বিবর্তনের পথে শহর দার্জিলিং-১৭/রূপন সরকার
বিবর্তনের পথে শহর দার্জিলিং, পর্ব-১৭।
শহর গড়ে ওঠার এক্কেবারে প্রাথমিক পর্বে বাসিন্দাদের প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রীর চাহিদা মেটাবার জন্য একটি বাজার গঠনে উদ্যোগতাদের যথেষ্ট প্রতিকূলতার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। কর্নেল লয়েডের নির্দেশে মিঃ পেরি ১৮৩৮ সালে দার্জিলিংয়ে একটি বাজার স্থাপনে উদ্যোগী হন। প্রাথমিকভাবে বাজারটিতে চাল, ডাল, চিনি, মাংস, ময়দা, ঘি, জ্বালানি সহ শাকসবজি ইত্যাদি প্রয়োজনীয় সামগ্রী সরবরাহ করার ব্যবস্থা করা হয়। মিঃ ইউলসন যখন দার্জিলিংয়ে প্রথম হোটেল খোলেন তখন সেখানে পর্যাপ্ত পরিমানে ইউরোপীয় জিনিসপত্র পাওয়া যেত। যদিও সেগুলির জন্য সম্পূর্ণভাবে কোলকাতার ওপর নির্ভর করতে হত। পরবর্তীতে ড. ক্যাম্পেলের নেতৃত্বে বাজারের প্রভুত উন্নতি ঘটে। তিনি কিছু নতুন দোকান তৈরি করে লোনের মাধ্যমে ব্যবসায়ীদেরকে বিতরণ করেন। পৌরসভা গঠনের পর বাজারের পুনরায় উন্নতি ঘটে। পৌরসভা ব্যবসায়ীদের জন্য ছাউনি তৈরি করা থেকে শুরু করে কসাইখানা, ব্যবসায়ীদের লোন দানের মাধ্যমে নতুন নতুন দ্রব্যসামগ্রীর দোকান খোলার জন্য ব্যবসায়ীদের উৎসাহিত করতো। স্থায়ী বাজার ছাড়াও শহরের নাগরিক প্রয়োজন মেটাবার জন্য সপ্তাহান্তে সাপ্তাহিক বাজার বসতো। পার্শ্ববর্তী এলাকা থেকে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ি, ছোট উৎপাদক, তাদের উৎপাদিত দ্রব্যাদি যেমন শাকসবজি, দুধ, ফল-ফুল, লোহার তৈরি ছোটখাটো হাতিয়ার গরম জামাকাপড় ইত্যাদি নিয়ে বাজারে আসতেন। সাপ্তাহিক বাজারে বিভিন্ন শ্রেণীর, ধর্মের, বর্ণের মানুষের সমাগম হতো। শহরের ব্যববা - বাণিজ্যের বিকাশে মাড়ওয়ারি সম্প্রদায়ের ভূমিকা অস্বীকার করার উপায় নেই। ১৮৪৫ সালে প্রতিষ্ঠিত 'জেঠমাল ভোজরাজ ফার্ম' ছিল শহরে ব্যাঙ্কিং পরিষেবা প্রদানের প্রথম সংস্থা। এছাড়া অন্যান্য উল্লেখযোগ্য প্রতিষ্ঠানগুলি ছিল 'Smith Stanistreet and Partridge & Co', 'Robert and Company', 'Jaylal Nurshing Das and Sons', 'Francis Harison Whiteway & Laidlow Hall' ইত্যাদি।
এখানে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই যে শহরের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড প্রধানত বাজারকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হতো। কিন্তু পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে দার্জিলিংয়ের পরিচিতির সাথে সাথে হোটেল ব্যবসার প্রসার ঘটতে লাগলো এবং শহরের নগরায়ণে উল্লেখযুক্ত ভূমিকা পালন করতে থাকে। ১৮৪০ সালের ৩১-শে মার্চ থেকে দার্জিলিং শহরে প্রথম হোটেল পরিষেবা শুরু হয়। এই হোটেলটির নাম 'দার্জিলিং ফেমিলি হোটেল' এর মালিক ছিলেন ডেভিড উইলসন। ইংলিশম্যান পত্রিকায় এর প্রথম বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয়। এর পর থেকে একে একে উইলসন হোটেল, উডল্যান্ড, রকভিল, বেলভিউ, সেন্ট্রাল হোটেল এবং হোটেল মাউন্ট এভারেস্ট চালু হয়। ১৯১৫ সালের অক্টোবর মাসে হোটেল মাউন্ট এভারেস্ট চালু হয়। এটিই ছিল দার্জিলিং শহরের প্রথম আধুনিক হোটেল। ১২০ টি থাকার রুম নিয়ে সুন্দর ডাইনিং হল এবং সমস্ত আরামদায়ক ব্যবস্থা নিয়ে হোটেলটি তৈরি হয়েছিল। পর্যটনকে কেন্দ্র করে হোটেল ব্যবসা নিঃসন্দেহে শহরের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে সমৃদ্ধ করেছিলো। হোটেল ব্যবসার পাশাপাশি উনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় থেকে দার্জিলিং শহরের পার্শ্ববর্তী পার্বত্য অঞ্চলে চা বাগিচা শিল্পের প্রসার শহরের অর্থনীতি ও নগরায়ণের প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে। চা বাগিচা শিল্পের সাথে যুক্ত বাণিজ্যিক আদন প্রদান, স্থানান্তর, হস্তান্তরের কেন্দ্র হিসেবে শহর দার্জিলিংয়ের ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। এর ফলে শহর দার্জিলিং একদিকে যেমন বাগিচা শিল্পের প্রয়োজনীয় সামগ্রীর সরবরাহের প্রধান কেন্দ্র হয়ে ওঠে এবং অন্যদিকে এই আদানপ্রদান শহরের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করে।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴
