বাংড়ি তিতি হাউড়ি শেষে
পর্ব-১৮
মিশা ঘোষাল
**********************
"টোটোপাড়ায় খাবারের সন্ধান ও সীতারামদার হোটেল"
দূরন্ত নদীপথ-
পাথরের চাই
রাস্তায় হাতির পাহারা
হরিণের দে ছুট-
ময়ূরের ময়ূরকন্ঠি পেখম
বানরের ঘুর ঘুর
বন-মোরগের ঝুঁটি
আর বৃষ্টির ঝির ঝির !
এসবের
মাঝেই চোখের দৃষ্টিকে একটু ঘুরিয়ে নিতেই পিছনের দিকে তাকিয়ে দেখি এক পাল
বাইসন ! তিতির কিনারে। তিতি নদীর পাড় ঘেঁষে জলদাপাড়া অভয়ারণ্যের বিস্তার।
এই অরণ্যসহ টোটোপাড়ার রাস্তার অপর পাশে লঙ্কাপাড়া রেঞ্জের আরও একটি
অভয়ারণ্য এসে মিশে গেছে যে পথে, সেই পথ ধরেই টোটোপাড়ার দিকে আরো একটু
এগিয়ে গেলেই এসে পড়ে 'ভগজ্যোৎ' গ্রামটি। এখান থেকেই টোটোপাড়া-বল্লালগুড়ি
গ্রাম পঞ্চায়েতের শুরু। এই পয়েন্টেই ভগজ্যোৎ-এর ফরেস্ট রেঞ্জ অফিস।
বাইসনগুলিকে
দূর থেকে দেখা যাচ্ছে ! কালো কুচকুচে শরীর। বিশাল বড় মোষের মতো দেখতে এক
একটা। একটু এপাশ ও পাশ হলেই চেটে দেবে শরীরের সব লবন ! বুনো বাইসন
টোটোপাড়ার এই পথের জঙ্গলের ভয়ংকর জীব। দেখতে খুব শান্ত, নিরীহ গোছের। পায়ের
দিকে তাকালে সাদা মোজা পরে আছে মনে হয়। কিন্ত এই বাইসনের কবলে পড়ে
পথচারীদের মৃত্যুর কথাও শোনা যায়। বাইসনের নাকি লবনই একমাত্র প্রিয় খাবার।
তাই কোনো মাংস ভক্ষণের আগে ওরা সেই মাংসের লবনটুকু চেটে সাবাড় করে আগে।
তারপর অন্য অংশ।
বাইসনের এক পাল চোখে পড়লে তাই গাড়ির
স্পীড বাড়িয়ে ছুটতে হয় সেখান থেকে। এরপর দয়ামারা ঝোরার রাস্তা, ঝোরার জল
শুকিয়ে এসে যে পাথুরে পথ তৈরি হয়েছে, সেখানে এসে হঠাৎ প্রচন্ড শব্দে গাড়ি
থেমে গেলে আৎকে উঠি আমরা। গাড়ির চাকা হঠাৎ পাংচার হয়ে যায়। আর গহীন জঙ্গলে
আমাদের গাড়ি থমকে যায়।
চাকা খোলা ও মেরামতের কাজ
চলে। পাশেই ছিল হাতির পাল সেদিন! বনকর্মীদের জঙ্গল সাফারি এসে হঠাৎ দাঁড়িয়ে
পড়ল আমাদের পাশে। বন দপ্তরের কর্মীরা চট জলদি জিপটি থামিয়ে নেমে পড়ল
আমাদের সামনে।
যাক বাবা বাঁচা গেল!
দেখলাম
ঐ ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের কর্মীদের হাতে বন্দুকও আছে। আমরা এবার ভয়হীন হয়ে
নেমে পড়লাম গাড়ি থেকে। আমাদের নামতে দেখে এক বনকর্মী বন্দুক হাতে এগিয়ে এলো
আমাদের সামনে। লিকলিকে শরীর, হাতের বন্দুকের ভারে নিজেই বেসামাল! এগিয়ে
এসে হাত দিয়ে একটি ভঙ্গিমা এঁকে বুঝিয়ে দিল হাতির লম্বা শুঁড়। ইঙ্গিতে
হাতির মূকাভিনয় করে দেখিয়ে বলল,
"এখানে হাতি দেখেছেন
আপনারা? একটি পাগলা বুনো দাঁতাল দলছুঁট হয়ে এই রাস্তায় এসেছে। তাই আমরা খবর
পেয়ে ছুটে এসেছি এখানে। এই দেখুন আমার হাতে বন্দুকের গুলি। ঘুম-পাড়ানি
ওষুধ মাখিয়ে এনেছি। আপনারা শুধু বলুন কোথায় ঐ পাগলা হাতি। আমি দেখতে
পেলেই... স্যুট আউট করে দেব। গুলি মেরে ঘুম পাড়িয়ে দেব ঐ পাগলা হাতিটাকে।"
একদিকে আমাদের জিপটি তখন অচল হয়ে অভয়ারণ্যের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে।
এর
উপর পাগলা হাতির দলছুট হবার খবর! ভয়াবহ এই পরিস্থিতিতে আমাদের কয়েকজনের
আতঙ্কের কথাবার্তা শুনে এগিয়ে এলেন জলদাপাড়ার রেঞ্জ অফিসার নিজেই। বললেন,
"আমরা তো আছি। আপনাদের কোনো ভয় নেই ম্যাডাম।"
আর
কী করা যাবে? ওনার আশ্বাসে কিছুটা ভয় কমে গেলেও, স্যাংচুয়ারিতে দাঁড়িয়ে
কতটা আর নিজেকে অবিচল রাখা যায়? রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষার পর মনে হল এবার বাঁচা
গেল। গাড়ি স্টার্ট দিল আমাদের।
অতঃপর আমাদের জিপের
চাকা মেরামত হয়ে গিয়ে নতুন চাকা লাগানো শেষ হলে আমরা ছুটলাম আবার সেই
জঙ্গলের ঝোরার রাস্তা দিয়ে হাউড়ির দিকে আবার।
এরপর
এলো হাউড়ির এবড়ো থেবড়ো পাথরের নদী পথ । হাউড়ি তার নিজস্ব এই গতিপথে ফেলে
রেখেছে বড় বড় পাথর। পাথর সরিয়ে রাস্তা বানানোর কাজে ব্যস্ত 'একশো দিনের
কাজে'র মহিলারা। আমরা হাউড়ির পথ পেরিয়ে অবশেষে পৌঁছে গেলাম টোটোপাড়ায়।
টোটোপাড়ায়
পৌঁছে সেদিন আমাদের সবারই খুব খিদে পেয়েছিল। ভাতের খিদে। টিফিন বক্সের আনা
খাবার ব্যাগেই থাকল। আমরা সেদিন বাঙালিআনায় ভরপুর দুপুরের খাবারের
সন্ধানে বেরিয়ে পড়লাম। গিয়ে পৌঁছলাম টোটোপাড়া বাজারে। সেখানে একমাত্র
বাঙালি খাবারের হদিস আগেই জানা ছিল। টোটোপাড়ায় সেই একমাত্র হোটেলটি আজও
রয়েছে। নাম "সীতারামদার হোটেল"!
একমাত্র বাঙালি হোটেল টোটোপাড়ার এটি। আর সীতারামদার পরিবারই টোটোপাড়ায় বসবাসকারী একমাত্র বাঙালি পরিবার। সীতারামদার নাম শুনেছি আগেই।
খাবারও
আনিয়েছি। সেই প্রথম যখন টোটোপাড়ার এই বিদ্যালয়ের কাজে যোগদান করেছিলাম
২০০৮ সালে, সেই সময় আমি রূপচাঁদ টোটোর বাড়ির একটি ঘর ভাড়া নিয়েছিলাম, তখনও
এই সীতারামদার হোটেল থেকেই খাবার আসত আমার। কিন্তু সশরীরে উপস্থিত হলাম এই
প্রথম সেদিন।
দাদা বাঙালি, এগিয়ে এলো, নমস্কার করে। বললেন,"কী খাবেন ম্যাডাম"?
আমি
বললাম, "যা আছে তাড়াতাড়ি দিয়ে দিন, গরম হলেই চলবে।" আমাদের স্কুলে আজ অনেক
কাজ। ক্লাস করিয়ে টিফিনের পর আবার Annual Sports meet-এর প্রাকটিস চলছিল
সেসময়।
বৌদিও এগিয়ে এলো সীতারামদার সাথে। সীতারামদার দুই মেয়ে। সবিতা ও ইরানী। দুজনই আমাদের স্কুলের ছাত্রী।
বৌদি বলল,"মুরগির ঝোল-ভাত আর ভুটানি স্কোয়াসের চচ্চড়ি আছে ম্যাডাম। ডাল সিদ্ধ হচ্ছে। আলুভর্তা করে দিতে পারব।"
সীতারামদা
বললেন, "এখানে পাহাড়ের আলুভর্তা বিশেষ ভালো একটি পদ। এখানকার সবাই খুব
পছন্দ করে। টমেটো পুড়িয়ে আলু সিদ্ধ করে, কাঁচা লঙ্কা দিয়ে ঝাল করে, কাঁচা
পেয়াজ সহযোগে সর্ষের তেল দিয়ে বেশ ভালো করে মাখা করে দেব। বেশি সময় লাগবে
না। আপনারা বসুন।"
এই
সবকিছু ছিল আমাদের সেদিনের খাবারের মেনু। খিদের সময় এরকম সুস্বাদু গরম গরম
খাবার পেলে আর কি ? জম্পেশ করে খাওয়াদাওয়া সেরে ফিরে এলাম স্কুলে আবার।
কাজ সেরে আবার সেই একই পথে ফেরা !
ব্যাক টু মাদারিহাট...
টোটোপাড়ায় এসে খাবার আবার কোথায় ?
সোজা চলে যাবে বাজারের মোড়ে...
পাশেই দাঁড়িয়ে সীতারামদা
খাবার রান্না করে !!