শালসিঁড়ি-১৮/বিমল দেবনাথ
শালসিঁড়ি-১৮
বিমল দেবনাথ
^^^^^^^^^^^^^^
- হ্যালো… অপূর্ব… কখন আসছিস…
- মাধুরী, অপূর্ব বলল ওর আসতে দেরি হবে। কী একটা ঝামেলা আছে - মিটিয়ে আসবে।
- আমি কিছু বুঝতে পারি না কী এত ঝামেলা ওর। ব্যবসার সোজা পাটিগণিত কেন এত জটিল করে কে জানে।
বিকাশ দেখতে পায় একটা নির্দিষ্ট সোফা খালি রেখে অপরূপা–মাধুরী-অংশু-ময়ূখ গল্প করছে। বিকাশ যখন বাড়িতে আসে লক্ষ্য করে ঐ সোফাতে অপরূপা বা অংশু কখনও বসে না। বিকাশের কেন যেন মনে হত ঐ সোফাটি শুধু ওর জন্য অপরূপা রেখেছে, খালি করে। আজ বাড়িতে বন্ধুরা এসেছে- আজও সোফাটি খালি রাখল কীভাবে! মাধুরী বসতে পারত, ময়ূখ বসতে পারত- কেউ তো বসল না। সোফার উপরে তো নাম লেখা নেই। এতদিন বিষয়টি খেয়াল করলেও বিকাশ গুরুত্ব দিত না। আজ কেন যেন বিষয়টি বেশ গুরুত্বপূর্ণ মনে হচ্ছে। অপরূপা ছোটখাটো বিষয়গুলো কী করে এত নিখুঁত ভাবে সামলায়! এই বিষয়গুলো কি ওর মনের বহিঃপ্রকাশ- গাছের ফুল ফোটার মত? মন বা হৃদয় তো বাইরে থেকে দ্যাখা যায় না। কার হৃদয়ে কী আছে সেটা কী এভাবে বোঝা যায়! বিকাশ ভাবে - ও নিজে অপরূপা অংশুর জন্য কি এই রকম কিছু করে! না - সেই রকম কিছু তো মনে পড়ছে না। বরং মনে পড়ছে ওদের ছোটখাটো দাবী মেটাতে অনেক সময় কত দেরি করত। মানুষ কি কাছের মানুষের জন্য এই ভাবে মনের ভিতরে জায়গা রাখে! প্রতিটি মানুষ কী এই জায়গা খোঁজে – মনের জন্য। এই জায়গা খুঁজে না পেলেই কী জ্বর আসে মনে শরীরে?
বিকাশের মনে পড়ে কাবু বলত - ঠিক জায়গায় ঠিক গাছের চারা লাগাতে; তা না হলে গাছ হৃষ্টপুষ্ট হবে না। জায়গা খালি রাখতে নেই। জমিন পতিত রাখলে আগাছায় ভরে যাবে বা দখল হয়ে যাবে। আগাছার প্রকোপে চারাগাছ তো বাড়তে পারে না। আর জমি দখল হলে তো সব গেল। তখন দেখবেন কত ঝামেলা।
বিকাশের মনটা কেমন যেন হু হু করে উঠল - চিলের ডাকের মতো। মনটা যেন তন্দুরির ভাট্টি। ধোঁয়া নেই; ড্রামের ভিতর গনগনে লাল আগুন দ্যাখা যায় না কিন্তু পুড়িয়ে দেয় রক্ত মাংস -সব। সকালে অংশুর ঠোঁটে সিগারেটের গন্ধ যেন ওর মনকে ঝলসে দেয়…
কাবু বলে- এই যে দেখছেন রাস্তার দুই পাশে ছাতুর ( ব্যাঙের-ছাতা) ঘর বাড়ি দোকানপাট উঠে আসছে- এ সবই জবরদখল। এই জায়গাগুলো আমাদের সবার। প্রয়োজনের সময় দেখবেন কত ঝামেলা হবে। হাঁটা চলার জায়গা পাবেন না। শুধু কী রাস্তা, এই রকম কত আছে বলে শেষ করা যাবে না। মানুষগুলো যেন গরু- ঘাস ছাড়া আর কিছু দ্যাখে না; ভাবে না। বিকাশ রাস্তার উপর দাঁড়িয়ে পড়ে। কাবুর কথা শুনে স্তম্ভিত হয়ে যায়। কাবু বলে- স্যার, কিছু ভাবলেন। কিছু মনে করবেন না স্যার। আমি কেন বললাম পরে একদিন বুঝতে পারবেন। তখন আমাকে মনে পড়বে। বিকাশের আজ কাবুকে কেন যেন খুব মনে পড়ছে…
বিকাশ ভাবে- চারা গাছ, শিশু মন, আর প্রথাগত শিক্ষার শেষে পেশার কাজের প্রথম পর্ব তো একই রকম- শিশুর মতন। কত কী জানতে হয়, বুঝতে হয়, খুঁজতে হয়- শালসিঁড়ির মতো। এই খোঁজ অসীম- অনন্ত। বিকাশের নিজের মনকে আটলান্টিক মহাসাগর মনে হয়। এই সাগরে অপরূপা অংশুর স্থান তো মুক্তোর মত। বিকাশের ডুব দিতে ভয় করে। উথাল পাথাল ঢেউ পর পর অবিরাম আছড়ে পড়ছে পাড়ে - উত্তরের দচিগাঁও থেকে দক্ষিণের নীল পাহাড়; পূর্বের মিশমি থেকে পশ্চিমের মরু-বন - সব। কিন্তু…
বিকাশ সোফায় বসে ডাকে-
- অংশু, আয় আমার পাশে বস্।
অংশু মাধুরীর পাশ থেকে আস্তে আস্তে উঠে এসে বাবার পাশে বসার আগেই ময়ূখ প্রায় লাফ দিয়ে বিকাশের ডান পাশে বসে পড়ে। বিকাশ ভাবে - কী অদ্ভুত! ময়ূখ কেমন করে যেন একটা সুনিশ্চিত জায়গা করে রেখেছে বিকাশের বুকে। আর সেখানে অংশু নিজের বাবার কাছে এসে বসতে কত ইতস্তত করছে। বিকাশ আজ সমুদ্রের পাড় - হাত বাড়িয়ে অংশুকে টেনে নেয় পাশে। শিশির ভেজা শালুকের মতো স্নেহ হাসি দিয়ে বলে…
- আজ তোমাদের আনেক মজার গল্প বলব।
- কাকু, মা বলছিল তুমি হাওয়া থেকে জল খাও। কী ভাবে?
ময়ূখের কথা শুনে সবাই হেসে উঠে লালপায়ু-বুলবুল পাখিদের বুলির মতো। এই হাসি ময়ূখের জানার ইচ্ছাকে মোটেও দমন করতে পারে না। ময়ূখ শালের থেকেও শক্ত পাকাশাল ( পাকাসাজ)। পাকাসাজ গাছ এমন শক্ত কাঠমিস্ত্রিরা কাজ করতে চায় না - সেখানে বুলবুলিদের বলাবলিতে ময়ূখের কিছু আসে যায় না। ময়ূখের যখন জানার ইচ্ছা ও জেনেই ছাড়বে। ময়ূখের ফুলের পরাগ রেণুর মত একনিষ্ঠা বিকাশের খুব পছন্দ। বিকাশ ময়ূখকে চেপে ধরে অংশুর মাথায় হাত বুলিয়ে বলে-
- অংশু, বলত ব্যাপারটি কী।
- সেই গাউরের পায়ে সাদা মোজা পরার মতো গল্প হবে- আর কি।
‘গাউরের পায়ে সাদা মোজা’ শুনে সবাই আবার হেসে ওঠে। অংশু বলে-
- এখন হাসলে কী হবে। তখন আর এখনকার মধ্যে অনেক তফাৎ। তখন আমি ছোট ছিলাম। এখন হলে বিশ্বাস করতাম না।
- জানিস অংশু এখনো অনেকে বিশ্বাস করে- গাউর মোজা পরে। গাউরের বাচ্চাকে হরিণ বলে।
‘গাউরের বাচ্চা হরিণ’- এই কথাটি শুনে অংশু হো হো করে হেসে উঠে। অপরূপা বলে-
- এই ছেলে ঐ রকম হাসছিস কেন? চুপ কর।
- কেন চুপ করব; আমি বলব।
- বল না অংশু বল; কি হয়েছিল?
অপরূপা শিশুকে কোলে তুলে চেপে ধরার মতো প্রশ্রয়ের ধমকে বলে-
- অংশু!!!
অংশু হাসতে হাসতে বলে-
- জানিস ময়ূখ, এক দিন বাবা গাড়ি পাঠিয়েছেন আমাকে আর মাকে নেবার জন্য। সময়টা বিকাল ছিল। আমরা জীপের মাঝের সীটে আর সামনের সীটে গার্ড কাকু বসে ছিল। বনের রাস্তায় তিন চার কিলোমিটার গেছি। দেখি জীপ দাঁড়িয়ে গেল। ভালো করে দেখে বুঝতে পারি যে- রাস্তার উপর এক দল গাউর দাঁড়িয়ে আছে। ড্রাইভার রবিকাকু বলে- এখানে একটু দাঁড়াই। সব গাউর এখন জল খেতে নদীতে যাবে। আমাদের দেখে গাউর যদি তাড়াহুড়া করে দৌড় লাগায় আর দাঁড়াতে পারবে না। গাউরের তো ব্রেক নেই- ব্রেক লাগাতে পারে না। তাই ছুটন্ত গাউরের সামনে পড়লে বাঁচার উপায় নেই। আমি তো গাউরের ব্রেক শুনে হেসে লুটোপুটি খাচ্ছি…
- তারপর তারপর…
- আরে তারপরই ঘটল আসল ঘটনা…
বিকাশ অপরূপাকে দ্যাখে; মাধুরী বিকাশকে দ্যাখে। ছেলেদের অকপট সরল আনন্দ দেখে বিকাশ অপরূপা ও মাধুরীর চোখ মুখ থেকে আনন্দ সুখ ঝরে পড়ে - পিটালি ফুলের মতো। অংশু বলে-
- তারপর হল কী – গাউরগুলো কিছুতেই রাস্তা ছাড়ে না। আমরা সবাই বসে বসে গাউরের বদমাইশি দেখছি। একটা গাউর আর একটা গাউরকে গুঁতিয়ে গুঁতিয়ে রাস্তা থেকে নামিয়ে দিচ্ছে। ঠেলা খেতে খেতে গাউরটি রাস্তা থেকে সরে এলেও আবার রাস্তায় উঠে দাঁড়িয়ে থাকছে। মাঝে মধ্যে কয়েকটা গাউর জিভ দিয়ে নাক পরিষ্কার করছে…
- কী বললি! জিভ দিয়ে নাক পরিষ্কার করছে?
- তাই তো করে দেখলাম।
- তারপর?
- হঠাৎ দেখি হরিণের মত একটা প্রাণী রাস্তায় উঠল – ছুটে এসে। মা বলে - দেখ অংশু দেখ। হ-রি-ণ… আমিও দেখলাম। সামনের গার্ডকাকু বলল- না ওটা গাউরের বাচ্চা। তখন মায়ের মুখটা যা হয়েছিল না- দেখলে চিনতে পারতি না…
অংশু হেসে ওঠে… ময়ূখ বলে- বা রে তাতে কাকিমনির কী দোষ! সবাই কী সব জানে। তখন মা বলছিল- কাকু নাকি হাওয়া থেকে জল খায়। কী ভাবে? আমরা কী জানি? সেটা তো কাকুকেই বলতে হবে…
বিকাশ ভাবে- মাধুরী যেন একই রকম রয়ে গেছে- লিভিং-ফসিলের মতো। আদি অতীত বর্তমান একসাথে অবস্থান করছে। সময়ের আঘাত; পাশের মানুষ অপূর্বর পেষাপেষি; নিজের শরীর বিদীর্ণ করা আর ময়ূখের উজ্জ্বল বিকিরণ – কিছুতেই কোন কিছু পরিবর্তন হয়নি। বিকাশের উপর এখন খুব আস্থা। বিকাশ যেন মাটি; ধরে আছে পাথর গাছ – সব। অধিক আস্থা কী মানুষের বুদ্ধিকে ভোঁতা করে দেয়- তা নাহলে সূক্ষ্ম মস্করাটি মাধুরীর মত ব্রিলিয়ান্ট মেয়ে ধরতে পারল না। সোজা সাপ্টা বলে দিল আমি হাওয়ায় জল খাই! বিকাশ ভাবে – বন্ধুত্ব আগুনের মতো। কত কী মলিনতা পুড়িয়ে আলো দেয় কী সুন্দর! এই আগুনে হাত দিতে নেই- শুধু তাপ নিতে হয় আলো নিতে হয়। বিকাশ চায়না ময়ূখ অংশুর গল্পের মধ্যে বাধা হতে। ওদের বন্ধুত্বের আগুন জ্বালিয়ে দিক অংশুর মনের সব আবর্জ্জনা। অংশুর মনের যে জায়গা বাবা মাকে সরিয়ে স্থান করে নিয়েছে অন্ধকার তা সরে যাক বন্ধুত্বের আলোতে। সেই আলোতে দেখুক মাকে বাবাকে… বিকাশের ব্যাকুল মন আবার পেতে চায় কাঠজামের গন্ধ অংশুর ঠোঁটে। বিকাশ বলে-
- তখন মায়ের মুখটা কেমন হয়েছিল? বনচাঁড়ালের পাতার মতো?
সব আলো উজ্জ্বলতা ধুপ করে পড়ে গেল।
- তুমি না বাবা কেমন। মাকে আমাকে কত কথা বল না।
অংশু অভিযোগ করে। বিকাশ ভাবে পৃথিবীর সব আভিযোগ তো বাবার দিকেই হবে। পিতা যে কলা পাতা। যে যেভাবে পারে ব্যবহার করে। বাবা যে পৃথিবীর মাটি। তুমি আঘাত করতে পার খুঁড়ে খাবলে নিতে পার তবুও তোমাকে ধরে রাখবে বুকে। বিকাশ নিজের বুকের উপর হাত বুলায়- অনুভব করে অপরূপা যেন গাছের মূলের মতো ওকে ধরে আছে পরম যত্নে। না হলে কবে উড়ে যেত মরু ঝড়ে। অপরূপা বলে-
- ও ভাবে বলে না অংশু। বাবার কত কাজ করতে হয়।
- সে যা হোক। বাবা এই সব সামান্য কথা মাঝে মধ্যে তোমাকে বলতে পারত। তোমরা কি কখনও কথা বল না।
- কেন কথা বলব না । আমরা তো কত কথা বলি।
- তাহলে!
অপরূপা যেন হঠাৎ কোথায় হারিয়ে যায়…
- হাতটা ছাড়- প্লীজ! আমাকে যেতে দাও।
- না আর একটু বস; আর একটু গল্প করি…
বিকাশ অপরূপার বাঁহাত নিজের কোলের উপর রেখে দুই হাতে ধরে আছে। অপরূপা শত চেষ্টা করেও ছাড়াতে পারে না। অপরূপাদের সময় পার্কে হাত ধরে বসাটা ইঙ্গিতবাহী পাণি গ্রহণ ছিল না; সে যেন ছিল পানিপথের সব যুদ্ধ। এই যুদ্ধে অপরূপার পরাজয় ছিল বাঁধাধরা। তিস্তা নদীর পাড়ে পার্ক। গ্রীষ্মের আগুন রাঙা কৃষ্ণচূড়া গাছের নীচে দূর্বা বসে থাকে যেন দুই তোতা পাখি। দূরে বাঁধের স্পারে পলাশের ঝাড়ে তখনো থেকে যাওয়া কয়েকটা পলাশ ফুল যেন ধরে রাখার চেষ্টা করে দিনের শেষ আলো রশ্মি; বলে- শেষ কর তাড়াতাড়ি- তোতা পাখি কথা… অপরূপা ভাবে তখন আমাদের কত কথা ছিল। এখন মুখমুখি বসার সময় কই? দুই পাখি দুই ডালে- সময় ফিরলেও বসতে হবে শুকনো গাছের ডালে। যৌবন কত স্বল্প স্থায়ী- ফুলের মত। এখন কাজ শুধু ফলের বোঁটা শক্ত করা ফল যেন অকালে ঝরে না পড়ে। তার জন্য মাটি চায় গাছ; গাছ চায় মাটি… ময়ূখের কথা শুনে অপরূপার ঘোর কাটে…
- কাকু, বল না বনচাঁড়াল কি?
- ওটা একটা গাছ। পাতা নিজে থেকে নড়ে- মাধুরী বলে।
- বাঃ এত ঘরকান্না করেও তো তোমার দিব্যি মনে আছে। তা হলে বলে দাও আমি কী করে হাওয়া থেকে জল খাই।
- না তুমি বল।
- না তুমি বল।
তোমরা কী শুরু করেছ সপ্তপদীর মত- অপরূপা হি হি করে হেসে উঠে। অংশু ময়ূখ অবাক হয়ে হা করে থাকে। ভাবে বাবা মা-দের আবার কী হল। সাত পায়ের আবার কী কোন বন্যপ্রাণ আছে!!!
এই ভাবে ওদের আড্ডা গাঢ় থেকে আরো গাঢ় হয়ে উঠে। বিকাশ ভাবে – এই রকমের সুন্দর আড্ডা কত দিন হয় না। এই রকমের ঘরোয়া আড্ডাতে মনের কত ফাঁক ফোকরের খবর পাওয়া যায়। কত শূন্য স্থান পূরণ করা যায়। মন ভরে ওঠে জামরুল ফলের গন্ধে জুঁই ফুলের গন্ধে। ময়ুখ বলে-
- কাকু বলনা। তুমি কি করে হাওয়া থেকে জল খাও।
- ওটা একটা কথা কথা; বনকে বোঝার জন্য।
- সেটা কেমন?
- আমি আগেও বলেছি বনে প্রতিটি পদক্ষেপে অনেক কিছু জানার আছে। এখন আবার বলছি; মনে রাখবে। পরে কাজে লাগবে।
ময়ুখের সাথে অংশুও উৎসুক হয়ে বলে-
- বাবা বলো না…
- শুধু হাওয়া থেকে জল খাওয়া নয়; আমি বনের গাছ ছুঁয়ে দিক নির্ণয়ও করতে শিখেছি।
- কম্পাস লাগে না? কি ভাবে?
- আমাদের এখানে সূর্য বেশীর ভাগ সময় কোন দিকে থাকে।
- দক্ষিণ দিকে।
- তোমরা যদি দাঁড়িয়ে থাক তোমাদের শরীরের কোন দিকে সূর্যের তাপ পাবে?
- শরীরের দক্ষিণ অংশে।
- উল্টো দিক কেমন থাকে?
- দক্ষিণ পাশ থেকে কম গরম।
- ঠিক। এই ব্যাপারটি বনেও ঘটে। একটা ঘটনার কথা বলছি-
- আমি কাবু সহ আরো কয়েক জন সন্ধ্যায় বনে টহলে গেছি। বনের পথ বন্য প্রাণীদের হাঁটার দণ্ডী ধরে হাঁটছি। কাবু বনের নানা ঘটনার কথা বলছিল। এক সময় কাবু বলে – সেই বনে এমন কিছু গাছ আছে যার কাছে গেলে মানুষের দিক-ভ্রম হয়ে যায়; বনে আর রাস্তা খুঁজে পাওয়া যায় না। রাতের বেলা হলে তো আর কথাই নেই। সারা রাত বনেই চক্কর কাটতে হবে। আমি বলি সে কী! তা হলে সে সব গাছের কাছে যেওনা।
- তারপর?
- অমাবস্যার রাত তার উপর গাছটির পাতাও হয় কালো। বনের নানা গাছের মধ্যে মিলে মিশে থাকে। এত দিন বনে কাজ করা সত্বেও ভুল হয়ে যায় কাবুর। আমরা সবাই হাঁটছি আর হাঁটছি। সারা বনে যেন কীটদের কীর্তন হচ্ছে। পায়ের তলায় নরম কিছু পড়লেই ভিতরে বাইরে চমকে উঠছি- সাপের গায়ে পা দিলাম না তো! সেই বার প্রথম বুঝতে পেরেছিলাম অন্ধকারও মানুষের মুখ ও মান রক্ষা করে। তা না হলে আমার ভয়ার্ত মুখ দেখে স্টাফরা কী ভাবতো কে জানে।
অংশু ও ময়ূখ হেসে উঠে। মাধুরী অপরূপা কৌতূহলী হয়ে উঠে।
- তুমিও ভয় পাও?
- পাবো না! তখন তো সবে বনের বর্ণ পরিচয় পড়ছি।
- তারপর?
- রাতচরা পাখিরা ধাতব শব্দে ডাকছে। কেমন যেন একটা ভুতুড়ে পরিবেশ। একটা পেঁচা এমন ভাবে ডেকে উঠল যে শরীর ঠন্ডা হয়ে গেল। গায়ের রোম খাড়া হয়ে গেল। কাউকে কিছু বলতে পারছি না। হাঁটছি আর হাঁটছি। মাঝে মধ্যে কিছু অন্যে রকমের গন্ধ ভেসে আসাতে কেউ বলে পাশে হাতি আছে কখন আবার কেউ অন্য গন্ধ পেয়ে বলছে বাঘ আছে… আমি তখন আমাকে জিম্ কর্বেট ভাবতে থাকি… না হলে যে আর কোন উপায় নেই।
মাধুরী অপরূপা মিচ্কি মিচ্কি হাসে। অংশু ময়ূখ বনচঁড়ালের পাতার মত বিস্ময়ে ওঠে নামে। অপরূপা বলে-
- তারপর কী হলো কর্বেট মশাই।
- হাঁটছি আর ভাবছি- ওরা কখন ফেরার কথা বলে। দেখি কাবু আকাশের দিকে দ্যাখে। তারা দ্যাখে। বলে স্যার অনেক রাত হয়ে গেল। আজ মনে হয় তেমন কিছু হবার নয়। ফিরে যাওয়া যায় স্যার। আমি ঘড়ি দেখি; দেখি তখন রাত দূটো বাজে। আমি বুকে জোর এনে গম্ভীর স্বরে বললাম – ঠিক আছে। তখনো বুঝতে পারিনি কপালে কী আছে। ধ্রুবতারা কেন যেন মিট্ মিট্ করে হাসছে আর আমরা ডানে বাঁয়ে ঘুরছি। হঠাৎ কাবু দাঁড়িয়ে পড়ে বলে- স্যার ফেরার রাস্তা হারিয়ে ফেলেছি…
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴