ভাস্কর্যের আঁতুড়ঘর-১৭/মৈনাক ভট্টাচার্য
ভাস্কর্যের আঁতুড়ঘর (পর্ব-১৭)
মৈনাক ভট্টাচার্য
বালাজি বসন্ত রাও তালিমের মার্বেল ভাস্কর্যঃ শিরডি সাইবাবা
“তুমি একটা ভূতের গল্প লেখো”। মেরিকে পরামর্শ দিলেন খোদ কবি লর্ড বায়রন। কিই বা বয়স তাঁর, সবে তো আঠারো। তবু ভাবতে বসে গেলেন মেরি শেলি, বায়রনের পরামর্শ বলে কথা। মুশকিল হয়ে দাড়াল- ভাবনা আসে কিন্তু লেখা আসেনা, লেখা আসে তো মন ভরেনা। কেননা লিখতে গেলে যে কল্পনার জগতে ঘুরে বেড়াতে হবে সেখানে কোথায় যেন মেরি আটকে আছে। এমনই একদিন সে স্বপ্ন দেখলেন এক জার্মান গবেষকের, যে মৃত মানুষকে আবার বাঁচিয়ে তুলতে সামর্থ্য হয়েছে। কিন্তু সেই মৃত্যু, প্রাণ পেয়েই রূপ নিয়েছে কুৎসিত শক্তিধর এক দানবে। স্রষ্টার ইচ্ছেবিরুদ্ধ সৃষ্টি কোন শিল্পীই বা মেনে নিতে পারে। গবেষকও মেনে নিতে পারলেন না, দুর্ব্যবহার করলেন। স্রষ্টার প্রতি প্রতিশোধস্পৃহায় দানবও হিংস্র হয়ে উঠল- উপন্যাসটির নাম দিলেন ফ্রাঙ্কেনস্টাইন; অর দ্য মডার্ন প্রমিথিউস। ফ্রাঙ্কেন্সটাইন উপন্যাসের এর পরের গল্প আমাদের জানা মিথ-।
জার্মান জৈব রসায়নবিদ আগস্ট কেকিউলের বেনজিন মলিকিউলের গঠন, ভারতীয় গণিতবিদ রামানুজমের নানান গাণিতিক তত্ত্ব, এমন কি অল্প বয়সী অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের স্বপ্ন- একদিন যখন তিনি একটি খাড়া পর্বতে ওঠার চেষ্টা করছেন। অবাক হয়ে লক্ষ করলেন যতই দ্রুত উপরের দিকে ওঠার চেষ্টা করছেন, ততই আলোর গতিপথ বদলে যাচ্ছে। স্বপ্নে নক্ষত্রগুলোও তাদের গতিপথ বদলে অন্য রকমভাবে দেখা দিচ্ছে তার সামনে। এর থেকেই তো তাঁর আপেক্ষিকতার তত্ত্ব সৃষ্টি। স্বপ্নে পাওয়া এমন প্রচুর সৃষ্টি ইতিহাস হয়ে আছে। তাই বলে ভাস্করকে কেউ স্বপ্নে তাঁর মূর্তি বানানোর জন্য সিটিং দিয়ে যায় এই অদ্ভুত ইতিহাসও দলিল হয়ে আছে ভাস্কর বসন্ত রাও তালিমের শিরডি সাইবাবা মূর্তি তৈরির আখ্যানে। স্রষ্টা মাত্রেই তো স্বপ্নচারিণী। চেতনে বা অবচেতনে স্বপ্নের এক স্তরে না পৌঁছলে সৃষ্টি ধরা দেয় না সে তো কবিও জানে, শিল্পীও জানে-।
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নেতৃত্বে বেঙ্গল স্কুল আন্দোলন আমাদের চিত্রকলাকে যেই ভাবে সাবালকত্বের পথ প্রদর্শক করার ব্রত নিয়েছিলেন ভারতীয় ভাস্কর্যে আধুনিকতার ধারাটি কিন্তু সেই তুলনায় ছিল অবহেলিতই। কেননা ভারতীয় ভাস্কর্যের ইতিহাসে সেই সময় ছিল ব্রিটিশ এবং মুসলিম আধিপত্যের প্রায় হাজার বছরের কথকতা। এই পরিস্থিতিতে বিংশ শতকের শুরুতে মহারাষ্ট্রে বেশ কয়েকজন প্রতিভাবান ভাস্করের আত্মপ্রকাশ ঘটে যারা সমসাময়িক অ্যাকাডেমিক রীতিতে কাজ করলেও শুধু রাজপুরুষ ও সম্ভ্রান্ত মানুষজনদের প্রতিকৃতি নির্মানের সীমাবদ্ধতা থেকে বাইরে বেরিয়ে এসে নিরপেক্ষ ভাব প্রকাশেও কাজে লাগিয়েছিলেন তাঁদের মেধাকে। এদের মধ্যে ভাস্কর বালাজি বসন্ত রাও তালিম বিশেষ উল্লেখযোগ্য হয়ে আছেন সন্দেহ নেই। বালাজি বসন্ত রাওয়ের শিরডি সাইএর মূর্তি নির্মাণের পরতে পরতে আছে ধর্ম বিশ্বাসের অদ্ভুত সব গল্প, যা বিশ্বাস অবিশ্বাসে আজও এক মুখরোচক মানা না মানার দোলাচল। শিরডির সাইবাবা প্রসিদ্ধ ছিলেন হিন্দু মুসলিম দুই সম্প্রদায়ের ধর্মীয় ঐক্যের বাতাবরণে। একাধারে তিনি যোগী আবার ফকিরও। উনিশশো আঠারোয় মৃত্যু হলেও উনিশশো চুয়ান্ন অব্দি সাইবাবার কোন মূর্তি ছিলনা। কারন, সেই সময় একটা মূর্তি বানানোর পরিকাঠামো আজকের মত অত সহজলভ্য তো ছিলই না, তার উপর সাইবাবার মাত্র একটিই ছবি কর্তৃপক্ষের কাছে ছিল যা থেকে মূর্তি বানানোও ছিল খুব কঠিন ব্যাপার। হঠাৎ বম্বে ডকে দাবীদারহীন কিছু ইটালিয়ান মার্বেল চোখে পড়ে। দীর্ঘ খোঁজ খবরের পরও কে বা কারা কেন এই পাথর এনেছেন কেউ বলতে পারেনা। অনেকদিন দাবীহীন ভাবে পড়ে থাকায় ডক ইয়ার্ড কর্তৃপক্ষ জায়গা খালি করার কারণে শেষ পর্যন্ত এই পাথরকে নিলামে তোলার সিদ্ধান্ত নেন। কোন ব্যক্তি তা কিনেও নেন, কিন্তু তিনি আবার সেই পাথর শিরডি সংস্থান মন্দির কর্তৃপক্ষকে দানও করে দেন। সমস্ত ঘটনাটাই যেন খুব অলৌকিক ভাবে এবং মন্দির কমিটির কোন পূর্ব পরিকল্পনাহীন ভাবেই ঘটে যায়। এমন ভাবে ইটালিয়ান মার্বেল প্রায় বিনা ব্যয়ে এসে যাওয়ায় প্রস্তাব আসে সাইবাবার মার্বেল মূর্তি তৈরির। এর পর মন্দির কর্তৃপক্ষ বসন্ত রাও তালিমকে ডাকেন। বসন্ত রাও তখন প্রথিতযশা ভাস্কর এমন ইটালিয়ান মার্বেল, সাই মূর্তির হাতছানি।যে কোন ভাস্করের কাছেই একটা লোভনীয় আকর্ষণ। তালিম কাল বিলম্ব না করেই রাজি হয়ে যান।
শিল্পী কাজ করতে বসে প্রথমেই সমস্যায় পড়েন যে বাবার একটাই মাত্র ছবি তাও অনেকটাই অস্পষ্ট। এই ছবি থেকে ত্রিমাত্রিক ছবি করা দুষ্কর। এই সব ক্ষেত্রে বিভিন্ন কোণ থেকে মূর্তিকে ঠিক মত ধরবার জন্য শিল্পীকে মডেল খুঁজে নিতে হয়। মডেল ভাবনা যখন বসন্ত রাওয়ের মাথায় জট পাকিয়ে আছে। আবার আর একটা ভাবনা সেই জটের ভেতর ঢুকেও আছে সাইবাবা বলে কথা মডেল দিয়ে কাজ করতে তাতে মনে সায়ও দিচ্ছেনা। বড্ড মুশকিল। মুশকিল আশান হয়ে বাবা নিজেই নাকি এক রাতে স্বপ্নে ধরা দিলেন বসন্ত রাও তালিমের মডেল হয়ে। বসে পোজ দিলেন শিল্পী ঠিক যে ভাবে যে ভাবে বললেন। তালিম তাকে ঠিক ঠিক ভাবে স্টাডি করলেন। বালাজি বসন্ত রাও তালিমের ভাষ্যে বাবাই তাকে পর পর পথ দেখিয়ে নিয়ে গেলেন কিভাবে পর্যায়ক্রমে বাবার এই ভাস্কর্য তৈরি করবেন। এর পর এই মূর্তি বানাতে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। মাটির মডেল সিরিডি কতৃপক্ষ এক বারেই অনুমোদন করে দেন।
এবার পাথর কাটা। লোকজন নিয়ে কাজ চলছে ছন্দেলয়ে । মার্বেল কাটা হচ্ছে মাটির মূর্তির মাপ মত। সমস্যা দেখা দিল মূর্তির বাম হাটুর কাছে এসে। হঠাৎ করে দেখাদিল মার্বেল পাথরের ভেতরে এক এয়ার পকেট। এও পাথর কাটার এক সমস্যা। পাথরের সব চেয়ে দূর্বল জায়গা এই এয়ার পকেট। তাও কিনা এমন জায়গায়, ছেনি মারতে গেলেই ভেঙ্গে পড়বে হাটুর টুকরো। গোঁড়া হিন্দু সংস্কার মতে জোড়া দেওয়া খণ্ডপ্রস্তরের মূর্তি তখনও পুজোয় ব্যবহার্য নয়। সমস্যায় পড়লেন শিল্পী বসন্ত রাও। এত দিনের শ্রম এত সুন্দর ইটালিয়ান মার্বেল সব বেকার হয়ে গেল বোধ হয়। মাথায় হাত দিয়ে বসলেন শিল্পী। ছেনি চালাতে ইতস্তত করতে লাগলেন তাঁর লোকেরাও। আবারও বাবার দ্বারস্থ হওয়া। এবং এবারও নাকি রক্ষাকর্তা সেই অলৌকিক বাবাই।
বসন্ত রাও প্রার্থনা করলেন তাঁর এত দিনের শ্রম যেন বৃথা না যায়। যেন শুনতে পেলেন অলৌকিক এক কণ্ঠস্বর। বাবা তাঁকে আশ্বস্থ করছেন। বাবা সাহস যোগাচ্ছেন কাজ এগিয়ে নিয়ে যেতে। কিন্তু তাঁর কোন সহযোগীই সাহস পেলেন না বাম হাটুর কাছে মার্বেলে ছেনি চালাতে। শেষ পর্যন্ত বালাজি বসন্ত রাও তালিম নিজে বাবাকে স্মরণ করে ছেনির ছোট্ট এক ঘা দিলেন - যা হবে দেখা যাবে ভেবে। খুব অলৌকিক ভাবে ছেনির ঘায়ে অতিরিক্ত অংশ টুকু মাত্র চাঁই থেকে বেরিয়ে এল। বাবার মূর্তি অক্ষতই রইল। শিল্পীর চোখ জলে ভরে উঠল। নিজের সৃষ্টিতে নিজেই বিভোর হয়ে উঠলেন। আরাধনায় বসে গেলেন শিল্পী শেষ না হওয়া সৃষ্টিকে সামনে রেখে। আনন্দে মিষ্টি বিতরণ করলেন নিজেদের ভেতর।
পাঁচফুট পাঁচ ইঞ্চির এই সাইমূর্তি দেখে চমকে উঠলেন বাবার সান্নিধ্যে থাকা স্বামী শ্রীসাই স্মরণানন্দ এবং লক্ষ্মীবাই। যেন বাবাই আবার ফিরে এসেছেন শিল্পী বসন্ত রাওয়ের শিল্পের হাত ঘুরে। সাইবাবার সমাধির পশ্চিম দিকে মৃত্যুর ছত্রিশ বছর প্রতিষ্ঠা হল সাইবাবার মূর্তি।
অলৌকিকতার এখানেই শেষ নয়। এই মূর্তি বানানোর সময়, সাইবাবা স্বপ্নে তাঁকে দেখা দিয়ে নির্দেশ দেন যাতে তিনি আর কোন ভগবান মূর্তি না বানান। তাঁর বিরাশি বছরের জীবনকালের শেষ ষোল বছর শিল্পী কোন ভগবান মূর্তি তৈরিতে হাত দেননি।
লৌকিক অলৌকিকের বৃত্তের বাইরে গিয়ে এই সব ঘটনার বিশ্লেষণ করতে বসলে একটাই জিনিষ স্পষ্ট হয়ে আসে-কোন সন্দেহ নেই ভাস্কর বালাজি বসন্ত রাও তালিম একজন ধর্মপ্রাণ মানুষ ছিলেন। কিন্তু এই কাজ করতে গিয়ে অবশ্যই নিজেকে ভাবনার এমন একটা স্তরে নিয়ে গিয়েছিলেন যেখানে একমাত্র একজন সৎ শিল্পীর পক্ষেই পৌঁছানো সম্ভব। এই ধ্যান না হলে উনিশশো চুয়ান্নোয় ভারতবর্ষে বসে তিনি এমন কাজ করেছিলেন যাঁর কাজের নমনীয়তা রদ্যাঁর চেয়ে কোন অংশে কম মনে হয়না। এই ধ্যান শুধু জানে একজন শুদ্ধ যোগী একজন সৎ কবি অথবা একজন এমন খ্যাপা, যার কাছে স্বপ্ন আর বাস্তবতার স্তরের কোন ফারাক থাকে না।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴