শালসিঁড়ি-১৯/বিমল দেবনাথ
শালসিঁড়ি-১৯
বিমল দেবনাথ
^^^^^^^^^^^^^
তারা দেখে দিক নির্ণয় করে হাঁটতে থাকি আমরা। কাবুদের বেশ সিরিয়াস মনে হচ্ছে। ওরা মাঝে মধ্যে নিজেদের ভাষায় কথা বলছে। কথার কিছু শব্দ মাঝে মধ্যে কাবুর খোলা ভোজালির মতো অন্ধকারেও চক্ চক্ করে ওঠে। অর্থ বুঝতে না পারলেও মনে হচ্ছে মাঝে মধ্যে ওরা নেপালি ভুটিয়া মেচ্ ও রাভা ভাষায় কিছু বলাবলি করছে আর হাঁটছে। কাবু কিছু একটা বলছিল তার মধ্যে একটা শব্দ কানে লাগলো- “শিং”। আমি একটু ঘাবড়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করি- কি হোল! শিং মানে কি? । গাছ। কাবু বলে – আমি সিকিমের ভুটিয়া, আমরা গাছকে শিং বলি। আমি ভাবি- যাক গাছ তো আর গুঁতো মারবে না। বনের ভিতর হাঁটছি আর হাঁটছি। বন থেকে বাইরে যাবার কোন ইঙ্গিত দেখতে পাচ্ছি না। সদ্য শেষ হওয়া পুঁথিগত শিক্ষা ও প্রশাসনিক শিক্ষার জ্ঞানের জন্য আমার পোলস্টারের ওপর আর কাবুদের ওপর খুব আস্থা। এক সময় ঠিক সরকারী আবাসস্থলে পৌঁছে যাব। কোয়ার্টারে ফিরে সেই ঠান্ডা ভাত আর গরম সবজী। কাবুর কড়া বারণ ছিল ভাত যেন বার বার গরম না করি। শরীরের পক্ষে ভালো নয়। ভাতে জল ঢেলে খেলে আরো ভালো। কী ভালো কী খারাপ জানা ছিল না। তাই ঘরে ফিরে খাদ্য সুখের লোভ হয়নি কখনোও। বরং ঘুরে ঘুরে রাতের বন দেখার আনন্দই ছিল আলাদা।
- খিদে পায়নি তোমাদের- অপরূপা জিজ্ঞাসা করে।
- খিদে? প্রথমে উৎকণ্ঠা পরে রাতে বন দেখার রোমাঞ্চ কখন যে হজমরস শুষে নিয়ে পেটে তিস্তাবুড়ির চরের মতো চড়া ফেলে দিয়েছিল বুঝতে পারিনি।
- তারপর বল -মাধুরী বলে।
অন্ধকার রাতে বনের ভিতর থেকে আকাশ কী সুন্দর ঝলমলে দেখায়। তারাগুলোকে স্পষ্ট বোঝা যায় - ওরা জ্বলছে আর নিভছে। এত দিন পরে মনে হলো গ্রহ আর নক্ষত্রের মধ্যে পার্থক্য যেন বই থেকে লাফ দিয়ে হাতের তালুতে এসে পড়েছে। শুধু কী আকাশের তারা! বনের তারা-জোনাকিরা কি কম উজ্জ্বল। গাছের গায়ে গায়ে জ্বলছে আর নিভছে। মনে হয় বনের তারারা কীটের কীর্তনের তালে তালে নাচছে। কিন্তু কীর্তনের তাল কেটে যায় হঠাৎ। কাবুদের হাবভাব দেখে আমার আনন্দ উধাও। বনটা যেন ফ্রীজ হয়ে গেল। জোনাকির আলো আর কীটের কথা যেন গিলে নেয় অন্ধকার। কী হল বোঝার আগে সমস্ত নীরবতা ভেঙে শোনা যায় বুনো হাওয়ার সর সর শব্দ। এই শব্দ যেন বন দেখার আনন্দকে শীতল করে দেয়। কাবু বলে- মনে হয় কোন মাংসাশী শিকার করল। দণ্ডীর বুকে ধূলোর স্তর আর বুনোদের টাট্কা পটির গন্ধ মনে করিয়ে দেয়, আমরা বুনোদের নির্জন কুঠুরির সবুজ সহজ উঠোনের উপর দিয়ে হাঁটছি। কাবু বলে - এখন খুব সাবধানে হাঁটতে হবে। বুনোদের ভীত সন্ত্রস্ত করা চলবে না। বুনোরা ভয় পেলে বিপদ। ভীত বন্যপ্রাণ ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে। আমি মনের গভীর থেকে সাহস তুলে আনার চেষ্টা করি - শাল গাছের প্রধান মূলের মতো, অতল তল থেকে জল তুলে আনার মতো। আমাদের এই যাত্রায় কপাল ভাল ছিল। বুনোদের গন্ধ পেলেও সাক্ষাৎ হয়নি সামনাসামনি। মন রোমাঞ্চ ও ভয়ে সিক্ত হয়ে ফুলে ফেঁপে ওঠে ডাউয়া গাছের ফলের মতো। মনে হয় - অন্ধকারে গাছের ছায়া যেন অশরীরী মানবী - আমাদের পাশে পাশে হাঁটে। কখন মনে হয় ওর হাত ছুঁয়ে যায় আমাকে। সেই ছোঁয়া সরীসৃপের ঠান্ডা ঢেলে দেয় আমার মেরুদণ্ডে। বনের অন্ধকারের আলোতে বুনোদের হাঁটাচলার দণ্ডীগুলোকে মনে হয় সেই অশরীরী মানবীর বিছিয়ে দেওয়া শাড়ির আঁচলের প্যাটার্ন- মাকড়সার জালের মতো। সেই নারী যেন আমাদের জড়িয়ে নিয়েছে তার জালে। আমরা কিছুতেই জাল ছিঁড়ে বেরিয়ে আসতে পারছি না। কী এক মোহিনী মায়ায় আচ্ছন্ন হয়ে আমরা সবাই রীতিমত দৌড়াচ্ছিলাম প্রাণ পণ করে।
- তারপর?- অংশু,ময়ূখ জিজ্ঞাসা করে।
- হঠাৎ মনে হলো ডান পা-টা যেন কে পিছনে টেনে ধরল। সামনের দিকে বনটা কিছুটা হালকা। ঐ হালকা গুল্মের বনে কাবুদের দেখা যাচ্ছিল কালো ছায়ার মতো। মনে হল কে যেন বলে উঠল যে অশরীরী নারীটি শরীরী। আমি ভাবলাম হলে হতেও পারে। তা না হলে এতক্ষণ কেউ একসাথে হাঁটে। ভাবি – কাবুরা কি ওকে দেখতে পায়নি। সে যা হোক, তা বলে পায়ে ধরে টানবে! পিছনে ফিরতেই দেখি, দূরে মলিন সাদা কাপড় পরে এক নারী উপুড় হয়ে বসে আছে। আমি থ!
- তারপর! তারপর!!…
অংশু,ময়ূখের চোখ বিস্ময়ে বিস্ফোরিত। ওদের মনের বিস্ফোরণে বিকাশের চোখ চিক্ চিক্ করে ওঠে। শালসিঁড়ির কথা ওদের মনে গেঁথে থাকা পেরেকগুলোকে যেন আস্তে আস্তে আলগা করে দিচ্ছে। বিকাশ আরো গম্ভীর হয়ে ভয়ার্ত স্বরে বলে-
- সমস্ত রোমাঞ্চ জমে পাথর হয়ে যায়। রাতে বনের নারীর হাত এত লম্বা হয়! আমার কেন যেন নিজের পায়ের দিকে তাকাতে ভয় হচ্ছিল। কাবুকে ডাকতে গিয়ে বুঝতে পারলাম গলার স্বর মরশুমী ঝোরার জলের মতো শুকিয়ে গেছে। নিজের কথা নিজে বুঝতে পারছিলাম না। কেমন যেন পাথর বজরীর ঘর্ষণের শব্দের মতো – ফাটা কর্কশ। কাবুদের ছায়া যেন আস্তে আস্তে পাতলা হয়ে অন্ধকারে মিশে যাচ্ছে। একি! কাবুদের কি আমার কথা খেয়াল নেই। বনের কাজে ঢুকেছি এখনও এক মাস হয়নি। তার মধ্যেই রাতে এই বিপত্তি- বনে।
- কাবুর সাথে তোমার সম্পর্ক জমে উঠার আগেই যে জল কেটে গেল- মাধুরী বলে।
- না না ব্যাপারটা সে রকম নয়। রাতে বনে কত কী ঘটতে পারে- আগাম তা কেউ জানে না।
- তোমার পায়ে কে পড়েছিল- মাধুরী মিটি মিটি হাসে।
- পেত্নী!!! ময়ূখ, অংশু এক সাথে ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞাসা করে।
পেত্নী শুনে মাধুরী অপরূপা হি হি করে হেসে উঠে। বিকাশ বলে-
- তোমরা হাসছ। তখন আমার অবস্থা খাঁচায় বন্দী বাঘের মতো। মনের ভিতর গর্জন ও ভয়ের সংমিশ্রণের ঘূর্ণিঝড়। এই ঝড়ে গাছ পড়ে না মন উড়ে যায়। কিন্তু আমার চোখে যে সবুজ স্বপ্ন। পা তুলতে গিয়ে অনুভব করি পা যেন শাল গাছের গুঁড়ির মতো ভারী হয়ে আছে। গভীর টিউ-কল টিপে টিপে জল তোলার মতো বুকে সাহস এনে নিচে নিজের পা দেখি।
- কী দেখলে? অপরূপা কৌতুহল নিয়ে জিজ্ঞাসা করে।
- কী দেখলাম! দেখলাম ডান পায়ে একটা লতা জড়িয়ে আছে। সেই লতা থেকে পা ছাড়িয়ে নিতে গিয়ে দেখি দূরের মলিন সাদা কাপড় পরা মহিলাটি নড়েচড়ে উঠল। আমি তাড়াতাড়ি পা ছাড়িয়ে নিয়ে পা চালিয়ে কাবুদের সাথে যোগ দিই। কাবুকে জিজ্ঞাসা করি ওরাও কি ঐ নারীকে দেখেছ? কাবুকে সব বলার পর কাবু সব বুঝে বলে- একটা নয় স্যার অনেকগুলো দেখেছি। আমি বলি- কী বল কাবু, অনেক মহিলা দেখেছ? হ্যাঁ স্যার, আপনি ডানে বাঁয়ে তাকান; আপনিও দেখতে পাবেন। আমি ডানে বাঁয়ে দেখি, দেখা যায়; অনেকগুলো ঐ রকমের নারী সাদা মলিন কাপড় পরে বসে আছে একই রকম ভাবে। আমি বলি- কাবু এরা কারা। কাবু বলে- বন কুল গাছ। কুলের পাতা গুলো সাদা-ধূসর রঙের হওয়াতে রাতে ঐ রকমের সাদা মনে হয়। ঝোপের আকৃতির ধরণের উপর নির্ভর করে, তৈরি হয় সেই নারীর শরীরের আকার প্রকার। আমি ভাবি- সবে তো শুরু আরো কী বাকি আছে কে জানে! আমরা আবার হাঁটতে শুরু করলাম। অনেকক্ষণ হাঁটার পর গবেন রাভা কী যেন বলছিল। আমি জিজ্ঞাসা করলে বলে – অনেকক্ষণ ধরে বনে বুনোদের চলার দণ্ডী ধরে হাঁটছি কিন্তু বনের বড় রাস্তা খুঁজে পাচ্ছি না। কখন যে হাতি বাঘ ভাল্লুকের সামনে পড়ি! মনে হচ্ছিল কিছুক্ষণ আগে কোন মাংসাশী শিকার করেছে… বনটা হঠাৎ কেমন নিস্তব্ধ হয়ে গেছিল! আমি বললাম- লাম মানে কী, কোন প্রাণী? সুনীল বলে- লাম হলো রাস্তা- রাভা ভাষায়।
- তোমরা তো তারা দ্যাখে হাঁটছিলে। তাও রাস্তা খুঁজে পাচ্ছিলে না কেন? অংশু জিজ্ঞাসা করে।
- আমিও তাই ভাবছিলাম অংশু, ওরা কেন রাস্তা খুঁজে পাচ্ছে না। হাঁটতে হাঁটতে সুনীল নারজিনারী “দইমা দইমা” বলে ডান দিকে ঘুরে হাঁটতে শুরু করে। কাবু দাঁড়িয়ে কানের পাশে দুহাতের তালু রেখে কান দুটোকে হাতির কানের মত বড় করে নেয়। আমি জিজ্ঞাসা করি- কাবু কী হল? কাবু বলে- স্যার, দেখছি কেন সুনীল “ দইমা দইমা” করে উঠল।
- দইমা কি?
- কাবু বলে- দইমা হল বড় নদী, মেচ্ ভাষায়। একাগ্র মনে কাবু কী যেন শুনতে থাকে। পরে সুনীলকে বলে- না সুনীল এই শব্দ কোন দিক থেকে আসছে বলা যাচ্ছে না। বনের গভীরে এই রকমই হয়। দূরের কোন শব্দ এত প্রতিধ্বনিত হয়ে আসে যে আসলে ঠিক কোন দিক থেকে শব্দ আসে তা সঠিক বোঝা যায় না। সুনীল বলে – এতক্ষণ তো তারা দেখে হাঁটলাম, এবার না হয় নদী খুঁজে হাঁটি। আমাদের তো আজ হাঁটতে হবে, না হলে সারা রাত্রি বনে বসে থাকতে হবে। কাবু বলে- ঠিক আছে, হাঁট; লাভ কিছু হবে না। আমরা অনেক ক্ষণ হাঁটার পর কাবু বলে, এই দাঁড়াও; দেখ গাছটিকে। এ যে সেই জ্যাকেট গাছটি। আমরা তো এই গাছটির কাছ থেকেই হাঁটা দিয়ে ছিলাম, এতক্ষণ হাঁটার পর আবার একই জায়গায় এসে হাজির। এক পাও এগোতে পারিনি।
- বাবা জ্যাকেট গাছ কী? অংশু বলে।
- কাবু আংকেল কেন হাতদুটোকে কানের পাশে ধরে কান বড় করে নেয়? ময়ূখ বলে।
- বলব এক এক করে সব বলব। হাতির কান বড় হয় কেন জান।
অংশু ময়ূখ ঘাড় নেড়ে অসম্মতি জানায়। বিকাশ বলে-
- হাতিদের কান বড় হবার অনেকগুলো কারণ আছে। তার মধ্যে একটি হলো – বেশি বেশি শব্দ তরঙ্গ ধরা যাতে কিনা হাতি কাছাকাছি কোন বিপদের বা অন্য হাতিদের উপস্থিতি বুঝতে পারে।
- হাতির বড় কানের আর কী কী সুবিধা- কাকু?
- সে পরে আর এক দিন বলব।
অংশু ময়ূখ নড়েচড়ে বসে। অপরূপা অজান্তে হাতের তালু কানের দুপাশে রাখতে গিয়ে উদরে মাধুরীর আংগুলের খোঁচা খেয়ে সাবধান হয়ে যায়, কিন্তু বিকাশের নজর এড়াতে পারে না। বিকাশ বলে-
- আরে লজ্জা কী। হাতের তালু কানের পাশে দিয়ে দেখ, শুধু বনে নয় এখানেও কত কী শোনা যাবে… এরপর যখন বনে যাবে নিজের কানকে হাতির কানের মতো করে চুপচাপ বনকে শুনবে- দেখবে কত কী মধুর শব্দ শুনতে পাবে- মন মোহিত হয়ে যাবে।
ময়ূখ অংশু হি হি করে হাসে, ময়ূখ বলে- চল আমরা একসাথে বনে যাই। বনে গিয়ে কানকে হাতির কানের মতো করে চুপচাপ বনের কথা শুনব। অংশু বলে-
- বাবা আমি আর ময়ূখ বনে যাব।
বিকাশের মনে পড়ে ভোরের বন। ভোরের সূর্য কী সুন্দর উজ্জ্বল প্রকট- খালি চোখে দ্যাখা যায়। ঘন সবুজ শালসিঁড়ি ভেদ করে সূর্য রশ্মি পড়ে শালসিঁড়ির পায়ে। বিকাশের মনে হয় সেই আলোর রশ্মি শালসিঁড়ির পায়ে নয় এখন থেকে পড়বে অংশুর মনে। সেই আলো সেই তাপ দূর করে দেবে মনের অন্ধকার, বায়বীয় হয়ে যাবে মনে জমে থাকা কালি, খালি করে দেবে মনে কত জায়গা। সেই জায়গা ঢুকে পড়ব আমরা… নদীর মতো।
- কেন এত ঝুলাচ্ছ বিকাশ। বলনা শেষে বন থেকে কী করে বের হয়েছিলে? মাধুরী জিজ্ঞাসা করে।
- ঠিক বলেছ আন্টি, বাবা শুধু আমাদের টেনশনে রাখছে- অংশু বলে।
- বিকাশ ভাবে- হালকা সহজ সরল কথায় উদ্দেশ্যহীন আড্ডার আনন্দ কী সুন্দর মলমের মত কাজ করে মনের উপর। সহজ আড্ডার আনন্দ-উত্তাপে কী অদ্ভুত ভাবে গলে যায় মনের গভীরে জমে থাকা কুঁচি কুঁচি বরফ… অংশুর মন এখন কত ফুরফুরে - তুষারের মত… পাখির পালকের মতো… শিমূলের তুলার মতো…
- শেষে কী ভাবে রাস্তা খুঁজে পেয়েছিলে- ময়ূখ জিজ্ঞাসা করে।
- সেটা একটা অভিজ্ঞতার আশীর্বাদ! কাবু বলে- স্যার আপনি আমার পিছনে দাঁড়ান। স্যারের পিছনে সবাই এক এক করে দাঁড়াও। এবার আমার পিছনে পিছনে হাঁটবে। দেখলাম কাবু একটি বেশ বড় গাছকে জড়িয়ে ধরে গাছের চারপাশে কী যেন দেখছে তারপর হাঁটছে… আবার কিছুক্ষণ পর আবার সেই রকম একটি গাছকে জড়িয়ে ধরে আবার কিছুক্ষণ হাঁটছে। এই ভাবে হাঁটতে হাঁটতে আমরা বনের একটা বড় রাস্তায় এসে হাজির হই। কাবু বলে – আর চিন্তা নেই। এই রাস্তা আমাদের চেনা। এবার আমরা কোয়ার্টারে ঠিক পৌঁছে যাব। কাবু লাটোর গাছের অতিপাকা ফলের মতো নরম গলায় বলে- স্যারের কত কষ্ট হল। আমি বললাম – আরে না না, কষ্ট তো আমরা সবাই করলাম। কাবু যেভাবে রাতের অন্ধকারে গাছকে জড়িয়ে ধরে ধরে আমাদের উদ্ধার করেছিল, আমারও কেন যেন কাবুকে বড় রাস্তার উপর জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করছিল…
বিকাশ অপরূপাকে দ্যাখে- অপরূপা বিকাশকে দ্যাখে। কে বলে শুভদৃষ্টি জীবনে একবার হয়! জীবন বয়ে চলে চখাচখি পাখিদের মতো। বিকাশের মনে হয়- অপরূপা যেন দুলে ওঠে, হাওয়ায় দুলে ওঠা সোনালু গাছের ঝুলে থাকা লম্বা হলুদ পুষ্পমঞ্জরির মতো। অপরূপার মনে পড়ে তিস্তাপাড়ের পার্কের কথা। বৈশাখের এক নির্জন দুপুরে কালবৈশাখীর চাবুক চমকানিতে বিকাশকে কত জোরে জড়িয়ে ধরেছিল! মনে হচ্ছিল- এ যেন কালবৈশাখী নয়, প্রেম-বৈশাখী। ওদের চোখ আবার চঞ্চল হয়ে ওঠে ময়ূখের কথায়। মাধুরী সব বুঝেও বসে থাকে - অবুঝ গাছের মতো।
- কাবু আংকেল কেন গাছকে জড়িয়ে ধরছিল।
- সেটাই-তো বনের বিজ্ঞান।
- কী কী!!! -রোমাঞ্চিত অংশুর ময়ূখের উত্তুঙ্গ প্রশ্ন।
- আমরা বনের বড় রাস্তা দিয়ে হাঁটছি। আকাশটা বৈশাখ মাসের ময়না গাছের পাতার মতো হালকা হলুদ হয়ে উঠছে। কাবুকে বলি – কাবু দেখ, আকাশ হলুদ হচ্ছে। আমরা ঠিক যাচ্ছি? কাবু আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে- স্যার, একদম ঠিক যাচ্ছি। আশ্বস্ত হতেই মনে যেন ক্লান্তি আসে। এতক্ষণ আশংকা ভয় এবং রোমাঞ্চের ক্লান্তি যে কোথায় ছিল কে জানে। সারা রাত্রি বনে বনে হাঁটলাম, কখনো এক ফোঁটা ক্লান্তি আসেনি। কোয়ার্টারে ফেরা সুনিশ্চিত হবার পর শরীর কেমন দুর্বল হয়ে পড়ল। পা যেন আর চলে না- পাংচার্ড টায়ারের মতো। গলা যেন শুকনো কাঠ। তখন গবিন ছুটে এল জীবন নিয়ে- স্যার স্যার এই লরং ( লতা)-টা নিন। মুখের উপর ধরুন। এর জলটা খান। জোর পাবেন। আমার হাতে দুই আড়াই ফুটের একটুকরো লতা ধরিয়ে দিল। আমি সেই লতা মুখের উপর ধরতেই মুখ ভরে গেল জলে। আমি আকন্ঠ পান করি সেই জীবন সুধা, এ-যেন অমৃত! শরীরে মনে জোর আসে অনেক। কাবুকে জিজ্ঞাসা করি- গাছ জড়িয়ে জড়িয়ে কী দেখছিলে? কাবু বলে- গাছের গায়ে শ্যাওলা( Moss) দেখছিলাম। বনে গাছের গায়ের উত্তর দিকে বেশি শ্যাওলা থাকে। তার উল্টো দিক হল দক্ষিণ। আমি দক্ষিণ বরাবর হেঁটে এই বড় রাস্তা বের করি।
- এত যদি অভিজ্ঞ হয় তাহলে প্রথমেই কেন এই অভিজ্ঞতা ব্যাবহার করল না। তাহলে তো তোমাদের এত কষ্ট হত না। - অপরূপা বলে।
- লোহা যেমন লোহা কাটে, বিষ যেমন বিষ কাটে ঠিক তেমনি গাছ গাছের হাওয়া কাটে। তাই কাবু যখন বুঝতে পারে আমরা ভুল করে, রাতের অন্ধকারে ভেলোয়া গাছের গন্ধ নাকে নিয়েছি, তখন ও শাল গাছের শ্যাওলার সাহায্য নেয়। মনে রাখবে ব্রহ্মাস্ত্র সবাই শেষেই মারে।
আনন্দে বিস্ময়ে অংশু ময়ূখ লাফিয়ে উঠে। হাত তালি দেয়। বলে – দারুণ দারুণ। অংশু বলে- শোন ময়ূখ এবার পড়াশুনার ফাঁকে সময় পেলে বনে যাব… বিকাশের মনে হল কতগুলো পেরেক অংশুর মন থেকে ময়ূখের মন থেকে ঘরের মেঝেতে ঝনঝন করে পড়ল… রান্নাঘর থেকে মিঠু বলে-
- কী গো বৌদি, ছেলেগুলোকে খেতে দেবে না। সারা রাত গল্প করলে হবে। আমার এবার যেতে হবে। অনেক রাত হয়েছে।
- না না পরে খাব। এখনও হাওয়াতে জল খাওয়া শোনা হয়নি বাবা!
- সে হবে ক্ষণ খাওয়া দাওয়ার পর। যাও এখন ডিনার করে নাও…
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴