ভোপলা/শুক্লা রায়
ভোপলা
শুক্লা রায়
চেহারা-চরিত্রে অস্বাভাবিকতা কিছু ছিল না। রোজকার মতো হাতে ব্যাগ ঝুলিয়ে হাটে যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়েছে। ভোপলা কিনতে। অভ্যাস বশত ফুলমণি একটু গজ গজও করেছে, এদিকেই কত ভোপলা! আবার ধূপগুড়ি হাট যেতে লাগে। অতীন খৈনী ডলতে ডলতে খৈনীর ধুলোটা যেমন ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিল, সেরকম ফুলমণির আপত্তিটাকেও হাসতে হাসতে উড়িয়ে দিল। শোলার ফুল ভোপলা ছাড়া দশমীর পুজো হবে না। বাড়িতে আবার অনেক ঠাকুর। কম করে এক ডজন ভোপলা হলে ভালোমতো হয়। শুধু তো ঠাকুর থানে নয়, ঘরের চালাতেও লাগে। ফুলমণি নিষেধ করা সত্ত্বেও শুনলো না অতীন। বলে এই সব হাটে দাম বেশি। ধূপগুড়ি হাট থেকে নিয়ে আসি। সেই যে গেল আজ অবধি লোকটা ফিরল না। দশ বছর অল্প সময় না। সবাই ফুলমণিকে বুঝিয়েছে, এতদিন হয়ে গেল, অতীন বোধহয় আর বেঁচে নেই। ফুলমণি তাও নিয়ম করে সিঁদুর পরে, সধবার সব আচার পালন করলেও কোনো শুভকাজে আর যায় না। এই দশবছরে অনেক কিছু বদলে গেছে। ছেলেটা বড় হয়েছে, মেয়েটার বিয়ে দিয়েছে। দেখতে দেখতে আগের ফুলমণি আর ফুলমণি নেই, ঝিমিয়ে পড়েছে। শরীরের শিরা-উপশিরায় শেকড় বাকড় ফুটে উঠে যেন জলহীন ক্লান্ত, শুকনো গাছ একটি। শাশুড়ি যদ্দিন বেঁচে ছিল ফুলমণির হাতে এক গ্লাস জলও আর মুখে তোলেনি কোনোদিন। কোনোদিন আর ভোপলা দিয়ে পুজো দিতে দেননি বাড়িতে। মরণকালেও সেই জেদ বজায় রেখেছে বুড়ি। তবে তখন চাইলেই ফুলমণি খাওয়াতে অন্তত পারত, পারত বুড়ির গুমোর ভাঙতে। কিন্তু ফুলমণিই চায়নি। মৃত্যুপথযাত্রী মানুষটার মনে কষ্ট দিয়ে আর নিজের পাপ বাড়াতে চায়নি।
আজও ভাবতে অবাক লাগে, লোকটা কোথায় যেতে পারে! কোনো কারণে কী সব ভুলে গিয়ে অন্য কোথাও চলে গেল? নাকি সবাই যা বলে সেটাই ঠিক, কোথাও গাড়ি চাপা পড়েছে, পুলিশ ঠিকানা না পেয়ে নিয়ে গেছে। তবে ফুলমণি এ কথা মানতে চায় না। কোত্থাও কোনো অ্যাক্সিডেন্টের খবর পাওয়া যায়নি আশেপাশের জায়গাগুলোতে। ফুলমণির বুকটা হু হু করে। মানুষটা কোথায় আছে, কী খাচ্ছে কে জানে! সেই থেকে ভালো-মন্দ খাবার ফুলমণি মুখেই তুলতে পারে না। বেঁচে থাকার জন্য যেটুকু পেটে দিতে হয়ে। প্রথম প্রথম ছেলে-মেয়ে দুটো জেদ করত, এখন ওরাও অভ্যস্ত হয়ে গেছে মায়ের এই জীবনের সঙ্গে। এখন অবশ্য সব কষ্ট সয়ে গেছে।
শাশুড়ি তো বলেই দিয়েছে এরকম অপয়ার মুখ দেখবে না আর। এই অলক্ষ্মীর জন্যই ছেলে আজ হারিয়ে গেল। সত্যিই কী হারিয়ে গেল? নাকি নিজে নিজেই হারাতে চেয়েছে! এই প্রশ্নটাই তুলেছিল কেউ একজন। সে প্রশ্ন অবশ্য পাত্তা পায়নি কারো কাছে। একদিকে থানা-পুলিশ, জেরার পর জেরা। ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে প্রচুর প্রশ্ন। শোকে বিহ্বল ফুলমণি মাটির সঙ্গে মিশে গিয়েছিল প্রায়। ছোট শিশুদুটি কিছুই বোঝে না। অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। ওরাও যেন কান্না করতে, জেদ করতে ভুলে গিয়েছিল। তার উপর আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশির নানান কথা, নানান প্রশ্ন। সেসবও কবে যেন ধীরে ধীরে থিতিয়ে গেল। এখন শুধু থেকে গেছে ফুলমণির একাকীত্ব আর অপরাধবোধ। তার জন্যই কী মানুষটা ঘর ছাড়া? এ প্রশ্নের উত্তর তো একমাত্র সেই লোকটাই দিতে পারে। কোনোদিনও কী ফিরবে না?
সেদিন সন্ধ্যা দিয়ে সবে রান্না ঘরে জলটল নিয়ে যাচ্ছে। রাতের রান্না বসাবে। ছেলে বাইরে থেকে এল কী একটা যন্ত্র নিয়ে। "মা মা" -বাড়ি একেবারে মাথায় তুলল। যন্ত্রটা মায়ের হাতে দিয়ে বলল, "এটাকে বলে মোবাইল ফোন। নাম্বার টিপলে কথা বলা যায়।"
টানা একমাস ধরে ট্রেনিং চলল ফুলমণির। ফুলমণি কিছুতেই নিজে ফোন করতে পারেনি। তবে ফোন এলে কোনটা টিপে কানে ধরে কথা বলতে হয় সেটা শিখল অবশেষে। এটুকুই যথেষ্ট। এরকমই এক সন্ধ্যায় হঠাৎ ছেলে জানাল বাইরে যাবে। ফুলমণির বুকটা কেঁপে উঠল। কেঁদে গড়াগড়ি খেল। কিন্তু ছেলে সিদ্ধান্তে অটল। অবশেষে এক মাস থেকেই চলে আসবে আর প্রতিদিন ফোন করবে -এই কথা দিয়ে ফুলমণিকে রাজী করানো গেল। বন্ধুদের সাথে কেরালা নয়, ছেলে গুজরাট গেল। অল্প বয়স। এখনি অতটা দূরে পাঠাতে ফুলমণির বুকটা হাহাকার করে উঠলেও কী আর করার আছে!
কথা ছিল প্রতিদিন ফোন করবে। কিন্তু তিনদিন হল ছেলের ফোন আসে না। নিজে ফোন করতে পারে না। ফুলমণি অস্থির হয়ে খাওয়া দাওয়া ছেড়ে দিল। খবর পেয়ে শ্বশুরবাড়ি থেকে মেয়ে এল। মেয়ে মাকে বোঝাচ্ছে। একটু কিছু খাওয়ানোর চেষ্টা করে মাথায় তেল বসিয়ে দিচ্ছে ধীরে ধীরে। বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যার অন্ধকার ধীরে ধীরে উঠোনে ছড়িয়ে পড়ছে। এমন সময় সেই আবছা উঠোনে কেউ এসে দাঁড়াল। ফুলমণি আর পারল না, ছুটে গিয়ে ছেলেকে জড়িয়ে ধরল।
রাতের খাবার খাওয়া হয়ে গেলে তিনজনে ঘরে বসে আছে। দুটো বাচ্চা নিয়ে প্রমিলা একাই এসেছে। বাচ্চাগুলো কাঁথার উপর ঘুমাচ্ছে নিশ্চিন্তে। ধীরে ধীরে মনোজ ডাকল, "মা, বাবাকে দেখে এলাম।"
কথাটা ফুলমণির যেন বিশ্বাস হল না। চমকে উঠে শুকনো গলায় বলল, "কী!"
মনোজ মাথাটা নিচু করে আছে। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। হয়ত মাকে একটু সামলে নেবার সুযোগ দিল। তারপর কোনো ভুমিকা না করেই বলল, "ঝর্ণা কাকিকে বাবা বিয়ে করেছে, দুটো ছেলে আছে।"
অতীনের বন্ধুর বৌ ঝর্ণা। রাগ করে বাপের বাড়ি চলে গিয়েছিল আর ফেরেনি।
ফুলমণির শরীরটা কেঁপে উঠল। এতদিনের সংশয়, অপেক্ষার নির্মম অবসান।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴