পইলা সাঞ্ঝির কথা/১৮
পইলা সাঞ্ঝির কথা
পর্ব : ১৮
শুক্লা রায়
÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷
কইনাগৎ
"বিষকুন্ডুলির তলে তলে ধোঁয়া গুটগুট করে/আজার বেটা লখিন্দর মানষি গোটো করে"
"নেও, কও তো কি?"
বলে চোখ চকচক করে সুকারুর বেটা সবার মুখের দিকে তাকায়। বলাই বাহুল্য সবাই এ ওর মুখের দিকে চেয়ে থাকে, কেউ বলতে পারে না। হুঁকো মুখে বুধেশ্বরের বাপ বুড়াটা অনেকক্ষণ থেকে ওদের এই ধাঁধার খেলা শুনছিল আর মজা পাচ্ছিল। এবার হুঁকো থামিয়ে হাসিমুখে ওদের দিকে তাকিয়ে বলে,
"এই টা কি? এইটাক কি কয়, মুই যে খাচোং রে!"
সবাই সমস্বরে বলে,
"হুটা আরো কায় না জানে, হুঁকা!"
বুড়া মজা পেয়েছে। বলে,
"এইটায় হইল ছিল্লোকের উত্তর। অ্যায় যে ধোঁয়াটা ভিতরত গুটগুট করেছে। আর হুঁকার শব্দ কানোত গেইলেই সোগায় কোনেক টানিবার আশাত বগলোত আসি বইসেছে, তে হইল না এলা মানসি গোটো? কি বাউ, কতা ঠিক তো?"
তারপর হুঁকোটা আরেকজনের হাতে তুলে দিয়ে বাচ্চাদের দিকে ঘুরে বসে। বলে,
"মুই একেনা সোজা চায়া কং, কও তো কায় কবার পান! আইরে আই/ ঘর আছে তো দুয়োরে নাই!"
কথা শেষ হল কি হল না সবাই চেঁচিয়ে উঠল,
"ডিমা, ডিমা!"
মন্তেশ্বরের উঠোনে আজকে পাড়ার দু'চারজন লোক বসে আছে। সঙ্গে গোটা পাড়ারই বাচ্চার দল। উঠোনের একপাশে পিতৃ পুরুষের উদ্দেশ্যে শ্রাদ্ধের আয়োজন। ব্রাহ্মণ নয়, শিবেন অধিকারীই সব করছে। মন্তেশ্বর প্রতি বছর 'কইনা' পালন করে।সবাই করে না, যাদের নিয়ম আছে বা গোত্রে আছে তারাই করে। রসবালাও এসেছে পুজোর জোগাড় করে দিতে। কাজ করতে করতে অধিকারী মহাশয়ের সঙ্গে ঠাট্টা-মস্করা করে চলেছে। সম্পর্কে জামাইবাবু শিবেন গম্ভীরমুখে বসে থাকতে থাকতে আর পারল না, হেসে ফেলল।
বসমতী এসে বসতেই রসবালার মুখটা খুশিতে ঝলমল করে উঠল। তাড়াতাড়ি চওড়া একটা পিঁড়ি পেতে দিল বসার জন্য। পাশ থেকে শিবেন এবার ফুট কাটল,
"নিজের দিদিটা আইসার সতে সতে খুব যে ঢাকলাউ করি পিঁড়াখান দিলু, আর মুই এক কাপ চায়ে পালুং না এলাও।"
রসবালা তড়বড় করে ওঠে,
"বনু তুই অমন মিছা কাথাখান না কইস, দিলুঙ যে সেলা বানেয়া।"
শিবেন এবার মুচকি হেসে ভুলে যাবার ভাণ করে বলে,
"হ, চা দিসিস? মোর ফমে নাই, আর এখেনা দে, তোর দিদিকো না খোয়াবু তে এলায়। মুই কি একেলায় খাইম।"
বসমতী পিঁড়িতে বসতে বসতে বলে,
"মরাটা, নিজের খাবার আল আর দিদির কাথা কয়। উয়ার দিদি চা খায়ায় আইচ্চে।"
তবে চা -য়ে অবশ্য উপস্থিত জনতার সবারই কিঞ্চিৎ অধিক আগ্রহই দেখা গেল। হঁকা টানতে টানতে নলিনের বাপ একটু থেমে খুক খুক করে কাশে। মনেশ্বর বলে,
"কি বাহে, কাশেছেন যে! গালাৎ ধোমা নাইগসে!"
একহাতে হুঁকা, একহাতে চোখের কোণে গড়িয়ে পড়া জল সামলে বুড়ো মানুষটা ফোকলা মুখে হাসে। হাসিটার সারল্য আর শরতের সকালিয়া রোদ যেন মিলে মিশে এক হয়ে গেল। তারপর হুঁকোটা আর একজনের হাতে ধরিয়ে বলে,
"অই যে অপঘাতে মরা বংশোত থাকিলে কাহো কাহো কইনা পালে। আর কাহারো গোতোতে থাকে বাহে। কইনা পালা কিন্তুক সোজা কাথা নাহয়, এই এতোলা দিন নিরামিষ খাবার নাগিবে। তার পাছোত তুই কচু, ঢেঁকিয়া হিলা মাটির জিনিস খাবু না। নিয়াম কি একখান?"
নাকেমুখে ওরকম কাশির পর হঠাৎ এই কথাটা কেমন অপ্রাসঙ্গিক শোনালেও কেউ কিছু মনে করে না তাতে। স্বতঃস্ফূর্তভাবে আলোচনা ঘুরে যায় 'কইনা' পালনের দিকে।
বুধেশ্বরের বাপ এবার নড়েচড়ে বসে। গলা খাঁকারি দিয়ে গলা পরিস্কার করল নাকি সবার মনোযোগ টানার চেষ্টা করল বোঝা গেল না। তবে সবাই ওর দিকেই তাকাল। একটু শিবেনের দিকে চকিতে চেয়ে নিয়ে শুরু করল,
"এইলা নিয়াম এক এক দ্যাশোত এক এক মতোন বারে।"
"হুটা তো হয়। যেদি যেমন আছে সেদি সেমন করি পালে মানষি। কাহোরো নিয়াম কোনেক বেশি কাহারো কম।"
নলিনের বাপ উত্তর করে। সঙ্গে সঙ্গেই আর একজন বলে ওঠে,
"মোরে পিসাইঘরের ওদি আরো আলদা নিয়াম। উমার আরো নানান মতোন কিরিয়া-কম্ম করির নাগে।"
বুধেশ্বরের বাপ ওকে বেশি আগাতে দিল না। ওখানেই থামিয়ে দিল। আসলে নিজের কথা বলবে বলেই শুরুটা করেছিল। সেজন্য গলায় জোর এনে বলল,
"মোর মামাঘরের ওঠেকার নিয়ামগিলা শুনো। আগোত তো পেরায় মামার বাড়িত গেসুং।"
তারপর গলাটা একটু নামিয়ে বলে,
"এলা আর মামাঘরও বাঁচি নাই, তেমনটা আর যাওয়াও হয় না। তে শুনো তাও। যেকিনা চোকুৎ দেখা মনৎ পড়ে কং।"
গল্প বলার ঢং, গলার উত্থান-পতনের বৈচিত্রে সহজেই বুধেশ্বরের বাপের দিকে আকৃষ্ট হয় সবাই। হাঁটুর উপর মলিন খাটো ধুতি, খালি গায়ে পৈতেখানাও ততোধিক তেলচিটে লাগছে। কিন্তু কন্ঠস্বরে তার কোনো চিহ্ন নেই। বসমতী আপনমনে বলে,
"ইমিরা হইল গানের দলের মানষি, ইমার কাথালায় শুনিবার ভাল।"
হাতে হাতে গরম চায়ের কাপ, বাটায় রাখা পান-সুপুরি, গল্পের গন্ধে মুহূর্তের জন্য হুঁকোটাও বুঝি থামল একটু।
"মোর মামার বাড়ির ওদিকার মানষিগিলার ধম্ম-কম্মে খুব মন বারে। উমার ওদি খানেক আবোস্তা ভাল হইলে সোগায় কইনা পালে। যার যেমন আবোস্তা, কাহো আট কইনা পালে, কাহো ষোল কইনা পালে।"
শুরুটা শুনেই লোকজন নড়েচড়ে বসে। বসমতী গল্পের আভাস পেয়ে মুখে একগাল পান-সুপারি ঢুকিয়ে পিঁড়িটায় গুছিয়ে বসে।
"ষোল কইনা পালিলে আমাবাইষ্যার দিন ছেরাদ্দ আদি করিয়া নিয়াম শ্যাষ করে। আট কইনা পালিলে কাহো কাহো অষ্টমীর দিনোত ছেরাদ্দ করে।"
ভিড়ের ভেতর থেকে কেউ বলে,
"হামার এদিকার মতোন না হয় তেয়?"
বুধেশ্বরের বাপ কথাটাকে তেমন গুরুত্ব দেয় না।
"শ্যাষ কইনা গেইলে আমাবাইষ্যার দিন ঠাকুরঘরের আগপাশে একটা কলার গছ গাড়ে, হামার মতোন করিয়ায় ছোট এখেনা ডিগি বানেয়া ওঠে বাঁশের পাত, দুকিনা মাগুর মাছ না হয় তো টাকি মাছ ছাড়ি দেয়। বড় একটা নয়া খাচারিত করি ষোল ঝুকি কলা থুবে। বাড়িত যতমন মানষিখান আসিবে সোগাকে কলা দিবে। ছেরাদ্দ করি ইতিমতোন পিন্ডদান করিবে, করিয়া ওই ডিগিটাৎ ফেলাবে। গারস্থ আর গিত্থানি দোনোঝোনে ওঠে বসিবে। আতি জাগরণ হবে আর আতি জাগরণের জইন্যে হিদি গান হবে আগিনাতে। তুক্ষা, মনোশিক্ষা - ওইলা একটা দিন ছিল বারে।"
উপস্থিত সবাই মাথা নাড়ে। কথাটা ঠিক। এখনকার মানুষ আগের মতো নাই!
"আর কাহো কাহো অষ্টমীর দিনা ছেরাদ্দ করে, হুটাও দেকিসুং। হুটাৎ একেমতোন করি ছেরাদ্দ পিন্ড এইলা করে, খাচারিৎ করি আট ঝুকি কলা সাজে থয়। এলাও বোদায় আছে এইলা নিয়াম। ওদি যাওয়া হয় না মেলা দিন।"
বুধেশ্বরের বাপ থামলে সবাই সেই দৃশ্যটা মনে মনে কল্পনা করে। এরমধ্যে বাচ্চাগুলোর নিজেদের মধ্যে ঝগড়া বেঁধেছে কোনো কারণে, হৈ-হট্টগোলে বাড়ি সরগরম। একজন ধমক দিল। গল্পের এই সুন্দর পরিবেশটা নষ্ট হওয়াতে বাচ্চাগুলোর উপর সবাই বিরক্ত। শিবেনও পুজো সাজাতে সাজাতে মন দিয়ে শুনছিল বুধেশ্বরের বাপের কথাগুলো। তারপর বলে,
"এলাও আছে বারে এইলা নিয়াম। তে হিদিকার নিয়াম তো আলদা মতোন। হিদি মুই বাপকাল থাকিয়ায় এমতোন দেখি আইসোছোং।"
তারপর একটু থেমে হাঁক দেয়,
"ন্যাও বারে গোছাটাৎ কোনেক ত্যাল দ্যাও, আর ধুনা আনো, ধুনা। বগলোত কাহোয় নাই, পূজা থুয়া মুই কিন্তুক চললুং মাই।"
রসবালা সঙ্গে সঙ্গেই কলকল কলে ওঠে,
"দেছোং বোনু, দ্যাছোং, কোনেক বাচ্চা, ওস্থির হোইন্না।"
.............................................................
ছিল্লোক - মজার ধাঁধা
আই - দিদা
ঢাকলাউ করি - সশব্দে
আল - অজুহাত
কোনেক বাচ্চা - একটু সবুর কর
.............................................................
তথ্য ঋণ : উমেশ শর্মা ★ ছবি : ময়ূখ রায়
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴