জার্নি/শুক্লা রায়
জার্নি
শুক্লা রায়
স্লিভলেস ব্ল্যাক কুর্তির সঙ্গে আইস ওয়াশ জিন্স। গলায় একটা বড় পুঁতির মালা। তার সঙ্গে ম্যাচিং দুল। ছোট্ট একটা স্লিং ব্যাগ কাঁধ থেকে ক্রশ করে নেমে কোলের উপর পড়ে আছে। বাঁ হাতের সরু রিস্ট জুড়ে একটা বিরাট ব্ল্যাক স্মার্ট ওয়াচ। এখনকার ট্রেন্ডিং লুক। তবে মেয়েটার মুখের উপর একটা মায়া মায়া শ্রী বসানো। কন্ডাক্টর তো স্টুডেন্ট দেখে তুলতেই চাইছিল না। মেয়েটা নরম সরম হলেও মোটেও ললিত লবঙ্গলতা গোছের নয়। উঠেও পড়ল, জানলার পাশে একটা সিটও দখল করে ফেলল। বসেই আজকালকার ছেলে-মেয়েদের যা হয় আর কি, কানে হেডফোন লাগিয়ে পৃথিবী ভুলে গান শোনায় মগ্ন হয়ে গেল। আরো দশমিনিট কন্ডাক্টর আর ক্লিনারের হাঁক ডাকের পর তবে গাড়ি জলপাইগুড়ি স্ট্যান্ড ছাড়ল। গাড়ির ভেতরের লোকজন ততক্ষণে ঘেমে ঝোল। এরমধ্যে একটা বছর দুয়েকের বাচ্চা তারস্বরে চেঁচিয়ে সবার মাথা খারাপ করে দিচ্ছে। বলার কিছু নেই, এই গরমে বড়রাই অস্থির তো বাচ্চার আর কি দোষ। জল খাইয়ে, কুরকুরের প্যাকেট দিয়ে কিছুতেই শান্ত করা যাচ্ছে না। বোঝাই যাচ্ছে ছেলের রাগ ভালোই আছে! বাসের ভেতর ঢুকতে ঢুকতে কোনোমতে একটা সিট পেয়ে মনমোহন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। সব সিটই প্রায় ভর্তি। মেয়েটার পাশের জায়গাটা তখনও খালি। লঝঝড়ে ব্যাগটা ঠেলেঠুলে উপরে তুলে দিয়ে আরাম করে বসল। মেয়েটা সহযাত্রীর দিকে একবার তাকিয়ে দেখেই পুনরায় গান শোনায় মনোযোগ দিল। মনমোহনও এক ঝলক তাকিয়ে দেখল। হাফহাতা সার্টের একটা সুবিধা হল পাশের জনের সাথে গায়ে গা লাগিয়ে বসতে পারলেই আরাম। গোবেচারা মনমোহনের প্রথম ধাপ সেটাই হল। মেয়েটার মসৃণ হাতের সাথে নিজের ঘেমো হাতটা লাগিয়ে বসল। মেয়েটা অস্বস্তি নিয়ে তাকিয়ে বাপের বয়সী লোকটাকে দেখে কিছুটা নিশ্চিন্ত হয়েই আবার চোখ বন্ধ করে গান শোনায় মন দিল।
আড়ালে একবার চোখ পিট পিট করে তাকিয়েই মনমোহন ঘুমের ভান করে মেয়েটার গায়ে চেপে বসল। গাড়ির ছোট সিট। নড়াচড়ার জায়গা নেই, সেখানে বুড়ো মানুষটার ঘুমিয়ে পড়া দেখে মেয়েটার অস্বস্তি হলেও কিছু বলতে পারল না। হয়ত সত্যিই ঘুম পেয়েছে, হয়ত খুব টায়ার্ড। কিন্তু এবার আর নিশ্চিন্তে গান শোনায় মন দিতে পারল না। ষষ্ঠ ইন্দ্রীয় বলছে লোকটার উদ্দেশ্য খারাপ, বিবেক বলছে বুড়ো মানুষ, তায় বাপের বয়সী, খারাপ উদ্দেশ্য থাকতেই পারে না। মেয়েটার বুকের ভেতর এখন দোলাচলের ধুকপুক। ইস! না এলেই হত। কেন যে বন্ধুর ডাকে গ্রাম দেখতে যাওয়ার শখ হল! পরক্ষণেই ভাবল, নাহ্, বাসে তো সবসময় উঠতেই হবে। সমস্যা থেকে পালিয়ে লাভ নেই, বরং মোকাবিলা করা ভালো।
কিছুক্ষণের মধ্যেই মেয়েটার কঠিন ধমকে বাসের সবাই সচকিত হয়ে উঠল।
"-কাকু, হাত সরান।"
লোকটা ঘুম চোখে মেয়েটা দিকে একবার তাকিয়ে অসহায় ভঙ্গীতে সরে বসার চেষ্টা করতে লাগল। লোকজন আবার যার যার মতো নিজেদের দিকে ঘুরে গেল। বাস তখন ময়নাগুড়ির কাছে, মেয়েটা আবার চিৎকার করল। কেউ কেউ বিরক্ত হলেও কেউ কোনো মন্তব্য করল না। অনেকেই আড়ালে মুচকি হাসল। নিজেদের মধ্যে বলাবলি করল, আজকালকার মেয়েদের একটুতেই গায়ে ফোস্কা পড়ে, অথচ দেখ হয়ত বাবা-মায়ের আড়ালে বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে কী না কী করে বেড়াচ্ছে, কেউ জানতেও পারছে না। মেয়েটা শুনল, কিন্তু কী আর বলবে! লোকটাও ঘুমের আড়ালে সবই শুনছে। ময়নাগুড়ি পেরিয়ে বাস ধূপগুড়ির দিকে ছুটছে। বাসে এখন বেশ ভিড়। মেয়েটা উসখুস করছে। বাসভর্তি লোকের বিরূপ মন্তব্যের ভয়ে সহজে কিছু বলতেও পারছে না। পাশে দাঁড়ানো লোকের ঠেলায় লোকটা আরো মেয়েটার গায়ের উপর চেপে বসল। কিছুক্ষণ চলল এভাবেই। একটা অস্বস্তিকর পরিবেশ। হঠাৎ পেটের দিকে আঙুলের স্পর্শ পেতেই মেয়েটি আর থাকতে পারে না। প্রচন্ড ক্রোধে ফেটে পড়ে। প্রায় হিতাহিত জ্ঞানশূণ্য হয়ে যায়। মুখে যা নয় তাই বলে চেঁচাতে থাকে। অসভ্য, জানোয়ার, পশু -কিছু বাদ নেই। লোকটা থতমত খেয়ে যায়। প্রথমটায় বুঝে উঠতে পারে না কী হয়েছে। তারপরে অসহায় ভাবে এদিক ওদিক তাকিয়ে আমতা আমতা করে। তার চেহারায় একটা অসহায়ত্ব, ভয় সবমিলিয়ে গোবেচারা মানুষটার চেহারাটা মলিন হয়ে যায়। ভদ্রলোক কন্ডাকটরের এবার মাথা গরম হয়ে যায়। মেয়েটার দিকে তেড়ে ওঠে। "-কিসের এত সমস্যা তোমার? এই গরমে জায়গা না পেয়ে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে আর তুমি বসে থেকেও বাস ছাড়ার পর থেকেই ঝামেলা ক্যাচাল করে চলেছ। না পোষায় নেমে যাও। লাগবে না আমার এমন যাত্রী।"
রাগে, ঘেন্নায়, লজ্জায় মেয়েটির চোখ-মুখ লাল হয়ে যায়। আর কিছু না বলে দ্রুত নেমে যায়। গাড়ি তখন জলঢাকায় দাঁড়িয়ে। গাড়ির প্রায় সবাই কন্ডাকটরের পক্ষে। কিন্তু কন্ডাকটরও হয়ত ভাবেনি মেয়েটা সত্যিই নেমে যাবে। কন্ডাকটর সবাইকে সাক্ষী মেনে নিজের দোষ ঢাকার জন্য বলে, "-দেখছেন তো বেচারা বুড়ো লোক। খামোখা ওর পেছনে লেগেছে সেই তখন থেকে।" বিষয়টা সবার কাছে বেশ মজা এবং রসিকতার পর্যায়ে চলে গেল এক সময়। শুধু এক মহিলা যাত্রী ভাড়া দেওয়ার সময় কন্ডাকটরকে ডেকে বলে, "-ভাই। বাইরের চেহারাটাই সব নয়। মেয়েটা তোমার নিজের কেউ হলে ব্যাপারটা নিয়ে তুমিও মাথা ঘামাতে। ও সত্যিই নেমে গেল মানে ও ওখানে বসে থাকতে পারছিল না।"
কথাটা শুনে লোকটা মনে মনে হাসল। মুখে অবশ্য একটা কাঁচুমাচু ভাব এনে সামনের দিকে তাকিয়ে থাকল। এটাই ওর বড় অস্ত্র। মেয়েটার ছেড়ে যাওয়া সিটে ততক্ষণে একটা ছেলে বসে পড়েছে।
ক্লান্ত, বিধ্বস্ত বিদীপ্তার আর কোথাও যেতে ইচ্ছে করছিল না। বাসে তো উঠতেই আতঙ্ক লাগছে। ওর চোখের সামনে দিয়ে হর্ণ দিয়ে বাসটা বেরিয়ে যেতেই জায়গাটা কেমন শান্ত হয়ে গেল। একটা ছোটখাট দোকানের সামনে দাঁড়াল বিদীপ্তা। তারপর ব্যাগ থেকে টাকা বের করে কোল্ড ড্রিঙ্কস নিল একটা। ফিরে যে যাবে সেও তো বাসেই চাপতে হবে। বুকের ভেতরটা অপমানবোধে আর কষ্টে মুচড়ে উঠছে। হার্টবিট বেড়ে গেছে বুঝতে পারছে। কিছুক্ষণ শান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে ফাঁকা দেখে একটা ছোট বাসে উঠে পড়ল। বন্ধুর বাড়ি পৌঁছতে পৌঁছতে বিকেল। রিনিকা রাস্তায় দাঁড়িয়েই ছিল। ফোনেই সবটা শুনেছে ও। বিদীপ্তাকে দেখে দ্রুত এগিয়ে গেল। ওর সঙ্গে গল্প আড্ডায় বিদীপ্তা অনেকটাই সহজ হয়ে গেল। দুপুরের বিষয়টা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলল একসময়।
কিন্তু লোকটার সঙ্গে আবার দেখা হল খেতে বসে। বিদীপ্তা এতটাই শকড যে খাবার মুখে তুলতেই ভুলে গেল। রিনিকা একবার বাবাকে আর একবার বিদীপ্তাকে দেখে দুপুরের গল্পটা অনুভব করতে পারল। বিদীপ্তাকে আটকায়নি আর। শুধু বিদায় দিতে এসে এক বুক লজ্জা নিয়ে বলেছিল, "আমার মরে যাওয়া উচিত রে!"
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴