দাঁড়াবার জায়গা/আঠারো
সমর দেব
^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^
স্কুলে
ম্যাগাজিন হবে। একদিন ক্লাসে নোটিশ এল, ছাত্ররা লিখতে চাইলে স্বরচিত
কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ জমা দিতে হবে অমুক তারিখের মধ্যে। স্মৃতি প্রতারণা না
করলে, সেবার ম্যাগাজিনের দায়িত্ব ছিল বিনয় সেন স্যরের হাতে। যথারীতি আমিও
লেখা দিলাম। একটা কবিতা এবং একটা গল্প। আমার লেখা যে ছাপা হবেই সে ব্যাপারে
নিশ্চিত ছিলাম। কারণ, কোচবিহার উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ম্যাগাজিন মূলত
আমার হাত ধরেই যাত্রা শুরু করেছিলো, তাতে আমার লেখাও প্রকাশিত হয়েছে। অতএব,
প্রবল আত্মবিশ্বাসী আমি দুটি লেখা জমা দিলাম। কিন্তু ম্যাগাজিন বেরতে দেখা
গেল, আমার লেখা তাতে নেই! ততদিনে আমার লেখা অনেক কবিতা ও গল্প জমে গেছে।
বিভিন্ন পত্রিকার পাতায় সেসব লেখার দু-চারটে ছাপাও হয়েছে। ক্লাসের বন্ধুদের
কেউ কেউ আমার কবিতা পড়ে খুশি। জ্যোতির্ময় একদিন বাড়ি থেকে কয়েকটা
ম্যাগাজিন (লিটল, তখনও জানতাম না কাকে বলে লিটল ম্যাগাজিন) এনে আমাকে দিয়ে
বলল, ‘তুই নিয়ে নে। ফেরত দিতে হবে না’। বাড়িতে এনে পড়তে গিয়ে দেখি একটায়
আমার কবিতা! মনে পড়ে গেল, সেই ম্যাগাজিনের পুরনো একটা কপি আমাদের বাড়িতে
পেয়েই সম্পাদকের ঠিকানায় লেখা পাঠিয়েছিলাম। সেই লেখা ছাপা দেখে আমার মাথা
খারাপ হবার জোগাড়! বিশেষ করে ছাপার অক্ষরে জ্বলজ্বল করছে নিজের নাম! আমার
বিস্ময়ের ঘোর কাটতেই চায় না। সে কাগজের নাম, সম্পাদক কে ছিলেন আজ আর মনে
নেই। তবে, ঠিকানায় এলাকা হিসেবে সম্ভবত শহরের পাটাকুড়ার উল্লেখ ছিল।
কিন্তু জেনকিন্স স্কুলের ম্যাগাজিনে আমার লেখা ছাপা হয়নি!
শুধু
সেবারই নয়, যখন বাইরের অনেক কাগজে আমার লেখা প্রায়ই ছাপা হচ্ছে, তখনও
স্কুল ম্যাগাজিনে আমার জায়গা হয়নি। জেনকিন্স স্কুলে চার বছর পড়েছি, সেই
চারবারের ম্যাগাজিনে আমার একটি লেখাও ছিল না! দীর্ঘকাল এনিয়ে তীব্র অভিমান
ছিল। কেন স্কুল ম্যাগাজিনে আমার লেখা ছাপার যোগ্য বলে বিবেচিত হয়নি সেটা
কখনও জানা হয়ে ওঠেনি। অথচ, ম্যাগাজিনে প্রকাশিত লেখাগুলো অধিকাংশই ছিল আদৌ
‘স্বরচিত’ নয়, বরং বিখ্যাত লেখকদের অনুকরণ! স্কুল ম্যাগাজিনে লেখা ছাপা না
হওয়ায় একটা অভিমান আমাকে কুড়ে কুড়ে খেতে থাকে। ছাপা না হওয়ার কারণ খুঁজে
পাই না। পরিণত জীবনে মনে হয়েছে, লেখা ছাপা না হওয়ার কারণ ছিল তার মৌলিকতা!
স্কুলের ম্যাগাজিনে ‘স্বরচিত’ লেখা চাওয়া হলেও বাস্তবে সেটা ঘটেনি কখনও!
এখনও স্পষ্ট মনে আছে, একবারের ম্যাগাজিনে -
‘ক্ষান্তবুড়ির দিদিশাশুড়ির
পাঁচ বোন থাকে কালনায়,
শাড়িগুলো তারা উনুনে বিছায়,
হাঁড়িগুলো
রাখে আলনায়’ –এর অনুকরণে একটা লেখা ছাপা হয়েছিল! কে লিখেছিল সেটা আজ আর
মনে নেই। কিন্তু, সে লেখা যে মোটেই মৌলিক নয় সেটা জানতাম, কারণ সুকুমার রায়
পড়া ছিল। ফলে, স্কুলের ম্যাগাজিন সম্পর্কে যেমন একটা নেতিবাচক মনোভাব
গড়ে উঠতে থাকে, তেমনই ম্যাগাজিনের দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষকদের সম্পর্কেও।
কিন্তু, এনিয়ে তো অভিযোগ চলে না। বিশেষত, গম্ভীর, রাশভারী শিক্ষকদের কাছে
গিয়ে প্রশ্ন করার মতো সাহস কখনই অর্জন করে উঠতে পারিনি।
কয়েকজন
শিক্ষক অত্যন্ত স্নেহ করতেন, প্রশ্রয় দিতেন ঠিকই, অধিকাংশের সঙ্গেই ছিল এক
দুর্লঙ্ঘ্য দূরত্ব। সেই দূরত্ব কোনওদিনই অতিক্রম করতে পারিনি, সেটা আমারই
দুর্বলতা। আমার দুর্বলতা যে অর্থনৈতিক সেটা চিরকাল জেনে এসেছি। আমার সারা
শরীর জুড়ে লেপ্টে থাকত দারিদ্র্যের মলিনতা। জেলার নামকরা স্কুলের ছাত্রদের
অধিকাংশই স্বচ্ছল পরিবারের। শিক্ষকদের অনেকেই এসব স্বচ্ছল পরিবারের
ছেলেদের ব্যক্তিগতভাবেই চিনতেন। অনেক শিক্ষককে দেখেছি, ক্লাসে বা অন্যসময়
অনেকের সঙ্গেই তাদের বাবা, কাকাদের নিয়ে হাসিমুখে কথা বলতে। তাতে বুঝতাম
তাদের পারস্পরিক ঘনিষ্ঠতা। এমনকি, অনেক সময় পাড়ায় খেলার মাঠে কে কেমন
খেলেছে বা দুষ্টুমি করেছে তা নিয়েও শিক্ষকদের কাউকে কাউকে প্রায়ই কথা বলতে
দেখেছি। এসবের বাইরেও ভালো খেলোয়াড় হিসেবে কোনও কোনও শিক্ষকের সঙ্গে
অতিরিক্ত ঘনিষ্ঠতা ছিল কারও কারও। স্কুলের শিক্ষকদের কারও কারও কাছে যারা
প্রাইভেট ট্যুইশানে যেত তারাও ঘনিষ্ঠ ছিল। আমার অনুকূলে এসবের কিছুই ছিল
না। ফলে, দু-চারজন ছাড়া অধিকাংশ শিক্ষকের সঙ্গেই অলঙ্ঘ্য দূরত্ব শেষ অবধি
থেকে গেছে। তবে, এরসঙ্গে সত্যের খাতিরে স্বীকার করা উচিত নিজের ত্রুটির
বিষয়টাও। পারিবারিক জীবনে বড়দের আচরণের জেরে বন্দিত্বের বোধ, নিজের
সামাজিক অবস্থান, দারিদ্র্য, শারীরিক দুর্বলতা ইত্যাদি ভীষণ রকমের এক
অন্তর্মুখীনতার জন্ম দিয়েছিল। নিজের চারপাশে একটা দুর্ভেদ্য বলয় গড়ে
উঠেছিল যেন। নিজেরই তৈরি করা সেই বলয়ে নিজেকে জড়িয়ে নেওয়ায় পরিপার্শ্বের
সঙ্গে ব্যবধান রচনা করেছিল। স্কুলে পড়াকালে সেই ব্যবধান ঘোচানোর একটা
দুর্মর চেষ্টাও ছিল, কিন্তু শেষ অবধি ব্যবধান ঘোচেনি, অন্তত স্কুল জীবন
অবধি। ছাত্র হিসেবেও তেমন উজ্জ্বল তো কোনওকালেই ছিলাম না!
আবার,
পাঠ্য বই, খাতা ইত্যাদির অভাব থাকলেও নানা সূত্রে প্রাপ্ত সিলেবাসের
বাইরের অজস্র বই পড়ার সুবাদে কিছু শিক্ষকের কাছে এমন স্নেহ পেয়েছি যা
সারাজীবনের সম্পদ হয়ে আছে। একবার বারীন রাহা স্যর আমার বইয়ের সমস্যা মেটাতে
বহুদূর অবধি চেষ্টা করেছিলেন, মনে আছে। দুর্ভাগ্যবশত তাঁর আপ্রাণ চেষ্টা
সত্ত্বেও সমস্যা মেটেনি! অনেক বাধা, অনেক প্রতিকূলতা থাকলেও স্কুলের প্রতি
আকর্ষণ কখনও কমেনি। বরং, এসব ঘাটতি মেটাতে বাইরের বই পড়া এবং লেখাকেই
উপযুক্ত মনে হয়েছিল। ফলে, একটি দিনের জন্যও লেখা এবং পড়া বাদ দিইনি। লেখার
জন্য কাগজের অভাব বোধ করিনি কখনও। কারণ, ক্যালেন্ডারের পেছনেও দিব্য কবিতা
লেখা যায়। মুদিখানা থেকে যেসব ঠোঙা আসত, তাতেও প্রায়ই লেখা যেত। এনিয়ে
কোনও ক্ষোভ ছিল না।
এরইমধ্যে
নতুন বছর। ক্লাস এইটে উঠেছি। সবে ক্লাস শুরু হয়েছে। দু-একদিন বাদে
প্রেয়ারের পরপরই, ক্লাসে ঢোকার মুখে আমাকে পেছন থেকে ‘এই শোনো’, বলে, একজন
কাঁধে হাত রাখল। সে বলল, ‘বই কেনা হয়ে গেছে?’ আমি বললাম, ‘না’। সে বলল,
‘নতুন বই কেনার মানে হয় না। তুমি আমার বইগুলো নিতে পার, অর্ধেক দাম’। আমি
কী বলব, ভাবছি। সে বলল, ‘কাল নিয়ে আসব’। বলেই সে চলে গেল। তার যাবার পথের
দিকে তাকিয়ে আছি। দেখি, সে ঢুকে গেল নাইন-বি –তে। গত বছর সেভেনে আমরা ক্লাস
করেছি ইংরেজি ‘এল’ আকৃতির একতলা ভবনের একেবারে ডানদিকের কোণার ঘরে। আমাদের
একপাশে সেভেন ‘এ’, অন্যপাশে ‘বি’। আমাদের স্কুলে ক্লাস থ্রি থেকে পড়ানো
হয়। থ্রি-তে একটিই সেকশন। ফোরেও তাই। ফাইভে নতুন করে ছাত্র ভর্তি হয় বলেই
আগের ক্লাস ফোর থেকে পাশ করা ছাত্ররা ফাইভে এসে ‘এ’ সেকশনে জায়গা পায়। নতুন
ভর্তি হওয়া ছাত্রদের জন্য সেকশন ‘বি’। ফাইভ, সিক্স একই থাকে। সেভেনে ফের
ছাত্র ভর্তি হয়। সেভেনের নতুন ছাত্রদের জন্য সেকশন ‘সি’ নির্ধারিত।
আমরা
এইটে উঠেছি। এইট-এর তিনটি এবং নাইনের তিনটি সেকশন এই সাদা ভবনের দোতলায়।
ভবনের মাঝখানে উঠে গেছে প্রশস্ত সিঁড়ি। দোতলায় উঠেই এপ্রান্ত থেকে
ওপ্রান্ত বারান্দা। দোতলার বারান্দায় উঠেই ডানদিকে এইট-এর তিনটি সেকশন
পরপর। একইভাবে, বাঁদিকে, ক্লাস নাইনের তিনটি সেকশন পরপর। এত বছর বাদেও
সেরকম ব্যবস্থাই আছে কিনা জানি না। নাইন ‘বি’-র যে ছেলেটি আমার কাছে তাঁর
বই সেকেন্ড হ্যান্ড বিক্রির প্রস্তাব করেছিল তার নাম সম্ভবত জিয়াউল (এতদিন
বাদে ভুল হতে পারে)। আমাদের ছাত্র জীবনে দু-এক বছরের উঁচু ক্লাসের ছাত্রদের
‘দাদা’ সম্বোধনের রেওয়াজ ছিল না বলেই পরিচয়ের পরে তাকে নাম ধরেই ডেকেছি ।
আমরা দু-এক ক্লাস উঁচুতে পড়া ছাত্রদের নাম ধরেই ডাকতাম। অনেকের সঙ্গেই
ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্বও গড়ে উঠত। আমাদের চেয়ে দু-এক ক্লাস নীচে পড়ে এমন
ছাত্ররাও দরকার হলে আমাদের নাম ধরেই ডাকত। একটু বেশি ব্যবধান হলেই দাদা
সম্বোধন করা হতো। এভাবে বেড়ে ওঠায় আমরা সদ্য পরিচিতকেও কাছাকাছি বয়স মনে
হলে নামেই সম্বোধনে অভ্যস্ত। তবে, এই লক্ষণটি বোধহয় শুধু সময়ের চিহ্নায়ক
নয়, তৎকালীন সমাজেরও বৈশিষ্ট্য হয়ত। আজকাল দেখি সমবয়সী তো বটেই, বয়সে
বড়রাও প্রায়ই ‘দাদা’ সম্বোধন করে! এনিয়ে আমার ঝুলিতে বেশ কিছু মজার
অভিজ্ঞতা আছে। সেসব পরে বলা যাবে।
তো,
জিয়াউল পরদিনই আমার হাতে কয়েকটি বই তুলে দিলো প্রায় জোর করেই। আমি একবারও
সম্মতিসূচক কিছু বলিনি, এমনকি ঘাড় বাঁকিয়েও সম্মতি জানাইনি। কারণ, আমি
জানি, এই বইয়ের দাম মেটাতে সমস্যা হবে। কিন্তু সে আমার কাছে কিছু জানতেই
চায়নি! যাবার সময় সে বলে গেল বইগুলোর মোট দাম কত। সে দ্রুত চলে যেতে থাকলে
আমি হাবার মতো তার দিকে তাকিয়ে থাকি। খুব অসহায় লাগে। সে বলে গেছে, অমুক
দিন সে দাম নিতে আসবে। আমি মনে মনে গুনতে থাকি আর কতদিন বাকি। হিসেব করে
দেখি তার বলা দিনটি সামনের সপ্তাহেই। এসব ভাবতে ভাবতে বিষণ্ণ হয়ে উঠি।
বাড়িতে কাকে বললে ঠিক হবে বুঝতে পারি না। বাড়িতে কে এসব বইয়ের দাম দেবে
তা নিয়ে কোনও ধারণাই নেই আমার। বাড়িতে ফিরে অপেক্ষা করি। আমার ঠিক ওপরের
দাদাকেই অপেক্ষাকৃত নিরাপদ মনে হয়। সে সম্প্রতি ইলেভেন পাশ করে এবিএন শীল
কলেজে পড়ছে। কিন্তু তাকে বলতেই সে বলে, ‘ওর কাছ থেকে কে তোকে বই কিনতে
বলেছে’? সত্যিই তো, কেউ বলেনি! চুপ করে থাকি। সে বলে, ‘কালই বইগুলো ওকে
ফিরিয়ে দিয়ে আসবি। বলবি, আমার সব বই-ই আছে। দুটো করে বই দিয়ে কী করব’! আমি
বুঝতে পারি না, কেন মিথ্যে বলতে হবে। বই তো আমার নেই-ই। পড়তে গেলে বই
লাগবেই। কিন্তু, কে কবে আমার কথা শুনেছে! পরদিন স্কুলে গিয়ে জিয়াউলের খোঁজ
করতেই সে হাসিমুখে এগিয়ে এলো। আমি তার হাতে বইগুলো তুলে দিলে সে কী করবে
যেন বুঝতে পারে না। তাকে বলি, যেমন শিখেছিলাম, ‘আমার সব বই-ই আছে। দুটো করে
বই দিয়ে আমি কী করব!’ বলেই আমি দ্রুত পালাই। কেমন অস্বস্তি হচ্ছিল আমার।
মিথ্যে মানুষকে কেমন দুর্বল করে দেয় সেদিনই অনুভব করেছি। বহুদূর সরে এসে
পেছনে তাকিয়ে দেখি জিয়াউল তখনও সেখানে দাঁড়িয়ে! তার হাতে স্পষ্ট দেখা
যাচ্ছে বইগুলো। সে এদিকেই যেন তাকিয়ে আছে অদ্ভুত দৃষ্টিতে।