স্মৃতি দিয়ে ঘেরা/সপ্তদশ পর্ব
রণজিৎ কুমার মিত্র
^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^
'আকাশ জুড়ে শুনিনু ঐ বাজে'.......
চারদিকে
তার আগমনের বার্তা এসে যেত, ক্যাম্পাসেও তা পৌঁছে যেত। উত্তরের নীলিমার
নীল যত গাঢ় হয়, কাঞ্চনজঙ্ঘার তুষার মুকুট তত দৃশ্যমান হতে থাকে। জলপাইগুড়ি
থেকে ইউনিভার্সিটির দিকে যেতে যেতে মনে হত ক্রমশ এগিয়ে যাচ্ছি ঐ দিকে।
মহানন্দার ব্রীজে উঠতেই মনে হত, এত কাছে "ঐ ভুবন মনমোহিনী!" ক্যাম্পাসেও
যেন সবার মনে বাজত সেই নিকট দূরের শৈশব থেকে শোনা, মেঘের কোলে রোদের হাসির
ছুটির গান। লাইব্রেরির পেছনে ফাঁকা মাঠের জায়গাটা ভরে যেত কাশফুলে।
ল্যাডলিদার কাছে একটা রেকর্ড
বুক ছিল, কোন বছরে কবে
থেকে কাশফুল ফুটেছে। শরতে ক্যাম্পাসের একটা নিজস্ব সৌন্দর্য ছিল। ক্রমশ
ডালপালা বিস্তার করে উত্তরবঙ্গে একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একাধিক
বিশ্ববিদ্যালয় হয়েছে, কিন্তু সেই প্রথম আলো! আজও তার জন্য মন কেমন করে!
স্মৃতির খেয়া ভেসে চলে। শুধু মনে হয়
"দেখি নাই কভু দেখি নাই, এমন তরণী বাওয়া। "
পূজার ছুটির জন্য সকলের ছিল অধীর আগ্রহ। অধ্যাপক পুলিন দাসের 'স্মৃতি জাগানিয়া'তে ধরা আছে এই আকুলতার কথা -
"মহালয়ার
আগের দিন বন্ধ হত বিশ্ববিদ্যালয়। পরের দিন, মহালয়ার দিন থেকেই শুরু হত
পুজোর ছুটি। খুলবে ভাইফোঁটার পর দিন। ছুটিতে দল বেঁধে যাওয়া কলকাতায়। সে এক
মজাদার ব্যপার। ট্রেন ছাড়ত রাত দশটা নাগাদ। অতি ব্যস্ত কোনো কোনো বন্ধু
বাক্স প্যাটরা গুছিয়ে রেখে দিয়ে যেতেন ক্লাশে। ক্লাশ শেষ হতেই দৌড়াতে
দৌড়াতে ফিরে এসে মালপত্র
কাঁধে তুলে দৌড় স্টেশন
অভিমুখে। সদা আশঙ্কা তাকে ফেলে রেখে ট্রেন বুঝিবা কলকাতার দিকে ছুটতে শুরু
করে। ভোর রাতে বীরেন ভদ্রর মহালয়া না শুনতে পারলে পুজোটাই মাটি। ট্রেন
চলাকালীন যাতে মহালয়া শোনা যায়, সেই জন্য জামা পরানো 'বুশ' রেডিওটা পাশে
নিয়ে জানালার
ধারে জায়গা করে নেন বন্ধুবর। বন্ধুর কল্যাণে আমাদেরও শোনা হয়ে যায় মহালয়ার চন্ডীপাঠ।
ছুটি ভোগ করে আবার শেয়ালদা স্টেশন থেকে একসাথে হৈ হৈ করে ফেরা। আবার প্রতিদিনের কাজে জড়িয়ে পড়া। "
এই
পুজোর বন্ধর আমেজ লাইব্রেরীতে ও শুরু হয়ে যেত। যাদের কলকাতায় বা
অন্যত্র দূরে বাড়ি তারা ট্রেনের বা দূরপাল্লার বাসের টিকিটের রিজারভেশনের
জন্য ছটফট করতেন। একটি দিনও নষ্ট না করে ঐ মহালয়ার আগের দিনই বাড়ির দিকে
রওয়ানা হতে চান। আমরা যারা জলপাইগুড়ির বা শিলিগুড়ির তারা অনেক নির্ভার
থাকতাম। আমাদের তো আর দার্জিলিং মেইল ধরতে হবে না। আমরা সেদিন ওদের কলকাতা
যাত্রাকে সহজ করতে একমাসেরর জন্য অফিস, লাইব্রেরি বন্ধ রাখবার জন্য
প্রয়োজনীয় কাজগুলো করে ফেলতাম। লাইব্রেরীতে অনেক কাজ থাকত। পোকামাকড়-এর
হাত থেকে বাঁচাতে বইতে কীটনাশক স্প্রে দেবার জন্য তদারকি করা, মেঝেতে যেন
কোন বই , পত্র পত্রিকা, কাগজ, কোন কিছুই
পড়ে না
থাকে, ইঁদুর যাতে কোনোভাবেই আক্রমণ না করে, একমাসের জন্য ছাত্র-অধ্যাপকদের
প্রচুর বই ইসু করতে হত, জানালা দরজা বন্ধ করা। ঐ পূজার ছুটির আগের
লাইব্রেরির খুব ব্যস্ততা থাকত। পুজোর কটা দিন বাদ দিয়ে, আভ্যন্তরীণ কিছু
কাজের জন্য লাইব্রেরি খোলা রাখতে হত অল্প কিছু সংখ্যক কর্মীদের নিয়ে। সে
সময় প্রচুর পত্রিকা, চিঠি, বুকপোস্ট ডাকে আসত। বস্তা বোঝাইকরে সেইসব নিয়ে
আসতে হত ক্যাম্পাসের ডাকঘর থেকে। প্রতিদিন সেগুলো রেজিস্টারে নথিভুক্ত করে,
পাঠক পরিষেবা দেবার প্রয়োজনীয় কাজগুলো করে রাখতে হত। এই পুজোর ছুটি পরে
অনেক কমে গেছে, সরকারী নিয়ম মতো। লাইব্রেরির কাজকর্ম অনেক বদলে গেছে,
কম্পিউটার ও নব্য তথ্যপ্রযুক্তির আগমনে।
গ্রন্থাগারিক
চিত্রভানু সেন ছিলেন একজন সুদক্ষ, গ্রন্থাগার বৃত্তি কুশলী ও সংস্কৃত ভাষা
ও সাহিত্যরসুপন্ডিত। ভারতীয় দর্শন, Indology, Comparative Religion
ইত্যাদি বহু বিষয়ে ছিল অগাধ পাণ্ডিত্য। ওনার স্ত্রী রেনুকা সেন ছিলেন
শিলিগুড়ি কলেজের
সংস্কৃতর অধ্যাপিকা। আমাদের আনন্দ
চন্দ্র কলেজের অধ্যাপক পরেশ চক্রবর্তীর কাছে চিত্রভানুবাবুদের অনেক গল্প
শুনেছি, ওরা তিনজনই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে সহপাঠী ছিলেন।
চিত্রভানু
সেনের নেতৃত্বেই গড়ে উঠেছিল গ্রন্থভবন। এখনো ওর হাতে লেখা Sanskrit
catalogueগুলো রয়েছে। বাংলা, ইংরেজি, সংস্কৃত, হিন্দি, নেপালি ভাষায়
catalogue হত। সে সময়, প্রথমে হাতে লিখে, টাইপ করে, টেনসিল কেটে,
ডুপলিকেটিঙ মেশিনে কালি মাখিয়ে, কাগজ কেটে Cardএ আঠা লাগিয়ে বসানো হত।
কম্পিউটার
আসাতে ঝামেলা কমে গেছে। লাইব্রেরি র
প্রতিদিনের অবশ্য করণীয় কাজগুলোতে এখন কম্পিউটারের সহায়তা নেওয়া হচ্ছে। এখন
মেশিন ক্যাটালগের যুগ। কম্পিউটার নলেজ সোসাইটি। তবে গ্রন্থাগার পরিষেবায়
'হিউম্যান টাচ'কমে যাচ্ছে। পাঠকরাও দুই শিবিরে বিভক্ত, গ্রন্থাগার
ব্যবহারে কম্পিউটার জানা ও না জানা, দুই শ্রেণির।
চিত্রভানু
বাবুদের মতো ধ্রুপদী গ্রন্থাগারিকরা প্রায় অবজ্ঞাত বলা যায়। ওনাদের মতো
গ্রন্থাগারিকদের সাজানো বাগান ক্রমশ শুকিয়ে যাচ্ছে।
পূজার
ছুটি র কথায় আবার আসি। এই ছুটির আগে ক্যাম্পাসের মহিলারা, বিশেষ করে
শিক্ষাকর্মী, অধ্যাপিকারা 'শারদমেলা' আয়োজন করতেন প্রতি বছর, নিজেদের তৈরি
রকমারি খাবারের পসরা সাজিয়ে আনন্দমেলা হত। আমাদের লাইব্রেরির তনয়া গুপ্ত
ছিলেন এই মেলার অন্যতম উদ্যোক্তা, কনট্রোলার বিভাগের আরতি কাঞ্জিলাল দিদি,
মিলনদি, ফিজিক্সএর অধ্যাপিকা শুক্লা পাল, ফিলোসফির ভাস্বতী চক্রবর্তী
অনেককেই
দেখতাম, ক্যাম্পাসের ছাত্র-ছাত্রী, কর্মী, আধিকারিক, অধ্যাপক সকলকেই এই
আনন্দ মেলায় সামিল হতে দেখেছি। এখনো পুজোর ছুটি আছে,
কিন্তু
সেই সব আনন্দমেলা কোথায় যে হারিয়ে গেল? আনন্দ অনুভব আর আনন্দ উপভোগ, এই
দুয়ের মধ্যে পার্থক্য ঘটে গেছে, সবাই কি আমরা এখন শুধুই উপভোক্তা?
বিশ্ববিদ্যালয়ের
আদি পর্বে ক্যাম্পাসে দুর্গা পুজো হত না। পরে চালু হয়। পুজোর মণ্ডপ হত
সিকিউরিটি অফিসের সামনে। প্রতি বছর উদ্যোক্তারা চাঁদা নিতে আসতেন।
ভাইফোঁটার পর দিন অফিস খুললে ইউনিয়নের নেতাদের সাথে, পুজো কমিটির লোকজনও
আসতেন, বাতাসা, কদমা, নকুলদানা নিয়ে, বিজয়ার কোলাকুলি, নমস্কার, প্রতি
নমস্কার চলত।জানি না এখন এসব আছে কিনা। ঐতিহ্য-পরম্পরা এখন বোধহয়
শুধুই শব্দ মাত্র, অভিধানেই শুধু থাকে।
ক্যাম্পাসএর
দুর্গা পূজা সরকারি জমিতে, সরকারী বিদ্যুৎ, গাড়ি ব্যবহার করা হত বলে একবার
ইউনিভার্সিটির কয়েকজন প্রভাবশালী বামপন্থী, সেকুলারবাদী আবাসিক অধ্যাপকেরা
নালিশ করলেন উপাচার্য র কাছে সেকুলার ইউনিভার্সিটিতে, সরকারি জিনিস পত্র
ব্যবহার করে দুর্গা পূজা করা তথা ধর্মীয় অনুষ্ঠান করা অসমীচীন।
সেকুলারবাদীদের পক্ষ থেকে প্রতিবাদ প্রতিরোধের ঝড় উঠল। পুজোকমিটির
উদ্যোক্তারা রেগে বললেন, সেকুলারবাদীদের পুজো কমিটির সামনে এনে উপযুক্ত
শিক্ষা দিতে হবে। অবশেষে দেখা গেল, সেকুলার-রিলিজিয়াস
নির্বিশেষে
সকলেই পুজোর আনন্দে মেতেছেন। সেই সময় উপাচার্য ছিলেন অধ্যাপক কৃষ্ণনাথ
চট্টোপাধ্যায়। যদিও তিনি জানিয়েছিলেন - "সেকুলার ইজমের বিশুদ্ধ ভক্ত
তিনি", তবে পুজো করা নিয়ে তিনি কোন উচ্চবাচ্য করেননি।
ক্যাম্পাসে পুজোর ছুটি নিয়ে সবচেয়ে বেশি
মাতামাতি
ছিল ছাত্র-ছাত্রীদের। হয়তো এখনও হয়, আমাদের নিজেদের সময়টা খুব মনে পড়ে।
সে সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের ষাট শতাংশ ছাত্র ছাত্রীই হোস্টেলে থাকতেন।
জলপাইগুড়ির আর শিলিগুড়ির নন ল্যাবরেটরি বেস ছাত্র ছাত্রীদের অধিকাংশই
ছিলেন নিত্যযাত্রী। দু জায়গা থেকেই
বাস ঢুকত
ক্যাম্পাসে। ছুটির ঐ আগের দিনটিতে যে যার নিজের জায়গায়, নিজের বাড়িতে যাবে।
যাবার সময় ওরা মানে হোস্টেলের বন্ধুরা হৈ হৈ করে উঠত এই দুটি বাসে,
শিলিগুড়ি অব্দি গিয়ে বাসে ট্রেনে যে যার গন্তব্য স্থানে। বাসের মধ্যেই
পেতাম ছুটির নিমন্ত্রণ। কারো কারো সেই একমাসের ছুটিতেই কাহিল অবস্থা, যেন
পদাবলীর নায়ক নায়িকা, "দুহু ক্রোরে দুহু কাঁদে বিচ্ছেদ ভাবিয়া।" ছুটির
বাঁশিতে, শারদ আলোর রেণুতে মাখামাখি হয়ে সবার মুখে আনন্দ যেন ঝলমল করে
উঠতো।
______
বি দ্রঃ
উত্তর
বঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের Hostel-এর ছবিগুলো ফজলুর রহমান,
প্রাক্তনী, ইতিহাস বিভাগ, মিউজিয়াম,-এর সৌজন্যে প্রাপ্ত।