শালসিঁড়ি-১৭/বিমল দেবনাথ
শালসিঁড়ি-১৭
বিমল দেবনাথ
--------------------
মাধুরী বার বার বলা সত্বেও অপূর্ব নামল না গাড়ী থেকে। “তোমরা বস, আমি আসছি- একটু বাদে” অপূর্ব চলে গেল গাড়ি নিয়ে নিজের কোম্পানির অফিসে মিটিং করতে। মাধুরী ময়ূখ বিকাশের বাড়ির দরজা খুলে উঠোন পেরিয়ে কলিং বেল টেপে। মিঠুদি দরজা খোলে -
- এসো মাধুরীদি, এসো।
অপরূপা ওপরে দরজা খুলে দাঁড়িয়ে আছে। মাধুরী ওপরে আসতেই মনে হল অগুনতি পাখি নীড়ে ফিরল। দুই নারী যেন হাজার পাখি। কত লক্ষ মুহূর্ত পরে মুখোমুখি পিঁপড়ের মতো। সন্ধ্যায় প্রিয় গাছে ফিরে এসে পাখিরা কী কথা বলে কে বুঝতে পারে! মাধুরী দেখতে পায় কলেজের মাঠে কৃষ্ণচূড়া গাছে সোনা-বৌ পাখি। এমনিতে সব সময় বেনে-বৌ আসত, ডাকত। সেদিন কী হয়েছিল কে জানে। বেনে-বৌ এল না; সোনা-বৌ এসে হাজির। কী সুন্দর ডাকছিল- কু ক্কু কুউ… সেই ডাক এখন কানে বাজছে…অপরূপা ভাবে মাধুরী যেন একটুকরো বন; শুষে নেয় সব কালো; জ্বেলে দেয় কত কী আলো…
- এসো এসো ভিতরে এসো।
- আন্টি, অংশু কোথায়।
- এক্ষুনি এসে যাবে। বাবার সাথে বাজারে গেছে।
- অপূর্ব এল না?
- আর বলো না। তোমাদের বাড়ির সামনে নামিয়ে দিয়ে চলে গেল মিটিং করতে; কোম্পানির অফিসে। পরে আসবে বলল।
- সে ঠিক আছে। আজ তো আর যাবার তাড়া নেই।
- তাহলে কী। একটা ফরমালিটি তো থাকে।
- কত দিন পর দ্যাখা হলো - বল।
- আরও আগে আসা যেত; কিন্তু কোভিড উনিশের কড়াকড়িতে এক বছর তো এমনই গেল।
- সেই তোমার বিয়ের বছর পাঁচেক পর বক্সা-বন; তারপর আজ কোভিড উনিশ কালে আমরা একসাথে …
- ঠিক বললে। সময়গুলো কেমন ভাবে চলে গেল চিরহরিৎ আম গাছের পাতার মতো। আমরা সবাই বেঁচে আছি কিন্তু দাগ ফেলে গেছে কত…
একদিন ক্লাসের গ্যাপে, নির্জন দুপুরে মাধুরী অপরূপা বসে ছিল কলেজের পিছনের মাঠে বট গাছের নীচে। বিকাশ এসে পরিচয় করায় অপূর্বর সাথে। অপূর্ব কলেজে এসেছে প্রথম বর্ষে। ‘অপূর্ব; আমার ক্লাস-মেট কাম রুম মেট। ও মাধুরী; আমার পুরনো বন্ধু। বোটানি অনার্স।‘ হঠাৎ একটা দমকা হাওয়া বট গাছের ঝরা পাতা উড়িয়ে নিয়ে যায়। সাথে উড়ে ওঠে মাধুরীর আঁচল-চুল। অপরূপার ওড়না কোমরে বাঁধা। ফাগুনে আগুন কখন লাগে বোঝা যায়না বট গাছের পাতা ঝরার মত। কিন্তু পাতা ঝরে হাওয়া বয়। মৃদুমন্দ হাওয়া বোঝা যায় অমলতাস গুলমোহরের লাল হলুদ পাপড়িতে। বট গাছ পবিত্র গাছ কত কী সয়, কত কী বয়। মাধুরী উড়ে যাওয়া আঁচল গোছায়, চুলে খোপা বাঁধে। বিকাশ বলে- অপূর্ব চল; হোস্টেল যাই। অপূর্ব দ্যাখে- কত পাখি বটের লাল ফল খায়। কত পাতা ঝরে যায় বটের; তবু সব সময় সবুজ থাকে; চাপ জারুল পলাশের মতো নেড়া হয় না কখনো। অপূর্বর চোখ বটের ফলের মতো লাল- চিক চিক করে; লোভ হয় কত কী।
- মাধুরী কিছু বুঝতে পারছিস।
- কী।
- অধীশ্বর।
- মানে?
- ঐ যে অপূর্ব। আমার মনে হয় ও সব কিছু পেতে চায়।
মাধুরী ভাবে- সবাই কী সব চাইতে পারে। মাধূরী অপূর্বকে দেখে। বট গাছ থেকে কোকিল ডাকে। মনে করিয়ে দেয় এখন বসন্ত। কোকিলটা যে বট গাছের কোথায় ছিল দেখা গেলনা কিছুতেই। সব কিছু কী দ্যাখা যায় - ধরা না দিলে। ধরা দিলে কী বোঝা যায় সব মাটির মত। মাটি চিনতে গাছ লাগে; গাছ চিনতে ফুল লাগে ফল লাগে- মানুষ চেনা যায় কী ভাবে। মাধুরীর ভাবনা জড়িয়ে যায় পানিলহরার লতার মতো।
- আমি মাধুরী
- জানি; বিকাশের কাছে জেনেছি কত কথা।
- আমি?
- তুমি অপরূপা। বিকাশের সৌখিন ফুলদানির সুন্দরী ফুল গাছ।
- আর আমি?
- তুমি এক টুকরো বন। সেই বোটানি এক্সকারশনের বন।
বিকাশ অপরূপা সবাই হেসে উঠে। বিকাশ বলে-
- তুই কী যাবি। আমি চললাম।
- আমার ক্লাস আছে মাধুরী, আমি উঠলাম।
- আমারও ক্লাস আছে, চল।
- বিকাশ, প্রথম আলাপটা ভেস্তে দিলি তো।
- কেন, আমি যাচ্ছি তোরা আড্ডা মার, কে মানা করল।
- কেউ মানা করেনি। তবে অপরূপা তোর জন্য ক্লাস বাঙ্ক করে; আমার জন্য তো কেউ ক্লাস বাঙ্ক করবে না।
মাধুরীর মনে হল কেউ এই প্রথম ওর দিকে ইশারা করল। পাখি দেখার অছিলায় গাছ দেখে। মাধুরীর অস্বস্তির মধ্যেও কিছুটা স্বস্তি লাগছিল গোলাপ ফুলের মতো। মাধুরীর মা’কে মনে পড়ে। মানুষের মনে হয় এমনই হয়। সুখে দুঃখে ভাঙ্গনে গড়নে মায়ের কথা মনে পড়ে। মা বলতেন- সংসারে নারী গাছের মত। মাটি জল ধরে রাখে। ফুল দেয় ফল দেয় ছায়া দেয় মায়া দেয়। বায়বীয় সংসার নারীর বাতাসে বাস্তব হয়ে ওঠে- বনের মত। পুরুষটি মাটি। ধরে রাখ সব। মাধুরীর মনে পড়ে ওদের বাড়ির উঠোন – কত সহজ সরল ছিল। মায়ের আদর ছিল আদেশ ছিল না। আশ্রয় ছিল প্রশ্রয় ছিল না। বাবার শাসন ছিল শোষণ ছিল না মনের ও মানের। বাড়ির বাসিন্দা পাখির মত। উড়ত আকাশে বাতাসে; প্রতি দিন ফিরে এসে আবার বসত এই গাছে। মাধুরী ভাবে পাখি দ্যাখা গাছ দ্যাখা এক মোহ; গাছের মধ্যে জল দ্যাখা মাটি দ্যাখা এক উপলব্ধি। উপলব্ধি কী দ্যাখা যায়! বুঝতে হয় অভিজ্ঞতায়; গাছের বড় হয়ে ওঠার মত।মাধুরীর মনে পড়ে ওর মা মারা যাবার পর ওর বাবা মরুভূমি হয়ে যায়। গাছপালা না থাকলে মাটি তো মরুভূমি। বাবা ওকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ছিল উদভ্রান্তের মত। মাধুরী মনের ভিতর খুঁজে পায় এক ঠান্ডা নদী। ভয় হয় শিকড়হীন মাটির জন্য। থার্ড ইয়ারের সব পরীক্ষা শেষ হয়েছিল- সেটা বড় ভাগ্য মাধুরীর। না হলে অনার্স গ্র্যাজুয়েট আর হতে পারত না। বিশ্ববিদ্যালয় যাওয়া হয়নি বলে ব্যথা ছিল মনে। বিকাশ অপরূপার জন্য গর্ব করত। বাবাকে চোখে চোখে রাখার দায়িত্ব কী কম। শুকিয়ে যাওয়া গাছে ফুল ফোটানোর পণ করেছিল মাধুরী। বিকাশের এই নিয়ে গর্ব ছিল প্রচুর। কত আদর যত্ন করার পর বাবা আবার স্বাভাবিক হচ্ছেন ক্রমশ। একদিন মাধুরীকে বলেন-
- মা, আমার একতারার তার ছিঁড়ে গেছে। বিকাশকে একবার ডাক। কথা বলব।
- ঠিক আছে বাবা। তোমার কি কোন অসুবিধা হচ্ছে!
- না সেরকম কিছু নয়। কত দিন কথাবার্তা হয় না।
- ঠিক আছে। আসতে বলব একদিন।
মথুরেশ নাথ অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক। চিকনমাটি গ্রামে সবাই চেনে। এলাকায় শিক্ষা প্রসারে তাঁর অবদান সর্ব স্বীকৃত। নিজে স্কুল খুলে প্রথম চিকনমাটিতে শিক্ষার আলো জ্বালেন। সেই স্কুলে বিকাশ ও মাধুরীকেও পড়তে হয়েছে। এক কক্ষ এক শিক্ষক অনেক শ্রেণী। মাঝে মধ্যে বেড়াহীন কক্ষে ঢুকে পড়ত গ্রামের ছাগল।
- বল কী!!! তোমরা ছাগলের সাথে… অপূর্ব অপরূপা হো হো করে হেসে ওঠে…বিকাশ গম্ভীর হয়ে ওঠে-
- বিষয়টা হাসির নয় অপরূপা; আদর্শের।
- মথুরেশ স্যার বলতেন - নিজের মেয়ে গ্রামের স্কুলে না পড়লে অন্যরা পড়বে কেন! তাই ব্লক সদর থেকে মাধুরীকে এনে ক্লাস ফাইভে ভর্তি করিয়ে দিলেন।
- আর তোর?
- আমারও তাই হলো। মাস্টারদা যা করবে বাবাও তাই করবেন। আসলে কী জানিস; নীতি আদর্শ তিস্তা তোর্সা নদীর মত। গোপনে চলেনা। সদর্পে বয়ে চলে প্রতিনিয়ত। বর্ষাকালে তো কথা নেই। দুই কুল ছাপিয়ে যায়। তখন চিকন মাটিতে যেন চলছে শিক্ষা প্রসারের বর্ষা। আমি, মাধুরী ওনাদের সাথে সাথে গ্রামে গ্রামে ঘুরেছি কত। আমাদের দেখিয়ে তাঁরা বলতেন- দেখ,এরাও ভর্তি হয়েছে চিকনমাটির স্কুলে। তোমাদের ছেলেমেয়েকেও ভর্তি করাও। কিছু মানুষ আবেদনে সাড়া দিয়েছিল কিছু মানুষ সাড়া দেয়নি। সেই স্কুল এখন সরকারী অনুদান প্রাপ্ত উচ্চ মাধ্যমিক স্কুল।
হাঁটা পথ শেষ করে পুকুর পাড়ে উঠে আসে তিন জন। পুকুরের নীল-কালো জল যেন মাধু্রীর-কথা। বাড়ির উঠানে পা দিতে বিকাশের পা ভারী হয়ে ওঠে। কী জানি কেন ডেকেছে মাধুরী। অপরূপা ডাকে…
- মাধুরী মাধুরী
সদর দরজায় গন্ধহীন সাদা কুন্দ ফুল ঝরে পরে উঠনের পায়ে। বিকাশ দেখে বাঁশের বেড়ায় বেড়ে ওঠা কুন্দফুলের লতা। মাধুরী বলে
- আয়, ভিতরে আয়।
- ও কে ? - মথুরেশ স্যার জিজ্ঞেস করেন।
- অপরূপা। বিকাশের বান্ধবী।
- আচ্ছা। আর ও ?
- অপূর্ব; বিকাশের বন্ধু। বিশ্ববিদ্যালয়ে একসঙ্গে পড়ে।
উঠানে আম গাছের ছায়ায় ডালিম কামরাঙা গাছের পাতার ফাঁকে দিয়ে দিনের শেষ আলোরেখা পড়ে। আতাগাছের ভিমরুল বাসায় কিছু ভীমরুল আর ভিতরে ঢোকে না। মথুরেশ স্যার বুঝতে পারেন এই বাসায় রাণী নেই। যে কয়টা ভীমরুল আছে তারাও হারিয়ে যাবে দিনে দিনে। মাধুরী জল দেয়। মথুরেশ স্যার বলেন-
- বিকাশ, আমার তার ছিঁড়ে গেছে। মাধুরীর জন্য চিন্তা হয়।
অপূর্ব কথা টেনে নিয়ে বলে - আমরা আছি স্যার। আপনি কেন চিন্তা করছেন।
- তুমি মাধুরীকে বিয়ে করবে?
মাধুরী দ্যাখে- গোধূলির আলো পুকুরের ঘাট ধরে উঠে আসে কুন্দ লতায়। শকুন্তলার পতি গৃহে যাবার মতো না হলেও সব মেয়েদের মতো মাধুরীর কেন যেন কুন্দলতা ডালিম কামরাঙা আতা গাছের জন্য মন কেঁদে ওঠে। সেই কান্না বন্ধের ব্যবস্থা বাবা করলেও এখন উপশম করতে পারেনি অপূর্ব… মথুরেশ স্যার মারা যাবার পর গ্রামের সব ঘর বাড়ি জমি বিক্রি করে দেয় অপূর্ব। হারিয়ে যাওয়া আতা ডালিম কামরাঙা কুন্দ লতা হয়ে ওঠে এক বড় বন মাধুরীর মনে। অপরূপা বলে…
- চা-টা যে ঠান্ডা হয়ে গেল। নাও চা-টা নাও…
বিকাশ অংশুর ঘরে ঢোকে। ওরা সন্ধ্যামালতির মত হাসে। ফ্রেশ হয়ে বিকাশ ময়ূখের পাশে বসে। মাধুরী অংশুকে অপরূপা আর ওর মাঝে বাসায়। ময়ূখ বলে…
- অংশু, তখন আন্টি বলছিল আমরা নাকি কাকুর বনে গিয়েছিলাম-ছোট বেলায়। তোর কি কিছু মনে আছে?
- না
- শুনবি? মা , বলনা... আমরা শুনব।
মিঠুদি পকোড়া ফিস-ফ্রাই আর মোচার চপ দিয়ে যায় সস্ সহ। বিকাশকে জিজ্ঞাসা করে-
- দাদাবাবু, আমি মাংসটা করে ফেলবো।
- না-না। কফি দাও। কফি-টা খেয়ে আসছি।
বিকাশ কফি খেয়ে উঠে পড়ে। মাধুরী বলতে শুরু করে-
- তোরা তখন খুব ছোট। বনবাংলোতে পৌঁছে দেখি তোদের জুঁই মাসি এসে হাজির। তোদের বন কাকু লাঞ্চ সেরে বন টহলে যাবে। জুঁই মাসি, আমি বায়না ধরলাম আমরাও যাবো তোর বনকাকুর জিপে। আমরা সবাই উঠে পড়ি জিপে। জিপ বনের ভিতর চলতে থাকে উঁচুনিচু বন পথে। বিকাশের বনের ভিতর চলা যেন চলা নয় এক অসীম খোঁজ। চলতে চলতে একটা স্যাঁতসেঁতে জায়গায় গাড়ি থেমে যায়। বিকাশ জুঁইকে বলে- জুঁই, এখানে আমি হাওয়াতে জল খাই। জুঁই বলে - চল আগে চল। হাতি দেখাও।
ময়ূখ বলে - তাই মা! কাকু হাওয়াতে জল খেল!
অপরূপা বলে- তুমি তো বিশ্বাস করে বিকাশের মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলে।
- হ্যাঁ সে ছিলাম। কিন্তু তোমরা দেখতে দিলে কই।
ময়ূখ বলে - তোমরা দেখেলে না কাকুর হাওয়ায় জল খাওয়া।
ও মন খারাপ করে বসে থাকে।
অংশু বলে- অত মন খারাপের কী আছে। বাবা আসলে জেনে নিস।
“বিকাশ আবার গাড়ি চালাতে ইশারা করে।
গাড়ি চলতে চলতে বনের ভিতরে একটা ক্যাম্পে এসে হাজির হয়। ক্যাম্পে কিসের যেন একটা বচসা হচ্ছে। বিকাশ গাড়ি থেকে নেমে ক্যাম্পে যায়। আমরাও ওর পিছু পিছু যাই। দেখি স্টাফরা একটি লোককে বকা-বকি করছে। বিকাশ জিজ্ঞাসা করে-
- কি হয়েছে।
ক্যাম্প-ইন-চার্জ বলে
- এই লোকটি গাছ কেটেছে।
- তোমরা একটু চুপ কর; আমি দেখছি।
বিকাশ লোকটিকে বসতে দিয়ে জিজ্ঞাসা করে
- বল, তুমি গাছ কেটেছ।
- হ্যাঁ।
- কেন কেটেছ… তোমার সাথে আর কে কে আছে?
- কেউ নেই।
- তবে কেন কেটেছ?
- আমার খুব টাকার দরকার ছিল।
- কত টাকা।
- দশ টাকা।
- মাত্র দশ টাকার জন্য একটা গাছ কেটে দিলে!
- হ্যাঁ সার।
- কেন???
- আমি তো পুরো গাছটি নিইনি। শুধু ছোট একটা টুকরো নিয়েছি।
- কেন?
- আমার দশ টাকার দরকার ছিল।
- কিন্তু কেন?
- আমার ছেলের জ্বর।
- ছেলের জ্বর বলে গাছ কাটবে? ম্যালেরিয়ার ওষুধ তো বিনা পয়সায় পাওয়া যায়।
- সে তো আনতে যেতে সদরে যেতে হবে। ভাড়া কোথায় পাব। কতজনকে বললাম দশটি টাকা ধার দিতে; পরে হাজিরা খেটে শোধ করে দিব; কেউ দিলনা। তারপর এক বাবু বলল সাত ফুটের একটা টিক লগ এনে দিলে দশ টাকা দিবে। জীবনে প্রথম গাছ কাটতে গিয়ে ধরা পড়ে গেলাম, স্যার। আমার ছেলে কে বাঁচান স্যার।
পরিবেশটা থমথমে হয়ে গেল- শ্রাবণের মেঘের মত- কদম কাটুশের মাটির মত। মাধুরী ভাবে বিকাশ কোথায় কাজ করে- যেখানে বিনা পয়সার ওষুধ পেতে পয়সা লাগে। ছেলের জ্বরে গাছ কাটে - পৃথিবীর জ্বর বাড়ায়। বিকাশ নিজের পকেট থেকে কুড়ি টাকা বের করে সোমরার হাতে দেয়। একটি মানুষকে জেলে পাঠিয়ে অমানুষ হবার হাত থেকে বাঁচায়। একজন পিতাকে সম্মান করে। বিকাশ স্টাফদের বলে – সোমরা কে ঘরে ছেড়ে আসতে আর বাবুটিকে সকালে অফিসে হাজির করাতে।
অপরূপা অংশুকে বুকে চেপে ধরে। সোমরার কথা মনে হওয়াতে মনে অভিমান জমে- সব জ্বর কী ম্যালেরিয়া! না সব জ্বর ম্যালেরিয়া নয়। সব জ্বরের ওষুধও এক নয়। নানা জ্বরের নানা রকমের ওষুধ।
অপরূপা বলে-
- জানিস, সেবার তোর বাবার সাথে আমরা বনে বনে কত ঘুরে ছিলাম; বাবার কাছে গল্প শুনিস - বেশ মজা লাগবে।
- সোমরা এখন কী করে?
- সে একজন বন-গাইড। পর্যটকদের বন চেনায়; পাখি দ্যাখায়। বনের গল্প বলে।
মাধুরী ভাবে- সোমরা যেন শালসিঁড়ির বাল্মিকি। বিকাশের সাথে সাক্ষাৎ সোমরার ব্রাহ্ম মুহূর্ত। জীবনের প্রথম প্রেম, প্রথম প্রাপ্তি, প্রথম ভুল, প্রথম অপরাধ ঠিক ভাবে বুঝতে না পারলে কত কী ঘটে যায়। জ্বর আসে ঝড় আসে বসন্তে। বসন্ত বাতাসে আগুনের গন্ধ আসে – বনে কোথায় যেন আগুন লাগে…
ময়ূখ ডাকে – বনকাকু, বনকাকু তাড়াতাড়ি এসো; আমাদের অনেক গল্প শোনার যে বাকী আছে…
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴