আমি এক যাযাবর-১৮/শৌভিক কুন্ডা
আমি এক যাযাবর
অষ্টাদশ পর্ব
শৌভিক কুন্ডা
হুইসপারিং পাইনস
পরিচিত জায়গাগুলো ছেড়ে ইচ্ছে করে অচেনা ভুঁইতে পা রাখার। আর সে ক্ষেত্রে নেট জগতের কোনো জুড়ি নেই। অন্তত আমার অভিজ্ঞতা তাই বলে। হ্যাঁ, অনেক সময়েই বাড়িয়ে বলা, দিশাহীন লোকেশন, বাস্তবের সাথে অপার ফারাক ইত্যাদি থাকে বটে, আবার হাতের মুঠোয় স্বর্গও জুটে যায়। তেমনি একটি নতুন, এক্কেবারে নতুন স্পট ঘুরে এলাম। হোম-স্টে ঠিক নয়, ফার্ম-স্টে বলাই ভালো। আরও সঠিক হয় যদি বলি নির্মীয়মান ফার্ম-স্টে। নেট জগৎ থেকেই হুইসপারিং পাইনসের সন্ধান পেয়েছিলাম। নামেই কুপোকাৎ। আবছা মনে পড়েছিলো লুংসেল থেকে ফেরার পাহাড়ি পথে এমন নামের একটা বোর্ড কখনো দেখেছিলাম। খোঁজখবর নিয়ে বের হয়ে পড়া অতএব। ডামডিম-গরুবাথানের চেনা পথে। মিনগ্লাস বাগান ছাড়াতে ছাড়াতে মধুপর্ণার উত্তেজিত গলা। ভাগ্যিস। মূল রাস্তা ছেড়ে বাঁদিকে সরু গলিপথ। একটু এগোতেই জারুলসম্ভার! অগুন্তি জারুল গাছ বেগুনি আবীর ছুঁড়ে দিচ্ছে আকাশে। এ বছর তখনও অবধি জারুলের এমন ঘটা চোখে পড়ে নি। দাঁড়িয়ে থেকে থেকে আশ মেটালাম। আবার গন্তব্যের দিকে। চেল নদীর ধারে রেস্টুরেন্টটিতে দুপুরের খাওয়া সেরে ওপরের দিকে ওঠা। গোটা পথই যোগাযোগ রাখছিলাম হুইসপারিং পাইনসের ম্যানেজার প্রীতমের সাথে। ওর পাঠানো গুগল লোকেশন ধরেই গাড়ি উঠতে লাগল। প্রচুর বাঁক। মাঝে মাঝেই নেটওয়ার্ক থাকছে না। এইসব বিপত্তিতে গন্তব্য ছাড়িয়ে কিছুটা এগিয়েও গেছিলাম। যোগাযোগ ফিরলে প্রীতমই সেটা জানাল আর গাড়ি ঘুরিয়ে নীচের দিকে নামতে বলল। এবার দীনেশচন্দ্রকে বলে রেখেছি ধীরে ধীরে চালাতে। উলটো দিক থেকে একটা বাইক, আমাদের গাড়ির দিকে অনুসন্ধিৎসু চোখে তাকাচ্ছে লাল জ্যাকেট গায়ে চালক। হাত তুললাম। হ্যাঁ, প্রীতমই। বাইক ঘুরিয়ে নিয়ে ফলো করতে বলল। পৌঁছলাম গন্তব্যে। গাড়ি রইল নীচে। ওপর থেকে দুজন ছেলে নেমে এসে মালপত্র নামিয়ে নিলো। একটু খানি হাঁটা। পাহাড় বেয়ে মিনিট দুয়েক। আর তারপরই ৫ একর জমির ওপর ছড়ানো ছেটানো ফার্ম হাউজ। এখনো নামের সাথে সঙ্গতি রেখে পুরোপুরি খামার বাড়ি হয়ে ওঠেনি। শৈশব মাত্র বলা যায়। কিন্তু যতটুকু আছে, মন ভরানোর পক্ষে যথেষ্টরও বেশি। আর, এই প্রথম এমন কোনো জায়গায় এলাম, যেখানে রেজিস্টার বইটিতে অন্য কোনো দাগ নেই। আমাদের নামেই প্রথম এন্ট্রি! ঘরে ঢুকে প্রথম চমক। প্রশস্ত বিন্যাসে দুজনের জন্য বিছানা। আর খাড়া কাঠের সিঁড়ি (মই বলাই ভালো) বেয়ে একটি এ্যাটিক, সেখানে আরো একজনের শোওয়ার ব্যবস্থা। এ্যাটিকটির দুদিকের দেওয়াল মেঝে থেকে দেড় মানুষ উচ্চতা পর্যন্ত স্রেফ কাচের। নীচের অংশে ব্যালকনির দিকটাও তেমনি কাচের দেওয়াল। ঘরে শুয়ে শুয়েই পাহাড়ের সারি, গাছের সবুজ আর পাখিদের ওড়াউড়ি। পাহাড়ি পথ, অনেক বাঁক, কোনো কোনো স্ট্রেচ যথেষ্ট খারাপ, সুতরাং ক্লান্তি কিছুটা জুড়ে বসেছিলো শরীরে। ব্যালকনিতে বসে সুস্বাদু চায়ে চুমুক দিয়ে দিয়ে সে ক্লান্তি কাটল অনেকটা। প্রীতমের সাথে কথা হ'ল, পরদিন সকালে পাখি দেখতে যাব। আমরা সে অর্থে বার্ড ওয়াচার নই যদিও। কিন্তু প্রীতমেরই উৎসাহে সায় না দিয়ে পারলাম না।
একটু বিশ্রাম নিয়ে হাঁটতে বের হলাম। একাই। বেশ ঠান্ডা এখানে। সকালে যখন বাড়ি থেকে বের হই, তখনও গরম ভীষণ! আর এখন পাঞ্জাবির ওপর জ্যাকেট, তারও ওপর চাদর জড়িয়ে হাঁটা! ভাবা যায়? হাঁটতে হাঁটতে প্রাইমারি স্কুল, একচিলতে মাঠে বাচ্চাদের খেলা। অল্পসময় পা মেলালাম। একটা ছোট্ট বাড়ি মাঠ লাগোয়া, মহিলারা দোকান চালাচ্ছেন। কারা যে ক্রেতা এই পান্ডববর্জিত ডোরখোলায়!
চত্বরে ফিরতে ফিরতে বিকেলের আলো কমে এসেছে। স্ত্রী-কন্যাও দেখি ঘর ছেড়ে বাইরে। তিনজনে এবার ঘোরাফেরা। ফার্মস্টের এলাকা ভুক্ত ধুপি গাছের জঙ্গল ঢাল বেয়ে নেমে গেছে। সে দিকে মুখ করে কাঠের বেঞ্চ টেবল, সুন্দর চা-আড্ডার ব্যবস্থা। এই ধুপিরাজত্বে হেঁটে হেঁটেই সময় কেটে যায় অনেকটা। এ চত্বর যেমন নীচের দিকে নেমে গেল, উল্টোমুখে আবার ওপরপানে পায়ে হাঁটা পথ। সে পথের পাশে পাশে কোথাও দোলনা, কোথাও উপত্যকামুখী বসার জায়গা, কোথাও তাঁবু খাটাবার ব্যবস্থা। সন্ধ্যে নামছে। মূল আবাসচত্বর আলো ঝলমলে। আর ৫ একর জমিনের এখানে ওখানে ছড়িয়ে গিয়েছে আরও কিছু আলোর ব্যবস্থা। জঙ্গল, কুয়াশা আর ঐ নির্জন বিস্তৃতি সে অপর্যাপ্ত আলোয় ক্রমশ রহস্যময় হয়ে উঠছে। ভরা মে মাসেও বেশ ঠান্ডা। অতএব ঘরে ঢুকে যাওয়াই ভালো। সেইমতো কোজি কর্ণারে আর এক দফা চা। এতক্ষণে ঘরটিকে খুঁটিয়ে দেখার সুযোগ এলো। আলমারি, বেডসাইড টেবল, কাচদেওয়ালের গা ঘেঁষে মুখোমুখি বসিবার সোফা, একটি ডাবল, সিঙ্গলও একটি। মাঝে সেন্টার টেবল। এক পাশে ল্যাম্প স্ট্যান্ড, বাহারি শেড। আর এক কোনে দেওয়াল ঘেঁষে ছোট্ট রিডিং টেবল। কাচদরোজা ঠেলে ঘর পেরোলে চওড়া বারান্দা। টেবল চেয়ার ছাড়া আর কোনো আতিশয্য নেই। এ্যাটিকঘরে বিছানা, বেডসাইড টেবল ছাড়া আরও একটি রিডিং টেবল। নীচেরটির তুলনায় বড়ো। বারান্দায়, ঘরে সব মিলিয়ে অন্তত ১৫ খানা চার্জিং পয়েন্ট! আর, নরম তুলতুলে রাগস বেছানো মেঝে। পায়ের পাতার আরামটির দিকেও সমান বা একটু বেশিই নজর এঁদের। রুমস্লিপারের ব্যবস্থা তিনজন মানুষেরই জন্য। আর, ঘরে-বাইরে দেওয়াল জুড়ে ফোটোগ্রাফস। পাখির, প্রকৃতির। প্রতিটি ফ্রেম অমিত কুমারের নাম বইছে। জানলাম এই সম্পত্তির অন্যতম অংশীদার এই "অমিত স্যার"।
আমি এ্যাটিক ঘরটির দখল নিয়েছিলাম। রাতের খাওয়া আর সামান্য গুলতানি সেরে ব্ল্যাংকেট শরণম। ভোরের বেলা হাল্কা আলো ঘুম ভাঙালো। রাতে কাচদেওয়ালের পর্দা টানি নি! বলে রাখাই ছিলো। সময় মেপে ঠিক সাড়ে ছ'টায় আমার জন্য কালো কফি চলে এলো। মা-মেয়ের ঘুম না ভাঙিয়ে বারান্দায় নেমে বসলাম। চোখের সামনে অসীম পাহাড়। উপত্যকা। ফার্ম হাউজের সীমানার ভেতর গাছগুলোতে কাঠের গামলা বাঁধা। পাখিদের জন্য বৃষ্টির জল ধরে রাখার ব্যবস্থা করেছেন এঁরা। চার পাশ আরো একটু পরিস্কার হতে শুরু হল তাদের উড়াল। কালো, ছাই, ঘন নীল, হলুদ, টকটকে লাল! দু চারজন প্রায় হাতের নাগালে এসে যেন বলে যাচ্ছে, "এই বাতাস-জঙ্গল স্রেফ আমাদের। এরই মাঝে যেটুকু পরিসরে পারো, নিজেদের রাখো। তার বেশি চেও না।"
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴