স্মৃতি দিয়ে ঘেরা/অষ্টাদশ পর্ব
রণজিৎ কুমার মিত্র
^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৃত সংজ্ঞা কী হতে পারে, এ নিয়ে
দেশ-বিদেশের বহু শিক্ষাবিদ-দার্শনিক-চিন্তক বিশ্ববিদ্যালয়কে নানাভাবে
সংজ্ঞায়িত করেছেন। তবে একটি বিষয়ে সবাই একমত যে ছোট-বড়, নবীন- প্রাচীন
যেমনই হোক না কেন সবাই বিশ্ববিদ্যালয়কে মধ্যযুগীয় শিক্ষালয় থেকে আলাদা
করে দেখতে চান। বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্ত পুরনো পদ্ধতি সংস্কার সরিয়ে রেখে
ছাত্র-শিক্ষক-গবেষকরা নতুন নতুন প্রশ্ন তুলতে পারেন, এমনই প্রত্যয় নিয়ে
উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়, এই আধুনিকতাকে সূচনালগ্ন থেকে আজ পর্যন্ত কতটা
বহন করতে পেরেছে, সে প্রশ্ন কিন্তু এই স্মৃতি কথাতেও তোলা যেতে পারে।
নোয়াম চমস্কির ভাষায় বিশ্ববিদ্যালয় হবে " incubators of ideas and
innovations " উত্তরবঙ্গে এখন একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়, তবে অভিজ্ঞতায়
আকারে-প্রকারে উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় অগ্র-পথিক হিসেবে মান্য। এই নতুন
ভাবনা উদ্ভাবনার প্রগতিতে দীর্ঘকাল অতিবাহিত করবার পর সে কতটা নতুন
ভাবনা-চিন্তায়-আবিষ্কারে সক্ষম সমর্থ হতে পেরেছে তার নিরীক্ষার অবশ্যই
দরকার। সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণাণ এর মতে শিক্ষা হবে "initiation into a higher
life " এই উচ্চকোটির জীবন উত্তরবঙ্গের কত শতাংশ মানুষ পেয়েছেন, নাকি
শিক্ষা-দীক্ষার বাজারের দাবিদাওয়া অনুযায়ী নব্য অর্থনীতিকেই শুধু পুষ্ট
করল? এসব নিয়ে কথা হচ্ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের সদ্য অবসরপ্রাপ্ত নিবন্ধকার
ডক্টর দিলীপ কুমার সরকারের সাথে। তাঁর এই পরিচয়ের চেয়ে আমার বেশি
পছন্দের হল তিনি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র, গবেষক, অধ্যাপক,
অধ্যক্ষ। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসক-নিবন্ধকারের চেয়ে ওইসব ভূমিকাতেই আমার
তাঁকে বেশি স্বছন্দ মনে হয়। তিনিও যে এই তুচ্ছ স্মৃতিকথা ফী হপ্তায়
পড়েন, ছাত্রবেলার ছাত্রাবাস জীবন নিয়ে এখনও যে দুরন্ত বালকের মতো
আবেগমথিত হন সেসব জেনে ঐ গ্যালিভার সদৃশ অনুজ প্রাক্তনীর সাথে আমিও
ক্ষণকালের জন্য উড়ে যাই রামকৃষ্ণ কিংবা বিবেকানন্দ Students' Hallএ।
ক্যাম্পাস জীবনের আমি যে আধখানা উপলব্ধি করেছি তিনি স্মরণ করিয়ে দেন। আমি
আগেই বলেছি ছাত্রাবাসে থাকিনি, আমরা ছিলাম নিত্যযাত্রী, জলপাইগুড়ি থেকে
একটি বাসে নিয়মিত যাতায়াত করতাম। ডক্টর সরকার মাঝে মাঝে আমার জলপাইগুড়ি
ফোবিয়া নিয়েও খোঁচা দেন, আমিও সকৌতুকে উপভোগ করি। পাল্টা আক্রমণে তাঁকে
বলি জলপাইগুড়ির কন্যার পানি গ্রহণ করে তিনিও জলপাইগুড়ির ফোবিয়ায় কম
আক্রান্ত হননি। ডক্টর দিলীপ কুমার সরকারের কথায় সবিস্তারে পরে আবার আসব।
আমার সৌভাগ্য যে বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনজন রেজিস্ট্রার-এর সময় আমি কর্মরত
ছিলাম - অধ্যাপক বিমল কুমার বাজপেয়ী, অধ্যাপক তাপস কুমার চট্টোপাধ্যায়,
অধ্যাপক দিলীপ কুমার সরকার। তিনজনই তাঁদের নিজস্ব ক্ষেত্রে স্বমহিমায়
উজ্জ্বল। বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যের সাথে সমান্তরালে রেজিস্ট্রারেরও একটা
গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে। একটা সময়ে এই উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়
রেজিস্ট্রার-এর পদ প্রায় পরিযায়ী রেজিস্ট্রারের পদে পরিণত হয়েছিল,
দুঃস্বপ্নের সেই দিনগুলিতে আধিকারিক সমিতিতে থেকে অনেক দুঃখজনক অভিজ্ঞতার
সম্মুখীন হতে হয়েছিল। যদিও তার সবকিছু এই স্মৃতিকথাতে স্মরণযোগ্য বলে মনে
করি না। কেউ নিভন্ত আগুন খুঁচিয়ে দিতে চাইলে বলি শিক্ষাক্ষেত্রে আর আগুন
জ্বালাবেন না, এই তীর্থ প্রাঙ্গন আর যেন কলুষিত না হয়। উপাচার্য পদটির
সম্মান বজায় থাকে তিনি মহাত্মা বা দুরাত্মা যাই হোক না কেন, গাধার পিঠে
তার কুশপুত্তলিকা চাপিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রদক্ষিণ করানোর মতো জান্তব
দৃশ্য আর যেন কোনোদিন দেখতে না হয়। সেই সময়কার বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই
আলোকিত সমাজের যুযুধানরত মূর্তি কল্পনা করলে আজও আমার আতঙ্ক হয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাসের পড়াশোনার পাশাপাশি গড়ে ওঠে আনুষঙ্গিক নানা
প্রতিষ্ঠান যেমন লাইব্রেরি প্রেস, প্রকাশনা, স্পোর্টস বোর্ড, ছাত্রাবাস,
ছাত্রসংসদ ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানগুলি যাতে গণতন্ত্রসম্মত পদ্ধতিতে পরিচালিত
হয় তার জন্য নানা কমিটি গড়ে তোলা হয়, তবে তা সব সময় কতটা গণতান্ত্রিক
এবং সুবিবেচনার হত তা নিয়ে বিভিন্ন সময়ে সংশয় ও উষ্মা প্রকাশ হতে
দেখেছি। মনে পরে সকৌতূকে লক্ষ্য করেছি আমার উপরওয়ালা এক আধিকারিককে, তিনি
আমাকে যথেষ্ট স্নেহ করতেন, আমিও তাঁকে শ্রদ্ধা সমীহ করেছি, কিন্তু ওই
খ্যাতির মোহ জালে আটকা পড়ে তাকে যেভাবে ছটফট করতে দেখেছি তা বেশ
কৌতূকের। তিনি ৩৪ বছরের জমানায় , তার অবসর কাল পর্যন্ত স্পোর্টস বোর্ড
চালিয়েছেন অথচ তিনি নাকি কোনোদিন কোনো খেলার মাঠেই পা রাখেননি, এটা নিয়ে
তাঁর সহকর্মীরা খুব হাসাহাসি করতেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে কমিটি গঠন ও সদস্য
মনোনয়ন বেশির ভাগ সময়ই পক্ষপাতদুষ্ট হত, অনেকেই আড়ালে কানাকানি করতেন কোন
কমিটিতে কোন মহাজন, উপাচার্য বা রেজিস্টার-এর কাছে আনুগত্যের বিনিময় পদ
পেয়েছেন ।রাজনৈতিক খবরদারির ফল্গুধারা তো প্রায় সবসময়ই সর্বস্তরের কমিটি
গঠনে ছিল। ফলে হরেক রকম বিভাজন তৈরি হত এইসব কমিটির মাধ্যমে। শিক্ষার মান
কতটা বাড়ল তা নিয়ে নয়, কমিটি কর্তাদের মান প্রতিপত্তি কতটা বাড়ল সেটাই
ছিল মুখ্য আলোচনার বিষয়। কমিটির কেষ্টবিষ্টুরা যতটা না তাদের নির্দিষ্ট
কাজের সাফল্যের জন্য সচেষ্ট হতেন, তার চেয়েও বেশি সচেতন ছিলেন নিজস্ব
পদোন্নতি বা স্বার্থসিদ্ধির জন্য। এই বিষয়ে তাঁরা অন্তত তাঁদের অপরিমেয়
মেধার প্রদর্শন করতেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের তথাকথিত ক্ষমতাসীনেরা এই
কমিটিগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করত। আধিকারিক সমিতির সভাপতি থাকাকালীন সময়ে আমি
দেখেছি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথা বা রীতি অনুযায়ী যেসব কমিটিতে আধিকারিক
সমিতির সভাপতিকে বরাবর রাখা হয়েছে সেখান থেকে আমি বাদ, কারণ তৎকালীন
উপাচার্য ও তার অনুগামী গোষ্ঠীর প্রিয় পাত্র বা স্তাবক গোষ্ঠীর
অন্তর্ভুক্ত ছিলাম না। চোখের সামনে অনেক কিছু দেখতে হয়েছ, যন্ত্রণা
অনুভব করতে হয়েছে, এক স্বার্থান্বেষী চক্র কিভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের
আধিকারিক সমিতিকে দু'ভাগে ভাগ করল, আধিকারিক সমিতি হয়ে উঠল উপাচার্যের
স্যাটেলাইট।
বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু
পুরনো বিন্যাসই বদলে গেছে নতুন এবং পুরনো দ্বৈরথের, একটা মজার ঘটনার কথা
মনে পড়ল। সেবারে বাংলা বিভাগের পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানে এক প্রাক্তনী তার
সময়ের অধ্যাপকদের কথা, তাদের শিক্ষাদানের কথা বলতে গিয়ে মুগ্ধ স্মৃতির
আবেগে বলেছিলেন যে ,তাদের ছাত্র থাকাকালীন সময়ে ছিল সুবর্ণ যুগ! হঠাৎ করে
এক বর্তমান অধ্যাপিকা উত্তেজিত কন্ঠে চিৎকার করে বলে উঠলেন, এই সময়ে যে
সমস্ত অধ্যাপক অধ্যাপিকা রয়েছেন তারা কি সব প্রস্তর, লৌহ যুগের অধ্যাপক?
প্রায় খেঁকিয়ে ওঠা সবার মাঝে ওই অধ্যাপিকার বক্তব্য শুনে, প্রাক্তনীটি,
যিনি নিজেও একটি কলেজের অধ্যাপিকা, হতবাক হয়ে গেলেন, তাঁর মুখে কোনো কথা
এলো না বিস্ময়ে,পরে নিচুস্বরে আমার কাছে এসে বলেছিলেন, আমি কি কিছু ভুল
বললাম, দাদা ? আপনারাও তো আমাদের সমসাময়িক ? কোনো উত্তর দিতে পারিনি। শুধু
মনে হয়েছিল, সময়ের সাথে সাথে কত কি বদলে গেল, বিশ্ববিদ্যালয়ের
সভা-সমিতির শিষ্টাচারগুলো কেমন বদলে যাচ্ছে ভয়াবহভাবে।
পুরনো দিনে অর্থাৎ যখন গ্রন্থ ভবনে আমার চাকরি জীবন শুরু হল,
সেই সময়ে গ্রন্থাগারে বসেই বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্ত অধ্যাপক-অধ্যাপিকাদের
চিনে ফেলতাম, কারণ গ্রন্থাগারে তাঁদের নিয়মিত যাতায়াত ছিল, ক্রমশ
বিশ্ববিদ্যালয়ের নবাগত অধ্যাপক অধ্যাপিকা প্রায় অচেনাই রয়ে গেলেন, কারণ
কাউকেই মাসে একবারও গ্রন্থাগারে আসতে দেখতাম না। বিশ্ববিদ্যালয়ের
সূচনালগ্নে, সেই ষাটের দশকে যোগদানকারী প্রায় সমস্ত অধ্যাপক অধ্যাপিকাদের
গ্রন্থাগারে নিয়মিত যাতায়াত ছিল, ক্লাস নেবার পর তারা অনেকটা সময়
গ্রন্থাগারে কাটাতেন, ফলে তাদের গ্রন্থাগার পরিষেবা দেবার সময় পরিচয় হয়ে
যেত, ধীরে ধীরে সেই পরিচয় আন্তরিক মানবিক সম্পর্কেও রূপান্তরিত হত, এবং
এই সম্পর্কটুকু শুধু গ্রন্থাগার পরিষেবার লেনদেনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকত
না। ইংরেজির অধ্যাপক বিনয় বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা খুব মনে পড়ে। মিষ্টভাষী,
একটু বেশিই বিনয়ী, হয়তোবা একটু বেশি বিগলিত, অবসর নেবার আগে তিনি তার
ইচ্ছার কথা জানালেন, অবসর নিয়ে যাবার দিন তিনি গ্রন্থাগারের সবার সাথে
দেখা করে, সবাইকে মিষ্টিমুখ করাবেন, যে গ্রন্থাগার পরিষেবা তিনি পেয়েছেন
তার জন্য সকলকে কৃতজ্ঞতা জানাবেন, ঘটনা হিসেবে এটা কতটা উল্লেখযোগ্য জানি
না, তবে ওই বরিষ্ঠ অধ্যাপকের গ্রন্থাগারের সঙ্গে যে হৃদয়ের সংযোগ ছিল তা
স্মরণ করতে আজও ভালো লাগে। নব্বইয়ের দশক থেকেই লক্ষ্য করতাম গ্রন্থাগারে
পাঠকের সংখ্যা ক্রমহ্রাসমান। জেরক্স, ইন্টারনেট এবং আরো আধুনিক
তথ্য-প্রযুক্তির সহায়তার জন্য পাঠকরা নাকি আর গ্রন্থাগারমুখো হচ্ছেন না,
অথচ গ্রন্থাগারে রক্ষিত গ্রন্থাগার পরিষেবার অত্যাধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির যে
সুযোগ সুবিধাগুলি প্রদান করা হয় সেক্ষেত্রেও ব্যবহারকারীর পরিসংখ্যান
আশানুরূপ নয়, অথচ এসবের জন্য লক্ষ কোটি টাকা ব্যয় হচ্ছে । বিস্মিত হতাম
লাইব্রেরি কমিটিতে এসে শিক্ষক-ছাত্র-গবেষক প্রতিনিধিরা গ্রন্থাগারের না
এসেও গ্রন্থাগার পরিষেবার মান নিয়ে নানা প্রশ্ন তুলতেন, অভিযোগ করতেন।
শিক্ষক ও গ্রন্থাগারিকদের সমমর্যাদা, সম বেতন নিয়ে কটাক্ষ করতেন। তবু আশার
আলো ছিল, এই সমাজেরই একাংশ গ্রন্থাগার সম্বন্ধে ধ্যান-ধারণায়, মুড়ি
মুড়কিকে আলাদা করতে পারতেন। সুবর্ণ যুগের এইসব পাঠকদের কাছ থেকে
গ্রন্থাগারের জন্য নানা সময়ে যাদের সমর্থন পেয়েছি, পাঠক হিসেবে যারা
আজও শ্রদ্ধায় স্মরণে শিরোধার্য হয়ে আছে, তাদের মধ্যে কয়েকজনকে আজ খুব
বেশি করে মনে পড়ে। অধ্যাপক অশ্রুকুমার সিকদার, মানস দাশগুপ্ত, বাণী
প্রসন্ন মিশ্ৰ, রজতশুভ্র মুখোপাধ্যায, বিমল দাস, আশীষ সেনগুপ্ত,
মঞ্জুলিকা ঘোষ, অজিত রায়, বিনয় ব্যানার্জি, এরকম অনেক পাঠককেই দেখেছি
যারা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার সাথে গ্রন্থাগারের সংযোগকে সবসময় গুরুত্ব
দিতেন। এই কারণেই বোধহয় ওই প্রাক্তনী সুবর্ণ যুগের কথা বলে ফেলেছিলেন।
শুধু এই সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ ভাবে আলোকিত তথ্যপ্রযুক্তিতে
সমৃদ্ধ পাঠকেরাই পার্থক্য করতে পারেন না কোনটা প্রস্তর যুগ আর কোনটা
সুবর্ণ যুগ । আসল স্মৃতির খাতায় আর নকল-এর পার্থক্য।
দুয়ারে শারদ উৎসব, মা দুর্গার কাছে শুধু একটাই প্রার্থনা সমস্ত
বিদ্যানিকেতনের বন্ধ দরজা আবার খুলে যাক, শিক্ষাক্ষেত্রে যে সমস্ত
শম্ভু-নিশুম্ভ, করোণাসুর দাপিয়ে বেড়াচ্ছে তারা নিপাত যাক। স্মৃতির
খাতায় এখন শুধু লেখা হোক চিরদিনের বাণী - "শিশিরে শিশিরে শারদ আকাশে ,
ভোরের আগমনী।"