ভাস্কর্যের আঁতুড়ঘর-১৯/মৈনাক ভট্টাচার্য
ভাস্কর্যের আঁতুড়ঘর (পর্ব-১৯)
মৈনাক ভট্টাচার্য
গোলপার্কের স্বামীবিবেকানন্দ মূর্তি
শহরের সৌন্দর্যায়নে পথভাস্কর্যের বড় ভূমিকা থাকে। শুধু সৌন্দর্যায়নই বা বলি কি ভাবে। একটা শহরের শিল্প চেতনায় প্রাচুর্য মানকের মূল স্তম্ভই তো এই পথভাস্কর্য। কিন্তু এই বাস্তবতা আমরা জ্ঞানে বা অজ্ঞানে ভুলে থাকি। তলিয়ে না ভেবে তাই একটা শহরে আলপটকা নানান ভাস্কর্যস্থাপনের পরিকল্পনাও করি। প্রশাসন বেশিরভাগ সময় এটা করে ওঠে দীর্ঘ চিন্তাভাবনা বর্জিত অজ্ঞতায় এবং তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তের স্বার্থেই। কখনও প্রশাসন সেটা করতে বাধ্যও হয় স্থানীয় আবেগের চাপে। আবার কখনও এই সিদ্ধান্ত নির্ভর করে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির ভাবধারায়। শহরের বিশেষ কোন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে ভাস্কর্য স্থাপনের ক্ষেত্রে বা মান বিচারে বেশিরভাগ সময়ই বিশেষ জ্ঞান সমৃদ্ধ জনমত সমীক্ষার পরামর্শও নেওয়া হয়না । ফল হয় মারাত্বক। প্রায় অনেক ক্ষেত্রেই গলগ্রহ হয়ে দাঁড়ায়। তাই শেষ পর্যন্ত একটা শহর বা শহরতলীর শিল্পদলিলে শহরের অহংকার হয়ে ওঠার পরিবর্তে এই ভাস্কর্য বরং শহরের বোঝা হয়ে থেকে যায় শিল্পবর্জ্য হিসেবে। সব চেয়ে বড় কথা শুধু ভাস্কর্যের মানই নয়, কোন ভাস্কর্য বসার আগে এই ভাস্কর্যের সাথে পারিপার্শিক আরও অনেক কিছু চিন্তা ভাবানার প্রয়োজন। মূল প্রয়োজন বোধহয় সঠিক স্থান নির্বাচন। মুক্ত আকাশের ভাস্কর্যে উচ্চতারও একটা বড় ভূমিকা থাকে। এই উচ্চতা কাজের ভেতর প্রায়শই অন্য ধরণের একটা অতিরিক্ত ব্যক্তিত্ব হিসেবে ধরা যায়। অথচ ভাস্করদের একটা ক্ষোভ সব সময়ই থাকে আর্থিক অথবা অন্য কারনে ভাস্কর্যের উচ্চতার সীমা বাঁধা পড়ে যায় প্রশাসনের বেড়িতে। শেষ পর্যন্ত নান্দনিক দৈন্যতার দায় বর্তায় খোদ ভাস্করের উপরে।
# #
কলকাতা গড়িয়া হাট গোলপার্কের স্বামী বিবেকানন্দের মার্বেল মূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে রামকিঙ্করের প্রথম প্রতিক্রিয়াই ছিল-“দাঁড়ানোর ভঙ্গিটার ভেতরেই তো গোলমাল। সামনের দিকে মাথার ঝোঁকটা বেশি”। একটা পোট্রেট একটা চরিত্র হয়ে উঠবে, একটা গল্প বলবে- তবেই তো সেই ভাস্কর্যের স্বার্থকতা। এটাই তো প্রকৃত ভাস্করের দর্শণ। রামকিঙ্কর কোনদিনই তাঁর কাজে চেহারার হুবহু নকল প্রতিরূপ দিয়ে করতে পছন্দ করতেন না। তাই দাঁড়ানোর ভঙ্গিতে সিংহের বিক্রমই রামকিঙ্করের কাছে বিবেকানন্দের প্রথম পরিচিতি। সেই বিক্রম না পেয়ে এই মূর্তি দেখে তিনি হতাশ হয়েছিলেন। পা আর মাথার লেভেলেও গোলমাল মনে হয়েছিল তাঁর এই মার্বেল মূর্তিতে। ড্রেপারির ফোল্ড গুলোর ভেতরেও যে প্রাণ নেই সেটাও দেখলেই বোঝা যায়, তাঁর পছন্দও হয়নি। তাঁর মন্তব্য ছিল-“ হয়ত ছবি দেখে করা তাই এমন হয়েছে”। উনিশশো পচাত্তরে কাজটা নিয়ে মতামত জানাবার জন্য তাঁকে নিয়ে পূর্নেন্দু পত্রী দেখিয়েছিলেন এই বিবেকানন্দ। সাত ফুট উচ্চতার মার্বেল পাথরের তৈরি কলকাতার প্রথম স্বামী বিবেকানন্দের মূর্তি বলে কথা। উনিশশো ছেষট্টির কাজ। এই কাজ দেখে সেই পঁচাত্তরেই শিল্পী রামকিঙ্করের মনে হয়েছিল মূর্তিটায় প্রচুর গোলমাল। আরও বড় হওয়া খুব উচিত ছিল। কারন লোকে তো দূর থেকেই দেখবে। তাঁর আরও মনে হয়েছিল বড় হলে তবেই না প্রথম পার্সোনালিটিটা ধরা যাবে নয়ত শুধু শুধু একটা পাথর দাঁড় করিয়ে কী লাভ। মূর্তির পেছনের সাপোর্টেরও কোন প্রয়োজন মনে হয়নি, অতিরিক্ত হিসেবে কাজটায় বোঝা হয়ে আছে। কোন ব্যালান্সই আসেনা এই সাপোর্টে। হয়ত দেওয়া হয়ে থাকবে কাজটার ভরকেন্দ্রকে আরও কিছুটা মজবুত করবার তাগিদে। একটা ভাস্কর্যের ক্ষেত্রে এটা কিন্তু বিরাট দূর্বলতা বলা যায়। আনন্দবাজার পত্রিকায় ফলাও করে ছাপা হয়েছিল কলকাতার একুশটি মূর্তি নিয়ে কলকাতার পথভাস্কর্যের মোটের উপর চেহারাটা কেমন রামকিঙ্করের চোখ দিয়ে। খুব প্রয়োজনীয় ছিল এই উদ্যোগের।
কলকাতার তো তাও একটা শিল্প অভিভাবকত্বের চাপ থাকে প্রশাসনের কাঁধে। কিন্তু এই যে বাকি শহর, মফস্বল এদের কি হবে। শিল্পদূষণ সব সময় জাতির জন্য প্রতিবন্ধক। এ যে একটা জাতীর ভাবনা এই ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু আমাদের দূর্ভাগ্য এই বোধটুকু আমাদের আজও তৈরি হয়না।
# #
গোলপার্কে এই স্বামী বিবেকানন্দের মূর্তি বিবেকানন্দের মৃত্যুর চৌষট্টি বর্ষপূর্তি উপলক্ষে উনিশশো ছেষট্টি সালে স্থাপন করা হয়। উনিশশো ছেষট্টি থেকে উনিশশো পচাত্তর। নয় বছরে কারও মনে হয়নি স্বামী বিবেকানন্দের এই মূর্তি নিয়ে এইসব ভাবনা। হয়ত রামকিঙ্করের এই মতামতের পর গোলপার্ক কতৃপক্ষের টনক নড়ে। তাঁদেরও মনে হয় সত্যিই গড়িয়া হাটের এই গোলপার্কের মত জায়গায় এই মূর্তি প্রয়োজনের তুলনায় সত্যিই ছোট। ২০০৫ সালে রামকৃষ্ণ মিশন ইনস্টিটিউট অফ কালচার কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নেন যে পুরনো এই শ্বেতপাথরের মূর্তিটি বদলে ফেলা দরকার, কেননা গোলপার্ক ও দক্ষিণ কলকাতা শহুরে পরিবেশের সঙ্গে পুরনো মূর্তিটি এই পার্কে মোটেই মানানসই নয়। এবং এখানে আরও বড়ো একটি মূর্তি স্থাপন করা হোক। কেননা সমীক্ষায় দেখা গেছে এই অঞ্চলের আকাশচুম্বী বাড়িগুলির পাশে মূর্তিটিকে খুব ছোটো মনে হয়।
এর পর মিশন সদস্যরা কলকাতা পৌরনিগম কতৃপক্ষের কাছে লিখিত ভাবে এই অঞ্চলের রামকৃষ্ণ মিশনেরে ঐতিহাসিক গুরুত্ব বিবেচনা করে শহরের স্বার্থে স্বামী বিবেকানন্দের একটি আরও বড় মূর্তি প্রতিষ্ঠা করার প্রস্তাব দেন। কলকাতা পৌরনিগমের তৎকালীন মহানাগরিক সুব্রত মুখোপাধ্যায় পরিস্থিতি বিচার করে এই মূর্তি বানানোর ছাড়পত্রও দেন। এই কাজের জন্য পরবর্তি পর্যায়ে কলকাতা কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে ব্রোঞ্জের বারো ফুট স্বামী বিবেকানন্দের মূর্তি বানানোর জন্য বারো কোটি টাকার বরাত দেওয়া হয় কলকাতার বিশিষ্ট ভাস্কর অনিত ঘোষকে। এর জন্য আট ফুট লম্বা একটি পেডেস্টালও তৈরি করা হয়। মার্বেলের পুরানো ভাস্কর্যের মায়া কিন্তু কাটিয়ে উঠতে পারেননি মিশন কতৃপক্ষ। সেই মার্বেল মূর্তিকে চিরতরে সরিয়েও ফেলবার মত সাহস কেউ দেখাতে পারেনি। সেই পুরানো বিবেকানন্দকে হয়ত ঐতিহাসিক গুরুত্বের কথা ভেবে নিয়ে আসা হয়েছে গোলপার্কের ভেতরে।
সব চেয়ে আশ্চর্যের বিষয় রামকৃষ্ণ মিশন কতৃপক্ষের কাছে বা কলকাতা পুরনিগম কতৃপক্ষের কারও কাছেই এই মার্বেল ভাস্কর্যের শিল্পীর কোন নথি নেই। বেশিরভাগ ভাস্কর্যের মত কলকাতার প্রথম স্বামী বিবেকানন্দের এই মূর্তিও নানা রকম ভাস্কর্যকলঙ্ক নিয়ে দিনের পর দিন শুধু ঐতিহাসিক কারনের দোহাই দিয়েই থেকে যাবে গোলপার্ক রামকৃষ্ণ মিশনের মত গুরুত্বপুর্ণ একটা জায়গায়। এই কলঙ্কের দায়ভার নীলকণ্ঠের মত বয়েও বেড়াতে হবে কলকাতা পুরনিগম কিংবা রামকৃষ্ণ মিশনকে। শিল্পীর নাম না জানায় শিল্পীর দায়বদ্ধতাও তাই শিকেয় তোলা রয়ে গেছে। এর পরেও কিন্তু আমরা শিখে উঠতে পারিনা এই ধ্রুব সত্য যে একটা শিল্প আর শিল্পীর শুধু নিজস্ব থাকেনা যখন তা জনগনের জন্য প্রদর্শিত হয়। জাগতিক নিয়মেই তা হয়ে ওঠে সার্বজনীন। শিল্পীকেই প্রথম নিতে হয় সেই শিল্পের ভালমন্দের দায়ভার। গোলপার্কের এই মার্বেলের স্বামী বিবেকানন্দের দায়বদ্ধতা স্রষ্টা ভাস্কর অস্বীকার করবেন কীভাবে। অথচ আজও প্রায় সব ক্ষেত্রে ভাস্কর্যের ফলকে শিল্পীর নামের বদলে উজ্জ্বল হয়ে থাকে সেই রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের নাম, যিনি উদ্বোধন করলেন এই মূর্তি। আমদের মত শিল্প চেতনাহীন অবার্চীনদের দেশে এই সংস্কৃতিই এখনও দস্তুর। এর একটা বড় কারন বোধ হয় আমাদের দেশে শিল্পের কথা ভেবে শিল্প তৈরির সংস্কৃতি আজও গড়ে উঠেনি, যা গড়ে উঠেছে তার সিংহ ভাগই রাজনৈতিক মুনাফার স্বার্থে।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴