তোর্সার ঘরবাড়ি-১৯
তোর্সার ঘর বাড়ি/ঊনিশ পর্ব
মণিদীপা নন্দী বিশ্বাস
-----------------------------------------
'না জানোঙ সাঁতার না জানোঙ পংরিবার/না জানোঙ ভুরা বহিবারে/ ওরে অ্যাম দরিয়া মাঝে কে দিবে খেওয়ারে/ আমি নারী কেমনে দিব পাড়ি'
পুরোনো নতুনে মেশামেশি মন, কিছু পাওয়া, অনেক না পাওয়া নিয়ে হাঁটে নারী এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত। যখন রাজ শহরের, ভালবাসার নদীর কুল ছেড়ে চলে যেতে হয়েছিল কে জানত নদী রহস্য, কে হায় শহরের এ কোণ ও কোণ তাকে ঘুরতে দিয়েছিল! কেউ দেয়নি। বাঁধাধরা সময় আর এলাকায় ছিল বন্দী, আর অভিভাবকের পুরো পাহারা আর কড়া নজরদারিতে। কলেজ স্কুল সবই যেন কেমন বুকের ভিতর ভয়। কার হাত ধরতে হবে কার সঙ্গে বেশিক্ষণ কথা বললে বহুজন বহু রঙ ধরিয়ে কথা বলবে, আর রাত করে বাড়ি ফেরা মানে প্রবল অপরাধ। বুকের কুঠুরীতে তাই জমে অনেক না পাওয়া। জমে থাকা অন্ধকার। যে বয়সে মানুষ কিছু এমন কাজ করে ফেলতে পারে যেটা আগামীর দৃষ্টান্ত হয়ে থাকে, সে বয়সটা মেয়েদের বিশেষ করে কেমন করে যেন বয়ে যায়... মুখ ঘুরে যায় ঐ নদীর মতই।হা হা আলেয়ার রহস্য। রাতের হরিধ্বনির নি:সার শরীর, রাজা মহারাজের অশরীরী হাতিরা জল খেতে আসে সে তোর্সার ধারে আকুল চাওয়া পাওয়ায়। বয়ে যায় কচুরীপানা একরাশ নীলচে বেগুনী ফুলে ভরে উঠে, কোথায় কে জানে! ওদের ও বুকে ব্যথার ইতিহাস যেন। হাঁটতে হাঁটতে এই সেদিন ও সন্ধেবেলা বিসর্জনের ঘাটের দিকে চলে গিয়েছিল মিনি। সঙ্গী হীন। কিন্তু অন্ধকার নয়। বরং আলোয় ফুটে উঠছে একটু করে। অভিজ্ঞ বয়স্ক মানুষের মুখে চেনা আদল খুঁজছে। যাঁরা ইতিহাস ধরে রাখেন বুকের ভিতর কিংবা লেখার কলমে। ঠিক সেইরকম এক মানুষ নিত্য ঘোষ। শ্মশান কালীবাড়ির কাছে বাড়ি। বিসর্জনের ঘাটের দিক থেকে এপাশে মুখ ফেরাতে সেদিন সন্ধে হয় হয়। একবার মিনির পুরোনো স্কুলের কথা মনে হয়। সেই ওয়ান, টু...কি বিরাট অতীত হয়ে যাওয়া দু বছর। খুঁজতে থাকে পাকা বাঁধ রাস্তা্য উপর থেকে স্কুলের ছবি।...না, এখন কি আর সে ধারার বেড়া কাঠের তক্তায় বানানো! ভাবতে ভাবতেই সে কালীবাড়ির নতুন রঙ করা লালচে আভা চোখে পড়ে। নামতে থাকে সরসরিয়ে। এখন তো আর বোল্ডার ঘাসজমি আর উঁচু মাটিতে পা রেখে অতি সাবধানে নামতে হচ্ছেনা। মাটির টানেই গ্রাভিটেশনেই কালো রাস্তা ধরে নীচে নামছে মিনি। বহুক্ষণ ধরে চিনতে চেষ্টা করে। এইতো সেই স্কুল, হেনা দি, চন্দন দিদিমণির স্কুল, খুব অল্পদিনের জন্য আসা নতুন মাষ্টারমশায়ের স্কুল। অনেক ভালবাসায় এ স্কুলবাড়ির পিছন উঠোন থেকে কুল পাড়া। ছড়িয়ে থাকা কুল কুড়িয়ে নিতেও পাঁচবার ভাবনা। কেউ দেখে ফেলল...আর কুল খেলে কাশি সর্দি। তারসর গলা ব্যথা জ্বরে দিন তিনেক শুয়ে থাকা, ভাল লাগেনা। মার বকুনীর ভয়। কিন্তু সে স্কুল টিফিনের দুপুর কে ফিরিয়ে দেবে! এখন বাঁধানো রোয়াক। নীলচে আকাশ রঙ আর সাদায় ঘিরেছে স্কুল। পিছনে সামনে পাশে পেল্লায় সব দালান বাড়ি। একটু এগিয়ে ডান ধারে তাকাতে সে মাঠ খুঁদে পায়না।নেই গাছপালা। যেখানে মিনিদের পৈত্রিক সম্পদ অল্প মাটি ছিল, শুনেছে সে সব কবেই বিক্রিবাটা, ভাগ বাঁটোয়ারা হয়ে গেছে। পাশের সরু কাঁচা গলি রাস্তার বদলে এখন পাকা কংক্রিট। ওটা ধরে হেঁটে গেলে সেই শরিক ভাইবোনের অস্তিত্ত্ব খুঁজে নেওয়া যায়। ওরাআ হারিয়ে গেছে। কয়েকমাস তো কেটেই গেল। চেনা মুখ ক ই তেমন! মহিলা কলেজের উল্টোদিকে সংস্কৃত কলেজ। চলছেতো টিম টিম। সোজা রাস্তা পেরিয়ে ডান হাতে রবীন্দ্রভবন পেরোতে হবে। ডানদিকে থানার কয়েদখানার সে বরাবরের রহস্য। বাঁ হাতি সোজা চলে যাওয়া রাস্তার ডানধারে প্রিয় কলেজ এ বি এন শীল। ঠিক এক ভাবে আচার্য ব্রজেন্দ্রনাথ শীলের আবক্ষ মূর্তিকে সামনে রেখে দাঁড়িয়ে আছে। কতদিনের! সে পঞ্চাশের দশকে কোন মানুষের সে ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে রাসটিকেট হওয়ার অন্য গল্প লেগে থাকে। বেতন বৃদ্ধি রুখতে অভিজিত বন্ধুরা সহ আন্দোলন করেছিল, এই ছিল অপরাধ।
স্কুল প্রাঙ্গণের মাটিতে দাঁড়িয়ে বাঁধানো পুলে কিছুক্ষণ দাঁড়ায়য় ঝাপসা চোখ।...কতগুলো ছেলে মেয়ে ছুটছে ছুটছে...কাল বৈশাখি ঝড় ধেয়ে আসছে, বগলে স্লেট, ব ই, চক খড়ির বাক্স, একজনের হাতে স্টিলের সুটকেশ...দৌড় দৌড় দৌড়...
এগিয়ে আসতে থাকে স্কুল পেরিয়ে বাঁধা রাস্তা ধরে নিজের পাড়ার দিকে।...এইতো ডান হাতে নিত্য ঘোষের বাড়ি। তার মানে বড়দি, হেনা দিদিমণিও আছেন। লোহার গেট খুলতে শব্দ হয়। সামনে দাঁড়ানো দ্বিতল বাড়ি। একতলার জানলার পর্দার ফাঁক দিয়ে এক সার বইয়ের আলমারি।প্রত্ন বেশ কিছু বই থাকে থাকে সাজানো আছে। কত কাজ করেছেন নিত্যকাকু। আবারর ঘিরে আসে ছবি। অভিজিৎ মিত্রের বাড়ির বৈঠকখানা বলতে বেড়া দেওয়া মাটির ঘরখানা সেখানেই নিত্য কাকু, অভিজিৎ মিত্র, আর বিভিন্ন পত্র পত্রিকা সম্পাদক কবিদের ভীড়। কত রাজ ইতিহাস, নদী ইতিহাসের কথা উঠে এসেছে সেসব আলোচনা জুড়ে। চিন্তা তরঙ্গে ঘা। সন্ধের আবছায়া অন্ধকার রাস্তার এলিডি আলো, বিভিন্ন বাড়ির আলোয় আলোকিত হতে হতে থাকে একটু একটু করে।...
দোতলা থেকে কুকুরের তীব্র চিৎকার। যেটা মিনির একদম পছন্দের না। গেটের শব্দ পাওয়া মানেই চোর, ছ্যাচোড়, দুষ্টুলোক...এযে কে ওদের মাদায় ঢুকিয়েছে! মিনি স্থবির ওখানেই। উপর থেকে নিত্যকাকুর গলা ভেসে আসে-কে...কে..., আর কে!'আমি''-- আমি'ঐ ক্ষীণ স্বর আর জোরালো করতে ইচ্ছে হয়না মিনির। নিত্যকাকু নিশ্চয় ই অনেক বয়সী এখন, বাড়িতে দরজা খুলে দেওয়ার লোক কাছে আছে কিনা মিনি জানেনা। লোহার গেট বন্ধ ই থাকে। বেশ বুঝতে পারে সিঁড়ি দিয়ে নিত্যকাকু নামার আগেই নেমে আসছে বিরাট আক্তির অ্যালসেশিয়ান। সঙ্গে অদ্ভুত তার ছটফটানি। যেন দরজা খোলা পেলেই মিনিকে দেখে নেবে।ছিঁড়ে খাবে। নিত্যকাকু গ্রীল গেটের কাছে এসে দাঁড়ান। বেশ খানিক দূরে রাস্তার কাছে মিনি ছোট গেটের কাছে দাঁড়িয়েই বলে ওঠে,' আমি মিনি। থাক রাত নামছে।তোমাকে আর খুলতে হবেনা। আর আমি ভীতু টাইপ। হার্ট ধক ধক করছে।....তোমার পোষ্য সামলাও'...
- ও মিনি..আমি শুনেছি বটে তুই এখানে এসেছিস। এতদিন পর! ভাবছিলাম কদিন ধরেই, দেখ দেখা হয়ে গেল। আয়...আয়।
আতঙ্কিত মিনি।...না না, বেশ জোরেই বলে। আজ আর আসছিনা। পরে একদিন কলেজ থেকে ফোন করে আসব। তুমি তোমার ঘেউ ঘেউকে উপরে আটকে রেখে আসবে।, আমি ঢুকব। নিত্য ঘোষ ঐ একই রকম কুকুর মালিক হয়ে ওঠেন।'ও কিছু করেনা, করবেনা জাতীয় কথা বলতে বলতেই মিনি দিদিমণির খোঁজ নেয়।...হেনা দিদিমণি ভালতো?- হ্যাঁ। ঐ বয়সের যে সব রোগ তাতো আছেই...'ঠিক আছে, পরে একদিন দেখি করে যাব। আর অনেক গল্প হবে। রাজ শহরের তখন এখন নিয়ে। রাজবাড়ির এনসাইকোপ্লিডিয়া তো তুমি। তোমার কাছেই জেনে নেব সেসব বদলে যাওয়া কথা আর কাহিনী। আজ আসি কাকু। হাত নাড়ায়, আর একমুহূর্ত দাঁড়ায়না সে। হাঁটতে থাকে নিজের মাটি আর রক্ত লেগে থাকা ধুলো পড়া পাড়া আর পাকা রাস্তা ছেড়ে নতুন বাজার পেরিয়ে গোলবাগান হয়ে সাগরদীঘির দিকে।...ওখানেই যে এখন মাঝশহর, আলোর রোশনাই। নতুন প্রজন্মের ভীড়। আরক্ষা ভবনকে বাঁ হাতে রেখে ডানদিকে সাগরদীঘির জলে টুকরো আলো ছায়ার ভিতর দিয়ে হেঁটে যায় স্বাধীন নারী এক নিজস্ব বাসা বাড়ির দিকে।
* * *
১৯৫৪ সালের বন্যার অভিজ্ঞতা মিনির নেই। কিন্তু কথা শুনে ছবি তৈরি হয়ে যাওয়া বাড়িটা সেই ছোট্ট থেকে এখনো। তুলসীতলে ঠাম্মা তখন প্রদীপ জ্বালছেন সন্ধে নেমে আসার আগের মুহূর্ত। মনে হল ঠাম্মা ধসে যাচ্ছেন, মাটির সঙ্গে সেঁধিয়ে যাচ্ছেন নীচে। মুহূর্তে জেঠুদের মধ্যে সেজ জেঠু ঠাম্মাকে পাঁজা কোলা করে তুলে এনেছিলেন ছুটে গিয়ে। কি আতঙ্কের গল্প শুনেছে! হয়ে গিয়েছিল এক আতঙ্ক নগরী। সব ছত্র ছান। সাজানো পাড়া জুড়ে নেমে এসেছিল ভয়ের ছবি। তলিয়ে যাওয়া দালানের জেগে থাকা মাথা। সে সবই পরের প্রজন্ম দেখেছে। এপাড়া থেকে অন্য পাড়ায় গিয়ে অর্ধেক ডুবে যাওয়া বাড়ি থেকে পলি বের করে সে আবার বাসযোগ্য করে তুলতে মানুষ কত যন্ত্রণা পেয়েছিল, নদী এসেছিল কাছে অনেক কাছে। সবসময়ের সঙ্গী হয়ে। সে বিয়ের ঘটে জল ভরা হোক, গঙ্গা নিমন্ত্রণ হোক, বা অক্ষয় তৃতীয়ার স্নান সব কিছু নিয়ে একটু একটু এগিয়ে আসা তোর্সা ঘিরে নিয়েছিল রাজবাড়ির পিছন দিকের খানিকটা দূরত্ব ঘেরা জায়গা। সমস্ত শহরের মুখ উঁকি দিয়ে দেখে নিচ্ছিল সে। আর মাছধরার জাল নিয়ে তৈরি ছিল জেলে বস্তির মানুষ। লোকাল ছোট ছোট মাছের সঙ্গে রূপোলি বোলোলী বেশ বড়সড় কিংবা বর্ষার পেট ভরা ডিম নিয়ে সুস্বাদু হয়ে উঠছিল।
প্রতি বর্ষায় মিনি, পুনু, রতু মিলুর প্রজন্মের আগেও নদীর এধার ওধারের সব মানুষ, চরের মানুষ আতঙ্কে দিন কাটাত। বার বার ঘর ভাঙত বর্ষার আকুল জলের তোর্সা। নতুন কেনা হ়াঁড়ি পাতিল, সাজিয়ে মুছে রাখা তুলসীতলা ভেসে যেত। জল নেমে গেলেও সে গাছ বা লাউমাচা আর খুঁজে পাওয়া যেতনা। কত আলোচনা, পরিকল্পনা তখন থেকেই। নদীকে আটকানো, তার প্রবল স্রোতের সঙ্গে এইযে রোদের ঝিলমিল বন্ধুত্ব, যাকে ঘিরে চরের একশ্রেণির মানুষের উপজীবিকা জড়িয়ে থাকে তারাও তো চায়না নদী স্রোত বাঁধা হোক। গ্রীষ্ম থেকে প্রতি ঋতুচক্রে নদীর চরে ফুটে থাক রকমারি গাছ, শরতের কাশবন, আর কলা বাগানের ঝাকে কত ব্যবসা। কলার থোড় থেকে পাতা, কান্ড থেকে ফল ফুল সব ই মানুষ প্রিয়।আর উপকারী। ...ফাঁসির ঘাট থেকে হেঁটে ফিরতে ফিরতে মিনি সেদিন দেখেছিল কত একর জমি জুড়ে সার সার কলাগাছের বাগান।বিসর্জনের ঘাটের কাছে অবহেলায় পড়ে আছে পুরোনো বাঁশের সাঁকো।প্রতি বর্ষায় একটু করে মরে গেছে। বর্তমানের পোক্ত বাঁশের সাঁকো কেশব আশ্রম, রাজাদের সমাধি ক্ষেত্র আর নিউ পাটাকুড়ার কাছাকাছি। প্রায় তলিয়ে যেতে বসা কেশব ধাম কে বাঁচিয়ে তুলে হিতেন্দ্র নারায়ণ রোড এখন ঝক ঝক করে রাতেও।বন্যার পরবর্তী গড়ে ওঠা বাঁধের ই দাক্ষিন্যে বেঁচে আছে রাণীর বাগান।...মিনি বাসার রেলিঙ থেকে তাকিয়ে থাকে নদী বাঁধের উপর জাতীয় সড়কের দিকে...রাতের এলিডির ছটা ছাড়িয়ে দূর পারের আলেয়াকে তুলে আনে বার বার।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴