পইলা সাঞ্ঝির কথা/১৭
পইলা সাঞ্ঝির কথা
পর্ব - ১৭
শুক্লা রায়
÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷
হাউসালি
রসবালা আজকে সেই ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠেছে। উপায় নেই। পূজা-পালির দিনটায় খাটনি একটু বেশিই হয়। অন্ধকার থাকতে উঠেই ঘর-বাড়ি উঠোন লেপা শেষ। আগের দিন বিকালেই পাশের একটা পুকুর পাড়ের মাটি কেটে বালতি ভরে ভরে এনে উঠোনের এক কোণে জড় করে রেখেছে। এখন সব পুকুরেই কম-বেশি জল আছেই। মাটি পাওয়া মুস্কিল। তবে কান্তা ধনীর বাড়ির পুকুরটায় উঁচু পাড়, মাটিগুলোও ধবধবে। বাড়ি-ঘর যেন হেসে ওঠে। ওখান থেকেই কালকে মাটি কেটে এনেছিল। উঠোনটায় অবশ্য মাটির সঙ্গে গোবর মিশিয়ে নিয়েছে। স্নান সেরে ফুল তুলে নিয়ে আসতে না আসতেই দেখে সুষেণ উঠে ভ্যানটাকে বের করেছে। একটা সাইকেলও আছে ওদের। ওটাকেও বের করে কূয়োর পাড়ে নিয়ে এসেছে ধোয়ার জন্য।
সুষেণ খুব নিয়মনিষ্ঠ। সাইকেল, ভ্যান ঘষে ঘষে পরিস্কার করে নিয়ে একটু রোদে দিল। তারপর চট করে নিজেও স্নান করে নিল। ভ্যানের প্যাডেলে চাপ দিতে দিতে পেছন ফিরে মা কে বলল,
"বাছা বাউক কইস তো নিন থাকি উটিলে গাও ধুয়া সাইকেলখান ধরি আসিবে। ওঠে পূজা হবে এলায়।"
রসবালা গলায় একটু তাচ্ছিল্য মিশিয়ে বলে,
"নানাগে, উয়ায় যে এলায় জোগোতে ঊঠিবে হয়া গেইসে। মুইয়ে এলায় পূজিম। বাড়ির ঠাকুল্লাক না দিবার নাইগবে কে।"
সুষেণ আর কথা বাড়ায় না। প্যাডেলে চাপ দিয়ে হাটখোলার দিকে চলে যায়। রসবালা এবার কাজের ফাঁকে ফাঁকে ছোট ছেলেকে ডাকতে থাকে,
"বাউরে, বাবা, উটখেনে। কতটা বেলাটা হইসে, দ্যাখ তো কোনেক বিরিয়া।"
তারপর হতাশ হয়ে আপনমনেই বলে
"ইমরা বাপ-বেটায় বোদায় আজি সেজারির খ্যার গুন্ডা করিবে।"
হাটখোলার একদিকে বড়সড় পুজোর আয়োজন। ভ্যান-রিক্সা ইউনিয়নের। সার দিয়ে নতুন পুরনো অনেক ভ্যান আর রিক্সা রাখা। তবে গ্রামে রিক্সার প্রচলন কম। সেজন্য রিক্সার পরিমাণও কম, ভ্যানই বেশি। সুষেণ ওখানেই ওর ভ্যানটা রেখে একদিকে বেঞ্চে বসে। অনেকের বাড়ি থেকেই মহিলারা চলে এসেছেন পুজোর জোগাড় করে দিতে। সুষেণের মা ও আসবে একটু পরেই। প্যান্ডেলের চারদিক কাপড় দিয়ে ঘেরা। ওরা নিজেরাই বাড়ি থেকে শাড়ি এনে সাজিয়েছে। তবে পুরোহিত ঢাকি কেউই মন্ডমে পৌঁছায়নি এখনও।
হাটখোলা থেকে ফেরার পথে রসবালা বসমতীর বাড়ি হয়ে আসে। পুজোর প্রসাদ ফল-মূল আর খিচুড়ি দিয়ে বলে,
"দিদি সাজিস, আইতোত কিন্তুক আরতি দেখির যামু।"
এ আর বলতে। বসমতী তো যাওয়ার জন্য বসেই আছে। রসবালা বাড়ি ফিরে ভাত বসাতে বসাতে সুষেণের বাবার উদ্দেশ্যে বলে,
"ততকরায় কং, দিদিটা হামার খিবে হাউসালি। কোনোটে একেনা না কয়না। সবলাতে যায়। মোক এমতনে ভাল নাগে।"
সুষেণের বাবা বিড়ি টানতে টানতে বলে,
"কাথাটা ঠিকে কইসেন। দিদি হামার মানষিটাও ভাল। তে দাদাটাও ভাল।"
তারপর একটু থেমে সসংকোচে বলে,
"কোনেক যে চাহা খাবার মনটা যাছে, তে চিনি টিনি আছে কোনেক? করিবেন?
রসবালার নিজেরও মনে হল একটু চা হলে মন্দ হয় না। তবু গলা তুলে বলে,
"তোমরা যে মানষি! এমতন তিনদুপুরা তালোত চাহা খাবার চাছেন?"
সুষেণের বাপ জানে রসবালা ঠিকই চা করবে। একটু মুচকি হেসে নিজে নিজে মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলে,
"জ্বালাও কোনেক। ভাত তো তোমার হইতে মেলা দেরি আছে।"
রসবালা রাতের রান্নার ঝামেলা রাখে না। সবাইকে খেতে বসিয়ে দিয়ে আব্দার করে,
"আতিত কিন্তুক আজি এইলায় খাবেন। মুই কোনেক আরতি দেখির যাইম।"
ছোটছেলে ঠান্ডাভাত খেতে ভালোবাসে না। সে বিরক্ত হয়ে বলে,
"তুই কি ওঠে ঝলপোয়াতে যাবু মা? হইতে হইতে তো হবে ওই নিশার আতি, পহল আতি। অত জোগোতে যায়া কি করিবু? মানষির না মাতা গোণিবু? মোক চাইট্টা গরম ভাত আন্দি দিয়া যাইস। শাক পিতার এইলায় হবে। নানাগে আর কোনো।"
সুষেণ রাগে গরগর করে ওঠে,
"এ বাউ, বেশি দেউনিয়াগিরি না দেখাইস। জোগোতে যায়া জাগা ধরির নাইগবে না? পাছোত গেইলে কোটে বসিবে? পিসাইও যাবে না মার সতে? খাড়া হয়া নবার পাবে এলায়?
রসবালা খুশি হয়। তারপর বলে,
"এলা কোনেক গাবুরে আছি, এলা হাউস আমোদ না কোরিমু তে কি বুড়ি হয়া কোরির পামু? বউ আসিলে সেলা কবেন মা তোক যাবার নানাগে, বাড়ি পাহারা দেক। গান রে বাজান রে, সেলা তোমরায় দৌড়াবেন। বুড়ি মাওটার কাথা মনতে না থাকিবে।"
এবার ভাষণ শুনে অর্ধৈয সুষেণ ধমক দিয়ে বলে,
"নে নে হইসে। তুই আরো ভাষণ ছাইরলে থামিসকে না। দে, মোক চাইট্টা ভাত দে।"
প্রায় সন্ধ্যার মুখেই রান্না শেষ করে ফেলেছে বসমতী। খাওয়ার পাট চুকিয়ে বাচ্চাগুলোকে রেডি করাতে বসেছে। কান্তেশ্বর এত তাড়াতাড়ি খেয়ে কি করবে ভেবে দিশা পাচ্ছে না। বিছানায় বসে বসে এদের হৈ-হট্টগোলগুলো দেখছিল। দুজনের মাথাতেই আচ্ছা করে নাড়কেল তেল মাখিয়ে চুপচুপে করে যত্ন করে বাঁদিকে সিঁথি করে পেতে আঁচড়ে দিল। মেয়ের চোখে বড় করে টেনে কাজল পরিয়ে একটা টিপ দিয়ে দিল। তারপর আঁচলের কাপড়টা ভাঁজ করে পাউডার ঢেলে থুপে থুপে কাজলের উপর, ঘাড়ে বুকে ছড়িয়ে দিল। এসব করতে করতেই ভ্যানের হর্ণ বাজতে লাগল পোঁ পোঁ। সঙ্গে রসবালার গলা,
"হইসে দি? আইসেক, বড়বাউ ভ্যানখানোত কোনেক আগে দেয় বলে।"
বসমতী তাড়াতাড়ি বেড়িয়ে এসে অপ্রস্তুত মুখে বলে,
"মুই যে এলাও কাপড়ে পিন্দোং নাই কইনা মাই?"
রসবালা ধীরে সুস্থে বলে,
"পিন্দেকখেনে, তোর না মেলা আওতা কাপড় আছে, একখান পিন্দিলে হইল। ভ্যানোত এলায় সাল্লাউ করি যামু। বাউ আছে তার কি।"
তারপর থেমে বলে,
"মোর মোতোন একতাওয়া করি পিন্দিবু না কুচি করিবু? কুচি কইল্লে করেক, মুই ধরিম এলায়।"
বসমতীর অবশ্য শাড়ি পরতে বেশি সময় লাগে না। কুচি করেই শাড়িটা পরে আঁচলটা সরাসরি গায়ে জড়িয়ে নিল। রুমালে পয়সা বেঁধে নিয়ে মেয়ের কাজলটা হাত দিয়ে আর একটু ঠিক করে দিল। আঁচলটাই একটু জিভে দিয়ে ভিজিয়ে নিয়ে ধ্যাবড়ানো অংশটা যত্ন করে মুছে দিয়ে কান্তেশ্বরের দিকে ফিরল।
"হামা যাই তে। ডডে শষে অমন নিন পাড়েন না। আজি কিন্তুক পাড়াখানোত মানষি কম। গোরুগিলা আছে। আর আসিয়া ডেকাইতে ডেকাইতে ঝুনি মরি যাবার নানাগে।"
কান্তেশ্বরের ওই এক দোষ। ঘুমালে আর কিছু টের পায় না। ডাকতে ডাকতে মরে গেলেও উত্তর নেই। ততক্ষণে রসবালা বাচ্চাগুলোসহ ভ্যানে গিয়ে উঠে পড়েছে। বসমতী গিয়ে বসতেই সুষেণ প্যাডেলে চাপ দিল। চারদিক থেকে মেয়ে-বউরা সব আরতি দেখার জন্য সেজে-গুজে চলেছে। কারো কোলে বাচ্চা, কেউ রাস্তাতেই রূমাল খুলে পানের পোঁটলা খুলে পান খেতে খেতে চলেছে। রসবালা আর বসমতী অন্ধকারেই যাদের যাদের চিনল কথা বলতে বলতে গেল।
...............................................................
হাউসালি - সৌখিন বা আমুদে
ততকরায় - সত্যি করে
ঝলপোয়াতে - তাড়াতাড়ি বা সন্ধ্যাতেই
নিশার আতি পহর আতি - অনেক রাতে
আওতা - তোলা
সাল্লাউ - চট করে
একতাওয়া - আটপৌরে কাপড় পরার ধরণ
ডডে শষে - নাক ডেকে
...............................................................
ছবি : ময়ূখ রায়
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴