অন্তহীন আকাশের নীচে/১৮
অন্তহীন আকাশের নীচে
পর্ব ১৮
দেবপ্রিয়া সরকার
-------------------------------
“শিববংশ জাত, অবনি বিক্ষাত,
বিশ্বসিংহ অনুপাম।
তাহার তনয়, অতি সুবিনয়,
নরনারায়ণ নাম।।
বাহু বীর্য্যে সন্ত, করিয়া বিক্রান্ত,
আক্রমিলা বহু দেশ।
তাহার তনয়, হৈলো শেষ ময়,
লক্ষ্মি নারায়ণ শেষ।।
সেহি বংশজাত, ভূবন বিক্ষাত,
ধৈর্যেন্দ্র নাম নরেস।
তাহার তনয়, অতি য়বিনয়,
হরেন্দ্র নামে যে শেষ।। ...”
আবৃত্তি থামিয়ে ইন্দ্রায়ুধ বলল, মহারাজ হরেন্দ্র নারায়ণ এভাবেই কাব্য ভাষায় নিজের বংশ পরিচয় লিপিবদ্ধ করেছেন।
-সে তো বুঝলাম, কিন্তু বাংলা বানানগুলো এমন অদ্ভুত কেন?
ইন্দ্রায়ুধের পাশে বসে তার হাতে ধরা বইটার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল স্বয়ংদ্যুতি।
-তুমি বাংলা পড়তে পারো?
-আলবাত পারি। ছোট থেকে লখনউতে বড় হলেও, বাড়িতে মা আমাদের বর্ণপরিচয়, সহজপাঠ নিয়ম করে পড়াত। রবীন্দ্র, শরৎ, বঙ্কিম রচনাবলী, জীবনানন্দ, বিষ্ণু দের কবিতার বই ছিল বাবার সংগ্রহে। বেঙ্গলী ক্লাবের লাইব্রেরি থেকে শরদিন্দু, সত্যজিৎ রায়, সুনীল গাঙ্গুলি, শীর্ষেন্দু মুখার্জী, নবনিতা দেবসেনের বই এনে পড়েছি একটু বড় হওয়ার পর থেকেই। সুতরাং প্রবাসী বাঙালি বলে আমাকে আন্ডারএস্টিমেট করার কোনও কারণ নেই ইন্দ্রবাবু।
ইন্দ্রায়ুধ হাসিমুখে বলল, ভুল হয়েছে ম্যাডাম, ক্ষমা চাইছি। প্রাচীন বাংলা শব্দ এভাবেই লেখা হতো। এখনকার মতো সুনির্দিষ্ট কোনও বানানবিধি তখন ছিল না।
সকাল সকাল তারা রাজবাড়িতে চলে এসেছে। ভিজিটারদের ভিড় বাড়ার আগেই চটপট ভিডিও রেকর্ডিং শেষ করতে চায় স্বয়ংদ্যুতি। আর্কিওলজি ডিপার্টমেন্টের অনুমতি নেওয়া আছে। শ্যুটিং শুরু করার আগে রাজ-রাজড়াদের সাহিত্যচর্চা বিষয়ে আলোচনা চলছিল। সেটা নিয়ে বলতে গিয়েই তার সংগ্রহে থাকা একটি বই থেকে মহারাজ হরেন্দ্র নারায়ণের লেখা কাব্য পড়ে শোনাচ্ছিল ইন্দ্রায়ুধ। কথা প্রসঙ্গে সে বলল, বিভিন্ন সময়ে কোচবিহারের রাজাদের উৎসাহে এবং পৃষ্ঠপোষকতায় যে সাহিত্যচর্চার ধারা চলে আসছিল তা হরেন্দ্র নারায়ণ ভূপের রাজত্বকালে শিখর ছুঁলো। সুদীর্ঘ ৫৩ বছর তিনি রাজত্ব করেছিলেন। এই সময়কে বলা হয় কোচ রাজদরবারে কাব্যচর্চার সুবর্ণ যুগ। বিভিন্ন শাস্ত্র পাঠ করে এবং বাংলা ও পার্শি ভাষায় দক্ষতা অর্জন করে মহারাজা স্বয়ং সাহিত্য রচনায় মনযোগী হয়েছিলেন। তাঁর রচিত ‘গীতাবলী’, ‘উপকথা’, ‘রাজপুত্র উপাখ্যান’, ‘সাংখ্য প্রবচন সূত্র’ ইত্যাদি বিভিন্ন সময় মুদ্রিত হয়েছিল বলে জানা যায়। এছাড়াও তাঁর লেখা অনেক পুথি নষ্ট হয়ে গিয়েছে। সেগুলি আর উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। শোনা যায় মহারাজ হরেন্দ্র নারায়ণ যখন উপকথা এবং রাজপুত্র উপাখ্যান রচনা করেছিলেন তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র কুড়ি বছর।
-মাই গড! ভাবতে পারো আজকের দিনে কোনও ওই বয়সী যুবক ক্লাবে, পাবে বা রেস্তোরাঁয় বন্ধুদের সঙ্গে হ্যাং আউট না করে ঘরে বসে মোটা মোটা বই লিখছে?
স্বয়ংদ্যুতির কথা শুনে সশব্দে হেসে উঠল ইন্দ্রায়ুধ। বলল, সে তো বটেই। আমরা এখন আপাদমস্তক একটা ভোগবাদী সমাজে বাস করছি। যাক্ গে, চলো আর সময় নষ্ট না করে ভেতরে যাওয়া যাক। তোমার ক্যামেরা ট্যামেরা সব তৈরি তো?
-ইয়েস স্যার।
হাতে ধরা অ্যাকশন ক্যামেরাটা চালু করে রাজবাড়ির মূল ফটক পেরিয়ে দরবার হলে প্রবেশ করল তারা। ঐতিহ্যবাহী রাজচিহ্ন, ঝাড়বাতি, দেওয়াল জুড়ে থাকা বড় বড় ছবির দিকে ক্যামেরা তাক করে কোচ-কামতা রাজইতিহাসের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দিচ্ছিল স্বয়ংদ্যুতি। দরবার হলে টাঙানো রাজাদের বংশ তালিকার কাছে এসে সে ইন্দ্রায়ুধকে অনুরোধ করল ক্যামেরার সামনে দাঁড়াতে। ফেডেড ডেনিম ট্রাউজার আর অফ হোয়াইট টি-শার্টে বেশ স্মার্ট দেখাচ্ছে ইন্দ্রায়ুধকে। ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে সপ্রতিভ ভঙ্গিতে নিজের পরিচয় দিয়ে সে রাজবংশের তালিকা ধরে ধরে অল্প কথায় বলে গেল প্রত্যেক রাজা সম্পর্কে। মহারাজ হরেন্দ্র নারায়ণের সাহিত্য কীর্তির কথা উল্লেখ করতে গিয়ে ইন্দ্রায়ুধ বলল, তাঁর রাজত্বকালকে বলা হয় কোচবিহারের সাহিত্য আলোচনার এলিজাবেথীয়ান যুগ। তিনি নিজে সাহিত্য রচনার পাশাপাশি বিভিন্ন পণ্ডিত ব্যক্তিদের নিযুক্ত করে রামায়ণ, মহাভারত, বিষ্ণুপুরাণ প্রভৃতি অনুবাদ করিয়েছিলেন।
বংশ তালিকায় মহারাজ হরেন্দ্র নারায়ণের পরেই ছিলেন তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র শিবেন্দ্র নারায়ণের নাম। শিবেন্দ্র নারায়ণ নির্বিবাদে তাঁর রাজত্ব সম্পূর্ণ করেছিলেন। কিন্তু তাঁর কোনও সন্তান না থাকায় তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র চন্দ্রনারায়ণ রাজা হন। রাজ্যাভিষেকের সময় তিনি নরেন্দ্র নারায়ণ নাম গ্রহণ করেছিলেন। ইন্দ্রায়ুধ বলল, মহারাজ নরেন্দ্র নারায়ণকে ব্রিটিশ গভার্নমেন্ট ‘মহারাজ বাহাদুর’ উপাধি প্রদান করেছিল। তিনি একজন সুশাসক ছিলেন এবং তাঁর রাজত্বকালেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বিখ্যাত জেনকিন্স স্কুল।
অনেকক্ষণ ক্যামেরা ধরে থেকে হাতে ব্যাথা হয়ে গিয়েছিল স্বয়ংদ্যুতির। সে অধৈর্য হয়ে বলল, এবার একটু ব্রেক নিই, কেমন?
দরবার হল থেকে বেরিয়ে তারা করিডোরে পাতা চেয়ারে এসে বসল। ব্যাগ থেকে জলের বোতল বের করে স্বয়ংদ্যুতি গলায় ঢালল কিছুটা, তারপর ইন্দ্রায়ুধের দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি জল খাবে?
ইন্দ্রায়ুধ মাথা নেড়ে পকেট থেকে একটা ডার্ক চকলেট বের করে স্বয়ংদ্যুতির সামনে ধরে বলল, এটা তোমার জন্যে।
স্বয়ংদ্যুতি চকলেটটা নিয়ে লাজুক স্বরে জিজ্ঞেস করল, তুমি কীভাবে জানলে ডার্ক চকলেট আমার ফেভারিট?
একটা ইঙ্গিতপূর্ন হাসি হেসে কাঁধ ঝাঁকাল ইন্দ্রায়ুধ। তার চোখ দুটো ভারী অদ্ভুত লাগে স্বয়ংদ্যুতির। এমন চোখ সে খুব কম দেখেছে। মুখে কিছু না বললেও চোখ দিয়ে অনেক কথা বলে যায় ইন্দ্র। বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায় না ওই চোখের দিকে। স্বয়ংদ্যুতির মনে হয় ওই চোখের অতল গভীরে একদিন সে নিশ্চিত তলিয়ে যাবে। ইন্দ্রায়ুধ একভাবে তাকিয়ে আছে তার দিকে। আচমকা কেমন একটা অস্বস্তি ঘিরে ধরল স্বয়ংদ্যুতিকে। ইন্দ্রায়ুধের দিক থেকে নজর সরিয়ে সে বলল, নরেন্দ্র নারায়ণ ভূপবাহাদুরের সুযোগ্য সন্তানই তো ছিলেন মহারাজা নৃপেন্দ্র নারায়ণ, তাই না?
-ইয়েস ম্যাডাম, নৃপেন্দ্র নারায়ণ ভূপবাহাদুর, দ্য লিজেন্ড হিমসেল্ফ ছিলেন কোচবিহার রাজপরিবারের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শাসক। তৎকালীন ভারত সরকার তাঁকে সম্মানসূচক ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর মেজর পদে নিযুক্ত করেছিলেন। এছাড়াও দেশে বিদেশে বহু সম্মান এবং উপাধি তিনি পেয়েছিলেন। মহারাজ নরেন্দ্র নারায়ণের অকাল মৃত্যুর পর বহু বাধা বিঘ্ন পেরিয়ে যখন নৃপেন্দ্র নারায়ণ সিংহাসনের অধিকার লাভ করেন তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র দশ মাস।
-সে কী!
-হুম। নাবালক রাজার নেতৃত্বাধীন রাজ্যকে সঠিক পথে পরিচালিত করার জন্যে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ কর্নেল হটনকে কমিশনার নিযুক্ত করেছিলেন। বেনারস, পাটনা ইত্যাদি জায়গায় বেশ কিছু নামীদামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ইংরেজদের তত্বাবধানে মহারাজ শিক্ষা লাভ করেছিলেন। তাঁর বিদেশ ভ্রমণের তোড়জোড় শুরু হলে বেঁকে বসেন তাঁর পিতামহী কামেশ্বরী দেবী এবং রাজমাতা। তাঁরা চেয়েছিলেন মহারাজ বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার পরই তাঁর বিলেত যাত্রার ব্যবস্থা হোক। অতঃপর খোঁজ শুরু হল মহারেজের উপযুক্ত পাত্রীর। শিক্ষিত, সংস্কৃতিমনস্ক, আধুনিক রুচিবোধসম্পন্ন একজন নারীকেই মহারাজের অর্ধাঙ্গিনী হিসেবে মানাবে বলে স্হির বিশ্বাস ছিল ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের। অবশেষে অনেক খুঁজে ব্রাহ্ম ধর্মের আচার্য কেশবচন্দ্র সেনের সুযোগ্যা কন্যা সুনীতি দেবীকে বেছে নেন তাঁরা। কেশবচন্দ্র এই বিয়ের প্রস্তাবে প্রথমে অসম্মত হলেও ডেপুটি কমিশনার ডালটন সাহেবের তদ্বিরে তিনি শেষ পর্যন্ত বিয়ে দিতে রাজি হয়েছিলেন। এই ঘটনার ফলে ব্রাহ্ম সমাজে তুমুল আলোড়ন পড়ে গিয়েছিল।
-এই ঘটনার কথা আমি জানি। সুনীতি দেবী মহারানি হিসেবে কোচবিহারে আসার পর অনেক প্রাচীন কু-প্রথার বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলেছিলেন। নারী শিক্ষার বিষয়ে তাঁর প্রচুর কন্ট্রিবিউশন ছিল। আমার মা তো সুনীতি অ্যাকাডেমিতেই পড়াশোনা করেছে। বাংলার পাশাপাশি ইংরেজি ভাষাতেও তিনি লেখালিখি করতেন শুনেছি। আমাদের ডিপার্টমেন্টের লাইব্রেরিতে সুনীতি দেবীর লেখা ‘অ্যান অটো বায়োগ্রাফি অফ ইন্ডিয়ান প্রিন্সেস’, ‘দ্য লাইফ অফ প্রিন্সেস যশোধরা’ বই দুটো দেখেছি, যদিও এখনও পড়া হয়নি।
স্বয়ংদ্যুতির কথায় উৎসাহ পেয়ে ইন্দ্রায়ুধ বলল, মহারানি সুনীতি দেবীর প্রভাবে নৃপেন্দ্র নারায়ণ ভূপবাহাদুর প্রজাদের হিতে অনেক নতুন আইন প্রণয়ন করেছিলেন। সাধারণের শিক্ষার জন্য একাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তৈরি করেছিলেন। শুধু স্কুল-কলেজ নয় মহারাজ নৃপেন্দ্র নারায়ণের রাজত্বকালে কোচবিহারে রেলপথ বিস্তার হয়েছিল। নতুন রাজপ্রাসাদ নির্মাণ, মদনমোহন মন্দির স্থাপন, দিঘিখনন, পথঘাট, চিকিৎসালয় নির্মাণ, অফিস-কাছারির কাজকর্মেরও প্রচুর উন্নতি হয়েছিল সেই সময়। শিকার এবং খেলাধুলার প্রতিও মহারাজের অসীম আগ্রহ ছিল। পরপর দু’বার রাজস্ব বন্দোবস্তের মাধ্যমে তিনি রাজ্যের আয় বৃদ্ধি করতেও সক্ষম হয়েছিলেন।
-মহারাজ নৃপেন্দ্র নারায়ণের তো বিলেতে থাকাকালীন মৃত্যু হয়েছিল বলে শুনেছি।
-হ্যাঁ, বেক্সহিলে। সেখানে মহারাজ রাজরাজেন্দ্রনারায়ণ পিতার স্মরণে একটা সুন্দর স্মৃতি ফলকের ফোয়ারা তৈরি করেছিলেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় মাত্র দু’বছর রাজ্য শাসন করেই রাজরাজেন্দ্র নারায়ণের জীবনাবসান হয়। এরপর রাজা হন তাঁর ভাই জিতেন্দ্রনারায়ণ। তিনিও তাঁর বাবার মতো একজন প্রজাহিতৈষী শাসক ছিলেন। বরোদার রাজকন্যা ইন্দিরাদেবীর সঙ্গে রাজসিংহাসনে বসার আগেই তিনি ইংল্যান্ডে পরিণয় সুত্রে আবদ্ধ হয়েছিলেন। আধুনিক ইউরোপীয় শিক্ষার আলকপ্রাপ্ত মহারাজ বেশকিছু স্কুল, লাইব্রেরি তৈরি করেছিলেন। কোচবিহারে প্রথম হাসপাতাল নির্মাণের কৃতিত্বও তাঁরই। মহারাজ জিতেন্দ্রনারায়ণের কাকা প্রিন্স ভিক্টর নিত্যেন্দ্র নারায়ণের উদ্যোগে এই সময় তৈরি হয়েছিল ‘কোচবিহার সাহিত্যসভা’। প্রাচীন মুদ্রা, লিপি, পুথি সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও প্রকাশের পাশাপাশি কোচবিহারের ইতিহাস রচনাতেও উদ্যোগী হয়েছিল এই সাহিত্য সভা। ভিক্টর নিত্যেন্দ্র নারায়ণের স্ত্রী নিরুপমা দেবীর সম্পাদনায় এই সাহিত্য সভা থেকে একটা পত্রিকাও প্রকাশিত হয়েছিল।
-তার মানে, মূলত রাজপরিবারের উৎসাহেই কোচবিহারের সাহিত্য, সংস্কৃতির এতটা উন্নতি সম্ভব হয়েছিল?
-একদম।
আড়মোড়া ভেঙে স্বয়ংদ্যুতি বলল, চলো বাকি কাজটুকু শেষ করে ফেলি চটপট, নাহলে দেরি হয়ে যাবে।
-হুম এবার ওঠা যাক। সাড়ে তিনটের সময় অনলাইনে জঙ্গল সাফারির গাড়ি বুক করে রেখেছি। এদিকের পর্ব মিটলেই রওনা দিতে হবে।
ইন্দ্রায়ুধ রাজাদের পরিচয় পর্ব শেষ করলে তারা দ্রুত সিঁড়ি ভেঙে রাজবাড়ির দোতলায় উঠে পড়ল। রাজপরিবারের ব্যবহৃত বিভিন্ন জিনিস দেখার পাশাপাশি তাদের নজর পড়ল ভারত সরকারের সঙ্গে কোচবিহারের শেষ মহারাজ জগদ্দীপেন্দ্র নারায়ণ ভূপবাহাদুরের হওয়া চুক্তিপত্রের ওপর। মহারাজ জিতেন্দ্রনারায়ণের মৃত্যু হলে তাঁর জ্যেষ্ঠ সন্তান জগদ্দীপেন্দ্র নারায়ণের রাজ্যাভিষেক হয়েছিল। সেই রাজ্যাভিষেকের ছবি রাজবাড়ির দেওয়ালে এখনও জ্বলজ্বল করছে। ভারত স্বাধীন হওয়ার পর মহারাজ স্থির করেন, তিনি ডোমিনিয়ন অফ ইন্ডিয়ার সঙ্গে যোগ দেবেন এবং সেই মর্মে স্বাক্ষরিত হয় চুক্তি। স্বাধীন রাজ্য হিসেবে কোচবিহারের অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়ে সে আত্মপ্রকাশ করে পশ্চিমবঙ্গের একটি জেলা হিসেবে।
ভিউয়ারদের রাজ পরিবারের কাহিনি বর্ণনা করার সময় পুরো প্রাসাদটা ঘুরিয়ে দেখাচ্ছিল স্বয়ংদ্যুতি। ঘুরতে ঘুরতে সে এসে দাঁড়াল রাজকুমারী গায়ত্রী দেবীর ছবির সামনে। দর্শকদের শোনাল কোচবিহারের রাজকুমারী থেকে তাঁর জয়পুরের মহারানি হয়ে ওঠার স্বপ্নিল যাত্রাপথের গল্প। রাজবাড়ির অন্দরে বিচরণ করতে করতে কখন যেন একটা মায়াবি দুনিয়ায় পৌঁছে গিয়েছিল স্বয়ংদ্যুতি। আশপাশের জগত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে সে পাড়ি জমিয়েছিল অনেক অনেক দিন আগের পৃথিবীতে। মনের চোখে দেখছিল রাজারানিদের ঐশ্বর্যের জমক, তাঁদের চলন বলন, আচারব্যবহার। মন্ত্রমুগ্ধের মতো চেয়ে ছিল দেওয়ালে ঝোলানো ছবিগুলোর দিকে। তার এই ভাবান্তর ইন্দ্রায়ুধের নজর এড়ায়নি। ভিডিও শ্যুট শেষ হওয়ার পর ধীর পায়ে স্বয়ংদ্যুতির সামনে এসে সে বলল, ইওর হাইনেস, যদি অনুমতি করেন তবে এবার আমরা রাজারানিদের বিদায় জানিয়ে জঙ্গলের দিকে পা বাড়াই?
স্বয়ংদ্যুতি অপ্রস্তুত হয়ে বলল, ও হ্যাঁ হ্যাঁ চলো।
ফেরার সময় একটা অবর্ণনীয় কষ্ট দলা পাকিয়ে উঠছিল স্বয়ংদ্যুতির গলার কাছটাতে। প্রাসাদ ছেড়ে বেরিয়ে আসার পরও সে বারবার ফিরে চাইছিল কয়েকশো বছরের ইতিহাস বুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা লাল রঙের বিরাট বাড়িটার দিকে। আপনজনদের ছেড়ে দূরে চলে যাওয়ার সময় যেমন অনুভূতি হয়, ঠিক তেমনই একটা অনুভব আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরছে স্বয়ংদ্যুতিকে। ইন্দ্রায়ুধের সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে বার পিছিয়ে পড়ছে সে। স্বয়ংদ্যুতির আচরণের এই আকস্মিক পরিবর্তন লক্ষ্য করে ইন্দ্রায়ুধ তার হাতটা আলতো করে ধরে বলল, আমি জানি এই প্রাসাদ, এই শহর ছেড়ে চলে যেতে হবে ভেবে তোমার মনখারাপ হচ্ছে। কিন্তু এটাই তো জীবনের ধর্ম টুপুর। ইউ ক্যান নট ডিনাই দিজ্। জীবন, জীবিকার টানে অনেকেই পরবাসী হয়। যেমন রাধাকান্ত জেঠু হয়েছিলেন। তোমার মেজমামা হয়েছিলেন। হয়তো একদিন আমিও হব। কিন্তু নিজের মাতৃভূমির প্রতি ভালবাসা রয়ে যাবে আজীবন। যত উত্থান, পতনই আসুক এই ভূমির টান অস্বীকার করার ক্ষমতা আমাদের কারও নেই। কোনও না কোনও অজুহাতে আমরা ঠিক ফিরে আসব এই শহরে, এই প্রাসাদের প্রাঙ্গণে।
ইন্দ্রায়ুধের হাত ধরে বিহ্বলভাবে হেঁটে চলল স্বয়ংদ্যুতি আর তাদের এই প্রস্হানের সাক্ষী হয়ে থাকল বহুপ্রাচীন অথচ চিরনবীন সুদৃশ্য এক অট্টালিকা।
তথ্যসূত্রঃ
১) সাহিত্যের ইতিহাসে কোচ-রাজদরবারঃ রণজিৎ দেব
২) কোচবিহারের ইতিহাসঃ ভগবতীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়
৩) কোচবিহারের সম্পূর্ণ ইতিহাস ( পৌরাণিক যুগ থেকে আধুনিক কাল) – মহেন্দ্র দেবনাথ
৪) ব্রিটিশ সরকারের ঐতিহাসিক ঘটকালিঃ নিখিল সুর (রবিবাসরীয় আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৯/৬/২০২২)
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴