আমি এক যাযাবর-১৯/শৌভিক কুন্ডা
আমি এক যাযাবর
উনবিংশ পর্ব
শৌভিক কুন্ডা
হঠাৎই তিনি বললেন, "কাল তো রোববার, যাবে নাকি, একটু ঘুরে আসি কোথাও?" এসব প্রস্তাব আমি লুফে নিই। এবারও নিলাম। বরাবরের মতোই এবারও প্রশ্ন আমার, "কিন্তু যাবটা কোথায়?" আর, বরাবরেরই মতো একই উত্তর তাঁর, "সে আমি কি জানি! ওসব তুমি ঠিক কর।" ডে-আউটিং খুব মনপসন্দ না আমার। দিনে দিনে গিয়ে ঘুরে আসার জায়গা বাকি আর কিই বা আছে! বিকেলে ডালিয়া এলো, এবং আমাদের সঙ্গী করে নিলাম। কিন্তু জায়গা? ডালিয়ার সোজা উত্তর, "একসাথে বের হবো, এটাই যথেষ্ট। হারা উদ্দেশ্যেই চলো না!"
পরদিন, রোববার দশটা নাগাদ রওনা অতএব। ডালিয়াকে তুলে নিয়ে শহর ছাড়াতে ছাড়াতে চালক দীনেশচন্দ্রকে জিগাই, যদি ওর খোঁজে তেমন কোনো জায়গা থাকে। লাভ হ'ল না। পাহাড়পুর মোড়ের আগেই তো সিদ্ধান্ত নিতে হবে, সেই বুঝে জাতীয় সড়কে উঠে ডাইনে বা বাঁয়ে। হঠাৎই মনে উঁকি দিলো অপশন, "চিসাং না সাকাম?" চুমকি-ডালিয়া দুজনেরই চিসাংকে ভোট। চলো তবে চিসাং।
লাটাগুড়ি থেকে বিস্কিট, মিষ্টি নিয়ে এগোতে এগোতে ঠিক হ'ল মুর্তি ব্রিজের কাছে গিয়ে চা খাওয়া। ব্রিজের কাজ চলছে এখনো। অতএব আমার প্রিয় বাতাবাড়ি স্ট্রেচে ঢোকা গেল না এ যাত্রাও। চা শেষ করে মাহাবাড়ির পথ। নইলে অনেকটা ঘুরে চালসা মোড় হয়ে গাড়ি হাঁকাতে হ'ত। কত হোমস্টে, রিসর্ট গজিয়ে উঠেছে এদিকটাতেও! বস্তি, বাগান ছাড়াতে ছাড়াতে খানিক পর জাতীয় সড়কে উঠে চাপড়ামারির রাস্তায়। বহুদিন পর এদিকে এলাম। আগে জানা ছিলো না, গৈরিবাস পর্যন্ত রাস্তা তৈরির কাজ চলছে। কম করে বাইশ পঁচিশ কিলোমিটার তো হবে! এ দিগরে অনেকেরই বুঝি খবরটা জানা। আসা বা ফিরে যাওয়ার পথে গাড়ি তাই হাতে গোনা। যদিও রোববার, শীতকাল, এবং এ রাস্তায় তো একের পর এক পিকনিক স্পট!
কোলিয়ারি অঞ্চলে আমি মাত্র দু'দিন গেছি। একবার আটের দশকে ডাকরা খনির ওপর দিয়ে, আর একবার বছর আটেক আগে আসানসোল পেরিয়ে। আজ এ পথে চলতে চলতে সেই টুকরো স্মৃতি ফিরে এলো। দু দিকে উঁচু টিলার মতো কেটে রাখা মাটি, মাঝ খান দিয়ে আঁকাবাঁকা আপৎকালীন পথ! কেবল রঙের পার্থক্য। কালচে-ছাইয়ের বদলে ধুসর গৈরিক। অরণ্যের দিকে তাকাতে মনখারাপ। প্রয়োজন ঠিকই, কিন্তু উন্নয়নের এই প্রয়াস গাছগুলোর সবুজকে ঢেকে ফেলেছে রুক্ষ ধুসর চাদরে।
গৈরিবাস মোড় ছাড়িয়ে আরো কিছুটা উঠতে উঠতে সবুজ ফিরে এল আবার। নীচে জলঢাকা উপত্যকায় রোদ। চেনা শীতের ইস্তেহার! মুশকিল শুরু ঝালংএর মুখে। চিসাং আগে যাইনি। দীনেশও রাস্তা চেনে না। পথচলতি একজনের কাছ থেকে জানার চেষ্টা করলাম। আধা হিন্দি আধা নেপালিতে যা বললেন, তাতে, প্যারেন শব্দটা চেনা ঠেকলেও বাকি সব গুলিয়ে গেল, মানে আমার থিওরেটিকাল ম্যাপটা আর কি! এত বেশি ডাইনে-বাঁয়ে, ওপরের রাস্তা, নীচের বাঁক ঐ পান্থজনার বক্তব্যে, তা-ও আবার আধচেনা বুলিতে! মধুপর্ণা অবশ্য কনফিডেন্ট, সবটাই নাকি বুঝতে পেরেছে! সুতরাং অবধারিত ভাবে প্যারেন থেকে ভুল রাস্তা নেওয়া। বেশ কিছুটা গড়গড়িয়ে ফিরে আসা একে তাকে শুধিয়ে! ডালিয়া জানালায় সেঁটে প্রকৃতিমগ্না! এদিকে আমার পেটে ছুঁচোরা ডন না দিলেও হাল্কা জানান দিচ্ছে তাদের অস্তিত্ব। সমস্ত উদ্বেগ, ক্লান্তি দূর হতে থাকলো পথের দুধারে রঙের রায়টে। মুসান্ডা, এডেলিয়া, পিটুনিয়ারা রোশনাই জ্বেলে দিয়েছে প্রতিটি বাড়ির সামনে। বারান্দা,রেলিং,উঠোনে। হলুদ মুসান্ডায় মোহিত দুই ললনা। ফেরার পথে নিতেই হবে! পথের পাশে আরও একজনকে পেয়ে চিসাংএর হদিস করতে স্নেহের হাসি দিয়ে এমন ভাবে হাতটা দেখালেন, যেন এই তো পৌঁছে গেলাম! গেলাম ঠিকই, কিন্তু আরও ঘন্টাখানেক পর। এবং আর ভুল না করেও! একটাই ঠিকানা মনে এসেছিলো, The Serene Acre, আক্ষরিক পিকচার পোস্টকার্ডবাঁকে চলতে চলতে তাকেও পেয়ে গেলাম। গাড়িরাস্তার থেকে সিঁড়ির ধাপ বেয়ে কিছুটা ওপরে এঁকে রাখা হোম-স্টে। আমাদের কোনো আগাম খবর দেওয়া ছিল না, তাই হোমস্টে মালিক রাইবাবু একটু অবাক হয়ে গাড়িটাকে দেখছিলেন ঝুঁকে। ইশারায় ওপরে ওঠার অনুমতি চাইলাম, পেলামও। খেয়াল করলাম সিঁড়ি বাইতে বাইতে, একটু যেন দ্বিধায় আছেন তিনি। চত্বরে পৌঁছে কারণটা বুঝতে পারি। "শিলিগুড়ি থেকে এসেছে ওরা, এনজয় করছে, অসুবিধে হবে না তো?" শুনতে শুনতে লনের অন্যদিকে দেখতে পাচ্ছি, চারজন ছেলে, একেবারেই কচি, ঘাসের ওপর পলি-শিট বিছিয়ে কেউ আধশোয়া, কেউ গিটারে আঙুল, সকলেরই সামনে প্লাস্টিকের গ্লাসে সোনালী তরল! নিজের ফেলে আসা দিন একবার উঁকি দিয়ে গেল। হাসলাম ওদের দিকে তাকিয়ে, হাত নাড়লাম। ওরাও হেসে মাথা ঝাঁকিয়ে উত্তর দিল। এদিকে আমার দুই সঙ্গী ততক্ষণে ছবি তোলার জন্য খাপেখাপ জায়গাগুলো খুঁজে নিচ্ছে! আর, সাজিয়ে রাখা ফুল গাছগুলোর দিকে পিপাসার চোখে তাকাচ্ছে। রাই ভাই জানালেন খাবার কিছুই পাওয়া যাবে না এখানে। যে হেতু এসময়ে রাতে থাকার মতো অতিথি কেউ নেই, ওঁদেরও প্রস্তুতি নেই! দিগন্তে আঁকা ক্যানভাসটির দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে চোখ জুরোয়, মন ভরে না। সময় নেই যে! ফিরতে হবে। ছুঁচোরাও বেশ দাপট দেখাতে শুরু করেছে ইতিমধ্যে। তোদে-র সাপ্তাহিক হাট হাতছানি দিয়েছিলো, কিন্তু, নাঃ, এ যাত্রা পাশ কাটাতেই হ'ল। ফেরার পথে এক গৃহস্থের সংগ্রহ থেকে হলুদ মুসান্ডা কিনে নিতে ভুল হয় নি। এই নির্জনে আর বেশ চমকে দিলো সামরিক বাহিনীর একটা আস্তানা! বুড়োঅকেজো একটা ট্রাককেই বিশাল ইগলু আকৃতির ঘর বানিয়ে নেওয়া হয়েছে! কাগজের চেইন দিয়ে সে আস্তানার বাইরেটা আবার জালের ঘেরাটোপে!
আসার সময় প্যারেনে একটা খাওয়ার দোকান দেখেছিলাম। কিন্তু ফেরার পথে সে দোকান তো দূর, গোটা প্যারেন-ই আর চোখে পড়ল না! হ্যাঁ, আবারও পথ ভুল করেছেন দীনেশচন্দর! তবে, এবার শাপে বর হ'ল। অচেনা রাস্তায় অনেকটা কম সময় লাগলো গৈরিবাসে নামতে। ওখানেই তো খাবার ডেরা! বিকেল হয়ে এসেছে। তা-ও লাঞ্চ! ঠান্ডা ভাত, ঠান্ডা সবজি, আধঠান্ডা মাংস। ডালটাই একমাত্র হালকা গরম। তবে সকলেরই যে পেট চুঁইচুঁই করছিলো, সেটার প্রমাণ, খাওয়ার সময় আমরা কেউই কোনো কথা প্রায় বলিনি!
নক্সালঝোরা আর কুমানির মাঝে ডানহাতে গাছভর্তি ময়ুরী! ডালিয়াই দেখল প্রথম, আর তারপর থেকে দেখতেই থাকল! গাছে, ঝোপে, ঘাসের ওপর ময়ুরী, ময়ুরী, আর ময়ুরী। এ চত্বর বোধহয় পুরুষবর্জিত! একটাও ময়ুর দেখা দ্যায় নি! ঠিক করে রেখেছিলাম আর চাপরামাড়ির দিকে বেঁকবো না। সেইমতো কুমানি তেমাথা থেকে সোজা পথে গাড়ি ছুটল। আজ পথভুল আমাদের কপালসঙ্গী। লোয়ার কুমাইএর রাস্তায় অনেকটা এসে খেয়াল হল। সুতরাং পিছে মুড়, মেটেলির রাস্তা খোঁজ। এরপর আর ভুল হয়নি। মুর্তিখোলার বুকে তখনও বেশ কিছু পিকনিক পার্টি। সন্ধের আস্তরণ বিছিয়ে যাচ্ছে তাদের গাঁকগাঁক করে বাজতে থাকা সাউন্ডবক্সগুলোর ওপর। ইয়ংটংএর হপ্তাবাজারে ল্যাম্পের আলো বাতাসে দুলছে।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴