রং নাম্বার/শুক্লা রায়
রং নাম্বার
শুক্লা রায়
কীভাবে গোল গোল চাকা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ফোনের নাম্বার ডায়াল করে সেটা জানতেই আমাকে কলেজ অবধি পৌঁছতে হয়েছিল। তার আগে ফোন যা দেখেছি সে শুধুমাত্র ভিডিওতে। সেই আমি কিনা আস্ত একটা ফোন কিনে ফেললাম। অবশ্য ততদিনে মাস্টার্স কমপ্লিট করে বিয়ের জন্য হা-পিত্যেশ করে বসে আছি। প্রেমিক প্রবর চাকরি পেয়ে বেশ বড় সড় দূরত্বে পগারপার। তা বলে আমি ছাড়ব কেন? অতএব দ্রুত যোগাযোগের মাধ্যমটির সুবিধা গ্রহণের চেষ্টা। চিঠি চিঠির মতো দৌঁড় ঝাঁপ করলেও দিনে একবার একটুখানি কথা বলার সুযোগ পাওয়া গেল। সেও বড্ড ঝকমারী। বাড়িতে বিএসএনএল আউট অফ সার্ভিস। তখনও জিও, ভোডাফোনের নামটুকুও শুনিনি। সুতরাং ফোন হাতে রাস্তার এমাথা ওমাথা খুঁজে অদৃশ্য ঈশ্বরকে ধরার করুণ প্রচেষ্টা। এই ফোন বিভ্রাট এখন হলে তো মোটে পাত্তা দিতাম না। কিন্তু তখনকার বিষয়টিই অন্যরকম। তবে কথা হত সামান্যই। বিল উঠত সাংঘাতিক। বিলের ভয়েই প্রেমই একটু কাট ছাঁট করে কম কম করতাম। তাছাড়া তিনি যেখানে থাকেন সেখানে মোবাইল ফোন চালুই হয়নি, পুরনো ল্যান্ড লাইনেই কথা বলতে হত বলে বিলও উঠত বেশিই। অবশেষে এত ঝামেলার প্রেমকে একেবারেই থামিয়ে দেবার জন্য বিয়েটাই হয়ে গেল। একবার বিয়ে হলে কী আর প্রেম থাকে! সেজন্য ফোনেরও কদর কমে গেল আমার কাছে। যেখানে সেখানে পড়ে থাকে। আমার গুণধর বেটি সুযোগ পেয়ে একবার বালতির জলে চুবিয়ে স্নান করাল। তা নোকিয়ার শক্তি অসাধারণ। তারপরেও দিব্যি চলতে লাগল। তবে আমাদের প্রেম বন্ধ হলেও অনেকের আবার ফোন পেয়ে প্রেম সহজলভ্য হল। ততদিনে ইনকামিং বিল তুলে দিয়েছে। অতএব বয় ফ্রেন্ডের টাকায় রিচার্জ করে প্রাণখুলে অবাধে প্রেম করার মহান সুযোগ পাওয়া যাচ্ছে। আমার তাতে কী লাভ! দীর্ঘশ্বাস চেপে মেয়ের আলাদা রান্না, আমাদের আলাদা রান্না এসবেই মন দিই। দিনে দশবার মেয়ের প্যান্ট পাল্টানো আর কাচাকাচিতেই জীবন সীমাবদ্ধ। আমার এসব ভেবে কী লাভ! মাঝে মাঝে দুঃখ ভুলতে পুকুর পাড়ে গিয়ে দাঁড়াই। দূরের ধানক্ষেতের দিকে তাকাই।কখনো হাটবারের দিন একটু আগে বিকালের চা টা করে দিয়ে শাড়ির কুচি, আঁচল ঠিক করে পাশের বাড়িতে ঘুরে আসি। আবার হাটুয়া ফেরার আগেই বাড়িতে হাজির। এই তো জীবন!
তবে শুনি, দেখি, এখন নাকি রং নাম্বারের সুবিধাটাও প্রেমের জন্য খুবই অনুকূল একটা ব্যাপার। একবার লেগে গেলেই কেল্লা ফতে। ভুলভাল নাম্বার ডায়াল করলেই একটা রং নাম্বার তৈরি হয়ে যায়। তারপর তো শুরুই হয়ে গেল, মাঝে মাঝেই কথা, রাত জেগে, দিনের বেলা - সবসময়। কে আটকাবে। তার দরকারও নেই। প্রেমের পুরনো ধারণা পুরো বদলে গেল। যাত্রা শুনতে গিয়ে, কীর্তন শুনতে গিয়ে, অষ্টমীর অঞ্জলি দিতে গিয়ে, সরস্বতী পুজো সব ফেল মেরে গেল। তার জায়গায় চলে এল রং নাম্বার।
আমি বেচারা বিয়ে করে ফেলেছি! এসব সুবিধা থেকে বঞ্চিত। তাও আবার প্রেমের বিয়ে! তা সেদিনও প্রেমের বিয়েকে শাপ-শাপান্ত করতে করতে গলদঘর্ম হয়ে রান্না করছি। এরমধ্যে পাশের বাড়ির জা এসে ঘোমটা ফাঁক করে দরজায় দাঁড়াল। "শুনছ নাকি ফুলের মা, ছাড়ার পাড়ে ছেলের বাড়িতে একটা মেয়ে চলে এসেছে।"
এটা একদম নতুন খবর এবং বিরাট বড় খবর। অ্যাদ্দিন ছেলেতে-মেয়েতে পালিয়ে বিয়ে করত, সেটাই চল ছিল। এবার একেবারে ছেলের বাড়িতে মেয়ে একাই চলে এসেছে! আমি থ। কীভাবে?
কীভাবে আবার। ছেলের দাদা বাইরে কোথায় কাজ করে, কেরালা না কোথায়। বৌ বাচ্চার সাথে কথা বলার জন্য ফোন কিনে থুয়ে গেছে। সেই ফোন দিয়াই মাথাভাঙার কোন মেয়ের সাথে প্রেম। সে মেয়ে আজকে ঠিকানা খুঁজে খুঁজে আইসাও পড়ছে।
এখন কী বিয়ে হবে?
জা মুখ ব্যাঁকায়। বিয়ে আর কী হবে। মেয়ে ফোনে যা শুনছে, আইসা তো দ্যাখে ছেলের কিছুই নাই। ভাঙা বাড়ি-ঘর। সে দেখেই মুখ কালো। তারপর ছেলেকে যখন দেখল, দাঁত উঁচু, ছেঁড়া লুঙ্গি পরা, গায়ের রঙ হাঁড়ির কাজল, সে দেখেই মেয়ে দাঁত কপাটি লেগে অজ্ঞান। জ্ঞান ফেরার পর শুধু একটাই কথা "আমারে বাড়ি দিয়া আস।"
ছেলের বাড়িতে কী হচ্ছে তা জানা নেই। উড়ো উড়ো খবর কিছু আসছে। কিন্তু আমাদের উত্তেজনা এবং দুশ্চিন্তা কোনোটারই খামতি নেই। ফাঁক পেলেই দুই জা মিলে গুজগুজ ফুসফুস। কিন্তু শান্তি আর কোথায়, সঠিক খবরটিই যদি না পাই! অতএব রাস্তায় বেরিয়ে একে তাকে ডেকে জিজ্ঞেস করে খবর জানার চেষ্টার সাথে যারা জানে না তাদেরও জানানোর পুরো দায়িত্ব আমরা আমাদের পবিত্র কাঁধে তুলে নিলাম। সর্বশেষ খবর পেলাম সন্ধ্যায়। মেয়ের সব ওজর আপত্তি চোখের জলকে অস্বীকার করে পুরোদমে বিয়ের আয়োজন চলছে। বিয়ে করবি না তো এসেছিস কেন? ছেলে ছেঁড়া লুঙ্গি পাল্টে প্যান্ট পরে ফিটফাট হয়ে ঘুরলেও মেয়ে সেই যে বিছানা নিয়েছে আর ওঠেনি। শরীর পুরো ছেড়ে দিয়েছে। শুনে আমাদের মনখারাপ হল। আহারে! শেষমেশ বিয়ে দিয়েই ছাড়বে!
ওমা! পরদিন সেই ছেলেকে দেখি আগের মতোই হতচ্ছাড়া পোশাকে গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে! বাড়ির টিউবওয়েলটার ওয়াশার পড়ে গেল বলে বাইরে রাস্তার দিকের টিঊবওয়েলে জল নিতে এসেছি। আশ্চর্য হয়ে বললাম, "কি রে, তোর না বিয়ে হল কালকে?"
পান খাওয়া দাঁতগুলো মেলে ছেতরে একটা হাসি দিল প্রথমে। তারপর বলল, "বিয়ে তো করতাম। আর পাঁচমিনিট বৌদি। সব ঠিক ছিল। মেয়েটাকেও সাজানো টাজানো হয়ে গেছিল। এর মধ্যেই ওরা এসে নিয়ে গেল।"
"কারা? আটকাতে পারলি না?"
এবার আমি ছেলেটার পক্ষ নিলাম। কালকে অবধি মেয়েটার দুর্দশার কথা ভেবে বুকটা ফেটে যাচ্ছিল। অবশ্য ছেলেটার কোনো হেলদোল নেই দেখলাম। অম্লান বদনে বলে দিল, "মেয়েটার বাবা-মা, পিসি। পুলিশও নিয়ে এসেছে। মেয়ের আঠারো হয়নি যে।"
বাহ্, স্পোর্টিংলি নিয়েছে দেখলাম বিষয়টা। ছেলেটার স্পিরিট আছে তো!
"তোর মনখারাপ হয়নি রে!"
"কিসের মনখারাপ বৌদি? ফোনটা আছে না। আরো কত রং নাম্বার লাগবে!"
তাই তো!
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴