নেওড়ানদী চা বাগিচা/গৌতম চক্রবর্তী
নেওড়ানদী চা বাগিচা
গৌতম চক্রবর্তী
^^^^^^^^^^^^^^^^^^^
নেওড়া মোড় বাসস্টপ থেকে লাটাগুড়ি-রাজাডাঙ্গা- মালবাজার রোড ধরলাম। লাটাগুড়ি ফরেস্ট রিট্রিট, নেওড়া পোস্ট অফিস পেড়িয়ে নেওড়া খেলার মাঠ। পাশেই নেওড়া নদী টি গার্ডেন এবং টি এস্টেট। কিছুদূরে রোমান ক্যাথলিক চার্চ। এই বাগানেরই সুমিতা ওঁরাও আর তার স্বামী বিশুয়া ওঁরাও দুজনেই চা-শ্রমিক। তাই বাগানে কাজের জীবনটা নিয়মে বাঁধা বলে সাইরেন বাজলেই ছুটতে হয় বাগানে। দুই ছেলে দুই মেয়ে। তাই ছেলেদের মধ্যে বড় জনকে পাঠিয়ে দিয়েছে আমাদের বিদ্যালয়ে।
ওদের সন্তান বাপি ওঁরাও আমার বিদ্যালয় ধাপগঞ্জ গভর্ণমেন্ট স্পনসর্ড আশ্রম টাইপ হাইস্কুলে আবাসিক ছাত্র হিসাবে পড়াশোনা করে। সরকারি খরচে এখানে পড়াশোনা করা যায় ছাত্রাবাসে থেকে। থাকা খাওয়া ফ্রি। এখানে ভর্তি করার মূল কারণ সেটাই। করোনার আগে একেবারে ছকে বাঁধা জীবন ছিল সুমিতা আর বিশুয়ার। কাজ না করলে ঘরে চুলা জ্বলবে না। স্বামী স্ত্রী মিলে যা আয় করত তাই দিয়ে দুই ছেলে এবং দুই মেয়ে নিয়ে ছয় জনের সংসার কোনরকমে চলে যেত। করোনার আগে ছোট ছেলে পড়াশোনা ছেড়ে গ্যারাজে কাজ শুরু করেছিল ওদলাবাড়িতে। বড় মেয়ে সেবারে মাধ্যমিক দিয়েছিল। ছোট মেয়ে চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ত। লকডাউন সবকিছু ওলট-পালট করে দিয়েছিল। উপার্জন ছাড়া এত বড় সংসার চলবে কিভাবে সেটা ভাবতে গিয়ে অথৈ জলে পড়েছিল তারা। মার্চে যে কটা দিন কাজ করেছিল শুধু সেইটুকু মজুরি পেয়েছিল। রেশন থেকে পেয়েছিল ১৫ কেজি চাল, ১০ কেজি আটা। মুদির দোকানে ধার ছিল চার হাজার টাকা। গালামালের আর আনাজের দোকানে দুই হাজার টাকা। দুবেলা কোনমতে সেদ্ধ ভাত, কোনদিন ডাল ও আলু ভাজা খেয়ে দিন কাটিয়েছে। বাগানে যেতেই দেওয়া হয় নি। কিভাবে দিন চলবে আর কিভাবেই বা তার ছেলেমেয়েদের মুখে অন্ন তুলে দেবে তা নিয়ে কোন ভাবনাই ঠাঁই পায় নি সুমিতা আর বিশুয়ার মাথায়। যাই হোক পরিস্থিতি আবার স্বভাবিক হলেও আতঙ্ক গ্রাস করে আছে ডুয়ার্সের চা শ্রমিকদের মধ্যে। এই পরিবেশ এবং পরিস্থিতিতেই এলাম নেওড়ানদী চা বাগিচাতে।
"নেওড়া নড্ডি" শব্দটি নেওড়া নদীর নাম থেকে এসেছে। নদীটি ভুটান পাহাড় থেকে উৎপন্ন হয়ে বাগানের পূর্ব পাশ দিয়ে প্রবাহিত হয়ে দক্ষিণে তিস্তা নদীর সাথে মিলিত হয়েছে। গরুমারা ন্যাশনাল পার্ক সংলগ্ন অঞ্চলে এই চা বাগানটি অবস্থিত। গোরুমারা জাতীয় উদ্যানের পরিধিতে সমৃদ্ধ এস্টেটের রেলওয়ে স্টেশন এবং পোস্ট অফিসের নামকরণও করা হয়েছে নেওড়া নদীর নামে। এটি পশ্চিমে চেল এবং পূর্বে নেওড়া এই দুটি নদীর মধ্যবর্তী 'দোয়াব' অর্থাৎ দুই নদীর মধ্যবর্তী ভূখন্ডে অবস্থিত মধ্যে অবস্থিত। নেওড়া নুডি টি এস্টেটের উৎপত্তি এবং আবির্ভাব ২০ শতকের গোড়ার দিকে, যখন স্কটল্যান্ডের জেমস ফিনলে দেশের উত্তর-পূর্বে চা বাগান রোপন করে চা চাষ শুরু করেছিলেন। এস্টেটটি পূর্বে কনসোলিডেটেড টি অ্যান্ড ল্যান্ডস কোম্পানি (ইন্ডিয়া) লিমিটেডের মালিকানাধীন ছিল। এখানকার প্রাচীনতম যে ডিভিশনের চা গাছ, যেখান থেকে এখনো পাতা সংগ্রহ করা হচ্ছে তা ১৯১০ সালে রোপণ করা হয়েছিল। ১৯৭৭ সালে টাটা এবং ফিনলে চা বাগিচার ব্যাবসাতে যোগ দিয়ে টাটা ফিনলে এবং নভেরা গঠন করে। পরবর্তীকালে ফিনলে তাদের শেয়ার টাটা গ্রুপের কাছে সরিয়ে দেয় এবং এর ফলে ১৯৮৩ সালে ‘নেওড়া নুডি’ টাটা টি-এর একটি অংশ হয়ে ওঠে এবং এপ্রিল, ২০০৮ পর্যন্ত এদের হাতে থাকে। অবশেষে অ্যামালগামেটেড প্ল্যান্টেশনস প্রাইভেট লিমিটেড এস্টেটটির মালিকানা দখল করে ২০০৮ সালের মে মাসে। ২০০৭ সালে এই টি এস্টেট তার চা উৎপাদনের ক্ষেত্রে রেকর্ড চা উৎপাদন করে। নেওড়ানুদী টি এস্টেট পরিবেশ এবং প্রকৃতি রক্ষায় নিজস্ব উপায়ে এলাকাতে অবদান রাখার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করার চেষ্টা করে চলেছে। টি এস্টেটের গবেষণা ও উন্নয়ন বিভাগের উদ্যোগে প্রতি বছর মাটিকে উন্নত করার জন্য বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষানিরীক্ষা করা হয়। সার প্রয়োগ করা হয় বিশেষজ্ঞদের সুপারিশ অনুযায়ী। ১৯৭৭ সাল সহ আরো বেশ কয়েকবার এই টি গার্ডেন টি বোর্ডের কাছ থেকে পুরস্কৃত হয়েছে।
আজকের বাগিচা সফর যখন শুরু করেছি তখন মার্চ মাস শুরু হয়ে গেছে। ১৪ ই ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হয়েছে পাতা তোলার কাজ। যত বেশি পাতা তোলা যায় তত বেশি পয়সা হাতে আসে চা শ্রমিকদের। তাই এই সময়কালে ব্যাপক উৎসাহ থাকে শ্রমিক মহল্লায়। তাছাড়া কিছুদিন পরেই শুরু হয়ে যায় ফাগুয়া পরব। আর কয়েকদিন পর যখন পরবর্তী বাগিচা সফরে আসব তখন নিয়ে আসব ফাগুয়া পরবের বহু অজানা গল্প। আজকের বাগিচা সফরে করোনাকালে যখন আমার ছা্ত্রের বাড়িতে এসেছিলাম তখনকার সমকাল তুলে ধরার চেষ্টা করছি। কারণ আপনাদের কোন ধারণা নেই সেই সময়কালে কি অসম্ভব লড়াই লড়েছিল চা বাগিচা সংশ্লিষ্ট মানুষজন। ২০২০ সালে মার্চ মাসের আগে ফাল্গুণের বৃষ্টিতে নতুন আশার সঞ্চার হয়েছিল চা পাতা উৎপাদনে। কারণ আবহাওয়ার পূর্বাভাস ছিল ফাল্গুণে বৃষ্টি হবে। ডুয়ার্সের বিভিন্ন এলাকায় পূর্বাভাস অনুযায়ী বৃষ্টি শুরু হলে আগামীতে ভালো ফলনের সম্ভাবনায় চা বাগিচাতে আনন্দের বান ডাকে। কিন্তু এই আনন্দ দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। ২০২০ সালের মার্চ মাসে লকডাউন জারি হবার পর টানা প্রায় একমাস অধিকাংশ চা বাগিচার শ্রমিকদের কোনো কাজ ছিল না। কর্মচঞ্চল জীবনটাই চার দেওয়ালে আটকে গিয়েছিল। কর্মহীন, উপার্জনহীন চা শ্রমিকদের সংসার। কতদিন চেয়েচিন্তে বা ঘরের সামান্য জমানো পুঁজি ভেঙে চলবে তা তারা জানে না। উপার্জন ছাড়া এত বড় সংসার চলবে কিভাবে সেটা ভাবতে গিয়ে অথৈ জলে পড়ল শ্রমিকেরা। তখন পর্যন্ত মার্চে যে কটা দিন কাজ করেছিল শুধু সেইটুকু মজুরি পেয়েছিল শ্রমিকেরা। রেশন থেকে পেয়েছিল ১৫ কেজি চাল, ১০ কেজি আটা। তবুও ছুটির দিনে স্বেচ্ছাশ্রমে সামিল হয়ে বিনা মজুরিতে চা গাছের পরিচর্যা, কীটনাশক স্প্রে, আগাছা ছাঁটাই, মাটির উর্বরা শক্তি বৃদ্ধির জন্য সার প্রয়োগ, কীটনাশক দমনে রাসায়নিক স্প্রে প্রয়োগ করার মত কাজ করেছিল নেওড়ানুদী চা বাগিচার বিশুয়া, নরেশ, মংলু, বিনোদ ওরাওরা। দেখেছিলাম ওদলাবাড়ির লিস রিভার, মালবাজারের গুডহোপ এবং মেটেলির বাতাবাড়ি চা বাগান সহ ওদলাবাড়ি, চিলৌনি, গয়েরকাটা এবং লক্ষ্মীপাড়া বাগানের শ্রমিক এবং স্টাফেরা রবিবার সাপ্তাহিক ছুটির দিনেও বাগানে বিনা মজুরিতে কাজ করেছিল। ওয়াশাবাড়ি এবং যোগেশচন্দ্র বাগানের শ্রমিকেরাও স্বেচ্ছাশ্রমে কাজ করে।
ডিবিআইটিএ ম্যানেজমেন্টের সদস্যভুক্ত মালবাজার মহকুমার নেওড়ানুদী টি গার্ডেনটির মোট ম্যানেজারিয়াল স্টাফ ৩ জন, সাব স্টাফ ৪৫ জন, করণিক ১০ জন, এবং ক্ল্যারিক্যাল, টেকনিক্যাল ও অস্থায়ী শ্রমিক মিলে মোট শ্রমিক সংখ্যা ৩৫ জন। বাগিচায় মোট শ্রমিক পরিবারের সংখ্যা ৬১৯। ৮২৩ জন স্থায়ী শ্রমিক সহ নেওড়ানুডির ৮৮১ জন স্থায়ী কর্মচারী রয়েছে এবং পিক সিজনে কোম্পাণী কমবেশি অতিরিক্ত ৩৫০ জন অস্থায়ী কর্মী নিয়োগ করে। বাগানে প্রতিষ্ঠিত এবং স্বীকৃত ট্রেড ইউনিয়নের মধ্যে উল্লেখযোগ্য পিটিডব্লিউইউ, সিবিএমইউ এবং ডব্লিউবিসিএমএস। ১৩৬৫.৯৯ একর জুড়ে বিস্তৃত নেওড়ানুডির চাষের এলাকা ২৬৩.৭৪ হেক্টর এবং উৎপাদন এলাকা ২৫২.৯০ হেক্টর। চায়ের জন্য উপযুক্ত নয় এমন জমির পরিমাণ ৮৫.২৩ হেক্টর। রাস্তা, ড্রেন ইত্যাদির জন্য প্রায় ১৫ হেক্টর জমি, গম চাষের জন্য প্রায় ১৪৫ হেক্টর জমি, বাড়িঘর এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের জন্য প্রায় ৪৫ একর জমি বাদ দিলে এস্টেটের আয়তন ৫৫৩.০৩ হেক্টর। সেচের সুবিধাযুক্ত অঞ্চল এবং পাশাপাশি মোট চাষযোগ্য উৎপাদনক্ষম আবাদিক্ষেত্র ধরলে বাগিচার চা উৎপাদন ক্ষেত্র ২৬৩.৭৪ হেক্টর। প্রতি হেক্টর উৎপাদনযোগ্য এবং সেচযুক্ত প্ল্যান্টেশন এরিয়া থেকে গড়ে ২৩৫৮ কেজি করে কাঁচা চা পাতা উৎপাদিত হয়। প্রতি হেক্টর জমি পিছু নেওড়ানুদী চা বাগিচার নিজস্ব উৎপাদিত কাঁচা চা পাতা গড়ে ২৫ থেকে ২৬ লাখ কেজি এবং ফ্যাক্টরিতে প্রস্তুত মোট বিক্রয়যোগ্য চা সাড়ে পাঁচ থেকে ছয় লাখ কেজি। বহিরাগত বাগান থেকে কোনরকম চা প্রসেসিং কারখানাতে হয় না। তাই এই বাগানের বাৎসরিক ৬ মিলিয়ন কেজি মাঝারি মানের ইনঅরগ্যানিক সিটিসি, গ্রিন এবং অর্থোডক্স চা উৎপাদন করার ক্ষমতা রয়েছে। প্লাকিং মরসুম মার্চ মাসে শুরু হয় এবং বছরের বাকি সময় ধরে চলে এবং ডিসেম্বরে শেষ হয়। বাগান থেকে তাজা সবুজ চা পাতা ছিন্ন করে কারখানায় প্রক্রিয়াজাত করা হয়। কারখানাটি এস্টেটের মধ্যেই অবস্থিত। উৎপাদিত চা ম্যানুয়ালি বাছাই করে পৃথকভাবে গ্রেড করা হয়। তারপর সেগুলোকে বস্তায় আলাদাভাবে প্যাক করা হয়, সিল করা হয়। নেওড়ানুদী টি গার্ডেনটির লিজ হোল্ডার অ্যামালগামেটেড প্ল্যান্টেশনস প্রাইভেট লিমিটেড। বাগান পরিচালনার কার্যকর মূলধনের অধিকাংশ শেয়ার আসে ব্যাংক, অন্যান্য প্রতিষ্ঠান এবং নিজস্ব অর্থনৈতিক সোর্স ও চা বিক্রি বাবদ আয়ের থেকে।
কৃষিক্ষেত্রে চা শিল্প বা বাগিচা শিল্পকেও ধরা হয়। তাই চা বাগানের মুনাফার উপরেও এত দিন কৃষি আয়কর দিতে হত। ছোট-বড় সব চা বাগানই এই করের আওতায় আসত। বাগিচা সফরের কাজ করতে গিয়ে এই ব্যাপারে জানতে চেয়েছিলাম ছোট চা চাষিদের সর্বভারতীয় সংগঠনের সভাপতি বিজয়গোপাল চক্রবর্তীর কাছে। তিনি জানিয়েছিলেন দশ টাকা হাতে পেলে বাগিচাগুলিকে রাজ্য সরকারকে তিন টাকা দিতে হত কৃষিক্ষেত্র কর বাবদ। যুক্তি দিয়ে তিনি বলেছিলেন, ধরা যাক কোনও বাগান কর্তৃপক্ষ কষ্টেসৃষ্টে বছরে ১ লক্ষ টাকা হাতে রাখতে পারল। তা হলে তার থেকে ত্রিশ হাজার টাকাই কৃষি আয়কর দিতে হত। এই চাপ অত্যন্ত বেশি ছিল বলে তাঁরা দাবি জানিয়েছিলেন ছোট চা বাগানকে কৃষি আয়কর থেকে পুরোপুরি বাদ দেওয়া হোক। বড় চা বাগানের খরচ বেশি হওয়ায় কাগজে কলমে মুনাফা কম হত। তাই বড় চা বাগানের উপরে কৃষি আয়করের প্রভাব তেমন পড়ত না বলে দাবি চা শিল্পের একাংশের। তাদের বক্তব্য অনুযায়ী বরং ছোট চা বাগানকে বেশি কর দিতে হত। ছোট চা চাষিদের যুক্তি ছিল যেহেতু ছোট চা বাগানে বিভিন্ন খাতে খরচের অবকাশ নেই তাই মুনাফার অঙ্ক বেশি এবং তা কৃষি আয়করের আওতায় চলে আসে। ঠিক এই সময়তেই রাজ্য সরকারের কর ছাড়ের সহায়তাতে সুবিধে বাগানে সম্প্রসারিত হল রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সদর্থক পদক্ষেপের ফলে। সেই আর্থিক বছর থেকে রাজ্য সরকার কৃষিক্ষেত্র থেকে সেই ৩ টাকা কর নেবে না বলে সিদ্ধান্ত নেয়। রাজ্য বাজেটে পরবর্তী আর্থিক বছর থেকে কৃষি আয়কর মকুবের কথা ঘোষণা করা হয়। এতে হাসি ফোটে চা শিল্পের সঙ্গে জড়িত মানুষগুলির মুখে। মন্দার বাজারে উত্তরবঙ্গের ছোট চা বাগানগুলিকে রাজ্য সরকারের এই সিদ্ধান্ত খানিকটা স্বস্তি দেয়। রাজ্যে মোট চায়ের উৎপাদনের প্রায় ৫৪ শতাংশ ছোট চা বাগান থেকেই আসে। মন্দার বাজারে দাম কম মেলায় পরবর্তী মরসুমে ছোট বাগানের চায়ের উৎপাদনেও প্রভাবের আশঙ্কা ছিল। কৃষি আয়কর সরে গিয়ে সেই আশঙ্কা অনেকটাই কেটে গিয়েছিল।
ঘুরতে ঘুরতে এলাম শ্রমিক মহল্লাতে। নেওড়ানদী চা বাগিচায় কর্মীদের থাকার জন্য ৬৯৯ টি শ্রমিক পরিবারের জন্য কোয়ার্টারের ব্যাবস্থা আছে। প্রায় ৮০ শতাংশ শ্রমিক কোয়ার্টারগুলি পৃথক মিটারিং সিস্টেমের বিধানের মাধ্যমে বিদ্যুতায়িত হয়েছে এবং অবশিষ্ট শ্রমিক কোয়ার্টারগুলিতে বিদ্যুৎ সরবরাহ করার জন্য কাজ চলছে। বাগিচাতে শ্রমিকদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করতে প্যাকেটজাত রেশন দেওয়া হয়। দেখলাম শ্রমিকদের স্বাস্থ্য ও পরিচ্ছন্নতা রক্ষার জন্য কুলি লাইন এবং ড্রেন নিয়মিতভাবে পরিষ্কার করা হয়। জীবাণুনাশকও পদ্ধতিগতভাবে মশার জন্মগত রোগের বিস্তার রোধ করার জন্য নিয়মিত ছড়ানো হচ্ছে যে তাও লক্ষ্য করলাম। এছাড়াও দেখলাম কুলি লাইনের কাছাকাছি একটি ২৫ শয্যাবিশিষ্ট কেন্দ্রীয়ভাবে অবস্থিত হাসপাতাল শ্রমিকদের চিকিৎসা এবং প্রয়োজনে স্বাস্থ্য পরিষেবা দেওয়ার জন্য নির্মিত হয়েছে। হাসপাতাল চত্বরের মধ্যে অবস্থিত সাব সেন্টারের মাধ্যমে শ্রমজীবী মানুষকে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করা হয়। নেওড়ানুদী এস্টেট সরকারী প্রোটোকল অনুযায়ী কর্মীদের জন্য প্রতিরোধমূলক টিকাদানও করে। এস্টেটের ২৬ বছরের অভিজ্ঞতা সম্পন্ন একটি অত্যন্ত সুসংবদ্ধ মেডিকেল টিম রয়েছে। বাগিচার এই হাসপাতালে চারটি করে পুরুষ এবং মহিলা আইসোলেশন ওয়ার্ড, মেটারনিটি ওয়ার্ডের ব্যবস্থাও আছে। মেল এবং ফিমেল ওয়ার্ডের সংখ্যা আটটি করে। হাসপাতালে অপারেশন থিয়েটার, অ্যাম্বুলেন্স আছে। দুজন প্রশিক্ষিত নার্স, দুজন স্বাস্থ্য সহযোগী আছে। তবে শ্রমিকদের অভিযোগ বাগিচায় পর্যাপ্ত ওষুধ সরবরাহ হয় না। বাগিচায় বাৎসরিক বোনাসের শতকরা হার গড়ে কুড়ি শতাংশ। বাগিচায় শিশুদের জন্য একটি ক্রেশ আছে। অ্যাটেনডেন্ট তিনজন। চা বাগানের অফিসের কাছে একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে যেখানে বিদ্যালয়ের ৫ জন শিক্ষক ২৮০ জন শিক্ষার্থীকে পড়ান। বাগিচা সংলগ্ন উচ্চ বিদ্যালয় অনেকটাই দূরে বলে শ্রমিক সন্তানদের বিদ্যালয় থেকে আনা নেওয়ার জন্য বাসের বন্দোবস্ত আছে। প্রতিটি বাগানের মতো নেওড়ানুদী বাগানেও বিনোদনমূলক ক্লাব বা খেলার মাঠ আছে। রয়েছে কমিউনিটি উন্নয়নের জন্য ৩০ জন সদস্য বিশিষ্ট এস্টেট এমপ্লয়িজ কাউন্সিল, মহিলা মন্ডল এবং ৪০ জন সদস্য নিয়ে গঠিত লিঙ্ক ওয়ার্কার্স কমিটি যারা বাসিন্দাদের মধ্যে জীবনধারা সংক্রান্ত বিষয়ে সচেতনতা তৈরি করার দিকে নজর দেয়।
লকডাউন এর কারণে বিশুয়াদের মত বহু শ্রমিক পরিবার দারুণ সমস্যায় পড়েছিল। সেই সময় লক ডাউনে চা বাগানে বসবাসকারী দুস্থদের রান্না করা খাবার বিতরণ করে মানবিকতার নজির স্থাপন করেছিল টি অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্ডিয়া অর্থাৎ টাই। টাই পরিচালিত ডুয়ার্স এবং তরাই এর বাগানগুলিতে এই কর্মসূচি পালিত হয়। নেওড়ানদী বাগিচাতেও বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান তাদের মানবিকতার হাত বাড়িয়ে দেয়। বিভিন্ন বাগান থেকে আসে এই ধরনের মানবতামূলক কাজে অংশগ্রহণের খবর। নাগরাকাটার বিভিন্ন চা বাগানগুলিতে কঠিন পরিস্থিতিতে সর্বত্র শারীরিক দূরত্ব ও সামাজিক স্বাস্থ্যবিধি মেনে খাবার দেওয়া হয়। অন্য অনেক বাগান কর্তৃপক্ষও রান্না করা খাবার বিতরণে শামিল হয় এবং করোনা বিরোধী যুদ্ধে শামিল চা বলয়ের সরকারি হাসপাতালের ডাক্তার, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের হাতে চায়ের প্যাকেট তুলে দেয়। তবে দেখেছিলাম সমস্যা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছিল লকডাউনে। অর্থনীতির ঝিমুনি চায়ের বাজারে প্রভাব ফেলেছিল। চা শিল্পমহলের কথায় কিছু ক্ষেত্রে চায়ের বাজার সঙ্কুচিতও হয়েছিল। কারণ সামগ্রিকভাবে চাহিদা কমেছিল। দেশের আভ্যন্তরীণ বাজারের কিছুটা ডুয়ার্সকে সরিয়ে দখল করেছিল অসম ও নেপাল। রফতানিতেও ঘাটতি হয়েছিল। পাকিস্তানেও সেভাবে চা রফতানি হয়নি। চা পর্ষদের হিসেবে এর পরিমাণ প্রায় ৬০ লক্ষ কেজি যার জেরে দেশের বাজারে চায়ের দামও ধাক্কা খেয়েছিল। ছোট চা বাগানের পাতার দাম বছরভর গড়ে কেজি প্রতি ১৩ টাকার বেশি ওঠেনি। বিজয়গোপালবাবুর কথায়, চা উৎপাদন করতেই তো কেজিতে প্রায় ১৩ টাকা লেগে যায়। তার পরে যেটুকু মুনাফা হত তা-ও কৃষি আয়করে চলে যেত। তার হাত থেকে অন্তত স্বস্তি। না হলে অনেক বাগানে সামনের মরসুমে উৎপাদন হত কিনা সন্দেহ। নেওরানুদী চা বাগিচাতে এবারের বাগিচা সফর করার সময় একটা কথাই ভাবছিলাম দুটো বছর কি সময়কালই না গেল। বিশেষ্করে উত্তরের চা বাগিচা প্রত্যক্ষ করল এমন এক লড়াই যে লড়াই নাড়িয়ে দিয়েছিল উত্তরের অর্থনীতিকে।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴