ পরিবারের একচ্ছত্র আধিপত্যের ইতিহাস। সাধারণত বাঙালি চা শিল্পপতি বলতে যাদের বুঝি এরা কিন্তু সেই ধরনের ছিলেন না। এদের কেউ ছিলেন উকিল, কেউ ডাক্তার, খুব কমই ছিলেন ব্যবসায়ী। সাহেবরা ডুয়ার্সে চা বাগান তৈরি করেছিল দেখে কয়েকজন বাঙালি ভেবেছিল তারাই বা পারবেন না কেন। জলপাইগুড়ির ঘোষেদের চা বাগিচাতে আসার ইতিহাস অনেকটা সেই জাতীয়তাবাদী ভাবধারা থেকেই। তখন জমি সস্তায় পাওয়া যেত। সরকারের কাছ থেকে সস্তাতে জমি লিজ নিয়ে ছোট ছোট কোম্পানি গঠন করা হত। এরপর শেয়ার বিতরণ করে তা থেকে মূলধন সংগ্রহ করা হত। তখন জলপাইগুড়িতে ছিল লয়েডস ব্যাংক। তারা টাকা ধার দিত। মাড়োয়ারিরাও টাকা ধার দিত।
পঞ্চাশের দশকের প্রথম দিকে গোপাল ঘোষের নাতি বীরেন্দ্র চন্দ্র ঘোষ পশ্চিম ডুয়ার্সে ব্রিটিশ কোম্পানি “দি এম্পায়ার অফ ইন্ডিয়া এন্ড সিলোন” টি কোম্পানির হাইহাইপাথার অর্থাৎ যেটি বর্তমানে এখন ‘রাজা টি এস্টেট’ নামে পরিচিত সেটি এবং গুড হোপ চা বাগান কিনে তার সঙ্গে যুক্ত করেন। এই দুটি বাগানের মোট আয়তন ছিল ১৬০০ একর। ১৯৬০ সালে বাগরাকোট টি কোম্পানির আউট ডিভিশন শাওগাও চা বাগান এই কোম্পানির সঙ্গে যুক্ত হলো। বীরেন ঘোষ বাগান দুটি কেনার পর দুটো বাগানেরই নাম তাঁর দুই মেয়ের নামে পাল্টে দেন। হাইহাইপাথার নাম রাখেন রূপালী আর শাওগাঁও এর নামকরণ করেন সোনালী। সরকারি খাতায় কিন্তু আগের নামই থেকে যায়। নতুন সাজে নাম জারি বা মিউটেশন করার কথা ভাবা হল না। হয়তো এর কারণ হতে পারে মিউটেশন করতে হলে সরকারি নিয়ম অনুসারে বকেয়া অর্থ মিটিয়ে দিয়ে লিজ নবীকরণ করতে হত। এটা আইন অনুসারে বাধ্যতামূলক হলেও বহু বাগান মালিক সেই দায়িত্ব পালন করতে চান নি। আসলে দার্জিলিং এবং জলপাইগুড়ি জেলার চা বাগান স্থাপনের সময় থেকে সরকারের ঘোষণা ছিল এই চা বাগিচা জমির মালিকানা থাকবে সরকারের হাতে। এই জমি বিক্রি করা চলবে না। ডুয়ার্সের জমি ছিল ভুটানের সম্পত্তি। ১৮৬৪-৬৫ সালে ভুটানের সঙ্গে ইংরেজদের যুদ্ধের শর্ত অনুসারে এই জমি ইংরেজ সরকারের অধীনে আসে। তাই এখানকার জমির বিলি ব্যবস্থাও নতুন করে করতে হয়। শাওগাঁও বা সোনালি চা বাগানের লিজ মেয়াদের সময়সীমা ছিল ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত। ওয়েস্ট বেঙ্গল স্টেট একুইজিশন অ্যাক্ট ১৯৫৩ অনুযায়ী লিজ নবীকরণের নোটিশ পাঠালেও বীরেনবাবুরা তাঁদের নতুন কোম্পানির নামে লিজ নবীকরণ করেননি। এমনকি তাঁর পরিচালনাকালে ভূমি রাজস্ব বিভাগে বা তৌজিতে কোন খাজনাও জমা দেননি।
নতুন কোম্পানির এই নতুন চা বাগানটির নাম সোনালি নামকরণ হলে কোম্পানির ম্যানেজিং ডাইরেক্টর হলেন বীরেন্দ্র চন্দ্র ঘোষ। শেয়ার হোল্ডাররা সবাই ছিলেন জলপাইগুড়ির বাসিন্দা। প্রতিটি শেয়ারের দাম ছিল ২৫ টাকা। বাগানটি ছিল মাল থানার অন্তর্ভুক্ত। এর কোন ফ্যাক্টরি ছিল না। চা আবাদি জমির পরিমাণ ছিল ৫০০ একর। এখান থেকে কাঁচা পাতা তুলে ১০ কিলোমিটার দূরে মূল বাগানের বাগরাকোটের ফ্যাক্টরিতে নিয়ে যাওয়া হত। বড় মাপের চা বাগানগুলিতে কাজের সুবিধার জন্য এইরকম দু-তিনটি আউট ডিভিশন যেমন তখন থাকতো, এখনও অনেক বড় বড় চা বাগানে আছে। বাগরাকোট টি কোম্পানির মালিকদের মধ্যে স্যার ওয়ালটার ডানকান এবং দি গুডরিক ছিলেন এখানকার চা শিল্প স্থাপনের অন্যতম পথিকৃৎ। দার্জিলিং, ডুয়ার্স, তরাই, আসাম, দক্ষিণ ভারত এবং সিংহলের অতি উৎকৃষ্ট চা বাগানগুলো ছিল তাঁদের মালিকানায়। ডানকান এবং গুডরিক পারস্পরিক বোঝাপড়ার মাধ্যমেই পৃথক হয়ে দুটি পৃথক কোম্পানি গঠন করে নিয়েছিলেন। গ্রেট গোপালপুর টি কোম্পানি ডানকান ব্রাদার্সের কাছ থেকে দু লক্ষ টাকায় বাগানটি কিনে নিল। তখন এর চা আবাদি জমির পরিমাণ ৫০০ একর হলেও এর মোট আয়তন ছিল ১১৭৩ একর। এই বাগানের চা পাতা উৎপাদনের পরিমাণ ছিল দুই লক্ষ কেজি। আসলে সেই সময়ে জ্যৈষ্ঠ থেকে শুরু করে আশ্বিন-কার্তিক পর্যন্ত আকাশ থেকে নেমে আসত পর্যাপ্ত পরিমান জল। সঙ্গে নির্মল আকাশ আর অকৃপণ সূর্যের আলো। মাটি তখনও পর্যন্ত ছিল খাদ্যে ভরপুর। ছেঁটে দেওয়া চা ঝোপের শত শত শাখা-প্রশাখা ভরে উঠত হাজার হাজার পাতা আর কুঁড়িতে। তাদের মাথা থেকে নিপুন হাতের তিন আঙ্গুলের চাপে তুলে নিতে হবে কচি কচি দুটি পাতা আর একটা কুঁড়ি। মরশুমে চার পাঁচ দিন অন্তর আর বর্ষা কমে এলে আট দশ দিন অন্তর।
১৯৫১ সালের জনগণনায় এর লোকসংখ্যা ছিল ১৩০০। বাগানে স্থায়ী-অস্থায়ী শ্রমিক মিলিয়ে মোট শ্রমিকের সংখ্যা ছিল ৫০০। দুই এক ঘর বাদ দিলে সব শ্রমিকই ওঁরাও আদিবাসী জনগোষ্ঠীভুক্ত। বীরেনবাবু প্রতিদিন এই বাগান থেকে কাঁচা চা পাতা তুলে ট্রাকে করে এখান থেকে ১৯ কিলোমিটার দূরে হয় গুড হোপ অথবা ২৫ কিলোমিটার দূরে হায়হায়পাথার ফ্যাক্টরিতে নিয়ে যেতেন। সেই সময় একজন ম্যানেজার, বাবু কর্মচারী বলতে অফিসে তিন চার জন কর্মচারী নিয়ে অফিস ঘর আর একটা দাওয়াইখানা ছিল। একজন মাত্র ডাক্তার, একজন বাগানবাবু আর বাকি সবাই ছিল শ্রমিক। টালির ছাউনি দেওয়া ৪৫ টি ঘর বাদ দিলে শ্রমিকদের জন্য সব ছিল কাঁচা ঘর। কর্মচারীদের জন্য বরাদ্দ দুই এবং তিন কামরাওয়ালা কোয়ার্টার। বাগানে ছিল না বৈদ্যুতিক আলো। বাগানে ১২৫ ঘর শ্রমিকের বাস ছিল। স্থায়ী শ্রমিকের সংখ্যা ছিল ৩৪৮। তার মধ্যে অর্ধেক নারী শ্রমিক। এখানে ছিল সাতটি শ্রমিক লাইন। শ্রমিকদের মধ্যে ২০৮ ঘর ছিল ওঁরাও আদিবাসী গোষ্ঠী। ১৪ ঘর বরহিক, ৩ ঘর মুন্ডা। ২০১৭ সালে সোনালি চা বাগিচার ম্যানেজার নবেন্দু রায়ের কাছ থেকে পেয়েছিলাম বাগানের সাম্প্রতিকতম তথ্য। বরাবরের মতোই খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছিল বাগান। অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার হিসাবে কোচবিহার থেকে এসেছিল তরুণ তুর্কী তথাগত দেবনাথ। তাদের কাছ থেকে জানা গিয়েছিল সেই সময় সোনালি চা বাগিচার নিজস্ব উৎপাদিত চা ছিল ৭০-৭৫ হাজার কেজি। বহিরাগত বাগান থেকে সংগৃহীত এবং কেনা কাঁচা চা পাতায় প্রস্তুত বিক্রয়যোগ্য চায়ের ক্ষেত্রে নিজস্ব ফ্যাক্টরি না থাকার জন্য বহিরাগত ফ্যাক্টরির উপর নির্ভর করেই চলতে হয়। অত্যন্ত দূর্বল এবং পরিকাঠামোহীন এই চা বাগানে উৎপাদিত চায়ের প্রকৃতি অনুযায়ী গ্রিন লিফ সিটিসি চা উৎপাদিত হয়। তবে লিজ রিভার বাগানের লাগোয়া সোনালি বাগানের অতীতে যথেষ্টই সুনাম ছিল।
সোনালি চা বাগিচা থেকে ফেরার আগে গেলাম বাগানের জরাজীর্ণ হাসপাতালে। ডিসপেনসরি নেই। বাইরে ভাঙ্গাচোরা অ্যাম্বুলেন্স অতীতের সাক্ষ্যপ্রদান করছে। কম্পাউন্ডার একজনকে পেলাম। গাছের ছায়াতে বসে। স্বাস্থ্য সহযোগী নেই। নার্সের সহযোগিনী আয়ার সঙ্গে কথা বলছে একতা বেঞ্চে বসে। আমার দিকে তাকানোর দৃষ্টি দেখে খুব একটা সুবিধার মনে হল না। বাগিচায় পর্যাপ্ত ওষুধ সরবরাহ মনে হয় গল্পগাথা। ভাঙ্গাচোরা, পর্যাপ্ত জলের ব্যবস্থা নেই। ১টি ট্রাকে করে সোনালি চা বাগিচার শ্রমিক সন্তানদের বাগরাকোট বিদ্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। তবে স্কুলে কতজন নিয়মিত যায় বা বাগানের ট্রাক নিয়মিত যায় কিনা প্রশ্ন করতে যে উত্তর পেলাম তাতে যা বোঝার বুঝে নিতে হল। ১৯৫১ সালের জনগণনা অনুযায়ী বাগানের লোকসংখ্যা ছিল ১৩০০। স্থায়ী অস্থায়ী শ্রমিক সংখ্যা মিলিয়ে মোট শ্রমিক সংখ্যা ছিল ৫০০। দু-এক ঘর বাদ দিলে অধিকাংশ শ্রমিক ছিল ওরাওঁ সম্প্রদায়ভুক্ত। এখন ভুখা পেটে শ্রমিকেরাই আছে, কিন্তু আর কিছুই নেই। আর আছে ট্রেড ইউনিয়ন, তবে ট্রেড নেই। বাগানে প্রতিষ্ঠিত এবং স্বীকৃত ট্রেড ইউনিয়ন ৩টি। এগুলি হল পিটিডব্লিউইউ, সিবিএমইউ, টিডিপিডব্লিউইউ। তথ্য বলছে এখন সোনালি চা বাগানের আয়তন এবং চাষযোগ্য আবাদিক্ষেত্র ৪২৬.২৯ হেক্টর। মোট চাষযোগ্য উৎপাদনক্ষম আবাদিক্ষেত্র ২০৬.২ হেক্টর। প্রতি হেক্টর উৎপাদনযোগ্য এবং ড্রেন ও সেচযুক্ত ‘প্ল্যান্টেশন এরিয়া’ থেকে প্রতি হেক্টর জমি পিছু ৭৩১ কেজি করে চা উৎপাদিত হয়। সোনালি চা বাগিচার সাব স্টাফের সংখ্যা ২২ জন। করণিক নেই। ক্ল্যারিকাল এবং টেকনিক্যাল স্টাফও নেই যেহেতু ফ্যাক্টরি নেই। বাগানে শ্রমিক পরিবারের সংখ্যা ২৯৬। মোট জনসংখ্যা ১৫০৯। স্থায়ী শ্রমিক ৩৩৪ জন। স্টাফ এবং অন্যান্য শ্রমিক সংখ্যা ২২ জন ধরে মোট শ্রমিক ৩৫৬ জন।
১৯৫৫ সালে খুব কম দামে বীরেনবাবু বাগানটি কিনেছিলেন। কিন্তু ১৯৬৯ সালে গ্রেট গোপালপুর কোম্পানির পক্ষ থেকে জানিয়ে দেওয়া হল তাদের শাওগাও বাগানে যে লোকসান হচ্ছে সেই বোঝা তারা আর বইতে পারছে না। কোম্পানির ব্যালেন্স শীট প্রকাশের পরে দেখা গেল ব্যাংক, টি বোর্ড, জমির খাজনা, পিএফ, বাজারের দেনা ইত্যাদির সুদ বাবদ ৪৩ লক্ষ টাকার দায় চেপে বসেছে কোম্পানির ওপরে। কিন্তু সেই রহস্য খুঁজে বার করার কোনো চেষ্টা করা হয়নি। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক ইউনাইটেড ব্যাংক অফ ইন্ডিয়া তাদের ঋণ আদায়ের জন্য জলপাইগুড়ি সাব জজ কোর্টে দেওয়ানী মামলা দায়ের করে। অথচ ১৯৬৮ সালে তারা যে ব্যালেন্স শীট প্রকাশ করেছিল তাতে বলা হয়েছিল বিগত তিন বছরের লোকসান সামলে তারা সেই অর্থবর্ষে লাভ করেছিল ৭৭৮০২ টাকা। আসামের সঙ্গে রেলপথের যোগাযোগের জন্য ডুয়ার্সের মধ্য দিয়ে মিটার গেজ রেল লাইন স্থাপন এবং প্রতিরক্ষার প্রয়োজনে বাগানের যে জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছিল তার জন্য সংশ্লিষ্ট দপ্তর থেকে ক্ষতিপূরণ পেয়েছিলেন বীরেনবাবু। তাই সব দায় ঝেড়ে ফেলে ব্যাংকের ঋণ সহ সব দায়িত্ব কাঁধ থেকে নামিয়ে দিতে চাইলেন বীরেনবাবু। এর মালিকানা নেওয়ার জন্য মালিকও জুটে গেল। বাগানটির সমস্ত দায় মাথায় নিয়ে কলকাতার বিজয় কুমার খেমকা এবং তার ভাই কৃষ্ণকুমার খেমকা বাগানের মালিকানা ঘোষেদের কাছ থেকে সব দায় সহ নিয়ে নিলেন। খেমকারা বীরেন ঘোষেদের যে শেয়ারগুলি কিনেছিলেন তার জন্য তাদেরকে এক টাকাও দিতে হয়নি। শেয়ারগুলি হস্তান্তর করা হয়েছিল বাকিতে। বীরেনবাবু এর জন্য কোন টাকা দাবি করেননি। তিনি চেয়েছিলেন ব্যাংকের ঋণ সহ সব দায়িত্ব ঘাড় থেকে নামিয়ে দিতে। খেমকারা বাগানে ঢুকে স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি বিক্রি করে দিতে শুরু করল। বাগানের ট্রাক্টর, ট্রাক, মহামূল্যবান কাঠের তৈরি বাংলো ভেঙে রাতারাতি বিক্রি করে দিল। শুরু হল শাওগাও বা সোনালী চা বাগানের পতনের ইতিহাস। খেমকাদের শোষণের চরিত্র এবং শাওগাও চা বাগানের চা ইতিহাসে প্রথম শ্রমিক সমবায়ের ইতিহাস, সাইমন ওরাওদের লড়াই, চিন্ময় ঘোষেদের ঐতিহাসিক সংগ্রাম, শ্রমিক দরদী সরকারের বিশ্বাসঘাতকতার ইতিহাস আলোচনা করব পরবর্তী পর্বে। নইলে বাগিচা সফরের অন্য আর একটি দিক অসম্পূর্ণ থেকে যাবে যে।
কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ সৌমেন নাগ - ডুয়ার্সের চা অবলুপ্তির পথে? মানস দাশগুপ্ত – উত্তরবঙ্গে চা শিল্পে বর্তমান সমস্যা, WW Hunter – A Statistical Account of Bengal, Tushar Kanti Ghosh - Tea gardens of West Bengal, B.C Ghosh - The Development of Tea Industry in the District of Jalpaiguri ( 1869-1968), সুপম বিশ্বাস – চা বাগিচা শিল্পে বাঙ্গালী উদ্যোগপতিগণ।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴