দাঁড়াবার জায়গা/উনিশ
সমর দেব
^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^
ক্লাস
এইটে পড়াকালেই একদিন গভীর রাতে অসহ্য পেট ব্যথায় ঘুম ভেঙে যায়। সারা
জীবনে নানাভাবে শারীরিক যন্ত্রণার অভিজ্ঞতা হয়েছে। কিন্তু সেই সময়ের পেট
ব্যথার সঙ্গে কোনও তুলনাই চলে না। কী ভয়ানক, অসহ্য সে যন্ত্রণা। দিনরাত
অবিরত যন্ত্রণা। সকলের সঙ্গে খেতে বসি ঠিকই কিন্তু খেতে পারি না। বিছানায়
শুয়ে পেটে বালিশ চেপে যন্ত্রণা সহ্য করার চেষ্টা করি আর মাঝে মাঝে জল খাই।
তৃতীয় দিন ব্যথা সহনশীলতার সব মাত্রা ছাড়িয়ে গেল। আর পেরে উঠছি না। টয়লেটে
গেলাম পরপর কয়েকবার। কিন্তু যা বেরিয়ে এল তাতে আমার ভয় করতে শুরু করল, ঘন
কালো পিচের মতো কিছু। ততক্ষণে বুঝে গেছি আমার ভয়ানক কিছু হয়েছে। পিঠোপিঠি
দিদিকে চুপি চুপি বললাম ব্যাপারটা। এবারে সেও ভয় পেয়েছে। কারণ, অল্প
কিছুদিন আগেই পাড়ার একজন মারা গেছে, যার কালো পিচের মতো পায়খানা হয়েছিল
মাত্র কয়েকবার। বাড়িতে জানাজানি হয়ে গেলে আমাকে হাসপাতালে (এমজেএন
হাসপাতাল) নিয়ে যাওয়া হলো। ডাক্তার দেখে-শুনে ভর্তির কথা বললেন। সঙ্গে
সঙ্গেই আমাকে নিয়ে যাওয়া হলো হাসপাতালের বেডে। দ্রুত ছুটে এলেন দুজন নার্স।
পরপর বেশ কয়েকটা ইঞ্জেকশন দেওয়া হলো। ডানহাতের কনুইয়ের উল্টোপিঠে লাগিয়ে
দেওয়া হলো স্যালাইনের সূঁচ। আমার ডানপাশে লোহার একটি স্ট্যান্ডের ওপর থেকে
ঝুলতে থাকল স্যালাইনের বোতল। দেখতে পাচ্ছি, সরু নলের মধ্য দিয়ে ফোঁটায়
ফোঁটায় নেমে আসছে তরল। আমি ততক্ষণে ভেবলে গেছি। প্রেসক্রিপশন নিয়ে মেজদা
ছুটে গিয়ে অনেকগুলো ওষুধের বোতল, প্যাকেট ইত্যাদি নিয়ে এলো। আমার বিছানার
চারপাশ ঘিরে দাঁড়িয়ে দাদা-দিদিরা। কেউ কেউ মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকল।
ওরা নিজেদের মধ্যে নানা কথা বলছিল। তবে, সেসবে আমার কান ছিল না। আমি
একদৃষ্টিতে তাকিয়েছিলাম স্যালাইনের বোতলের দিকে। হাতে যান্ত্রণাও হচ্ছে
খুব। নার্স দিদি আবার সেই হাতের নীচে একটি সবুজ শক্ত কিছু রেখে বেঁধে
দিয়েছে হাতটা, ফলে নাড়ানোর ক্ষমতা নেই। চিত হয়ে শুয়ে আছি। সারা দুপুর কখন
গড়িয়ে গেছে। মাঝে মধ্যে চোখ বুজে এসেছে আমি টের পাইনি। হাসপাতালের ওয়ার্ডে
দিনরাত আলো জ্বলে। ফলে বোঝা যায় না দিন অথবা রাত। একটা সময় সেজদা বলল,
‘এখন আমরা যাচ্ছি। ভয় পাস না। কিচ্ছু হবে না। মেজদা তোর সঙ্গে থাকবে। কাল
সকালে আবার সবাই আসব’। আমি জানতে চাই এখন রাত কিনা। সেজদা বলে, ‘হ্যাঁ।
সাড়ে নটা বেজে গেছে’। সবাই একেএকে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। তারপর সকলেই চলে
যায়। মায়ের সঙ্গে আমার চিরকালের শোয়া। জীবনে এই প্রথম বাড়ির বাইরে,
একেবারে হাসপাতালের বেডে একা একা আমি। রাতে তন্দ্রায় আচ্ছন্ন থাকলেও বহুবার
চোখ মেলেছি। প্রতিবারই দেখেছি মেজদা আমার বিছানার একপাশে বসে আছে। চোখ
মেলতেই মেজদা মুখের কাছে ঝুঁকে পড়ে বলছে, ‘তেষ্টা পেয়েছে’? আমি বলি, ‘না’।
মেজদা বলে, ‘ঘুমা। আমি আছি’।
কিন্তু
ঘুম কোথায়! ওদিকের বেডে কেউ একটা হেঁড়ে গলায় চিৎকার করে কাঁদছে। এরই
মধ্যে একবার কয়েকটা কুকুর আর বেড়ালের মধ্যে তুমুল লড়াই হয়ে গেল। সে এক
ধুন্ধুমার অবস্থা। কে যেন ‘ভাগ, ভাগ’ বলে চিৎকার করে তাদের দিকে তেড়ে গেল।
কখনও কখনও ওপাশের বেডের পাশে এসে দাঁড়াচ্ছে একজন নার্সদিদি। কয়েকবার আমার
স্যালাইনের বোতল দেখে, তরল ঠিকঠাক নামছে কিনা পরীক্ষা করে গেছে। প্রথম
বোতলের তরল শেষ হয়ে যাওয়ায় ফের একটা বোতল ঝুলিয়ে দিয়ে গেছে। আমার কেবলই মনে
হচ্ছে, আমি কি মরে যাব? কিন্তু বুঝতে পারছি না। কখনও ভাবছি, মরে গেলেই বা
কি। কিন্তু মরে যাওয়া কাকে বলে সেটাও জানি না। ধ্যুস, ভাল্লাগে না। চিত হয়ে
শুয়ে থাকতে থাকতে এখন পিঠেও যেন ব্যথা করছে। তেষ্টায় গলা শুকিয়ে কাঠ। জল
চাইলে চামচে করে সামান্য জল দিয়েছে সারাদিন। তাতে তেষ্টা মেটে না। ভাবছি,
মরে গেলেই তেষ্টা পাবে না বোধহয়। তবু নিশ্চিত হতে পারি না। হাতের ব্যথায়
মাঝে মাঝে কঁকিয়ে উঠছি। কিন্তু কিছুই করার নেই।
ভোর
হতেই ওয়ার্ড জুড়ে অনেক মানুষের কথাবার্তা, হইচই। খানিকক্ষণ পরে একটা
ট্রলি ঢোকে। সেখান থেকে অনেকেই চা আর পাউরুটির স্লাইস চেয়ে নিচ্ছে। ঘাড়
ঘুরিয়ে এসব দেখতে থাকি। ডানদিকের দুটি বেডের দুজন বোধহয় অনেকদিন ধরেই এখানে
আছে। তারা নিজেদের মধ্যে হেসে হেসে কথা বলছে। তাদের দেখে মনেই হচ্ছে না
তারা অসুখ নিয়ে এখানে এসেছে। ভাবছি, যত কষ্ট আমারই! এজন্য কাউকে দোষারোপ
করা গেলে বোধহয় বেশ স্বস্তি হতো। কিন্তু কেন আমার অসুখ করেছে জানি না,
অসুখটা ঠিক কী তাও আমার কাছে অস্পষ্ট। ডাক্তার অবশ্য বলেছিলেন, ‘ম্যালিনা’।
অদ্ভুত শব্দটা আমার চেতনায় কোনও অনুরণন তুলতে ব্যর্থ হয়েছে। ফলে, কাউকে
দোষারোপের সুযোগ নেই। সেকারণে আরও অসহায় লাগে। এভাবে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে
যায়। বাড়ি থেকে নতুন করে কেউ এলে চনমনে লাগে। প্রায়ই ভুলে যাই যে,
হাসপাতালে আছি। বরং, আমার জন্য সবাই উদ্বিগ্ন এটা আমাকে বেশ তৃপ্তি দেয়।
সবাই এসে কেমন আছি জিজ্ঞেস করে। মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। ইস, সারা জীবন যদি
এমন অসুখ থাকে বেশ হয়। এখন যেন যা খুশি চাইলেই এরা এনে দেবে। যে কোনও
আব্দার মেনে নিতে সকলেই প্রস্তুত। আমার খুব আনন্দ হয়। মনে মনে কামনা করি,
সবাই আসুক। এমনকি পাড়া প্রতিবেশীরাও আসুক। কেউ যে আসেনি, তা নয়। তারাও
অনেকে এসেছে হাতে চকোলেট নিয়ে। কেউ কেউ এসেছে কমলালেবু নিয়ে। কিন্তু একে
একে চলে যাওয়ার উপক্রম হতেই মন খারাপ হয়ে যায়। সকাল, সন্ধ্যায় ডাক্তার এসে
হেসে হেসে কথা বলেন। জানতে চান, কেমন আছি। কোন স্কুলে, কোন ক্লাসে পড়ি
জানতে চান তিনি। জেনকিন্স স্কুলের ক্লাস এইটের ছাত্র শুনেই তিনি বিস্ময়
প্রকাশ করেন। ডাক্তারকে ভালো লেগে যায়। তৃতীয় দিন স্যালাইন খুলে দিলে সুস্থ
হয়ে উঠি। ওয়ার্ডের ভেতরে হেঁটে বেড়াই। ওয়ার্ডে যাঁরা ভর্তি আছেন সকলেই
বয়স্ক মানুষ। তাঁরা ডেকে ডেকে কথা বলেন। তাঁরা প্রায়ই আমাকে আশ্বস্ত করেন,
‘সেরে যাবে’। আমি ভাবি, সেরে তো গেছিই। তবু অপেক্ষা করতেই হয় বাড়ি ফেরার
জন্য। দুপুরের দিকে আমার ডানপাশের বেডের ভদ্রলোকের জন্য খাবার নিয়ে আসেন
তাঁর স্ত্রী। আটপৌরে চেহারা। সাধারণ শাড়ি পরনে। একটা কাপড়ে জড়িয়ে তিনি
খাবার নিয়ে আসেন। আমি নীরবে তাকিয়ে তাকিয়ে সব দেখি। আমার ডানদিকের তৃতীয়
বেডের ভদ্রলোক বিছানায় বসে বসে এই ভদ্রলোকের খাওয়া দেখতে থাকেন। এটা সেটা
প্রশ্ন করেন। একদিন বলেন, ‘গিন্নি কী মাছ আনলো, হরিপদদা’? তার মানে লোকটার
নাম হরিপদ। তিনি জবাবে বললেন, ‘গড়াই মাছ’। সেটা কী মাছ জানি না, ফলে প্রবল
কৌতূহল হয়। ঘাড় উঠিয়ে দেখার চেষ্টা করি। কিন্তু, মাথা যতটা তুললে তাঁর
খাবার থালা আমার নজরে পড়তে পারে, ততটা মাথা তুলতে পারি না। মেজদা পাশে
বসেই আমার দিকে ভুরু নাচিয়ে জানতে চায়, ব্যাপারখানা কী? আমি বাঁহাত দিয়ে
মেজদার মাথাটা মুখের কাছে টেনে আনি। তারপর ফিসফিস করে বলি, ‘কী মাছ বলল’?
মেজদা সেভাবেই মুখটা আমার কানের কাছে রেখে বলে, ‘গড়াই মাছ, মানে সাটি মাছ।
কেউ কেউ বলে, টাকি মাছ’। এবারে বুঝতে পারি। আমাদের পাড়ায় সকলেই চেনে সাটি
মাছ। আমাদের পুকুরেও আছে এই মাছ। হরিপদবাবুর পাশের বেডের লোকটা বলে, ‘জিওল
মাছ আনবেন’। বুঝলাম, তার লক্ষ্য হরিপদবাবুর স্ত্রী। মহিলা হেসে হেসে
দু-একটা কথাও বলেন। হরিপদবাবু বলেন, ‘সিং মাগুর পাইব কই! যা দাম। আমাদের
মতো গরিবের জইন্য গড়াই মাছ, পুঁটিমাছ’। এতক্ষণে খেয়াল করি, এই ঘরে যত রোগী
আছে সকলেই বেশ গরিব। তাদের চেহারা, পোশাকআশাক এবং রোগীদের দেখতে আসে যে
আত্মীয়স্বজনরা তাদের দেখলেই বোঝা যায় সকলেই গরিব মানুষ। বুঝে যাই, গরিবরাই
হাসপাতালে আসে। কারণ, গরিবদেরই বোধহয় অসুখবিসুখ হয়। এই সরকারি হাসপাতালে
বিনা পয়সায় চিকিৎসা হয়। আমার চিকিৎসাও বিনা পয়সায়। কিন্তু স্বচ্ছল
মানুষদেরও তো অসুখবিসুখ হতে পারে, হয় নিশ্চয়ই। মেজদাকে বলতেই ও বুঝিয়ে বলে,
স্বচ্ছল মানুষ অসুখ করলে পকেটের টাকা খরচ করে ডাক্তারের ব্যক্তিগত
চেম্বারে যায়। দরকার হলে নার্সিংহোমেই ভর্তি হয়। সরকারি হাসপাতালে আসতে হয়
না তাদের। কথাটা আমার মনঃপুত হয়। চুপ করে যাই।
সপ্তাহ
খানেক পর ছুটি পেয়ে বাড়ি যেতে পারি। বাড়িতে যেতেই মা এসে জাপটে ধরে। গত
এক সপ্তাহে মা বার দুয়েক হাসপাতালে যেতে পেরেছে আমার কাছে। বিশাল পরিবারের
ঘরগেরস্থালীর সমস্ত কাজ সামলে তাঁর পক্ষে হাসপাতালে আমার কাছে যাওয়ার তেমন
সুযোগ হয়নি। তাছাড়া, ছোট ছেলেকে তিনি যে একটু বেশি ভালবাসেন সেটা সকলেরই
জানা। অনেকদিন পর মায়ের গন্ধ বুক ভরে টেনে নিই। মায়ের আঁচল টেনে নিয়ে মুখ
মুছি। মায়ের বুকে মুখ গুঁজে শিশু হয়ে যাই। আমার সারা শরীরে মায়ের পেলব
হাতের স্পর্শ পাই, পেতেই থাকি। মা আমার থুতনি ধরে একটু উঁচু করে চোখে চোখ
রেখে বলে, ‘খিদে পেয়েছে’? আমি মাথা নেড়ে বলি, ‘না’। কিন্তু মাকে ছাড়ি না,
জাপটে ধরে রাখি। আমাদের চারপাশে বাড়ির বাকি সকলে ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকে।
পাশের বাড়ির কেউ কেউ এসে দাঁড়িয়েছে ততক্ষণে। একজন মন্তব্য করে, ‘মাকে
ছাড়া এতদিন থাকলি কী করে’!
কী
করে? আমিও কি ছাই জানি! নিষ্ঠুর, হৃদয়হীন এক অসুখ আমাকে মায়ের থেকে দূরে
সরিয়ে দিয়েছিল। আমি আরও জোরে মাকে জাপটে ধরি। আজ, এত বছর বাদেও, মা যখন এই
পৃথিবীর সব মায়া ছেড়ে চিরতরে চলে গেছেন, তখনও মায়ের গন্ধ স্পষ্ট অনুভব
করতে পারি। সেই আদি উৎস থেকে কতদূর চলে এসেছি। ভাবলেই ব্যথা জাগে। কিন্তু,
মায়ের সেই মধুর ঘ্রাণ আজও নাকে এসে লাগে। কোনও কোনও রহস্যময় গভীর রাতে হঠাৎ
ঘুম ভেঙে গেলে আজও নাকে এসে লাগে সেই জাদু ঘ্রাণ। যদিও জানি, সেই আশ্চর্য
স্পর্শ আর কখনই ঘটবে না এই জীবনে!