পাহাড়ের প্রান্তদেশে সবুজ গালিচায় ঘেরা এলেনবাড়ি/গৌতম চক্রবর্তী
পাহাড়ের প্রান্তদেশে সবুজ গালিচায় ঘেরা এলেনবাড়ি
গৌতম চক্রবর্তী
===================================
‘সহজ উঠোন’ এর বাগিচা সফরে সবুজ গালিচাতে পদচারণা করতে গিয়ে জানছি চা বাগিচার কত অজানা তথ্য, কত জীবনাখ্যান, সরকারি বেসরকারি জনকল্যাণমূলক প্রকল্পের কথা। দেখছি ভালো নেই ডুয়ার্সের এই সরল সাধাসিধা মানুষগুলি। তাই আদিবাসী – নেপালী – মিশ্র ভাষাভাষী মানুষের এই ডুয়ার্সকে চেনার প্রয়াসে বাগিচা সফরে আজ এলাম এলেনবাড়ি চা বাগানে। কোচবিহারের উত্তর দিক এবং ভুটান পাহাড়ের দক্ষিণ উপত্যকায় অবস্থিত ছিল ১৮টা
দুয়ার। প্রত্যেক দুয়ার ছিল কতগুলি তালুকে বিভক্ত। এই দুয়ারগুলি দিয়ে ভুটানে প্রবেশ করা সহজসাধ্য ছিল বলে ইংরেজরা এই অঞ্চলকে বলত ডোর অব ভুটান। ফলত ভুটান পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত উত্তরের বিশাল ভূখণ্ডই ডুয়ার্স। ভুটানের মধ্য দিয়ে তিব্বতের সঙ্গে যে বাণিজ্য পথ তার ট্রানজিট রুট ছিল এই আঠেরোটি 'দুয়ার’ বা ‘ডোর’ বা ডুয়ার্স। এই দরজাগুলি দিয়েই ছিল সুপ্রাচীন ট্রেড রুট বা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যপথ যা দিয়ে হিমালয়ের অন্তর্গত ভুটান পাহাড়েও প্রবেশ করা যেত। দিগন্তবিস্তৃত সবুজ চা-বাগিচার চাদর, জল-জঙ্গল পরিপূর্ণ বনভূমি, হস্তীযূথের বৃংহতি, ছোপছোপ হলুদের চকিত চমক, গন্ডারের দীপ্ত বিচরণ, ভীত হরিণের কাজল টানা চোখের মায়াবী চাউনি এবং কোচ, মেচ, রাভা, গারো, রাজবংশী, নেপালি, আদিবাসী মানুষের নন্দনকানন এই ডুয়ার্স। পশ্চিমে তিস্তা থেকে শুরু করে পূর্বে সংকোশ নদী পর্যন্ত যে বিশাল ভূখণ্ড তা ছিল সুদূর অতীতে কোচবিহার সাম্রাজ্যের অন্তর্গত। কিন্তু কোচবিহারের দূর্বলতার সুযোগ নিয়ে ভুটান কোচবিহারকে দীর্ঘদিন দখল করে রাখে। কালিম্পংকে ১৭০৬ সালে ভুটান সিকিমের কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে তা দখল করে। দখল করার পূর্বে কালিম্পং যখন সিকিমের অংশ ছিল তখন এর নাম ছিল ডামসাং বা ডালিমকোট। তিব্বতে যেতে হলে ডালিমকোট দিয়েই যেতে হত।
উত্তরের কাঞ্চনজঙ্ঘার বর্ণচ্ছটা, বর্ষার খরস্রোতা জলপ্রবাহের উদ্দাম নৃত্য, শ্যামল ঘন বনানীর অসংখ্য বন্যপ্রাণীর হিমশীতল দৃষ্টি, সবুজ আঁচল এর মতো তরল সবুজ সোনার দিগন্তবিস্তৃত চা সাম্রাজ্য ডুয়ার্সে যে মায়াময় সৌন্দর্য স্থাপন করেছে তার তুলনা দেওয়া ভার। সুন্দরী ডুয়ার্সের এমন প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য এই রাজ্যে তো বটেই, সারা ভারতবর্ষের পর্যটনকেন্দ্রিক প্রতিযোগিতায় অনন্যা হওয়ার দাবি রাখে। ডুয়ার্সের মাটিতে প্রকৃতি স্তরে স্তরে সাজিয়ে রেখেছে নানান প্রাকৃতিক সম্পদের প্রাচুর্য। গরবিনী ডুয়ার্স স্বর্ণগর্ভা। সে তার প্রাকৃতিক সম্পদের প্রাচুর্য গর্ভে ধারণ করে অপেক্ষা করে ছিল কবে আধুনিক প্রকল্প রচয়িতা কোন রামের স্পর্শে তার বন্ধ্যাত্বের অভিশাপ ঘুচিয়ে সে প্রসব করবে তার শিল্পসাম্রাজ্য। সেই উন্নতির প্রথম তাগিদ এল ডুয়ার্সের চা বাগান প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে। কারণ ডুয়ার্সের চা বলয় জন্ম দিয়েছিল আজকের চা শিল্প সাম্রাজ্যকে। ডুয়ার্সের চা বাগানগুলিকে কেন্দ্র করেই তো গড়ে উঠেছিল এখানকার একের পর এক জনপদ। অনেকেই বুঝতে পারল চা বাগান একটা স্বর্ণখনি। সুতরাং সেখানে আস্তে ধীরে পা ফেলা যেতে পারে। হাতে যখন টাকা পয়সা আছে তখন দেখাই যাক না ঝুঁকি নিয়ে। যদি লেগে যায় তাহলে তো পোয়াবারো। যখন ধীরে ধীরে ডুয়ার্স থেকে সাহেবরা বিদায় নিল তখন বাঙালিরা চা বাগান গড়ে তুলল খুব দ্রুতগতিতে। পাশাপাশি চা বাগানের অন্দরমহল দখল করে নিল সাধারণ মানুষ যাদের পরনে খাঁকি হাফপ্যান্ট আর হাফশার্ট। একে একে শুরু হলো শেয়ার বিক্রি। শেয়ার বিক্রি হল আর চা বাগানের মালিকানা হস্তান্তরিত হল।
আজকের সফর এলেনবাড়ি। আজকের সফর আমার স্বল্প দূরত্বের। নামব বাগরাকোট অথবা ওদলাবাড়ি। যাব এলেনবাড়ি, বাগরাকোট, লিজ রিভার, শওগাঁও বা সোনালি হয়ে মানাবাড়ি, পাথরঝোরা— তাই একটু দ্বন্দ্বে পড়লাম শিলিগুড়ি জংশন থেকে সকাল ৭.১৫ এর বামনহাট প্যাসেঞ্জারে উঠে যে কোথায় নামব? বাগরাকোট না ওদলাবাড়ি? কারণ বাগরাকোট, ওয়াশাবাড়ি, এলেনবাড়ি নামতে গেলে বাগরাকোটে নামতে হবে। আবার যদি মানাবাড়ি হয়ে পাথরঝোরা যাই তাহলে ওদলাবাড়িতে নামতে হবে। শেষ পর্যন্ত ওদলাবাড়িতে নামব বলেই সিদ্ধান্ত নিলাম। প্যাসেঞ্জার ট্রেনে ওদলাবাড়ি পর্যন্ত প্রায় ৪০ মিনিট লেট। সকাল ৯ টায় নেমে ওদলাবাড়ি থেকে দীপকের সফরসঙ্গী হলাম। দীপক রায়। ভদ্র, শিক্ষিত ছেলেটির একটি অল্টোই জীবন জীবিকার একমাত্র নির্ভরযোগ্য সঙ্গী। সেই অল্টোয় সঙ্গী হয়ে সোজা এলেনবাড়ি। মালবাজার মহকুমার অন্তর্গত এলেনবাড়ি চা বাগানটি এলেনবাড়ি টি কোম্পানি লিমিটেডের অন্তর্গত। ইন্ডিয়ান টি প্ল্যান্টার্স অ্যাসোসিয়েশন বাগানটির ম্যানেজমেন্ট সংক্রান্ত সমস্যাগুলি দেখাশোনা করে। আইটিপিএ এর জলপাইগুড়ির সচিব অমিতাংশু চক্রবর্তী একজন দক্ষ সংগঠক যিনি চা-বাগান মালিকপক্ষের অন্যতম মুখ্য উপদেষ্টা।
১৯৬৭ সালে এলেনবাড়ি টি কোম্পানি বিগত কোম্পানির কাছ থেকে বাগানটির পরিচালনভার গ্রহণ করে। ২০১৭ সালে আমি যখন বাগানের ক্ষেত্রসমীক্ষা করি তখনকার প্রেক্ষিতে বাগানের পরিসংখ্যানগত তথ্য খুব একটা বেশি পরিবর্তনের সম্ভাবনা কম। তবে পরিসংখ্যান পরিবর্তিত হতেই পারে।
সিনিয়ার ম্যানেজার ডি আর চৌধুরী ৯৭৩৫০০১৭১০
ট্রেড ইউনিয়ন ২ সিবিএমিউ, পিটিডব্লিউইউ
গ্রস এরিয়া ৩৮০.০২ হেক্টর গ্র্যান্ট এরিয়া ৩৬২.০২ হেক্টর
আপরুটেড এরিয়া ৬৯.৬৬ হেক্টর
রিপ্ল্যান্টেড ৬৯.৬৬ হেক্টর
ক্ষেত্রসমীক্ষার সময়ে সেচযুক্ত জমির পরিমাণ ২২৯.৪৬ হেক্টর
সেচযুক্ত জমির পরিমাণ ২২৯.৪৬ হেক্টর
প্ল্যান্টেশন এরিয়া ২২৯.৪৬ হেক্টর
প্রতি হেক্টর জমি ১৭০০ কেজির মতো কাঁচা চা-পাতা ফ্যাক্টরিতে আসে প্রসেসিংয়ের জন্য
ক্লার্কের সংখ্যা বড়বাবুকে ধরে ১০ জন মেডিক্যাল স্টাফ ২ জন
ক্ল্যারিক্যাল বা টেকনিক্যাল স্টাফ ২১ জন সাব স্টাফ (ক্ল্যারিকাল) ৬ জন
মোট শ্রমিক পরিবার ৩১১ মোট শ্রমিক ৬২১ মোট জনসংখ্যা ২৫৪২
দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে নিযুক্ত শ্রমিকসংখ্যা ৫১৯ কোনও ক্যাজুয়াল কর্মী নিয়োগ নেই
ফ্যাক্টরিতে নিযুক্ত কর্মী এবং স্টাফ শেষ অর্থনৈতিক বছরে ৬৭ জন সাব স্টাফ ২৬ জন
এলেনবাড়ি চা-বাগানে উৎপাদিত কাঁচা চা পাতা ৰছরে প্রায় ১২ লক্ষ কেজি গড়ে। উৎপাদিত তৈরি চা প্রায় ২.৫ থেকে ৩ লক্ষ কেজি কমবেশি। প্রায় ৪ লক্ষ কেজি চা-পাতা পার্শ্ববর্তী বাগান থেকে কিনে চা পাতা প্রসেসিং করা হয়। তাই বলা যেতে পারে ৬.৫ লক্ষ থেকে ৭ লক্ষ কেজি চা এলেনবাড়ি টি গার্ডেনে উৎপাদিত হয়। বাগানের চা ইনঅরগ্যানিক সিটিসি টি। এলেনবাড়ি চা-বাগানের ব্যাঙ্কিং পার্টনার ব্যাংক অব বরোদা। বাগানের লিজ হোল্ডার এলেনবাড়ি টি কোম্পানি লিমিটেড।এলেনবাড়ি চা বাগানে শিশুদের পোশাক প্রদানের ব্যবস্থা আছে। বাগিচার ছেলেমেয়েরা বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে। বাগরাকোট হায়ার সেকেণ্ডারি স্কুল, এলেনবাড়ি জুনিয়র হাই স্কুলে চা বাগিচার বাচ্চারা পড়াশোনা করে। বাগিচার ট্রাকে করে বাগানের ছেলেমেয়েরা স্কুলে যায়। স্কুলে নিয়ে যাওয়ার যানবাহন এই একটিমাত্র ট্রাকই। বাগিচায় গড়ে ১৮ লক্ষ টাকা শ্রমিকদের প্রভিডেন্ট ফান্ড বাবদ জমা পড়ে। কোনও প্রভিডেন্ড ফান্ড বকেয়া নেই। মজুরি, রেশন, জ্বালানি, ছাতা, কম্বল, কোনও কিছুই বকেয়া নেই। মজুরি চুক্তির নিয়ম মেনেই শ্রমিকদের মজুরি দেওয়া হয়। এলেনবাড়ি চা-বাগিচায় বিগত ৫ বছরে গ্র্যাচুইটি প্রদানের গড় হিসাব ছিল প্রায় দেড় লক্ষ টাকা। মোট ৭ জন শ্রমিক অবসরগ্রহণের পর এই গ্র্যাচুইটি পায়। ৪২ জন শ্রমিকের গ্র্যাচুইটি বকেয়া ছিল। বাগিচায় ২০ শতাংশ হারে বোনাস হয়। বোনাসের আওতাভুক্ত প্রায় সাড়ে পাঁচশো শ্রমিক বোনাসের জন্য গড়ে প্রতিবছর কোম্পানির ২২-২৫ লক্ষ টাকা খরচ হয়।
এবারের চা বাগানের ক্ষেত্রসমীক্ষার নির্যাস ছিল বিধানসভা পরবর্তীকালীন বাগিচা রাজনীতির ভিন্নধর্মী ধারা। তাই বেরিয়ে পড়েছিলাম মালবাজার এবং মেটেলি সার্কিটের বাগানগুলির ক্ষেত্রসমীক্ষা করতে। মালবাজার এবং মেটেলি ব্লক এ জন্যই বেছে নিয়েছিলাম যে একসময় কমিউনিস্ট পার্টির দূর্গ ছিল এই ব্লকের অন্তর্গত চা বাগিচাগুলি। বামপন্থী ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন এর ভিত্তি স্থাপিত হয়েছিল মালবাজার এবং মেটেলিকে কেন্দ্র করে। কিন্তু এখন কেমন যেন ভিন্ন সুর। জাতপাত, সম্প্রদায়, সুবিধাবাদী রাজনীতির প্রাবল্য। দাবি-দাওয়াকেন্দ্রিক লড়াই নেই বললেই চলে। সরকারি সুযোগ-সুবিধা, পাইয়ে দেওয়া রাজনীতি সবকিছু মিলে ডুয়ার্সের রাজনীতি এখন ভিন্ন খাতে বইছে। মূল্যবোধের অবক্ষয়, শাসকশ্রেণীর চোখরাঙানি, গণতন্ত্রের সঙ্কট, বিরোধীদের প্রতি দমননীতি শাসকশ্রেণীর প্রাধান্যকে যে প্রতিষ্ঠিত করেছে একথা বললে সত্যের অপলাপ হয় না। একথাও ঠিক, বর্তমান সরকারের আমলে উন্নয়ন যে হয়েছে একথা বিরোধীরাও অস্বীকার করতে পারবে না। তাহলে কেন ভোট এলে বা গেলে এই মারধর, খুনখারাবি, দলাদলি, বিরোধীদের উপর আক্রমণ, গোষ্ঠী রাজনীতি, বলপ্রয়োগ করে পঞ্চায়েত বা অন্যান্য নির্বাচনে বিরোধীদের মনোনয়ন জমা না দিতে দেওয়ার কারণটা কি এটা বুঝে উঠতে পারেন না মেটেলি, মালবাজার এবং সংলগ্ন এলাকার মানুষ। কারণ শান্তিপূর্ণ ভোটদানেই অভ্যস্ত এতদঞ্চলের মানুষজন। ভোটের দিনগুলিতে থাকত উৎসবমুখর পরিবেশ। তাছাড়া সরকারি সুযোগসুবিধাও তো কম পাচ্ছে না গরীব মানুষজন। তাহলে কেন শাসনক্ষমতা দখল করার এই ঘৃণ্য কৌশল? বিরোধীদের মতে রাজ্যের অর্থনীতিকে দেউলিয়া করে ঋণ নিয়ে পাইয়ে দেওয়ার উন্নয়নই বর্তমান শাসক দল করে চলেছে। সত্যিই কি তাই? নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে ডুয়ার্সের সবচেয়ে সংকটাপন্ন চা বাগিচা মজদুরদের ভাবনাচিন্তা কোন পথে প্রবাহিত হতে চলেছে তার সুলুক-সন্ধানের জন্য ডুয়ার্সের নাগেশ্বরী, কিলকট এবং সামসিং চা বাগানের আর্থ-সামাজিক জীবনের চালচিত্র অনুসন্ধান করতে বাগানে সার্ভে করতে করতেই টের পেলাম মানুষ বড় কষ্টেই আছে।
প্রকৃতপক্ষে বাংলার চা শ্রমিকদের মজুরি ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকেই অন্যান্য সংগঠিত শিল্পের শ্রমিকদের মজুরির থেকেও কম। গত দেড়শ বছর ধরে ওদের মজুরি যা ছিল বা আজও যা আছে তা শুধু বাংলা নয়, সমগ্র উত্তর-পূর্ব ভারতেও একই অবস্থা কমবেশি। তবে সুযোগসুবিধা প্রদানের প্রশ্নে বাংলায় শোষণের হার অনেক বেশি। চা শিল্প যখন গড়ে উঠেছিল তখন ওদের কত মজুরি দেওয়া হত তা জানা যায় না। কোটি কোটি গাছ চাষ, গুল্মলতা, কাঁটার জঙ্গল, স্যাঁতসেঁতে ঘন অন্ধকারে আবৃত জঙ্গলে যে কঠিন কাজ শ্রমিকেরা করত তার মজুরী কত নির্ধারিত হয়েছিল তা জানা দুষ্কর। বাংলায় ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে কোন মহিলা ও শিশু এই কাজে আসেনি। জঙ্গল পরিষ্কার করে শ্রমিক নিয়োগের বিভিন্ন অভিজ্ঞতা থেকে চা-করেরা আবিষ্কার করেছিল এই শিল্পে সমস্ত শ্রমিক পরিবারকে পরিবারভিত্তিকভাবে নিয়োগ করা যাবে এবং কম পয়সা দিলেও চলবে। পরীক্ষামূলকভাবে যখন চা শিল্পে মহিলাদের নিয়োগ করা হয় তখন জানা যায় মহিলা শ্রমিকরা পুরুষদের থেকেও ক্ষিপ্রগতিতে পাতা তুলতে পারে। সুতরাং মহিলা শ্রমিক নিয়োগ আবশ্যক হয়ে ওঠে। কিন্তু মহিলারা ভালো কাজের হলেও দীর্ঘ একশো বছর পুরুষের চেয়ে কম বেতন পেয়েছে। এরপর কিশোর-কিশোরী এবং বালক-বালিকাদের নিয়োগ করা হয়। শিশু শ্রমিকদের মজুরি ছিল আরও কম। সেই ট্র্যাডিশন এখনও চলছে। ‘সহজ উঠোন’ এর বাগিচা পরিক্রমায় একমাত্র ব্যাতিক্রম ওয়াশাবাড়ি চা বাগিচা সেটা আগেই বলেছি।
২ মার্চ ছিল ডুয়ার্সের চারণকবি লাল শুকরা ওরাওঁ এর জন্মদিন। কিন্তু জন্মদিনে ব্রাত্যই থেকে যান লাল শুকরা ওরাওঁ। ক্ষেত্রসমীক্ষা করতে যাচ্ছি মেটেলিতে। চালসা গোলাইতে গাড়ি পার্ক করে একটু চা খাবার জন্য নামলাম। পশ্চিম ডুয়ার্সের চালসা গোলাই এর মেটেলি বাসস্ট্যান্ডের পাশে রয়েছে লাল শুকরা ওরাওঁয়ের মূর্তি। ২ মার্চ ১৯১১ সালে উনি জন্মগ্রহণ করেন। মৃত্যু হয় ৩০ মে ২০০১ সালে। ছবি তুলতে গিয়ে দেখলাম জন্মদিনের একদিন পেরিয়ে গেলেও একটি ফুলও পড়েনি ডুয়ার্সের বিশিষ্ট চাৱণকবি তথা তেভাগা আন্দোলনের অনন্য সৈনিক লাল শুকরা ওরাওঁয়ের পদপ্রান্তে। বিষয়টা নিয়ে একটু খোঁজখবর নেবার ইচ্ছা হল। কি আশ্চর্য্য! চালসাতে এমন একজনকেও পেলাম না যে লাল শুকরার সম্পর্কে জানে। মূর্তিতে তার জন্মদিন পালন নিয়ে সরকারিভাবে কোনও কর্মসূচিও চোখে পড়ল না। ২০০৯ সালে তদানীন্তন বামফ্রন্ট সরকার চালসা গোলাইয়ে ওনার আবক্ষ মূর্তি বসায়। সে সময় তদানীন্তন অনগ্রসর শ্রেণিকল্যাণ বিভাগের মন্ত্রী যোগেশ বর্মন এই আবক্ষ মূর্তি উন্মোচন করেছিলেন। পরবর্তীতে ওনার নামেই চালসায় লাল শুকরা পার্কের নামকরণও করা হয়েছিল। ওনার জন্মদিনে কেউ একটি ফুলও দিল না। এটা খুবই দুঃখের বিষয়। মাটিয়ালি বাতাবাড়ি-১ গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান দীপক ভূজেল জানিয়েছিলেন ওনার জন্মদিন পালনের সরকারিভাবে কোনও নির্দেশ আসেনি। পরবর্তীকালে অখিল ভারতীয় আদিবাসী বিকাশ পরিষদের জলপাইগুড়ি জেলা সভাপতি রাজেশ লাকড়া (টাইগার) কে বিষয়টা জানিয়ে ছিলাম। তিনি অবশ্য জানিয়েছিলেন সরকারি স্তরে লাল শুকরার মতো বিশিষ্ট ব্যক্তিকে অসম্মান এবং উপেক্ষা করা হলেও সংগঠনের তরফে ওনার মূর্তিতে মাল্যদান করা হয়েছিল। আমি শুধুই অবাক হয়ে গিয়েছিলাম একথা ভেবে যে হায় মূর্তি নিয়েও রাজনীতি!
এলেনবাড়ির পাশেই বাগরাকোট। চা বাগান মানে যে শুধু দারিদ্র্য, হতাশা, অপুষ্টি, শোষণ তা নয়। চা বাগিচা মানে আশা নিরাশা, সুখ দুঃখময় সবুজ গালিচার মানুষগুলোর ছোট ছোট সুখ দুঃখগুলোকে বোঝা। এর জন্য প্রয়োজন একটু মানবিক হওয়া। কোন কোন সময় দেখা যায় জেলা প্রশাসনের শীর্ষ কর্তারা মানবিক হয়ে ওঠেন। তখন হাসি ফোটে এইসব মানুষগুলির মুখে। তাই ঠাণ্ডা ঘরে বসে জেলার প্রান্তিক মানুষের সমস্যা বোঝার চেষ্টা না করে তার পরিবর্তে প্রশাসনকেই সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য জনসংযোগ কর্মসূচি গ্রহণ করা হলে তার সুফল সত্যিই পাওয়া যায় কিনা তা সরেজমিনে প্রত্যক্ষ করতে এসেছিলাম বাগরাকোট। বাগরাকোট কমিউনিটি হলে সমস্ত আধিকারিকদের নিয়ে চা বাগান ঘেরা এলাকার সাধারণ মানুষের সমস্যার কথা শুনেছিলেন জলপাইগুড়ির জেলাশাসক শিল্পা গৌড়িসারিয়া। এক ঝাঁক প্রশাসনিক আধিকারিককে হাতের নাগালে পেয়ে ঘন্টা দেড়েকের এই শিবিরে চা শ্রমিক থেকে শুরু করে এলাকার গৃহবধূ, শিক্ষিত বেকার যুবক এবং পড়ুয়া সহ সকলেই তাদের ব্যক্তিগত এবং এলাকার সমস্যাগুলোর কথা জেলাশাসক এবং প্রশাসনিক আধিকারিকদের সামনে তুলে ধরেছিলেন। স্থানীয় গ্রাম পঞ্চায়েত সদস্যের বক্তব্যে জানতে পেরেছিলাম ডিজিটাল রেশন কার্ড হাতে পাননি এমন পরিবারের সংখ্যা প্রায় ৪০০। এর ফলে এই পরিবারগুলো রেশন তুলতে পারছিলেন না। তাছাড়া ২২ টি আইসিডিএস সেন্টারের মধ্যে বেশিরভাগেরই ছিল বেহাল অবস্থা। শিশুদের খাবারের মানও ভালো নয় বলেও জানিয়েছিলেন তিনি। এই অভিযোগ এবং সমস্যার কথা শোনার পর সংশ্লিষ্ট বিভাগের আধিকারিকদের দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে নির্দেশ দেন জেলাশাসক শিল্পা গৌড়িসারিয়া। জেলাশাসক বলেছিলেন জেলা সদরে বসে সাধারণ মানুষের সমস্যার কথা সবসময় শোনা যায় না। তাই জনসংযোগ কর্মসূচির মাধ্যমে ছোট ছোট এই সমস্যা বা চাহিদাগুলো শুনে যাতে আগামী কয়েকদিনের মধ্যেই তার সমাধান করা যায় তা অবশ্যই দেখা হবে। দেখেছিলাম বস্তির বাসিন্দাদের প্রায় ৩০০ টি পরিবার জমির পাট্টা না পাওয়ার কারণে তাদের যে সমস্যা হচ্ছিল তার সমাধানের প্রচেষ্টা দুয়ারে বসে করার। তখনই একটা ব্যাপার পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল সদিচ্ছা থাকলে এই কাঠামোতেও গরীব মানুষের পাশে থাকা যায়। 'দুয়ারে সরকার' বা 'পাড়ায় পাড়ায় সমাধান' প্রকল্পগুলির মাধ্যমে যদি সত্যি সত্যি নিষ্ঠা সহকারে কাজ হয় তাহলে আগামী দিনে আর্থ-সামাজিক বিপ্লব যে ঘটবেই এটা নিশ্চিত বলা যায়। চা বাগান স্তরেও "সবুজের গালিচাতে সরকার" জাতীয় কোনো প্রকল্প করা যায় না কি?
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴