চা-ডুবুরী-১৮/সুকান্ত নাহা
চা-ডুবুরি : পর্ব -১৮
সুকান্ত নাহা
^^^^^^^^^^^^^^^^
হাসি তার রেখে গেছে...
অবশেষে নীলপাহাড়ির তালা খুলল। মাস চারেক পর জীবন ফিরল তার স্বাভাবিক ছন্দে। রুজির খোঁজে যারা পাড়ি দিয়েছিল অন্যত্র, ফিরতে লাগলো তারাও। দীর্ঘ অজ্ঞাতবাসে কাটানোর পর ম্যানেজাররা একে একে নিঃশব্দে ফিরে এলো রাতের অন্ধকারে। ঠিক যেমনভাবে নিরাপত্তার অভাব বোধ করায় অদৃশ্য হয়েছিল তারা বাগান যেদিন বন্ধ হয়ে যায় সেই রাতে। ফেরেনি শুধু একজন। সুদেশ গর্গ। বাতাসে খবর ভাসে মালিক নাকি তার ডানা ছেঁটে ফেলেছে। নীলপাহাড়ির আকাশে তাকে আর উড়তে দেখা যাবে না কোনও দিন ।
ম্যানেজার মিস্টার সহায়কে ততটা অসহায় দেখাচ্ছে না আর আগের মতো। গর্গ নামক রাহুগ্রাস থেকে মুক্তি পেয়ে তিনি যেন স্বস্তি পেয়েছেন মনে হচ্ছে। সদানন্দ পাঠক ফিরে এসেছে তার আগের জায়গায়। পুরনো মেজাজে। বরং আগের চেয়ে আরো যেন চার্জড দেখাচ্ছে তাকে। সেটা পথের কাঁটা সরে যাওয়ায় নাকি হঠাৎই মালিকের খুব কাছের মানুষ হয়ে ওঠায় সেটা বোঝা যাচ্ছে না। ম্যানেজার সহায় তবে বুঝে গেছেন তারও প্রাণভোমরা আপাতত সদানন্দের কৌটোয় বন্দী। তাই যে কদিন চাকরি থাকে তাকে সমীহ করেই চলতে হবে।
নেপথ্যে নিহিত এতসব কূটনৈতিক বিষয় নিয়ে শ্রমিকদের অবশ্য কোনও মাথাব্যথা নেই। বাগান খোলার পর থেকেই মেলা (কাজের জায়গা) গুলোয় কর্মব্যস্ততা শুরু হয়েছে। সরগরম হয়ে উঠেছে বাগানের অফিস কম্পাউন্ড। কারখানায় জোরকদমে শুরু হয়েছে শীতকালীন মেরামতির কাজ । যদিও বাগান পরিচর্যার কাজ সময়মত না হওয়ায় গাছে নতুন পাতা কেমন আসবে, কবে আসবে তার ঠিক নেই। সহকারী ম্যানেজার থেকে শুরু করে সরদার, বৈদার, পানিওয়ালা, দফাদার, বাবু সবাই মিলে লেগে পড়েছে যুদ্ধকালীন তৎপরতায়। ক্ষতি যা হওয়ার হয়ে গেছে। এখন যতটা জমি ফিরে পাওয়া যায় তারই লড়াই চলেছে। যে করেই হোক ঘুরে দাঁড়াতে হবে। সকলের মনে এটাই যেন সংকল্প ।
বাগান খোলার সাথে সাথে একমাসের বেতন নগদে তুলে দেওয়া হয়েছিল শ্রমিক কর্মচারীদের হাতে। বকেয়া বেতনও আগামী কয়েক মাসের মধ্যেই মিটিয়ে দেওয়া হবে চুক্তি অনুযায়ী। পুরোদমে কাজ শুরু হওয়ায় শ্রমিকরাও খুশি। মহল্লায় মহল্লায় আবার ফিরে এসেছে আনন্দেোচ্ছাস। বেতনের দিন হাট বসেছিল কারখানা গেটের বাইরে। শ্রমিকরা আগের মতোই ঐ 'গুদরি-হাট' থেকে কেনাকাটা করে ফিরে গেছিল যে যার বাড়িতে। বহুদিন বাদে আবার মাংসের চনমনে ঘ্রাণ ছুটেছিল শ্রমিক বস্তিগুলির ঝিমিয়ে পড়া অলিগলির ভেতর। হাঁড়িয়া, কাচ্চি-দারুর ঝাঁঝালো মৌতাতে মাতাল হয়েছিল 'ঘর-আঙনা'য় লুটিয়ে পড়া খুশির বাতাস। আর সেদিনই গভীর রাতে হঠাৎ করে মানুষ শুনেছিল কোথায় যেন 'গিজ্জর-গিজ্জর-তাং-তাং' বোলে বেজে চলেছে একটানা আনন্দধ্বনি। আনন্দের আতিশয্যে কেউ পরম আদরে ধুলোঝেড়ে ঐ ভালোবাসার বাদ্যযন্ত্রটা ঝুলিয়ে নিয়েছিল গলায়। রঙিন নেশায় মত্ত হয়ে শিশির ভেজা উঠোনের মাটিতে, কিংবা হয়ত কোনও শুনসান টাঁড়-ময়দানের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে এতোল-বেতোল পায়ে ঘুরে-ঘুরে বাজিয়ে গেছিল সারারাত। অন্ধকারে একা। নিভৃত এক কালপুরুষের মতো।
মাদলের বোল খুশির তরঙ্গ নিয়ে ছুটে গেছিল দূর থেকে দূরান্তে। হিম কুয়াশার চাদর সরিয়ে পাতা ও কুঁড়ির কানে কানে, ছায়া গাছের শূন্যডালে। নতুন ভোরের বার্তা শুনিয়ে সেই তরঙ্গ রাতভর খেলা করেছিল নিশ্চিন্ত ঘুমে ডুবে থাকা শ্রমিকের স্বপ্নের ভেতর, ছটফটে জংলি খরগোশের মতো । শুধু সেই সঞ্জীবনী ছন্দ কিছুতেই পৌঁছতে পারেনি প্রায় নব্বই কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে শহরের মাল্টি-স্পেশালিটি হাসপাতালের তিনতলায় আই. সি. ইউ কেবিনে। অচেতন পড়ে থাকা একজন স্বপ্ন-দেখা-মানুষের কানে। যে মানুষটা এই দিনটিরই অপেক্ষায় ছিল। দিন ফেরানোর যুদ্ধে লড়ে গেছিল আপ্রাণ। নতুন দিনের আলো ফুটলেও, যুদ্ধ তার থামেনি। সে তখনও লড়ে যাচ্ছে মৃত্যুর সাথে। অন্য আরেকটি যুদ্ধক্ষেত্রে।
বাগান খোলার দিন ফিরতে পারেনি সুবর্ণ। মেঘাকে নিয়ে সারাদিন পড়েছিল হাসপাতালে। মেডিকেল কলেজ থেকে বন্ডে সই করে সুমন্তকে নিয়ে আসা হয়েছে এই প্রাইভেট হাসপাতালে। মেঘা যতটা ভেঙে পড়বে বলে মনে হয়েছিল ততটা মোটেই ভাঙেনি। বরং বাস্তবকে মেনে নিয়ে মনশক্ত করে পুরো ঘটনাটার সাথে সে যুঝে চলেছে। বাবাকে এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে এনে ভর্তি করানো থেকে শুরু করে আত্মীয় স্বজনদের খবর দেওয়া, মায়ের সাথে যোগাযোগ করে টাকা পয়সার বন্দোবস্ত করা থেকে ডাক্তারের সাথে কথা বলা সব করে চলেছে আশ্চর্য দৃঢ়তায়। যে মেয়েটা বাবা সম্পর্কে এতটা স্পর্শকাতর তার এই অদ্ভুত শীতলতা বেশ অবাক হয়েছিল সুবর্ণ। পরিস্থিতি বদলে দেয় মানুষকে। কার্ডিও সার্জেন ডঃ পিল্লাইয়ের কথাগুলোই হয়ত ওকে যে কোন পরিস্থিতির মুখোমুখি হওয়ার জন্য প্রস্তুত করে দিয়েছে!
এমারজেন্সি থেকে লিফটে উঠিয়ে সুমন্তকে তেতলার কার্ডিয়াক ডিপার্টমেন্টে ঢোকানো হয়েছিল। তারপর বাইরে বসে শুধুই উদ্বিগ্ন অপেক্ষা। ডাক্তার পিল্লাই যখন সুমন্তকে চেক-আপ করছে ভেতরে ঠিক তখনই শ্রম দপ্তর থেকে অম্বরীশবাবুর ফোন আসে ,
' সুবর্ণ, এইমাত্র মিটিং শেষ হল। কাল থেকে তোমাদের বাগান খুলে যাচ্ছে। সুমন্তকে জানিও। বাই দি ওয়ে, ও কেমন আছে এখন...। ' সুমন্তর খবর শুনে সকলে টেনসড হয়ে পড়ে। উপস্থিত ট্রেড-ইউনিয়ন নেতারা সকলেই আসতে চায় ওকে দেখতে। শ্রমদপ্তরের কাছেই এই প্রাইভেট হাসপাতাল। কিন্তু ভিজিটিং আওয়ারস ছাড়া যে ওকে দেখতে দেবে না সেটা জানতে পেরে ওরা মত বদলায়। অম্বরীশবাবু বলেন,
'ডাক্তার কী বলে জানিও। আর যে কোনও সাহায্যের জন্য যোগাযোগ কোরো। আমরা আছি... ' পাশ থেকে আরো অনেকের গলা শোনা যায়, ' হ্যাঁ...হ্যাঁ,আমরা আছি...আমরা আছি'। কলটা কেটে যায়।
বেরিয়ে এসে ডঃ পিল্লাই কী বলেন তার অপেক্ষার প্রতিটি মুহুর্ত তখন অন্তহীন মনে হচ্ছিল। আনার সময় খুব কষ্ট হচ্ছিল সুমন্তর কথা বলতে । অ্যাম্বুলেন্সে সারাটা রাস্তা মেয়ের হাতটা ধরে ওর মুখের দিকেই একদৃষ্টে চেয়েছিল। চোখের কোণে চিকচিক করছিল জল। কষ্ট হলেও মেঘা যে আপ্রাণ নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করছে সেটা বুঝতে পারছিল সুবর্ণ। করিডরের গ্লাস-ওয়ালের ওপাশে ঝুঁকে থাকা মেঘলা বিকেল। মনমরা সেই আলোর দিকে মুখ ফিরিয়ে দাঁড়িয়েছিল মেঘা। ওর মেঘ-নামা মুখের ওপর থমকে ছিল বৃষ্টি। কিন্তু খানিক বাদেই ডঃ পিল্লাই বেরিয়ে এসে খুব সংক্ষেপে যে কথাগুলো বলে গেলেন তা যেন দমকা ঝড়ের মত দুজনেরই বুকের ভেতরটা লন্ডভন্ড করে থমকে দিয়ে গেল। দৃশ্যত বৃষ্টি না হলেও অন্তর্গত তুমুল বৃষ্টিপাতে মেঘা যে ভিজে যাচ্ছে তা বেশ অনুভব করতে পারছিল সুবর্ণ। পাশে এসে পিঠে হাত রাখতেই মুহুর্তে টলে ওঠে ওর ধ্বস্ত পলকা শরীরটা। ধরে বসিয়ে দিতে গিয়ে সুবর্ণ জিজ্ঞেস করে, 'কী রে,শরীর খারাপ লাগছে ...! জল খাবি..?'
কোনও উত্তর করে না মেঘা। ঠোঁটটা থরথর করে কেঁপে গভীর একটা দীর্ঘশ্বাস উঠে আসে বুক ঠেলে। সুবর্ণর কানে বাজতে থাকে ডাক্তারের কথাগুলো,
'দিস ইজ টু মাচ লেট । অলমোস্ট থ্রি ডেজ হ্যাভ গন...হোয়েন- এভার দ্য পেশেন্ট উড হ্যাড টু বি রিচড হিয়ার উইদিন ফোর আওয়ারস আফটার অ্যাটাক। অ্যান্ড দ্যাট পিরিয়ড ওয়জ দ্য মোস্ট ভাইটাল টু সারভাইভ। হাউএভার উই আর ট্রাইং আওয়ার বেস্ট...নাউ প্রে টু গড... ' বলে নিজের বুকে ক্রস টেনে আঙুল টা ওপরের দিকে দেখিয়ে হনহন করে বেরিয়ে গেলেন। একটু বাদেই যখন ট্রলি-স্ট্রেচারে করে বের করিয়ে আনা হচ্ছিল সুমন্তকে, সুবর্ণ কাছে গিয়ে দুহাতে ওর একটা হাত শক্ত করে ধরে। চোখের কোল বেয়ে টপটপ করে জল গড়িয়ে পড়ে সুমন্তর। জোর করে মুখে হাসি ফুটিয়ে সুবর্ণ বলে,
' আরে কাঁদছিস কেন...কিস্যু হয়নি তোর। চিয়ার আপ বস... শোন একটা সুখবর আছে... বাগান খুলে যাচ্ছে কাল থেকে। এখন তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে ওঠ্... তারপর সেলিব্রেট করব...'
কথা ফোটে না মুখে। শুধু ম্লান হাসি সাড়া দেয় সুমন্তর ঠোঁটে। ট্রলিটা সন্তর্পণে ঢুকে যায় কেবিনের ভেতর।
পরদিন বড় সাহেবের ফোন পেয়ে সুবর্ণকে ফিরে আসতে হয়েছিল বাগানে। কিন্তু বাগানে পৌঁছতেই খবর আসে দ্রুত অবনতি হচ্ছে সুমন্তর অবস্থার। পরদিন রবিবার থাকায় সঙ্গে আরও কয়েকজন কলিগ এসেছিল হাসপাতালে সুমন্তকে দেখতে। এক এক করে দেখে সবাই যখন নেমে আসছিল নিচে সবশেষে বড়বাবু দিব্যেন্দু রায়, লিফটের উঠতে গিয়ে হঠাৎ সুবর্ণর হাতটা চেপে ধরেন,
'সোনা, তুমি একটু চল ভাই। খুব নার্ভাস লাগছে।'
দুজনকে একসাথে কেবিনে ঢুকতে দেবে না। সুবর্ণ তবু যায়। দিব্যেন্দু রায় ভেতরে ঢুকলে সে দাঁড়িয়ে থাকে বাইরে। বেরোতেই সুবর্ণ শুধু জিজ্ঞেস করেছিল, 'কেমন দেখলেন? '
সুবর্ণ লক্ষ্য করে বড়বাবুর নাকের চশমাটা অনেকটা নেমে গেছে । মুখটা ঝুলে গিয়ে কেমন যেন আতংকগ্রস্ত মনে হয় তাকে। পকেট থেকে রুমাল বের করে মুখে চাপা দিতে গিয়ে হঠাৎ ফুঁপিয়ে উঠেন উদ্গত কান্নায় । কিছুটা ধাতস্থ হয়ে বলেন, ' দেখা যায় না গো, এ দৃশ্য দেখা যায় না...নাকে মুখে নল লাগানো...শ্বাস নেওয়ার জন্য হাঁকপাক করছে। নার্সকে বললাম, কোনও উত্তর করল না। আমার হাতটা শক্ত করে ধরেছিল। কথা বলার জন্য ছটফট করছিল... কিছুতেই ছাড়তে চাইছিল না...হায় ভগবান,ওর'ম শক্তসমর্থ মানুষটা...কী ভীষণ যে অসহায় দেখাচ্ছিল...সহ্য হচ্ছিল না গো দেখে ... জোর করে হাতটা ছাড়িয়ে...'' গলা বুজে আসে দিব্যেন্দু রায়ের।
ভিজিটিং আওয়ারসের সময় ফুরিয়ে আসছিল। প্রাণপণে শক্তি সঞ্চয় করে একবার ভেতরে ঢোকে সুবর্ণ। কাছে যেতে সাহস হয় না । দূর থেকে চোখে পড়ে বন্ধুর বুকের দ্রুত ওঠানামা । ঈষৎ বিস্ফারিত দৃষ্টি ওপরের দিকে নিবদ্ধ। কাউকে যেন খুঁজছে। কাকে খোঁজে সুমন্ত! মেঘাকে? পায়েলকে! নাকি তাকে! কিছু কি বলতে চায় ও? নার্সকে চোখে পড়ে না। শূন্য ঘর জুড়ে অদ্ভুত এক হিমেল নিস্তব্ধতা। নীল কার্ডিয়াক মনিটরে গ্রাফের অনিয়মিত চড়াই-উতরাই। ড্রিপিং চলছে অত্যন্ত বিলম্বিত লয়ে। বিন্দু বিন্দু ঝরে পড়ছে জীবনের ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর আশ্বাস। অজানা ভয়ের মেঘ সম্পূর্ণ গ্রাস আগে একরকম পালিয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসে সুবর্ণ। মেঘাকে খুঁজতে খুঁজতে নিচে নেমে আসে ।
নিচে নেমে চোখে পড়ে দূরে পায়েল সেই লোকটার সাথে বসে চা খেতে খেতে গল্প করছে বাগানের বেঞ্চের ওপর বসে। এই লোকটির সাথেই তো পায়েল এসেছিল কলকাতা থেকে! একটু অবাক হয় সুবর্ণ। লোকটার তো সেদিনই ফিরে যাওয়ার কথা ছিল! এমন ভান করছিল যেন ভীষণ ব্যস্ত মানুষ। 'টাইট-সিডিউল' ' ট্যূর' ' মিটিং' 'ফ্লাইট'- 'সেমিনার'- পায়েলের সাথে কথোপকথনের মাঝে সুযোগ বুঝে বারবার ঐ শব্দ গুলো গুঁজে দিয়ে নিজের এক্সিকিউটিভ কর্পোরেট স্ট্যাটাস জাহির করছিল। নেহাৎ দায়ে পড়ে পায়েলকে নিয়ে আসতে হয়েছে সেটা বোঝাতে চাইছিল হাবেভাবে। পায়েল পরিচয় দিয়েছিল 'দাদা' বলে। দেখে অবশ্য ওর চাইতে ছোটই মনে হয়েছে সুবর্ণর। লোকটা যে একটা 'পাতি-চালিয়াত' সেটা বুঝতে অসুবিধে হয়নি সুমন্তর। এই সংকটজনক পরিস্থিতিতেও ওদের যেন বড় নিশ্চিন্ত দেখাচ্ছে । ওদের কাছে যাওয়াটা কী ঠিক হবে। তারচেয়ে বরং ফোন করা যাক। ভাবতে ভাবতে মোবাইলটা বের করে রিং করতেই পিঠে কারো স্পর্শ পায় সুবর্ণ,
'কাকে ফোন করছিলে কাকু?' মেঘাকে দেখেই কলটা কেটে দেয় সুবর্ণ।
-' এই তো তুই... কোথায় ছিলি? '
-' নিচেই বসেছিলাম। তোমরা তাহলে সবাই শেষ দেখা দেখে এলে বাবাকে...? ' শীতল যান্ত্রিক এই উচ্চারণে চমক লাগে সুবর্ণর।অনিবার্য সত্যি কথাটা এভাবে কানে বাজতেই বুকের ভেতরটা চৈত্রের খাঁ-খাঁ মাঠের মতো ফাঁকা হয়ে যায় । তড়িঘড়ি সেই শূন্যতায় সান্ত্বনার প্রলেপ দিতে ব্যস্ত হয়ে ওঠে সুবর্ণ,
' এ সব কি কথা বলছিস...শিগগিরই ও ভালো হয়ে যাবে ... ভালো ওকে হতেই হবে... ওকে আমরা সুস্থ করে ফিরিয়ে নিয়ে যাব বাগানে দেখিস....ওর মতো ফাইটারকে যে ফিরে আসতেই হবে । '
পরদিন সত্যি সত্যি ফিরে এসেছিল সুমন্ত। তবে গলা থেকে পা পর্যন্ত মোড়া, পায়ের আঙ্গুলে তেরো সংখ্যা লেখা মর্চুয়ারির ট্যাগ ঝোলানো হতভাগ্য সুমন্ত ঘোষাল হয়ে। ফিরেছিল অবশেষে ওর চিরকাঙ্খিত ভরা সংসারে। ওর 'আপনজন'দের কাছে। যারা সকলেই ব্যস্ত মানুষ। মৃতের জন্য দু দন্ড বাড়তি সময় ব্যয় করতেও যারা হিসেব কষেন। তবু তারা এসেছেন বড্ড 'ব্যাকুল' হয়ে। কয়েকশো কিলোমিটার অতিক্রম করে কেউ চারচাকায়, কেউ বা বিমানযোগে ছুটে এসেছেন চিরনিঃসঙ্গ তেরো নম্বর লাশটার কাছে। ওরা অপেক্ষারত। 'ক্রিমেশান' শেষে তাদের 'ফিরতেই' হবে। কেবল সেই যে 'টাইট-সিডিউল' ছিল যে লোকটার সে-ই কেবল রয়ে গেল তখনও পর্যন্ত।
সুমন্তকে রাখা হয়েছিল কোয়ার্টারের সামনে ফুলবাগানের ঘাস জমিটার ওপর। খবর পৌঁছতেই ছুটি ঘোষণা করা হয় বাগানে। 'মেলা' থেকে শ্রমিকরা ছুটে আসতে থাকে। যাদের সঙ্গে সুমন্তর সারাটা দিন কাটত। এতকাল যারা ওর জীবনের খুব কাছাকাছি ছিল। যারা ওকে ভালোবাসত, ভরসা করত। ওদের প্রায় সকলের হাতেই ফুল। ধুপকাঠি, মোমবাতি। কারো হাতে সাদা 'কাফন-কাপড়'। সেই কাপড় ওরা পেতে দিচ্ছে পরম মমতায় নিস্প্রাণ শরীরটার ওপর। সারিবদ্ধ হয়ে নিঃশব্দে ওরা আসছে। হাতজোড় করে দাঁড়াচ্ছে কয়েক দন্ড। কেউ বুকে ক্রস চিহ্ন একে হাত জড়ো করে প্রার্থনা শেষে নীরবে ফিরে যাচ্ছে। কেউ আবার ভেঙে পড়ছে অঝোর কান্নায়। সে কান্নার উৎসমুখ বড্ড গভীরে। হাজারো প্রশ্ন চিহ্ণ মাথা খুঁড়লেও যার তল খুঁজে পাবে না।
একে একে ম্যানেজার, সহকারী ম্যানেজাররা সবাই এলেন শেষ শ্রদ্ধা জানাতে। ফুলের মালা দিয়ে অপলকে চেয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। দিব্যেন্দু রায় কাছেই ছিলেন। তাকে জানিয়ে গেলেন, ওরা শ্মশানঘাটেও যাবেন। কোনও কিছু দরকার পড়লে যেন জানানো হয়। দাহকার্যের যাবতীয় জিনিস যদিও আগেই ট্রাক্টরে তোলা হয়েছিল। সুবর্ণর মোবাইলে ইউনিয়ন অফিস থেকে ফোন আসে সদস্যরা সেখান থেকেই চলে যাবেন ঘাটে। সেখানেই শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করবেন তারা।
ট্রাকে তোলা হচ্ছিল সুমন্তর দেহটা। যদিও ওটা তখন আর সুমন্তর নেই। পেছনের প্রচুর মানুষ প্রস্তুতি নিচ্ছে শ্মশানবন্ধু হওয়ার। বাঁশের মাচায় বাঁধা সুমন্তর শরীরটা ঘিরে বেশ কিছু লোকজন কোমরে গামছা বেঁধে প্রস্তুত। হরিধ্বনি দিতেই গাড়িটা সচল হলো। সচল হচ্ছে একে একে পেছনের মোটরবাইক, চারচাকা গুলো। শববাহী গাড়িটা এগুতেই জায়গাটায় মুহুর্তে নেমে আসে নিস্তব্ধতা। সুবর্ণ পেছনে ফিরে একবার সুমন্তর স্মৃতি জড়ানো কোয়ার্টারটা দেখে। বিষণ্ণ বারান্দাটা ফাঁকা। সুমন্তর মেলে রেখে যাওয়া গামছাটা শুধু হাওয়ায় দুলছে। স্তব্ধ বাড়িটার গা ঘেঁষে বেড়ে ওঠা শিরিষ গাছ থেকে নিঃশব্দে অশ্রু পাতের মতো পাতা ঝরে যাচ্ছে ফাগুন হাওয়ায়। হঠাৎ জেগে ওঠা ঘূর্ণি ধূলোয় পাক খেতে খেতে একটি সেগুনপাতায় উড়ে এসে লুটিয়ে পড়ে পায়ের কাছে। সুমন্ত যেন নাড়া দিয়ে বলে যায়, 'কীরে..আসবি না...! '
বাইকে উঠতে যাচ্ছিল সুবর্ণ। ঠিক তখনই শূন্য বাড়িটার খোলা জানলা দিয়ে ছুটে আসে অস্বাভাবিক চিৎকার। মেঘার গলা, 'চলে যাও.... কেন রয়ে গেলে তোমরা.... চলে যাও... আমি একা থাকতে চাই.... আমাকে একা থাকতে দাও...' সশব্দে কিছু আছড়ে ফেলার শব্দ শোনা যায়। বাইক স্ট্যান্ড করে দ্রুত ফিরে আসে সুবর্ণ। ঘরে ঢুকতেই চোখে পড়ে ড্রয়িং রুমে চেয়ারে এককোণে জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে পায়েল। সেই লোকটা ভেতরের উঠোনে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছে। আর বেডরুমের দরজা বন্ধ করে চিৎকার করে চলেছে মেঘা। সুবর্ণ ঢুকতেই পায়েল অসহায়ের মতো চোখ তুলে তাকায়। কিছু বলে না। চিৎকার ক্রমশ বাড়তে থাকে।
সুবর্ণ দরজা ধাক্কিয়ে বলে, 'মেঘা...মেঘা...দরজা খোল... কি হল তোর...অমন করছিস কেন...? '
চিৎকার থেমে যায়। কিন্তু দরজা খোলে না। সুবর্ণ ফের ডাকে, 'মেঘা... মেঘা রে... মেঘা.. মা আমার... দরজা খোল.. '
কয়েক মুহুর্তের স্তব্ধতা। তারপর একসময় দরজা খুলে যায়। চুল এলোমেলো। চোখ দুটো লাল। চোখের কোনে কালি। বেশবাস অবিন্যস্ত।ঝড়ে বিধ্বস্ত পাথরপ্রতিমার মতো স্থির দাঁড়িয়ে অদ্ভুত চোখে তাকায় মেঘা।
-' অমন করছিস কেন মা। শান্ত হ। শান্ত হ তুই। তুই এরকম করলে তোর বাবা যে কষ্ট পাবে। তোকে তোর বাবা.... '
কথা শেষ হয়না। আচমকা বাঁধভাঙা কান্নায় আছড়ে পরে মেঘা সুবর্ণর বুকের ওপর,
' আমি সহ্য করতে পারছি না ওদের....সবাই চলে গেছে...ওরা কেন রয়ে গেল কাকু...ওদের চলে যেতে বল তুমি। ঐ লোকটাকে আমি দেখতে চাই না এ বাড়িতে...এ বাড়িতে ওকে থাকতে দেব না আমি....কক্ষণো না... বাপির কোনও জিনিস ও ছোঁবে না... ওর জন্যই আজ আমার বাপি... কত কষ্ট পেয়ে... কত... কত... ' কান্নার দমকে হেঁচকি উঠতে থাকে মেঘার।
সুবর্ণ লক্ষ্য করে অ্যালবাম থেকে বের করা অজস্র ছবি সারা বিছানায় ছড়ানো। অধিকাংশই সুমন্ত আর পায়েলের যুগল ছবি।কয়েকটি ছবিতে বাবার কোলে মেঘা। ওদের বিয়ের টুকরো দৃশ্য কিছু, মধুচন্দ্রিমায় সমুদ্রের ধারে, সবুজের অরণ্যের কোলে, চা গাছের ফাঁকে...পাহাড়কে পেছনে রেখে দাঁড়ানো সূর্যাস্তের বিভায় ওদের জীর্ণ হয়ে যাওয়া সোনালী দিনগুলো যেন বলতে চাইছে 'এগুলোর কি সত্যিই কোনও মূল্য ছিল নানা কোনোদিনই! '
ছবিগুলো যেন অনেক কথা বলতে চায়। অ্যালবামে চাপা পড়া সেই কন্ঠস্বর সেদিনও যেমন কেউ শুনতে চায় নি, আজ শুনতে চাইলেও সেই স্বর স্মৃতি ছাড়া ফিরিয়ে দেবে না কিছুই। ছবির ভিড়ে একটি ছবিতে চোখ আটকে যায় সুবর্ণর। সুমন্ত হাসছে। সহজ, সারল্য মাখানো সেই হাসির দিকে তাকিয়ে চোখটা ঝাপসা হয়ে আসে সুবর্ণর।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴