ভাস্কর্যের আঁতুড়ঘর-১৮/মৈনাক ভট্টাচার্য
ভাস্কর্যের আঁতুড়ঘর (পর্ব-১৮)
মৈনাক ভট্টাচার্য
অরুণ যোগীরাজের ইন্ডিয়া গেটের নেতাজী
প্রতিদিন শব্দের ভিড়ে কখনও নুতন কোন শব্দ এসে যায়। এই সব শব্দের উৎস ধরার তাগিদে মনের ভেতর জটপাকাতে থাকে। দুইহাজার বাইশ সাল, নেতাজির একশ পঁচিশতম জন্মদিন। সরকারী ভাবে ঘোষণা করা হল, এই উপলক্ষে তাঁর পূর্ণাবয়াব মূর্তির থ্রিডি হলোগ্রাম উন্মোচন করবেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। পরবর্তীতে সেই মূর্তি পাকাপাকি ভাবে তৈরি হলে তা ইন্ডিয়া গেটেই স্থাপন করা হবে। প্রহেলিকার মত সাধারণ মানুষের মনে দানা বাঁধতে থাকে- মূর্তির হলগ্রাম ব্যাপারটা কী?’ খোঁজ নিয়ে জানা গেল হলোগ্রাম মূর্তি হল প্রজেক্টরের মাধ্যমে লেজার দ্বারা তৈরি করা একটি প্রতিবিম্ব। পুরো বিষয়টি আলোর মাধ্যমেই তৈরি করা সম্ভব।
এক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়েছিল দুটি ফোর-কে রেজলিউশন প্রজেক্টর। যেগুলির ব্রাইটনেস বা উজ্জ্বলতা ত্রিশ হাজার লুমিনাস ক্ষমতা সম্পন্ন। অত্যন্ত মূল্যবান এই প্রজেক্টরগুলি এক একটির প্রক্ষেপন ক্ষমতা ছিল দৈর্ঘ-প্রস্থে তেরফুট করে বর্গ ক্ষেত্র জুড়ে। শুধু প্রজেক্টরই নয়, ওই হলোগ্রাম মূর্তি তৈরি করার জন্য একটি হলোগ্রাফিক স্বচ্ছ ঝুলন্ত পর্দাও ব্যবহার করা হয়েছিল। এই পর্দা এতটাই স্বচ্ছ ছিল যে কারোর পক্ষে পর্দার অবস্থান বোঝাও ছিল প্রায় দুষ্কর। ওই হলোগ্রাফিক পর্দায় সম্পূর্ণই ত্রিমাত্রিক প্রতিবিম্ব দেখা সম্ভব। এইসব কারনে সাধারণ দর্শকের মনে হবে তিনি যেন একটা সত্যিকারে মূর্তিই দেখছেন, কোন প্রতিবিম্ব নয়।
ইন্ডিয়া গেটের এই যে ক্যানোপি, যেখানে নেতাজীর হলোগ্রাম মূর্তি দেখানো হল সেটা আমরা কিন্তু খালি দেখতেই অভ্যস্ত। এটি মুলত ভারতের জাতীয় স্মৃতিসৌধ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ও তৃতীয় ইঙ্গ-আফগান যুদ্ধে নিহত নব্বুই হাজার ভারতীয় সেনা জওয়ানদের স্মৃতিরক্ষার্থে এই স্মৃতিসৌধটি নির্মিত হয়। প্যারিসের ‘আর্ক দে ত্রিম্ফ’ এর আদলে নির্মিত এই সৌধটির নকশা করেন বিশিষ্ট ব্রিটিশ স্থপতি স্যার এডউইন লুটিয়েনস। এটি লাল ও সাদা বেলেপাথর ও গ্র্যানাইট পাথরে তৈরি এই সৌধের আগে নাম ছিল "অল ইন্ডিয়া ওয়ার মনুমেন্ট"। ইন্ডিয়া গেটের এই যে তিয়াত্তর ফুট উচ্চতার ক্যানোপি, তার ইতিহাস বলে- রাজা পঞ্চম জর্জের রাজ্যাভিষেককে সম্মান জানাতে তা নির্মান করা হয়েছিল খুব জাঁকজমকপূর্ণ ভাবে। মহাবলীপুরমের ষষ্ঠ শতাব্দীর তোরণের অনুপ্রেরনায়। এই ক্যানোপিতে স্থাপন করা হয়েছিল রাজা পঞ্চম জর্জের রাজ্যাভিষেকের পোষাকে সুসজ্জিত একটি মার্বেল মূর্তি। এই মূর্তিটিও তৈরি করা হয়েছিল সেই সময়ের বিশিষ্ট ব্রিটিশ ভাস্কর এবং যুদ্ধ স্মারক বিশেষজ্ঞ সার্জেন্ট চার্লস জ্যাগারকে দিয়ে। স্বাধীনতার দুই দশক অব্দি এই মূর্তি থাকলেও এক সময় প্রবল বিতর্ক তৈরি হয়। কেন স্বাধীন ভারতে দিল্লির এমন সম্ভ্রান্ত এক জায়গায় রাজা পঞ্চম জর্জের রাজ্যাভিষেকর এই মূর্তি এখনও শোভা পাবে। বিতর্কের জেরে পঞ্চাশ ফুটের বিখ্যাত এই মার্বেল মূর্তি ১৯৬৮ সালে উত্তর দিল্লির যমুনায় আন্তঃরাষ্ট্রীয় বাস টার্মিনাসের কাছে করোনেশন পার্কে স্থানান্তরিতও করানো হয়। এই ক্যানোপি তারপর থেকে দীর্ঘদিন খালি থাকায় বিভিন্ন সময় নানান মূর্তি এখানে বসানোর ভাবনাও হয়। যেমন উনিশশো চুরাশিতে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর মৃত্যুর পর একবার তাঁর মূর্তির ভাবনা হলেও ইতিহাসবিদ সহ বিরোধী রাজনৈতিক মতাদর্শের সহমত না হওয়ায় তা বাস্তবায়িত করা সম্ভব হয়নি। সেই সময় ইতিহাসবিদরা যুক্তি দিয়েছিলেন যে, শূন্যতাই দেশের অতীতের স্মারক হিসেবে কাজ করুক। পাঁচ দশকেরও বেশি সময় ধরে, ছাউনিটি তাই খালিই ছিল। যার জন্য গ্র্যান্ড ক্যানোপির নামই হয়ে যায় ‘খালি ছাউনি’।
# #
নেতাজীর মূর্তি তাঁর একশ পচিশতম জন্মদিবসে ইন্ডিয়া গেটে স্থাপনের ভাবনার প্রস্তাবনা পাশ হতেই ডাক পড়ে মহিশূরের পাথর খোদাই ভাস্কর অরুন যোগীরাজের। তাঁর তৈরি আদি শংকরাচার্যের বারো ফুট মূর্তি প্রধানমন্ত্রী ইতিমধ্যেই দুইহাজার একুশ সালে কেদারনাথে উন্মোচন করেছেন । তাঁর মূর্তিকলা দক্ষতা নিয়ে কিছু বলার নেই। আলোচনায় ঠিক হয় এই মূর্তি হবে গ্রানাইট পাথরের এবং উচ্চতা হবে আঠাশ ফুট। সেইমত শিল্পীর তরফ থেকে প্রাথমিক ভাবে ম্যাকেট(মূর্তির খুদ্র সংস্করণ, যা হবে মূল মূর্তির প্রতিরূপ) তৈরিও হয়ে যায়। মূল মূর্তি বানানোর ছাড়পত্র পেতেই শিল্পীর প্রথম ভাবনা হয় এই গ্রানাইট কোথা থেকে আসবে। অনেক খোঁজাখুজির পর তেলঙ্গানার খাম্মামএ মেলে মনমতো পাথর। কাটার পর আনুমানিক ওজন দাঁড়ায় প্রায় দুইশ আশি টনের মত। মাথায় বাজ পড়ার উপক্রম, এত ভারী গ্রানাইট পাথর, খাম্মাম থেকে প্রায় সাড়ে ষোলশো কিলোমিটারের কিছু বেশি পথ। কি ভাবে আনা যাবে নয়াদিল্লিতে। অনেক চিন্তা ভাবনার পর এর জন্য বিশেষভাবে ১৪০টি চাকা সহ একটি ১০০ ফুট লম্বা দৈত্যকার ট্রাকও তৈরি করা হয় এই গ্রানাইট পাথর বহন করবার জন্য। এবং এই ভাবেই শেষ পর্যন্ত এই পাথর দিল্লিতে এসে পৌঁছায়।
অরুন পাঁচ প্রজন্মের ভাস্কর। ছেনী হাতুড়ি তাঁর রক্তে। এম বি এর পাঠ নিলেও তাই সে জাত ভাস্করই। মূল মূর্তি তৈরির বিশেষ ভাবনা মাথায় রেখে ভাস্কর অরুন তাই ঠিক করলেন মূর্তিটির বিশেষতঃ হবে ঐতিহ্যগত কৌশল এবং আধুনিক সরঞ্জাম ব্যবহারে। এবং তা হবে সম্পূর্ণ হাতে তৈরি সনাতনী এবং সাবেকি প্রথায়। সে না হয় হবে, কিন্তু হাতে সময় বড্ড কম। কাজ করতে হবে যুদ্ধকালীন তৎপরতায়। ভাস্কর অরুণ তাই সহযোগী হিসেবে রাজস্থান, অন্ধ্রপ্রদেশ, তামিলনাড়ু থেকে বেছে বেছে নিয়ে এলেন বেশ কিছু সুদক্ষ সহ ভাস্কর। সংখ্যায় সেটাও প্রায় ছয়শ মত তো হবে। সকলের কমবেশি ছাব্বিশ হাজার ঘণ্টার অক্লান্ত পরিশ্রমে তৈরি হল জেট ব্ল্যাক গ্রানাইটের এই নেতাজির মূর্তি। দুইশ আশি টন ওজনের গ্রানাইট পাথরের চাঁই খোদাই করে তৈরি করার পর এই মূর্তির ওজন দাঁড়াল পয়ষট্টি টন বা পয়ষট্টি হাজার কেজি।
দুই হাজার বাইশের পচাত্তরতম স্বাধীনতা দিবসে এই মূর্তিটি ইন্ডিয়া গেটে বসানো হবে বলে জানুয়ারিতেই আগাম ঘোষণা করলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। প্রশাসনিক কারনে পরিকল্পনায় কিছুটা বদল এনে আটই সেপ্টেম্বর রাজপথের নাম বদলের সাথে সাথেও কেটে গেল এই অঞ্চল জুড়ে আর এক ব্রিটিশ কলোনীয়াল হ্যাংওভার। পঞ্চম জর্জের মূর্তির জায়গায় আগামী প্রজন্মের ইতিহাস হয়ে রইল নেতাজির এই মূর্তি। আবার নুতন করে ইতিহাসের লেখা হয়ে গেল প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ও তৃতীয় ইঙ্গ-আফগান যুদ্ধে নিহত ভারতীয় সেনা জওয়ানদের স্মৃতির ‘খালি ছাউনি’র নুতন ইতিহাস। তৈরি হয়ে গেল অমর কথার নুতন এক অধ্যায়। ইন্ডিয়া গেটের এই ক্যানপিতে- পঞ্চম জর্জের ইতিহাসকে বাস্তবিকই অবজ্ঞা করতে পারার মত এমন সম্মানজনক জাতির এক পাহারাদারের কথকথাও।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴