নানা রঙের গানগুলি-১৮/শৌভিক কুন্ডা
নানা রঙের গানগুলি(১৮)
শৌভিক কুন্ডা
-----------------------------
আটের দশক। মাঝামাঝি পর্ব। সে সময়ে কলেজে কলেজে 'সোশ্যালে' বহিরাগত শিল্পীরা আসতেন। দু'দিনের উৎসব, দ্বিতীয় দিনে মহিলা বা কো-এড কলেজে নৃত্যনাট্য বাঁধা। তার পর পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান, তারপরই আমন্ত্রিত শিল্পীরা। প্রথমে স্থানীয় দু একজন নামজাদা, তাঁদের অনুষ্ঠান শেষ হলে বিখ্যাত বহিরাগত, আর ছেলেদের বা কো-এড কলেজে তারও পর অবশ্যই অর্কেস্ট্রা। এভাবেই জেলা স্কুল শতবর্ষতে (আরও আগে, তখন আমি নিতান্তই গেঁড়ে) মানবেন্দ্র মুখার্জি , চিন্ময় চট্টোপাধ্যায়, পিডি উইমেন্স কলেজে ধীরেন বসু, এসি কলেজে পিন্টু মুখার্জি, অংশুমান রায়। তবে ধারে ভারে এগিয়ে থাকতো জেকল্যাট, জলপাইগুড়ি গভঃ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের বাৎসরিক অনুষ্ঠান। এই সব সোশ্যালে আমরা তখন অপেক্ষা করে থাকতাম ঐ অর্কেস্ট্রার জন্য। এবং বিভিন্ন কপি সিঙ্গার বা কন্ঠীরা ছিলেন এইসব দলের প্রাণ! মহম্মদ আজিজ তখন 'মুন্না', কুমার শানুও, শুনেছি 'শান্তনু কুমার'। তবে আমরা মূলতঃ শুনতাম চন্দন দা(মুকেশ), বাপুজি কাকু(রফি), ব্ল্যাক ডায়মন্ড তথা প্রদীপ চক্রবর্তী (কিশোর), একটু হঠকে মনে পড়ছে কাঞ্চন নামে একজন, সম্ভবত ফালাকাটায় থাকতেন (বাপ্পি লাহিড়ী) : এঁদের কথা। দু একজন ছাড়া, বাকিরা যথেষ্ট ক্ষমতা থাকতেও ঐ 'কন্ঠী' হয়েই রয়ে গেছিলেন।
আজ এমনই এক কন্ঠীর গল্প। তাঁর গলায় একটিই মাত্র গান শোনার সৌভাগ্য হয়েছিলো আমার। হ্যাঁ, একটিই। আজ সেই আশ্চর্য অভিজ্ঞতার কথা।
জেকল্যাট। সাল ভুলে গেছি।
প্রতি বছর ওখানে ইন্টার কলেজ কালচারাল কম্পিটিশন হ'ত। সেবারও। প্রতিবারের মত বেশ ক'টি প্রাইজ জিতেছি। সুতরাং, মূল অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণ পেয়েছি। সেবারের অতিথি সপরিবার সলিল চৌধুরী।
মূল বিষয়ে ঢোকার আগে, এলোমেলোই মনে এসে গেল সবিতা চৌধুরীকে। প্রথমেই "হলুদ গাঁদার ফুল" ধরলেন, আর দু কলি গাইতে না গাইতেই পেছন থেকে মাইক ছাপিয়ে ভেসে এলো টলমল গলার হুংকার, "আমনে সামনে, আমনে সামনে", সবিতাও গান থামিয়ে দিয়ে বলে উঠলেন, " হ্যাঁ ভাই, আমনে-সামনে-ডাইনে-বাঁয়ে সব হবে, সব হবে। এখন আমাকে দুটো গাইতে দিন!" কিশোরী অন্তরার "বুলবুল পাখি", " এক যে ছিলো মাছি"। সলিল গেয়েছিলেন "এই রোকো, পৃথিবীর গাড়িটা থামাও" এবং আরও অনেক। কিন্তু সে সব তো পরে। ঘোষণার হল। সলিল চৌধুরী দলের পক্ষে মুখবন্ধ করলেন। তারপর ডেকে নিলেন এক সহশিল্পীকে, যতদূর মনে পড়ছে, নামটা ছিলো রমেশ। পদবী ভুলে গেছি। বিশাল বপু। আঁধার কালো গায়ের রঙ। তখন সিএবি লীগে ক্রিকেট খেলেন বিখ্যাত দুই ভাই, প্রলয় চেল, প্রবীর চেল: অনেকটা তাঁদের গোছের চেহারা। এই মানুষ গান গাইবে, এ ভরসা আমিও খুব একটা পাই নি। তবে উৎকট চীৎকার উঠলো পেছন দিক থেকে। এবং সেটা এতই জোরালো, যে ভদ্রলোক গান গাইতেই পারলেন না। হ্যান্ডমাইক ড্রামারের হাতে দিয়ে স্টেজ থেকে বের হয়ে গেলেন। আবারও ক্যাপ্টেন সলিল মাইক ধরলেন, এবং স্পষ্ট জানালেন সহশিল্পীর এই অপমান তাঁরা মানছেন না, প্রতিবাদে কেউই গান করবেন না। প্রয়োজনে এ্যাডভান্স হিসেবে যে টাকা নিয়েছিলেন, সবটাই ফেরৎ দেবেন। খানিকক্ষণ গোটা অডিটোরিয়াম পাথরনিশ্চুপ।
তারপর ইউনিয়ন নেতাদের তৎপরতা, ক্ষমা চাওয়া, ইত্যাদি পেরিয়ে অনুষ্ঠান শুরুর নিশ্চয়তা পাওয়া গেল। আবারও ফিরে যাওয়া প্রথম দৃশ্যে। বাজনার আবহে সেই বিশালবপু রমেশবাবুর প্রত্যাবর্তন। প্রথম বার নমস্কারটুকু বলেছিলেন, বলা ভালো, বলতে পেরেছিলেন। এবার সেসবের ধার কাছ দিয়ে গেলেন না। শুরু করলেন সরাসরি,
"জানে কাঁহা গ্যয়ে য়ো দিন
কহতে থে তেরি দাঁস্তে
নজরোঁকো হম বিছায়েঙ্গে"!
আর, ম্যাজিক। হ্যাঁ, ম্যাজিক। সারা অডিটোরিয়াম সত্যিই মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে গেল। গান শেষ হলে স্ট্যান্ডিং অভেশন। হল ফেটে যাচ্ছে হাততালিতে। নির্বিকার শিল্পী আবারও মাউথপিস নামিয়ে বের হয়ে যাচ্ছেন, সকলের সাথে গলা মিলিয়েছিলাম আমিও, "আরো শুনবো", "প্লিজ দাদা" ইত্যাদি ইত্যাদি। রমেশ (সম্ভবত) ফিরলেন। মাউথপিস নিলেন, এবং অল্প কটা কথা বললেন, "ধন্যবাদ সবাইকে। আমিও যে একটু আধটু গাইতে পারি সেটা প্রমাণ করার সু্যোগটা দিয়েছেন। নমস্কার।" এবং নির্বিকারভাবেই স্টেজ থেকে বের হয়ে গেলেন।
"চাহে কাঁহি ভি তুম রহো
চাহুঙ্গা তুমকো উম্রভর
তুঝকো না ভুল পায়েঙ্গে...."
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴