বাগানিয়া জার্নাল – তৃতীয় ভাগ
পর্ব।। তিন।।
শিশির রায়নাথ
^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^
চার্লস আলেকজান্ডার ব্রুসের জন্ম ১১ই জানুয়ারী ১৭৯৩, স্কটল্যান্ডে। চার্লস দীর্ঘ ষাট বছর আসামে ছিলেন এবং ওখানেই মারা যান। তিনি অত্যন্ত ভালোভাবে অসমিয়া ভাষা শিখেছিলেন।
১৮০৯ সালে, তাঁর বয়স যখন মাত্র ষোল বছর, ‘উইন্ডহ্যাম’ নামে এক জাহাজে চড়ে রওনা দিয়েছিলেন ভারতবর্ষের দিকে।পথে ফরাসী লুঠেরারা সে জাহাজ আক্রমণ করে অন্যদের সঙ্গে তাকেও আটকে রাখে এক দ্বীপে। পরে বৃটিশরা গিয়ে লুঠেরাদের হারিয়ে তাদের উদ্ধার করে। সেখান থেকে তিনি ভারত তথা আসামে এসে পৌঁছন।
১৮২৪ সালে শুরু হয় প্রথম ইংগো-বর্মী যুদ্ধ।
সেসময়ে ডেভিড স্কট ছিলেন গভর্নর-জেনারেলের উত্তর-পূর্ব সীমান্ত অঞ্চলের প্রতিনিধি (Agent)। চার্লস ব্রুস তাঁর অধীনে নৌ-সেনাবাহিনীতে যোগ দেন এবং ক্রমে গান-বোটের কমান্ড্যান্ট হন। তাকে পাঠানো হয় সাদিয়া অঞ্চলে।
নৌ-বাহিনীতে চাকুরিরত অবস্থাতেই চার্লস দাদার কাছ থেকে জানা জংলি চা-গাছ খুঁজে বেড়াতেন চারিদিকে। অবশেষে একদিন দাদার পরিচিতির সূত্রে সিংফোদের কাছ থেকে এক নৌকা (canoe) ভর্তি চা-চারা ও বীজ নিয়ে এসে স্কট এবং আসামের অন্যান্য অফিসারদের (যারা চা নিয়ে উৎসাহী ছিলেন), এমনকি কলকাতার অফিসারদের কাছেও, পাঠান।
স্কট যখন আসামের জংলি চায়ের কথা জানতে পারেন তখন তিনি সে খবরের উৎস হিসেবে চার্লস বা অন্যদের নামগুলো চেপে দেন; বদলে ১৮২৫,১৮২৬ এবং আবার ১৮২৭ সালে তিনটি ভিন্ন ভিন্ন জায়গা থেকে- রংপুর(শিবসাগর), সম্ভবত মনিপুর এবং চিনের ইউনান সীমান্ত অঞ্চল থেকে জংলি চায়ের শুকনো পাতা সংগ্রহ করে ওয়ালিচ সাহেবকে পাঠিয়ে তাদের পরিচয় জানতে চান।
কিন্তু ওয়ালিচ সাহেব সেগুলোকে চা হিসেবে চিনতে পারেন নি। আসলে তাঁর বদ্ধমূল বিশ্বাস ছিল যে সত্যিকারের চা গাছ শুধুমাত্র চিন দেশেই জন্মায়। তাছাড়া তিনি তাঁর কাছে পাঠানো ‘নমুনা’ ভালোভাবে যাচাই করার জন্য সেইসব গাছের ফুল ও ফল দেখতে চান নি। তাই গাছগুলোকে ‘ক্যামেলিয়া’ বলে মেনে নিলেও তাদের ‘চা গাছ’ বলতে তিনি নারাজ ছিলেন। ফলে চায়ের জন্য ভারতবর্ষকে আরও বেশ কয়েকটা বছর অপেক্ষা করতে হল।
১৮৩০ সালে এ্যান্ড্রু চার্লটন লেফটেন্যান্ট হিসেবে আসামে এলে ইতিহাসের এক নতুন অধ্যায় শুরু হয়।চার্লটন ডাচ ইস্ট ইন্ডিজে (ইন্দোনেশিয়া) কাজ করার সুবাদে চা-গাছ চিনতেন। তিনি দেখলেন পূর্ব- আসামের সাদিয়ার আশেপাশের পাহাড়ি ঢালে প্রচুর চা-গাছ আছে।
নিজের মালির কাছ থেকে কীকরে চা-গাছ বড় করে তুলতে হয় সেসব জেনে, আসাম-চায়ের চারা সংগ্রহ করে জোরহাটে নিজের বাংলোতে লাগান। চার্লটন চারটে চা-চারা কলকাতায় ড.জন টেইলার(Dr John Tytler)-কেও পাঠালেন। টেইলার সেগুলো বোটানিকাল গার্ডেনে লাগিয়েছিলেন। কিন্তু চারাগাছগুলোকে বড় করে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার আগেই সেসব শুকিয়ে মরে গেল।কপাল!!!
১৮৩১ সালে কলকাতায় গিয়ে চার্লটন ড.টেইলারের মাধ্যমে সেই গাছের চারটি চারা এগ্রিকালচারাল এ্যান্ড হর্টিকালচারাল সোসাইটিকে উপহার দ্যান।কিন্তু তার সে উপহারকে গুরুত্ব দেওয়া হয় না। চারাগাছগুলো নাকি অতিরিক্ত ছোট। আবার কপাল !!!
ততদিনে আসাম পুরোপুরি বর্মী-মুক্ত হয়ে বৃটিশ-রাজের অধীনে এসে গ্যাছে। সরকারি নির্দেশে ক্যাপ্টেন জেনকিন্স (Francis Jenkins- পরে মেজর জেনারেল হয়েছিলেন) ছয় মাসের জন্য (অক্টোবর’৩২ – এপ্রিল’৩৩) আসামে এসে ব্যাপক জরীপ করেছিলেন। ১৮৩৩ সালের শুরুর দিকে চার্লস ব্রুস তাঁকে একান্ত সাক্ষাৎকারে এবং খোলা চিঠি লিখে জানিয়েছিলেন যে আসাম জুড়েই জংলি চা-গাছের বেশ বাড়-বাড়ন্ত। জেনকিন্স সাহেব চার্লটন সাহেবের কাছ থেকেও আসামের জংলী চা-গাছের কথা জেনেছিলেন। তিনিও খুব জোরের সঙ্গে টি-কমিটিকে আসামই চা-চাষের উপযুক্ত জায়গা বলে জানান। কিন্তু তখনও কমিটির ঘুম ভাঙে নি।
অবশেষে ১৮৩৪ সালের নভেম্বর মাসে চার্লটন ফল সমেত কিছু গাছ আবার পরীক্ষার জন্য ওয়ালিচ সাহেবকে পাঠান – এবং এবার, সমস্ত বৃটিশ সাম্রাজ্য উত্তেজনায় দাঁড়িয়ে পড়ে।
ওয়ালিচ সাহেব জানান যে আসামের ‘ক্যামেলিয়া’ সন্দেহাতীত ভাবে চিনা চায়ের মতই সত্যিকারের চা-গাছ। ৬ই ডিসেম্বর,১৮৩৪ সালে ওয়ালিচ সাহেব ‘টি কমিটি’কে লেখেনঃ ‘I humbly submit that a more interesting and more valuable fact has never before been brought to light in Indian Agriculture than has been established beyond all dispute by Lieut. Charlton.’
ওয়ালিচ সাহেবের মতামতের পরেই সবকিছু দ্রুত ঘটতে লাগল।
আসামে প্রাকৃতিক ভাবে সত্যিকারের চা-গাছ জন্মায় – এটা জানার পরেই ‘টি-কমিটি’ বুঝতে পারে যে মাটি,জলবায়ু ইত্যাদির ভিত্তিতে আসামই চা-চাষের ক্ষেত্রে সবচেয়ে উপযুক্ত(দার্জিলিং তখন সদ্য বৃটিশদের হাতে আসতে চলেছে)। তবে সেখানকার জংলি, স্বাভাবিক ভাবে জাত চাগাছের পাতা থেকে কেমন চা তৈরি হবে – সে সম্পর্কে তাদের কোন ধারনা ছিল না। ধারনা ছিল না চিনারা বা সিংফোরা কী ভাবে চা-বানায় সে সম্পর্কেও । তাই আসামকে চা-চাষের জন্য বেছে নেবার পর প্রথমে চিনা চা-গাছকে ‘ভারতীয় করে তোলার (Indianize)’ চেষ্টা করা হয়েছিল অর্থাৎ আসামে চিনা চাগাছ চাষের পরিকল্পনা করা হয়।এই উদ্দেশ্যে সেসময়ে ‘টি কমিটি’-র সেক্রেটারী জর্জ জেমস গর্ডনকে চিনে পাঠানো হয়েছিল খাঁটি চিনা চারাগাছ ও বীজ জোগাড় করে আনার জন্য। সঙ্গে চা-চাষ ও পাতা-থেকে-চা-তৈরি সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান অর্জন এবং যত টাকা লাগুক পটিয়ে পাটিয়ে চিনা চা-কারিগরদের (Tea-maker) ভারতে নিয়ে আসার জন্য।
একই সঙ্গে এমন একজন মানুষের খোঁজও চলছিল যে আসামে চা-চায়ের ব্যাপারে কিছু দিশা দেখাতে পারে।
#
সেসময়ে আসাম ছিল ঘন জঙ্গলে ভর্তি। লম্বা লম্বা গাছ, খাগড়া আর ১০-১৫ ফুট লম্বা জলজ ঘাসে পরিপূর্ণ।মানুষের পক্ষে সেখানে প্রবেশ করা প্রায় অসম্ভব। বিভিন্ন রেকর্ড থেকে দেখা যায় (বুনো) মানুষদের থেকেও হিংস্র জন্তু-জানোয়ারে ভর্তি ছিল সেসময়ের জঙ্গল। পাশাপাশি, মহামারী ও অন্যান্য সংক্রামক রোগের তীব্র প্রাদুর্ভাবে এবং বর্মীদের ঘন ঘন আক্রমণে গ্রামবাসীরাও নিজেদের ঘরবাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিল অন্য জায়গায়। ফলে জঙ্গল এবং তার আশেপাশে প্রচুর পরিত্যক্ত বাড়িঘর ও প্রার্থনাঘর ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল।
চার্লস, দুজন সঙ্গী নিয়ে, সেসব জঙ্গল – যেমন বীরাকুলাম, তেরাপানি, কুঞ্জি, নিংগো, রানগাগারা ইত্যাদি-ঘুরে বেড়িয়েছিলেন চা-গাছ খুঁজতে। তিনি আফিম ঘুষ দিয়ে সিংফোদের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে তুলেছিলেন।সিংফোরা প্রথমে তাকে চা-গাছ দেখাতে চায় নি। কিন্তু চার্লস সুকৌশলে তাদের কাছ থেকে চা-গাছের সন্ধান ও চা-তৈরির কায়দা জেনে নিয়েছিলেন। জংলি চা-গাছগুলো কুড়ি থেকে চল্লিশ ফুটের মত লম্বা হত। সিংফোরা হাতির পিঠে চড়ে বা গাছে উঠে তার কচি পাতা সংগ্রহ করত।
[যদিও চার্লস আফিম দিয়ে সিংফোদের খুশী করে এসব কাজ হাসিল করেছিলেন – তিনি কিন্তু আফিম-নেশার বিরোধী ছিলেন।তিনি আসামবাসীদের সত্যিকারের পছন্দ করতেন এবং লিখেছিলেন –‘ আফিমের নেশা আসামবাসীদের ভারতের সব জাতির চেয়ে নিকৃষ্ট, ভীতু ও অকর্মণ্য বানিয়ে দিয়েছে। যদি আমাদের সচেতন সরকার আসামকে বাঁচানোর জন্য এই কু-অভ্যাস বন্ধ করতে পারে – তাহলে তারচেয়ে ভালো কাজ কি আর কিছু হতে পারে?’]
শারীরিক দিক থেকে চার্লসের ছিল লোহার শরীর।যেমন শারীরিক শক্তি তেমনই অদম্য মানসিক জোর। তিনি চা-গাছের খোঁজে পাহাড়-জঙ্গলে শয়ে শয়ে মাইল পায়ে হেঁটে চষে বেড়িয়েছিলেন। চা-গাছের স্বভাবচরিত্র ভালোভাবে জেনে একটা ‘হ্যান্ডবুক’ও বানিয়েছিলেন। চার্লস বুঝতে পেরেছিলেন যে আসাম-চা চিনা-চায়ের থেকে অনেক ভালো।