বাংড়ি তিতি ও হাউড়ি শেষে
পর্ব-১৯
মিশা ঘোষাল
************************
'টোটোপাড়া' ও 'কালিখোলা' ঝোরার কাহিনি
'কালিখোলা'
একটি ঝোরার নাম। নেপালি ভাষায় 'খোলা' শব্দের অর্থ হল 'ছোট নদী' বা
'ঝরনা'। ভুটান পাহাড় থেকে নেমে আসা একটি দূরন্ত ঝরনা হল 'কালিখোলা'। এই
প্রবল জলস্রোতের ধারা পাথরের খাড়া পাহাড়ের ঢাল বেয়ে যখন টোটোপাড়ায় বাজার
লাইন পেরিয়ে পূজাগাঁওকে পাশে রেখে, পোয়ারগাঁও যাবার রাস্তাটিকে আড়াআড়িভাবে
পার করে টোটোপাড়া থেকে তোর্ষার দিকে ছুটে যায়, তখন এর নাম হয় 'কালিখোলা'।
অবিরাম
ঝরে পড়া এই ঝর্ণার নির্মল জলধারা টোটোপাড়ার উপর দিয়ে নীচে চলে যায়,
অবশেষে পাহড়ের গা বেয়ে সমতলে এসে তোর্ষার জলস্রোতে গিয়ে মেশে।
টোটোপাড়ায়
এই 'কালিখোলা' পেরিয়ে একটু এগিয়ে গেলেই এসে পড়ে টোটোদের 'ডেমসা' বা
টোটোদের মন্দির। টোটোরা এই 'কালিখোলা'কে দেবী রূপে পূজা করে। তাঁরা এই
'খোলাটি'কে 'গুয়াটি' বা 'গোয়াটি'
নামেও ডাকে। পবিত্র
এই ঝর্ণার জলে ফলমূল নিবেদন করে টোটোদের 'গুয়াটি' পূজার পরই টোটোপাড়ায়
উৎপন্ন সমস্ত রকম ফলমূল মুখে তোলা যায়। গুয়াটি পূজা না হলে তাঁদের নিজেদের
গাছের ফলমূলও মুখে তোলা নিষিদ্ধ।
টোটোপাড়ায়
বসবাসকারী নেপালিরা এই ঝরনাটিকে 'কালিখোলা' বলে ডাকে, আর টোটোরা বলে
'গুয়াটি'। ফল পাকলে বছরে একবার এই গুয়াটি পূজার আয়োজন করা হয় টোটোপাড়ায়।
মেয়েরা এই পূজায় অংশ নিতে পারে না।
টোটোপাড়ার মরসুমি কিছু ফলের গাছ আছে। সেই গাছের ফলগুলি যেমন-
কমলালেবু,
মুসাম্বি, বাতাবি লেবু, ছোটো লেবু (টোটো ভাষায় যাকে 'জামসে' বলা হয়),
কাগজী লেবু, পাতি লেবু ইত্যাদি। এসব দিয়ে এই কালিখোলায় পূজা নিবেদন করা হয়।
প্রকৃতির পূজারী টোটোরা এই ঝোরাটিকে দেবতা জ্ঞানে পূজা করেন। টোটোদের
পূজারী বিজলে টোটো এই ঝোরায় ফলমূল নিবেদন করে ভাসিয়ে দেন জলে। প্রথমটায়
টোটোদের পবিত্র পানীয় 'ইউ' সেবন চলে ঝোরার জলের কিনারায়। পূজারী ও ভক্তদের
সমবেতভাবে 'ইউ' পানের পর ফলমূলের সাথে 'মুকুলালে' নামের জঙ্গল থেকে ধরে আনা
এক বিশেষ প্রকারের পোকার রক্ত ও মাংস দিয়ে পূজা নিবেদন করা হয়। এই
'গুয়াটিতে' আরও বলি দিতে হয় একটি শূকরকে। ফলমূল, 'মুকুলালে' ও 'শূকরের'
রক্ত দিয়ে কালিখোলায় 'গোয়াটি' পূজার নৈবেদ্য সাজিয়ে ঝোরার জলে অর্পণ করেন
টোটোদের পূজারী।
এই জংলি 'মুকুলালে' মানুষকে কামড়ে
দিলে বিষক্রিয়া না হলেও রক্তপাত হয় প্রচুর। টোটোপাড়ার জঙ্গলে থাকা এই
'মুকুলালে' দেখতে অনেকটা কাঁকড়ার মতো। হাত পা এদের কাঁকড়ার মতো। এরা খুব
দ্রুত শরীর থেকে একপ্রকার লালারস উৎপন্ন করতে পারে যা দিয়ে এবং খুব
তাড়াতাড়ি এই লালারসকে কাজে লাগিয়ে নিজেরাই নিজেদের চারিদিকে একটি বাসা
বানিয়ে নিতে পারে। এই নির্গত রস দ্রুত শুকিয়ে গিয়ে রসি বা সুতোয় পরিণত হয়,
ফলে অনেক রসির এই আস্তরণ যা দিয়ে একটি বাসা বানিয়ে নিয়ে অভয়ারণ্যের লতা ও
গাছের ডালে বা পাতার আড়ালে ঘর বানিয়ে আত্মরক্ষামূলক আচ্ছাদন তৈরি করে নিতে
পারে এই 'মুকুলালে'। এমনকি তাদের এই লালারসের/দেহ নিঃসৃত রসের দ্বারা
নির্মিত বাসস্থানে অন্য কোনো পোকামাকড় এসে পড়লে ঐ জালে ফেঁসে গিয়ে আটকে
যায়। তারপর 'মুকুলালে' ঐ আটকে যাওয়া পোকামাকড় দ্রুত আত্মস্থ করে তার থেকে
নিজের প্রোটিন জাতীয় খাদ্যের অভাব পূরণ করে। এই 'মুকুলালে' কাঁকড়া জাতীয়
একটি খাবার। এই বিষয়ে ভবেশ টোটোর কাছে বিস্তারিত জানতে চেয়েছিলাম। ভবেশ
টোটো পশ্চিমবঙ্গের আলিপুরদুয়ার জেলার আদিবাসী কল্যাণ দপ্তরের কর্মী।
টোটোপাড়ায় ওনার হোম-স্টেও রয়েছে। তাছাড়া টোটোপাড়ায় যে সরকারি আবাসনটি(
Cottage, B.C.W.Department, Govt.Of W.B.) রয়েছে সেখানকার দায়িত্বপ্রাপ্ত
কর্মীও তিনি।
টোটোদের 'নাইয়ু' পূজার পর এই ঝোরার জলে
ফলগুলি নিবেদন করে গুয়াটি পূজা করে ওরা। ফলমূল ও ইউ নিবেদন করার পর শূকর
বলি দিয়ে এই ঝোরার জলে শূকরের রক্ত দিয়ে পূজা সম্পন্ন করা হয়। 'মুকুলালে'ও
থাকে প্রসাদ হিসেবে। গুয়াটি দেবতা প্রসন্ন থাকলে সারা বছর আর টোটোদের তথা
টোটোপাড়ায় কোনো সমস্যা থাকে না এমনটাই মানা হয়। অরণ্যের নিভৃতে, ঝোরার
জলে আদিম টোটোদের এই জঙ্গলের লেবু জাতীয় ফল সহযোগে জংলি পোকা 'মুকুলালে' ও
'শূকরের'রক্ত নিবেদন-
এক আদিম পরম্পরারই নিদর্শন!
তবে টোটোরা এই পূজায় দুটি দল বা গোত্রে ভাগ হয়ে এই গুয়াটি পূজায় অংশগ্রহণ করে।
গুয়াটি
পূজার পরই টোটোরা কোনো ফলের রসাস্বাদন করতে পারে। টোটোপাড়ায় এক বিশেষ
প্রকারের লেবু জাতীয় ফল হয়। এই লেবুটি জামবুড়ার চেয়ে একটু ছোটো মুসম্বির
চেয়ে একটু বড়ো হয়। এই ফলটিকে টোটোরা 'জামসে' বলে চেনে। এইই ফলগুলি গুয়াটি
ঝোরায় নিবেদন করে পূজা অর্পণ করে টোটোদের পূজারী। বর্তমানে 'বিজলে টোটো'
এই গুয়াটি পুজোর দায়িত্বে রয়েছেন। টোটো মেয়ে ও বৌদের এই পূজায় অংশগ্রহণ ও
দর্শন কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। কালিখোলায় এসে টোটোদের 'ইউ' পান ও 'গুয়াটি' পূজা
চলে প্রতি বছরই অগাস্ট/সেপ্টেম্বর মাসে।
এই গুয়াটি
পূজা হয়ে গেলে টোটোরা টোটোপাড়ার 'ডেমসাতে' নাচ গানের অনুষ্ঠানে মেতে ওঠে
মাদলের তালে তালে। টোটো পূজার উৎসব 'নাইয়ু' তে মেতে ওঠে টোটোরা তখন।
ই'উ' পান করে গুয়াটিতে ফলমূল নিবেদনকে টোটোরা বলে,"সাঙাই"...
কালিখোলায় ঝোরার দেবীকে ফল দান করে এসে নেপালিরা বলে,
"ভাকাল' করা হয়ে গেল, এখন ফলমূলের রসের স্বাদ নিতে পারব"...
প্রথম ফল নিবেদন করে বিজলে টোটো (টোটোদের পূজারী) গোয়াটিতে। ও 'দেরসে' বা বড় লেবু দিয়ে পূজা অর্পণের পর 'ইউ' পান করতে থাকে।
টোটোপাড়ার
কালিখোলায় পূজা করার আগে কোনো ফল গাছ থেকে ছিঁড়তে দেওয়াও হয় না এখানে।
খাওয়াও যায় না 'সন্তরা' বা কমলা... 'জামসে' বা ছোট লেবুও না !
গোয়াটিতে 'ভাকাল' করলেই খাওয়া যায় এসব।
বর্তমানে কিন্তু 'মানকা' পূজার পর পরই খাওয়া শুরু করে দেয় এখনকার টোটো ছেলেমেয়েরা। বড়রা 'গোয়াটি'তে পূজার পরই খায়।
আগে নাইয়ু পূজার পর খাওয়া হত টোটোপাড়ায় উৎপন্ন ফলমূল।
'মুকুলালে', যা দিয়ে 'গোয়াটি'তে পূজা করা হয় সেটি আসলে জঙ্গলের একটি জীব। একটি বড় মাপের পোকা।
এই পোকার শরীর থেকে এক রস বের হয়, তা দিয়ে তারা ঘর বানিয়ে নিতে পারে।
পোকা মাকড় ফেসে গেলে 'মুকুলালে' ঐসব পোকামাকড় খুব সহজেই ধরে খেতে পারে।
অবাক কান্ড এই যে, 'মুকুলালে' ওর শরীর থেকে নির্গত রস দিয়ে ওর গতিপথে অনবরত ইংরেজিতে লিখে রাখে !
অর্থাৎ
যেভাবেই ও দিক পরিবর্তন করে চলে, তার সাথে সাথেই ওই নির্গত রসের সাহায্যে
ইংরেজি হরফে অনবরত কিছু লেখা ভেসে ওঠে! ( the regular secretion of fluid
from 'Mukulale' makes images of 'English' alphabets)
এটি নিঃসন্দেহে টোটোপাড়ার একটি আশ্চর্য বিষয় !
এই
'মুকুলালে' টোটো ও নেপালীরা রান্না করে খায়। কড়াইতে তেল দিয়ে ভাজা করে
খাওয়া হয় এই 'মুকুলালে'। খেতেও নাকি বেশ ভালো। কাঁকড়ার মতো দেখতে অনেকটা এই
'মুকুলালে'।
পা হাত কাঁকড়া র মতো করে চলে জঙ্গলের লতা পাতায়। কামড়ে দিলে রক্ত বের হয়।
কালিখোলা ঝোরায় দুইটি মন্দির বা পুজোর স্থল রয়েছে। 'মাইসি' ও 'দেইশি'...
'মাইসি' বলতে টোটোদের একটি গোষ্ঠীকে বোঝায়।
টোটোদের
এই 'দেইশি'র মধ্যে যারা পড়ে তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন শচীন টোটো,
ইন্দ্রজিৎ টোটো প্রমুখ ব্যক্তিরা। পূজারী বিজলে টোটোও 'মাইসি'দের
অন্তর্ভুক্ত।
এই দুই গোষ্ঠীর পূজা আলাদা আলাদাভাবে
কালিখোলায় করা হয়। পূজারী একই থাকে।পূজার আগেই পূজারী ও ভক্তবৃন্দ সবাই
একত্রে 'ইউ' পান সেরে নেয়। মেয়েদের কিন্তু এই ঝোরার কাছে আসা একেবারেই
নিষেধ থাকে তখন।
'মাইসিদে'র মধ্যে আছেন কালিচরণ টোটোও।
টোটোপাড়ার উপপ্রধান রূপচাঁদ টোটো 'দেইশি'-'দেঙ্গত্রোবি' গোষ্ঠীর।
এই কালিখোলাকে নিয়ে অনেক কাহিনী আছে। সে কাহিনী অনেক কালের পুরোনো। সেই সময় এই কালিখোলার জঙ্গলে একটি অলৌকিক কান্ড ঘটেছিল।
মনস্কামনা সিদ্ধির জন্য পূজা দিতে এসে উমেশ টোটো আর কল্পনা টোটো হঠাৎই এই কালিখোলার গভীর জঙ্গলে নিখোঁজ হয়ে যায়...