তোর্সার ঘরবাড়ি-১৮
তোর্সার ঘর বাড়ি//অষ্টাদশ পর্ব
মণিদীপা নন্দী বিশ্বাস
--------------------------------------------
'তিস্তা ধর্লা তোর্সা নদী
কান্দছে তারা নিরবধি
তারি তীরে কাইন্দা ফিরে
জানমের বাউদিয়া...'
ভিতরের শিশু তো মরে না। তাই তো যত যন্ত্রণা মিনির, কত পর্ব জীবনের। সে উঠোন তো ছাড়ে না সঙ্গ। সে পাকা পুল, সে বিরাট কূটরাজ, পেয়ারা, গেটের কাঠের তক্তা পেরিয়ে ডান হাতি বাগানের গোলাপি থোকার বর্ষার ফুল, সুগন্ধি টগর- একই গাছে দুই রঙ, বেগুনী আর সাদা আর বাঁহাতে আপ্যায়ণের জন্য দাঁড়ানো কাঠগোলাপ... সব যে বুকের মধ্যে ছবি। আর আছে একটু ঢুকে জলপাইয়ের স্বচ্ছ সবুজ পাতা, সবুজের ও কতনা শেড, আর কমলা লাল পাতা। একি গাছের এত রূপ সেই ছোট্টবেলা জুড়ে খুঁটিয়ে দেখেছে সে। ওর মত এমন করে কেই বা দেখে! সব তো মাটি ভোলে, দাওয়া ভোলে, ভোলে কাঠের পুল, এক্কাদোক্কার কোট, মাটির জন্মের দাগ আর দোলনার দড়ি। সব তো কবেই গেছে, তবু মিনি বাঁধজোড়া হাইওয়ে দেখবে কখনো ভাবেনি, ভাবেনি ঐ নরম বালির বস্তা দিয়ে শক্ত করা বাঁধ কংক্রিট হবে একদিন। ভাবেনি সব পাড়ার রাস্তা পাকাপোক্ত কালো ঝকঝকে সাদা বর্ডার দেওয়া হয়ে উঠে যাবে সোজা বাঁধে। আর সেখানে চলবে হরদম চার চাকা, দু চাকার গাড়ি অহরহ। মিনির লালচে ছাতাটা কেমন ফ্যাকাসে এখন। পুরোনো আঁকড়ে রাখা ওর স্বভাব। ও তো এই তোর্সার ধারে কখনো প্রজ্ঞা নয়। হতেই পারে না। বাঁধের মাথায় এখন দাঁড়িয়ে আছে সে। নদীর দিকে চোখ ফিরিয়েছে মুগ্ধতায়। লাল সবুজ হলদে বড় বড় ছাতার নীচে ফলের দোকান, মুদিখানা সব চলছে। ওদিকের বাঁশের সাঁকো দিয়ে বাইক, স্কুটি আসছে আর যাচ্ছে। নদীর ওপারে পসারির হাট, শুটকাবাড়ি, টাপুরহাট। মিনি ঐ সাঁকো ধরে হেঁটে যাবেই যাবে একদিন। আজই যেতে পারে, কিন্তু আজ যে বাঁধ ধরে সোজা পাকা কালচে রাস্তা দিয়ে সোজা খুঁজতে খু্ঁজতে যাবে পাটাকুড়া, সেই ধারার বেড়া দেওয়া কালীবাড়ির এখনকার রূপ, অপরাজিতা গোপ্পীর বাড়ি, সেই হলদে কলকে ফুলের গাছের নীচে চন্দন দিদিমণির বাড়ি, কৃষ্ণচূড়া, তারপর গীতাদির বাড়ি...সমীরদার অপলক তাকিয়ে থাকার গল্প।এরপর হাজরাপাড়া। ওখানেই তো রাস্তা খুঁজতে যাবে সে, ছোট্টবেলায় ঐ পাকা রাস্তা থেকে বাঁধে উঠবে বলে বড় বড় বোল্ডার আর ঘাস মাটির খাঁজে খাঁজে পা রেখে উঠে এসে দাঁড়াত বাঁধের উপর। কাঁচা ঘাস মাটির বাঁধ, নীচে তাকালেই নদী। বেড়া দেওয়া দু একটা বাড়ি দূরে দূরে চরুয়া বস্তির মাসীদের, ওখানকার বন্ধুদের। আর বর্ষা এলে সে সব বাড়ি ডুবে যেত, শুধু খোড়ো চাল কিংবা বেড়ার গা উঁচিয়ে থাকত। এখন তো এ রাস্তায় হেঁটে অথবা চার চাকা চেপে বার কয়েক ভাড়া বাড়ির দিকে গেলেও মিনি নিজের বাড়ির রাস্তা চিনতে পারবে না। তাই সে হাঁটছে, হাঁটছেই। ডান হাতে সাঁকোর কাছে মাশান মন্দির। কখনো দেখেনি এত কাছে সে মাশান মূর্তি। সে অনেকসময় দিনহাটা গোসানীমারির পথে যেতে যেতে ঘেরা কয়েক জায়গায় মাসান ঠাকুরের ছেঁড়া ফাটা, মাটি গলে যাওয়া ঘিরে রাখা অগোছালো ঘর দেখেছে, মূর্তি দেখেছে, এরকম দশাসই নীলচে রঙ, বেশ যত্নে মন্দির করে তুলে সাজানো প্রণামীর বাক্স এমন চর এলাকায় দেখেনি আগে। একে কি বলবে! উন্নয়ণ, না কুসংস্কার বৃদ্ধি! নাকি চরবাসীরা খুঁজে নিয়েছে জাগ্রত দেবতা! যেমন পাশেই চায়ের দোকান...চকলেট, চানাচুরের স্থায়ী দোকান ও তৈরি হয়েছে। দু একটা ভাতের হোটেল ঐ পোক্ত বাঁধের ধারে। চরের ঝাঁকবাঁধা সার সার টিনের কোঠা বাড়িগুলোর দিকে পিছন ঘুরে বসেছে। ওদের প্রয়োজন মিটছে। পাশেই সেলুন। হাঁটতে হাঁটতে বাঁ হাতে দু-একটা মন্দির, তার রঙ করে গড়ে ওঠা সিমেন্টের চূড়ো সব রয়েছে। সেখানেও পুজো আর উপার্জন পাশাপাশি। বাঁ হাতে অর্ধেক বন্যায় মাটির ভিতর ঢুকে যাওয়া গোপ্পী বাড়ি, পুরোনো ভাঙা চাল, দত্ত বাড়ি সব খুঁজে মরে মিনির আকুল চোখ। মনে মনে কল্পনা করে এটাই বোধহয়। ওই-বুঝি! না, মেলেনা হিসেব। বদলে কয়েকটা সুন্দর বাংলো প্যাটার্নের দোতলা চোখে পড়ে। পাশে কয়েকটা পায়রার ঘর বানানো কাঠের খোপ। মন আবার পিছন ধরে টানে। সেই আগের মিত্র বাড়ির উঠোনের দিকে। যৌথ বাড়ির রান্নাঘরের চালের পাশেই উঁচু করে তৈরি করা ছিল পায়রার বাসা। বড় জেঠুর ছেলে মেয়েরা দেখাশোনা করত ওদের। আর ছিল, কতগুলো হাঁস মুরগীর ঘর। সে সব ও দেখভাল করত দাদা দিদিরাই। কবে যেন কালের নিয়মে সবেতেই ভাঁটা পড়ে। তলিয়ে যায় বিক্রি হয়ে যায় সেসব।...ঠিক তেমনি দেখছে এখানে এই ফাঁকা জায়গায়। দাঁড়িয়ে ফটাফট কয়েকটা ছবি তোলে। আর অদ্ভুত ভাবে লক্ষ্য করে বাঁধের উপরের কংক্রিটের রাস্তাটুকু বাদ দিয়ে দুদিকেই নীচে যাওয়া আসার রাস্তা ছেড়ে বাঁধের গায়ে জমির উপর তৈরি হচ্ছে বিরাট বিরাট পাকা সিমেন্টের বাড়ি। মিস্ত্রীর কাজ চলছে। কেমন বিস্ময়ে হতবাক হয় সে। এখানেও মিউটেশন হয়! পারমিশন নিশ্চয় ই নিয়েছে, কি করে পেল! এত নদী দূষণ, প্রবল পরিবেশ দূষণ, বাঁধকে কমজোরি করে দেওয়া। আসলে বাঁধ আর কখনোই ভাঙবেনা। নদী মুখ ঘুরে গেছে জায়গায় জায়গায়। প্লাবণ আর শহরকে ভাসিয়ে নেবেনা বলেই বোধহয় স্থির বিশ্বাস আর সাহস। আচ্ছা, কেউ বলতে পারে, কখনো নদী কূল ছাপিয়ে এদিক পানে আসবেনা, কখনো ভূমিকম্প বিপর্যস্ত করবেনা! কে বলতে পারে! ভিতরে আবার শিহরণ। তীব্র প্রতিবাদ স্পৃহা। বুকেই মরে যায় সব। হাঁটতে থাকে বিসর্জনের ঘাটের দিকে। ডান হাতে ঘিঞ্জি এলাকা জুড়ে গাছপালার পাশাপাশি সমস্ত বানানো ঘর।স্থায়ী বসতি বেশ কয়েক বছরের। বেশির ভাগ টিনের। সবই কি সরকারি সাহায্যে তৈরি! এখানে চর এলাকা যেন এক আঞ্চলিক কথা তৈরি করেছে। কোনদিন এ অঞ্চলের আলাদা স্কুল বাড়ি তৈরি হবে। ঐ পাড় থেকে উজিয়ে বাঁধ পেরিয়ে শহরে ঢুকতে হবেনা।...সব দেখতে দেখতেই কখন যেন শ্যাওলা সবুজ কয়েক ধাপ খাড়া সিঁড়ি দেখতে পায় মিনি, আর আবিষ্কারের নেশায় 'ইউরেকা' বলে চেঁচিয়ে ওঠে। ঐ -- ঐ তো দুটো সরু পাকা রাস্তা, বাঁ হাতি রাস্তা বাঁধ থেকে নেমেই বাঁ হাতে টিন আর সিমেন্টের একতলা তৈরি হয়েছে....এই এখানেই তো শেষ দেখেছে মিনি, মনো আর ওর মাকে। ভাঙা বেড়ার মাটির ঘরে আরো বাসিন্দাদের মধ্যে ওচারী তিত্তিরীরাও ছিল... এখন ওদের মুখগুলো ছোটবেলার ঘোলা জল ঘেঁটে বেরিয়ে আসতে চায়। খুব দেখতে ইচ্ছে করে। মনে হয় দরজায় কড়া নাড়ে।... সংযত হয় মিনি। কতবছর...কতগুলো সেই চেনা মানুষ মুখ হারিয়ে গেছে কবেই।...আর ডানদিক ধরে যে রাস্তা সোজা বাঁধানো কুয়োর পাড়ের মোড়ে মিশেছে ওটা ধরে সোজা গেলেই সেই কালভার্ট, যেখানে একাত্তরে লেখা ছিল শ্লোগান কালো লাল অক্ষরে। যেখানে দুর্গা পুজোয় জমিয়ে বসত আড্ডা। সেখান থেকেই ট্রাকে চড়ে প্রতিমা প্রতিবছর বিসর্জনে যায়। যেখানে বসে সার সার পাড়ার ছেলে মেয়েরা 'ঢালা' খায়। ঐ 'ঢালা' সব বাড়ি থেকে চাল, ডাল, আনাজ, তেল তুলে এনে বিসর্জনের পরদিন প্রতিমাহীন ফাঁকা মন্ডপের ধারে খড়ির উনুনে পাড়ার ছেলেরা তৈরি করত। একে একে বাচ্চাদের দলছ বসে পড়ত পুনু মিনি, রতু, মিলু, রঞ্জু ওরা... হলদে বালব্ জ্বলত দুদিকে দুটো। টিম টিম করে।...বুকের ভিতর কেমন আনচান করে। শরীর খারাপ লাগে মিনির। আসলে শরীর নয় মন কেমনের জল চোখ বেয়ে গলা বেয়ে নামছে যে! সিঁড়ি ধরে কগন যেন নেমে দাঁড়িয়েছে ঘোষ আর দত্ত বাড়ির মাঝ বরাবর অংশটুকুতে। নেমে দাঁড়িয়ে বাঁধের দিকে তাকাতেই আকাশ দেখে সে। ওখানেই তো সেই খেজুর গাছের খোঁচা খোঁচা শরীর আর পাতা। সদ্য হলদে হয়ে ওঠা খেজুর পেড়ে দু একটা মুখেও দিয়েছে কতদিন বন্ধু পাল্লায়। ঐ বাঁধের উপর ই তো একদিন শুনেছিল ভালবাসার গল্পগাথা। আর 'বিয়ে' নামের শব্দবন্ধের নতুন ব্যাখ্যান। রোমাঞ্চ আর ভয়ে দৌড়েছিল বাড়ির দিকে।
...ঐ ঐ তো সে যে পাকা পুল ধরে শেষবার হলদে অ্যমবেসেডারে চড়েছিল মিনি, সব ছেড়ে চলে যাবে বলে। পাড়ার লোকেদের ভীড়ে সে সন্ধে রাতে সে খুঁজেছিল জল ছল ছল দু একটা মুখ। যারা ভাবেইনি মিনি চলে যাচ্ছে... সত্যিই চলে যাবে একেবারে...এঘর এ নদী এ রাস্তা এ রাবার গাছ... এ বাড়ির বইগুলো ছেড়ে এলোমেলো ছাপানো পত্রপত্রিকা, কাগজ ছেড়ে, মার পাহারাদারি ছেড়ে চলে যাবে!...
অন্যমনস্ক মিনি সজনে, কাঁঠাল, রবার গাছের জঙ্গল ভেদ করে ঘোষ বাড়ির পাকা দালানের পাশে নিজেদের বারান্দাটটা খুঁজে পায়। নিষ্পন্দ দাঁড়িয়ে থাকে। গ্রীল গেটের তালাটা ঝক ঝক করে। দোতলাও চাপা পড়ে আছে নারকেল গাছের পাতায়। এক ফাঁক দিয়ে বাড়ির অস্পষ্ট নামটা একটুখানি দেখা যায়। অনেকদিন তাতে রঙ পড়েনি।...খুব হালকা লেখা। নামটা মিনি জানে তাই পড়তে পারে সহজেই মনের দৃষ্টটিতে। 'নীলাঞ্জন'
...এখানে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকাটা ঠিক হচ্ছে না, লোকে পাগল ভাবতে পারে। একটু আগেই এক মাঝবয়সী লোক ঘোষ বাড়ির ভেতর ঢুকে গেল।... ওই তো চেতন। ওইতো নিজেকে একসময়'রাজেশ খান্না' ভাবত। মিনিরা তখন কত ছোট।, ঐ কুয়োর পাড়ের ধারের বাড়িটার মেয়ে খুকুকে চেতনের খুব ভাল লাগত। মনে মনে ওকে ভাবত 'হেমামালিনী'। মিনির ও সে সময় কাগজে ছবির হেমামালিনীর সঙ্গে খুকুদির খুব মিল মনে হত। আর মনে মনে চেতন আর খুকুর বিয়ে দিয়ে ফেলত। আর মজা পেয়ে খুব একটা নেমন্তন্ন খাওয়া যাবে এ বাড়ি ওবাড়িতে, ভেবে খুশি হয়ে উঠত।....ও মা! একলা দাঁড়িয়ে নিজেই গুরগুরিয়ে হেসে নিচ্ছে যে! এখুনি মনে হচ্ছে বাড়ি থেকে মিলুর মা সন্ধ্যা বৌদি, যে কিনা এ পাড়ার 'বৌদিভাই' বেরিয়ে আসছেন। এখুনি বলে উঠবেন কলকলিয়ে,'...ওরে মিনি,...কত্ত বড় হইছিস, চেননই যায় না।' বড় ঠোঁট কাটা মহিলা সে। পাড়ার সকলে সমঝে চলেছে। আর লাগানী, ভাঙানী, ঝগড়া কোন্দলেও বেশ পটুও দেখেছে তাকে।...মিনি তো জানেই না ওরা কেমন আছে। মিলুর ভাই রঞ্জুটাই এখন বুঝি বাড়ির কর্তা গোছের। ঐ চেতনের মত ই দশা হবে রঞ্জুর। বুড়োটে। না, সে সব মুখ বদলানো কাহিনীর চরিত্রদের দেখতে চায়না মিনি। মনে মনে ঠিক করে বাড়ির সামনে দিয়ে সোজা বাঁধানো কুয়োর পাড়ের দিকে যাবে। ডান হাতে থাকবে তরুণ দলের ক্লাবঘর খানা আর কিছু ছেলেবেলা, যৌবনবেলার হারিয়ে যাওয়া প্রিয় মুখ...ও হেঁটে যাবে কালভার্টের দিকে টোটোর জমায়েতের দিকে...শূন্যতা আর কিছু পূর্ণ কলস নিয়ে...
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴