পইলা সাঞ্ঝির কথা/১৯
পইলা সাঞ্ঝির কথা
পর্ব : ১৯
শুক্লা রায়
÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷
যাত্রা পূজা
বালতির মধ্যে গোবরজল গুলে উঠোন লেপা হচ্ছে। এই কাজটি সেই ভোর থেকেই চলছে। সকাল হতে হতেই রসবালা এসব শেষ করে দা, কুড়ুল, বাসিলা, কোদাল, ছেনি থেকে কাটারি, নারকেল কুড়ুনী সব ধুয়ে ধুয়ে উঠোনের তুলসীমঞ্চের কাছে কলাপাতায় রাখে। দুটো কলার ঢোনায় একটাতে সিঁদুর অন্যটাতে খড়িমাটি গুলে রাখে। বাড়ির প্রায় সব জিনিসপত্র, ঘরের কপাট, চৌকাঠ, আসবাব, তুলসিমঞ্চে সুন্দর করে ফোঁটা দিতে হবে।
"ঠাকুরের কত যে নিয়াম',
রসবালা কাজ করতে করতে আপন মনে ভাবে। কাজ করলে কি হবে, মুখটা বন্ধ নেই। হাতের সাথে সাথে মুখও চলছে। সুষেণের বাপ এসব দেখে শুনে আস্তে করে ছেলেকে বলল,
"তোর মার মুখ আর হাত সামান চলে দেখং মুই।"
আস্তে বললেও রসবালার কান খুব খাড়া। মুখ মুচড়িয়ে বলল,
"তে তোমারে মতোন। খালি মুখখানে সামানে চলে, হাতগিলা তো নড়ে না। বাড়িত নইলে তোমরা খ্যারখান চিড়ি দুইখান না করেন।"
সুষেণের বাপ হাসে।
"মুখখানে হইল আসল বুজলু! কতলা মানষি মুখ চলেয়ায় খায়। হর আও করিই তিন সইঞ্জার খাবার জোটায়। হয় না বাউ?"
ছোটছেলে সকালেই কোথাও বেরিয়েছে। বড়টাও এদের ততটা পাত্তা না দিয়ে গামছা একটা কোমরে বেঁধে বেরিয়ে গেল। পেছন থেকে রসবালা চেঁচাল,
"কোটে যাইস? দোনো দেওয়ানী তো আপনকার মনে বেরাছেন, মোর ওইলা জিনিস কায় কোনেক জোগাড়-যন্ত্র করি দেয় শুনোং? গরু-বাছুর ছাগল-ছেলি নইল কিন্তুক পড়িয়া। দেখিম এলায়।"
"আনেছে বাচ্চাবাউ"
"তোর পিসাইক দিয়া আসির কইস ওদি। দাদা আরো কোটে দৌঁড়াবে তোমরা ভাতিজাগিলা থাইকতে।"
তবে মুখে বললেও বসমতী জানে যাত্রাসী গাছের পাতা আনবে যখন ওর পিসির জন্যও নিশ্চয় আনবে।
বাইরে বেরিয়ে ভাইকে আড্ডা দিতে দেখে সুষেণের মাথা গরম হয়ে গেল।
"কি বাউ তুই এঠে বুড়া মানষিলার নগদ আড্ডা দিছিত, ওইলা আনিবু না? যাত্রাসীর পাত?"
বুধেশ্বরের বাপ উল্টে সুষেণকেই ধমক দিয়ে বলে,
"বুড়া দেখি কি হামরা মানষি না হোই বাফোই? বুড়ালা যেগিলা কাথা জানে তোমরাল্লা হুলা কোনোই না জানেন। কও তো আজি যে এইলা পূজা দেছেন, হিটা কেনে করেছেন?"
বটতলায় বানিয়ে রাখা বাঁশের তৈরি বসার জায়গাটায় বেশ কয়েকজন বসে আছে। জায়গা না থাকলেও বুধেশ্বরের বাপ ডাকে,
"এদি আয়, বইস। হামারে বাড়িত মেলা যাত্রাসী গছ, বাড়িটা যাত্রাসী দিয়ায় ঘিরিসি, দেখিন্নাই? কতলা নাগে নিগাইস এলায়।"
সুষেণ একটু লজ্জিত হয়। থতমত খেয়ে বলে,
"নাহয় বারে, মাও এখেরে আতলাছে। কও তে তোমাল্লার কাথা কোনেক শুনোং। হামরা যেলা বুড়া হোমু হামরাও হামার নাতি-পুতিক কোমু বারে!"
বুড়া খুশি হয়। খালি বুকের পাঁজর ক'খানার উপর কয়েকবার হাত বুলায়, গলার পৈতেটা ঠিক করে নেয়। তারপর বলে,
"অ্যায় যে আজি হামরা পূজা করিমু দাও, কুড়াল, বাসিলা, কাটাই, কোদাল আদি হইতে নাঙল, যোঙাল ঘরের যতোমন কাজের জিনিসখান আছে সোগাকে। কেনে কোরিমু?"
একজন সবজান্তা সবখানেই থাকে। শুকারু অতি আগ্রহে বলে ফেলে,
"কেনে আরো, বিশ্বকর্মাক দিমু। বিশ্বকর্মা তো দেবী মারে বেটার মতোন!"
বুধেশ্বরের বাপ যারপরনাই বিরক্ত হয়ে বলল,
"অ্যায় যে একখান কাথা কোলু না জানিয়া। তে বই-পত্রগিলা ফির কেনে পূজা করে আজি? হুলা তো মাও সরস্বতী? ঘরে ঘরে, ঠাকুরমারীত যাত্রাসীর পাত আর ভোপোলা কেনে বান্দির নাগে তে? হিটা এলা ভাঙি ক মোক। তুই যুদি কোবারে চাছিত।"
বোঝা গেল বুড়োর মনে আঘাত লেগেছে। সেজন্য বেশ উত্তেজিত। সবাই তাকে থামিয়ে দিল। বলল,
"হুটা চেংরা মানসির কাথা বাদ দ্যাও তো। তোমরায় কও, হামরা শুনি।"
ওখানে নগেনের শ্বশুর উপস্থিত ছিলেন। লোকে বলে এই বুড়াও আগের দিনের কথা আলোচনায় কম যায় না। উনি এতক্ষণ মুচকি মুচকি হাসছিলেন একা একাই। এবার মুখ খুললেন।
"ন্যাও তোমরা আগোত তোমার নিয়ামখেনা কও, সেলা মোর কাথা কইম এলায়।"
বুধেশ্বরের বাপ ওনার দিকে তাকিয়ে বলে,
"হুটা তো হয় বারে, একদেশে এক এক মোতোন নিয়াম।"
"কেনে, তুই কি এলা কাথা কইতে ভয় খাছিত ঠাউদ্দা?"
খচ্চর নাতির এ হেন খোঁচায় বুড়োর চোখদুটো জ্বলে উঠলেও সামলে নিলেন। ভাব করলেন এসব বালখিল্যদের কথায় কর্ণপাত না করাই শ্রেয়। গলাটা খাঁকরে নিয়ে শুরু করলেন,
"অ্যায় যে আজি সব যন্ত্রপাতি, বই-বস্তা সবেরে পূজা দিছি এইটা হইল আজি হামার মাতা চন্ডীর পূজা। এই পিথিবিত যত অস্ত্র আছে, সবে মাতা চন্ডীর। হামার শাস্তরের কাথা। আজি হইল মাতার পূজা আর কালি তো জানেনে, কালি হইল যাত্রা পূজা। কালি তো কম বেশি সোগায় হালযাত্রা করিবেন। নাহয়?"
একটানে কথা শেষ করে প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিয়ে বুড়ো নগেনের শ্বশুরের দিকে তাকালো। নগেনের শ্বশুর ততোধিক বৃদ্ধ। মেয়ের বাড়িতে এসেছেন গরুর গাড়ি চেপে। এখন আর বেশি দূর দূর হাঁটতে পারেন না। জমি-জমাওলা অবস্থাপন্ন মানুষ। ধম্মে-কম্মেও মন খুব। তবে অবস্থাপন্ন বলেই হয়ত গলায় একটা স্বাভাবিক কম্যান্ড কাজ করে। তিনি একটু নিচু গলায় শুরু করলেন। বার্ধক্যজনিত কারণে গলাটা সামান্য কাঁপলেও যথেষ্ট দৃঢ়।
"এইলা শাস্তরের কাথা অতটা না হয় বারে। এইলা হইল এই যে হামরা সারাবছর যেইলা কাজ করি আজি সেইলা জিনিসেরই পূজা। এইলা চলি আইসেছে হামার আগিলা দিন থাকি। এই দাও, কাটাই, বাসিলা, কুড়াল হইতে নাঙল, যোঙাল সবেরে পূজা। এইলা হামার আদি পুরুষ হইতে চলি আইসেছে। উমরায় শিকাইসে যেইলা জিনিস না হইলে হামার চলে না, ওইলাক এখেনা পূজা দিবার নাগে। হামার বাড়ি-ঘর সবলাকে ভগমানের মতোন দেখির নাগে।"
উপস্থিত সবাই মাথা নাড়ল। একজন বলল,
"কাথাগিলা হয় বারে। তা ভোপোলাটা কি ফির তায়? ভোপোলা কেনে বান্দে?"
"কেনে আরো!"
প্রশ্ন শুনে নিজেকে পুনরায় জাহির করির সুযোগ পেয়ে বুধেশ্বরের বাপ সে সুযোগ হাতছাড়া করতে চাইল না। কিন্তু নগেনের শ্বশুর এখানে উপস্থিত, বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষ। সেজন্য বলতে গিয়েও থমকাল। তারপর ওনার দিকে ফিরে বলল,
"তোমরায় কও বারে। তোমরা এঠে আছেন আগিলা দিনের মানষি, হামাল্লার থাকি তোমরা জানেন বেশি।"
কিন্তু নগেনের শ্বশুর মাথা নেড়ে সম্মতি দিয়ে বলল,
"কওখেনে, তোমরা কি আর কম জানেন?"
আসলে সম্মান পেলে সম্মান দিতে কুন্ঠিত হয় না লোকে। নগেনের শ্বশুরও তাই বুধেশ্বরের বাপকে জায়গা ছেড়ে দিতে দ্বিধা করল না। বুধেশ্বরের বাপ শুরু করল,
"হামরা যে বাড়ি-ঘরত থাকি, এইটা একটা হামার বাসস্থান, হামার মনে কর পবিত্র জাগা। এই বাড়ি-ঘরত আজি পূজা দিবার নাগে। তে দুধ দিয়া পূজিবেন, স্যাও দুধ বাছুরে খায়, আঁইঠা। ফুল দিয়া পূজিবেন স্যাও ফুলোত ভোমরা আর মৌমাছি মধু খায়, আঁইঠা। কিন্তুক শোলার ফুল আঁইঠা না হয়। শোলাক ওউদোত শুকিয়া তাহার পাছোত ফুল বানায়। তোমরালা এলা ভাবিয়া দ্যাখো! হয় কি না হয়!"
কথা শেষ করে নগেনের শ্বশুরের দিকে তাকালো। নগেনের শ্বশুরও মাথা নাড়ল।
"কাথা ঠিক।"
"তে এইলা ফুলোত অস কস নাই আর কি! বাসনাও নাই। খালি দেখিবার ঢক।"
ভিড়ের মধ্যে কেউ একজন বলে ওঠে। আলোচনা নিজের মতো ঘুরতে লাগল বিভিন্নভাবে। কিন্তু বেশিক্ষণ চলল না। সবারই ব্যস্ততা আছে আজকে। গরু-বাছুর, ছাগল, সমস্ত পোষ্যকে স্নান করিয়ে সিঁদুর পরিয়ে দিতে হবে। তাদের মুখেও ধরে দেওয়া হবে পুজোর প্রসাদ। কাজ কি কম? সুষেণ একটা ধমক লাগালো এবার,
"কি বাছা বাউ, মাও যে ডেকাছে? যা গরুগিলাক ধরি বড় বাড়ির ডিগি যা।"
"না যাও মুই ডিগি। তুই যাবার পাছিত না? কালি হালযাত্রা করিবে কায়? তুইয়ে না তে করিবু?"
"মুই হালযাত্রা করিম দেকি মোকে গরুগিলাক গাও ধোবার নাগিবে? যা আগোত বাড়ি, মাক কয়া দেছোং।"
এদের ঝগড়ার মাঝখানে বুধেশ্বরের বাপ নগেনের শ্বশুরকে জিজ্ঞেস করল,
"তোমার ওদি হালযাত্রার আলদা নিয়াম থাকিলে কওখেনে বারে, শুনি।"
নগেনের শ্বশুর একটু অবাক হয়ে এবং গলায় কিছুটা তাচ্ছিল্য মিশিয়েই বলল,
"হালযাত্রার আরো কি নিয়াম বারে, একে না। গরুগিলাক খোয়া-দোয়া হালযাত্রা করির নাইগবে। কলার ঢোনাত করি একেনা ভাসার মতোন বানেয়া, ওঠে একেনা পুঁটি মাছ নাগে, দেওয়ারী গোছা, ধূপ ধরেয়া পূজাখেনা দিয়া গরুর ঠ্যাঙোত জল দিয়া এই আড়াই পাক ঘুরি দিলেই না হয়া গেল হালযাত্রা করা। তোমাল্লার কেমতোন?"
বুধেশ্বরের বাপ উত্তর দেবার অবকাশ পেল না, দূর থেকে রসবালার খ্যানখেনে রাগ রাগ গলা ভেসে এল,
"বাছা বাউ, বড় বাউ! নন, আজি তোমরা আইসো আগোত বাড়ি, তোমাক আজি আতিত খাজা খোয়াইম এলায়। মাও রে মাও, এলাক্ষণে গেইসে, এলাও বাড়ি আইসে? আর গরু-বাছুরগিলা আগদোরোত কেমন চায়া আছে? ইমাক কোনেক দেখির নানাগে আজি? তোমার ঝুনি বাড়ি চাপিবার সোমায়ে নাহয়, আইসো আগোত।"
এই দীর্ঘ বাক্যবাণ সবাইকেই সচেতন করে ফেলল। ধীরে ধীরে পুরো বটতলাই ফাঁকা হতে সময় লাগল না।
.............................................................
যাত্রাসী - এক ধরণের বেড়া গাছ
ভোপোলা - শোলার ফুল
ডিগি - পুকুর
'দেওয়ারী-গোছা' - মাটির প্রদীপ
.............................................................
ছবি - বনিশা মাঝি
তথ্য ঋণ - দীনবন্ধু রায়
পুন্ডিবাড়ি, জুড়াপানি
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴