চা-ডুবুরী-১৭/সুকান্ত নাহা
চা-ডুবুরি : পর্ব-১৭
সুকান্ত নাহা
^^^^^^^^^^^^^^^^
স্মৃতির আনাগোনা
দেয়ালে ঝোলানো চাবিটা হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ বাবার দিকে চেয়ে থাকে সত্যপ্রিয়। পাশ ফিরে শুয়ে আছেন কুমুদরঞ্জন। চাদরে ঢাকা শীর্ণকায় শরীরটা নিঃসাড় পড়ে আছে। ছোট্ট ঘরটায় সারাটা দিন প্রায় এভাবেই শুয়ে থাকেন তিনি। খাবার সময় হলে উঠে বসেন। সুনয়নী চামচে করে খাইয়ে দেন তাকে। যেদিন স্নানের ইচ্ছে প্রকাশ করেন সেদিন মাথা ধুইয়ে গা মুছিয়ে দিতে হয় সুনয়নীকেই। উঠে বাথরুমে গিয়ে যে স্নান করবেন সেটিও করতে চান না। কথাবার্তা বিশেষ বলেন না। কারণে অকারণে রেগে যান স্ত্রীর ওপর। ছেলের সাথেও খুব প্রয়োজন ছাড়া কথা বলেন না।
জগতের সবকিছুর প্রতিই যেন তার বিতৃষ্ণা।
বিছানার কাছে এসে একটু ঝুঁকে আলতো স্বরে বাবাকে ডাকে সত্যপ্রিয়, ' বাবা...'। কোনও সাড়া নেই। গায়ে হাত রাখতেই এবারে সামান্য পাশ ফিরে চোখ মেললেন।
'-একটু উঠে বসবে? ' কথাটা শুনে কিছুক্ষণ নিস্পলকে চেয়ে থাকেন কুমুদ ছেলের দিকে। তারপর ধীরে ধীরে বিছানায় উঠে বসেন। উঠে বসতেই সত্যপ্রিয় বাবার পায়ে হাত ছুঁইয়ে হাতটা মাথায় রাখে। একটু যেন অবাক হন কুমুদ। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চেয়ে থাকেন। ততক্ষণে সুনয়নী এসে দাঁড়িয়েছেন দরজার কাছে। দৃষ্টিটা এবার স্ত্রীর দিকে ফেরান। তারপর সহসা স্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে একটি অপ্রত্যাশিত প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন ,' কী ব্যাপার? হঠাৎ প্রণাম করল যে ও? বিয়ে করে এল নাকি! '
এমন একটা প্রশ্নের ঝাপটা খেতে হবে আঁচ করেনি সত্যপ্রিয়। কাউকে না জানিয়ে একদিন বউ নিয়ে বাড়িতে ঢুকে এভাবেই হঠাৎ করে বাবাকে প্রণাম করেছিল বিশ্বপ্রিয়। ঘটনাটা আঘাত করেছিল কুমুদকে। কথাগুলো যেন সেই বেদনারই প্রতিফলন। কথা সরছিল না সত্যপ্রিয়র মুখ থেকে। সুনয়নীই উত্তর দেন,
-' চাকরি পেয়েছে ও। আজ প্রথম স্কুলে যাচ্ছে। তুমি যে স্কুলে কাজ করতে সেই স্কুলে। ওকে আশীর্বাদ করো। '
দৃষ্টিটা এবারে ছেলের দিকে ফেরান কুমুদরঞ্জন। পূর্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে থাকেন কিছুক্ষণ অপলকে। তারপর নিস্পৃহ স্বরে যেন টুকরো কুটোর মত হাওয়ায় ভাসিয়ে দেন দুটিমাত্র কথা, 'ভালো...এসো।'
সত্যপ্রিয় চলে যেতে উদ্যত হতেই কুমুদরঞ্জন আবার ডাক দেন,
'-শোনো, মন দিয়ে কাজ কোরো....ফাঁকি দিও না কাজে। শিক্ষককে বলা হয় মানুষ গড়ার কারিগর। অথচ শিক্ষকদের প্রাপ্যের কথা কেউ ভাবে না। দারিদ্রই যেন শিক্ষকের অলংকার...ও হ্যাঁ, পারলে পোস্ট অফিসে একবার খোঁজ করে দেখো তো। বেতনটা এ'মাসেও কেন যে এল না ... এই পিওনগুলোও হয়েছে যেমন... কোনও কাজ করতে চায় না... সব ফাঁকিবাজ।'
শেষের কথাগুলো মনে হল নিজের সাথে বলে পাশ ফিরে শুয়ে পড়লেন কুমুদরঞ্জন। ইদানিং কথা কম বলেন। হঠাৎ করে বলতে শুরু করলে এভাবে একটানা বলে যান। খাপছাড়া, অসংলগ্ন। দীর্ঘ দিন বেতন না পাওয়ার যন্ত্রণা অবচেতনে এখনও যে তাকে কষ্ট দেয় কয়েকটি কথায় তা স্পষ্ট হয়ে ধরা পড়ে। মাকে প্রণাম করে নিঃশব্দে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসে সত্যপ্রিয়।
বাইরে আসতেই চোখে পড়ে, গেটের বাইরে গুটিকয়েক ছোট ছোট ছেলেমেয়ে অপেক্ষা করছে। ওরা সকলেই বাসালাইনের বাবুদের ছেলেমেয়ে। আজ অনেকদিন বাদে আবার স্কুল খুলছে। এ খবর তারা পেয়ে গেছে। অভিভাবকরাই তাদের পাঠিয়েছেন । সত্যপ্রিয়র সাথে ওরা স্কুলে যাবে। কাছে এসে সত্যপ্রিয় হেসে সস্নেহে প্রশ্ন করে তাদের, 'তোমরা স্কুলে যাবে বলে এসেছ?'
সমস্বরে উত্তর আসে 'হ্যাঁ-অ্যা-অ্যা...অ্যা '
-' এসো আমার সাথে।' বলে সত্যপ্রিয় হাঁটা দেয় স্কুলের দিকে। হঠাৎ তার নজরে পড়ে সকলে হাঁটা শুরু করলেও একটি ছোট্ট ফুটফুটে মেয়ে তখনও পেছনে ঠায় দাঁড়িয়ে। ঘুরে তাকায় সত্যপ্রিয় , 'কী হল ... দাঁড়িয়ে আছ কেন... তুমি যাবে না স্কুলে? '
মেয়েটি শান্ত গলায় কেটে কেটে উচ্চারণ করে, 'তো-মা-র সা-থে যা-ব না। মা-স্টার-দাদু কোথায়? আমি মা-স্টা-র দাদুর সাথে যাব।'
সত্যপ্রিয় হাসিমুখে জিজ্ঞেস করে, 'তোমার নাম কি? '
-' অপর্ণা মিত্র। '
হাঁটু মুড়ে মেয়েটির সামনে ঝুঁকে পড়ে সত্যপ্রিয় বলে, ' ও, তুমি তাহলে আমাদের ডাক্তার দাদাবাবুর মেয়ে। বাঃ খুব সুন্দর নাম তো তোমার। ' বলে মেয়েটির চিবুক দরে আদর করে সত্যপ্রিয়। তারপর মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, ' মাস্টার দাদুর তো অসুখ করেছে, তাই উনি আর আসতে পারবেন না। আজ থেকে আমি তোমাদের পড়াব। তোমরা আমাকে কাকু বলে ডাকবে, কেমন ?'
-'দাদুর কী হয়েছে? ' অপর্ণা জানতে চায়।
-' জ্বর হয়েছে। ' চটজলদি কথাটা যুগিয়ে যায় সত্যপ্রিয়র মুখে।
খানিকক্ষণ চুপ থেকে এবারে সে বলে, 'জ্বর কবে সারবে? জ্বর সারলে আসবে, দাদু? '
-' তা তো জানি না। তবে মনে হয় জ্বর সারলেই আসবেন । তুমি এখন এসো আমার সাথে।'
-' তুমি বকবে না তো? দাদু কিন্তু আমাকে বকে না।' সন্দিগ্ধ চাহনিতে তাকিয়ে দেখে দূর থেকে মিষ্টি মেয়েটি।
ভীষণ হাসি পেয়ে যাচ্ছিল কথাটা শুনে সত্যপ্রিয়র। মেয়েটিকে কোলে তুলে নিয়ে আদর করতে করতে বলে, 'তুমি তো ভাল মেয়ে। খামোখা বকব কেন।' ওকে কোলে উঠতে দেখে অন্য বাচ্চারা হাততালি দিয়ে বলতে থাকে, 'এ মা, কোলে উঠেছে, এ-মা কোলে উঠেছে...ছোটবাচ্চা...।'
সাথে সাথে নামার জন্য ছটফট করে ওঠে অপর্ণা। নামিয়ে দিতেই সে হাঁটতে থাকে পেছন পেছন।
বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে বাগানের অফিস। কাজলিডাঙা নামক সবুজঘেরা প্রান্তিক জনপদের প্রাণকেন্দ্র। অফিস-বারান্দার শেষ প্রান্তে সহকারী ম্যানেজারের কাচের জানালা ঘেরা অফিস। পাশের ঘরটি বড়সাহেবের। ঘরটি প্রশস্ত, কাচের জানালাগুলো পর্দা দিয়ে ঘেরা। এখানে বসেই বাগানের দন্ডমুন্ডের কর্তাটি হুকুম জারি করেন। শ্রমিকদের অভাব অভিযোগের কথা শোনেন।
বড়সাহেবের অফিসঘর সংলগ্ন বড়বাবুর নিজস্ব কুঠুরি। বড়সাহেবের পরেই যার দোর্দণ্ড প্রতাপ। কেবলমাত্র তার সাথেই বড়সাহেব কথা বলেন। খুব প্রয়োজন ছাড়া অন্যান্য বাবুদের সাথে তিনি কথা বলেন না। কোনও সমস্যায় পড়লে তিনি বড়বাবুরই পরামর্শ নেন। বড়বাবুর অফিসরুমের পাশেই অন্যান্য বাবুদের বসার ঘর। এখানে বসে তারা খাতাপত্রের কাজ, শ্রমিকদের বেতন প্রদানের কাজ করেন। অদূরেই চায়ের কারখানা। সেখানে দিনরাত চা তৈরি হচ্ছে। সহকারী ম্যানেজারের ঘর পেরিয়ে একচিলতে কাঁচা রাস্তা। রাস্তা পেরোলেই ছোট্ট স্কুল ঘরটি দূর থেকে চোখে পড়ে। সত্যপ্রিয় ধীর পায়ে হেঁটে চলেছে সেদিকে। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা অনুসরণ করছে তাকে। স্কুল খুলছে খবর পেয়ে লেবার-লাইনের দু চারটে বাচ্চাও স্লেট বগলে এসে যোগ দিয়েছে ওদের সাথে।
সত্যপ্রিয়র পরনে ধুতি আর সাদা ফুলহাতা সার্ট। ধুতি পড়ার কায়দাটা একটু ব্যতিক্রমী। ঠিক মাঝামাঝি জায়গায় কোমরে গিঁট দিয়ে সামনে ঝুলে থাকা অংশ দু'ভাগ করে পেছনে নিয়ে গিয়ে দু'টি করে কাছা দেয়া। কোনও কোঁচা থাকে না ধুতিতে। বেশ আঁটসাঁট হয়ে শরীরে লেগে থাকে বলে চলাফেরা করতে, সাইকেল চালাতেও বেশ সুবিধে হয়। স্কুল জীবনটা হাফপ্যান্ট পরেই কেটেছে। মনোময় মুখার্জীকে দেখার পর থেকে ধবধবে সাদা ধুতির পাঞ্জাবির প্রতি আকর্ষণ জন্মায় তার। তবে পাঞ্জাবির বদলে ফুলহাতা সার্ট পরতেই সত্যপ্রিয় অভ্যস্ত। নতুন পদ্ধতিতে এই ধুতি পরার কায়দাটি তাকে শিখিয়েছে বন্ধু পরেশ। কলকাতার ছেলে। বীরপাড়ার টেলিফোন এক্সচেঞ্জের কর্মী। স্কুল জীবন শেষ হওয়ার পর যখন উচ্চশিক্ষার আশাটা ক্রমেই থিতিয়ে যাচ্ছিল, শিক্ষালাভের আকাঙ্ক্ষা যেন ততই তীব্র হচ্ছিল সত্যপ্রিয়র বুকের ভেতর। মনে একটা জেদ চেপে গেছিল যে লেখাপড়া বন্ধ হলেও বইয়ের জগত থেকে সে দূরে থাকবে না। আজীবন নিজেকে ডুবিয়ে রাখবে পড়াশোনার ভেতর। যে কারণে শিক্ষা-সংস্কৃতির পরিমন্ডল খুঁজে নিতে চা বাগানের বদ্ধ জগত ছেড়ে সত্যপ্রিয়কে প্রায়ই ছুটে যেতে হয় বীরপাড়ায়। সেখানে সদ্য গড়ে ওঠা স্কুল, টেলিফোন এক্সচেঞ্জে কাজ করতে আসা কিছু শিক্ষিত মানুষজনের সংস্পর্শে। সেখানেই পরিচয় ঘটে শিক্ষক অতীন সেন, শশীভূষণ পাল, টেলিফোন অপারেটর পরেশ সরকারের মত দক্ষিণবঙ্গের শহরাঞ্চল থেকে আসা কিছু উচ্চশিক্ষিত মানুষজনের সাথে। এদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। পরিচয় হয় স্কুলের হেডমাস্টার এম.এ, এম.এড শ্যামাদাস চক্রবর্তীর সাথে। গুরুগম্ভীর মানুষ। জ্ঞানের ভান্ডার। এদের সাথে পরিচিত হওয়ায় পড়ার আগ্রহ বাড়ে, নানান বিষয়ে আলাপ আলোচনা হয়। কিছুটা হলেও মনের খোরাক মেটে।
কাজলিডাঙা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জরাজীর্ণ ঘরটার সামনে এসে একটু দাঁড়ায় সত্যপ্রিয়। কয়েক মুহুর্ত চেয়ে থাকে বন্ধ ঘরটার দিকে। এই স্কুলেই তার শিক্ষা জীবনের শুরু। সময়ের চাকা ঘুরে সেই স্কুলেই আজ শিক্ষক হিসেবে পা রাখতে হচ্ছে। আজকের অনুভূতিটা তাই একটু অন্যরকম। বাড়িতে থাকলে কোনোদিন যেতে দেরি হলে চাবিটা দিয়ে বাবা বলতেন , 'যা তো, স্কুলটা খুলে দিয়ে আয়। নয়ত বাচ্চাগুলো অপেক্ষা করে ফিরে যাবে।' সে আসা ছিল অন্যরকম আসা। আজ একটি গুরুদায়িত্ব কাঁধে নিয়ে আসতে হয়েছে। এতগুলো ছেলেমেয়েকে গড়ে তুলবার দায়িত্ব।
স্কুলের বাইরে সেই টিনের সাইনবোর্ডটা আর নেই। দেয়ালের চুন-সুরকি জায়গায় জায়গায় খসে গেছে। মাথার ওপর টিনের চালায় জায়গায় জায়গায় ফুটো। সামনের নাতিপ্রশস্ত খোলা জায়গা জুড়ে আগাছার জঙ্গল। এগিয়ে গিয়ে দরজার সামনে দাঁড়ায় সত্যপ্রিয়। পকেট থেকে চাবি বের করে কাঠের দরজার গায়ে বসানো তালার গর্তে চাবি ঘুরিয়ে পেতলের গোল হাতলটা ধরে মোচড় দিতেই খুলে যায় দরজাটা। বন্ধ ঘরের ভেতর থেকে ভ্যাপসা চেনা একটা গন্ধ এসে নাকে লাগে। ছোটবেলায় বাবার সাথে স্কুলে এলে বাবা যখন দরজা খুলতেন, এমনই গন্ধ পাওয়া যেত। ভেতরে ঢুকে জানালাগুলো খুলে দিতেই আলো ঝাঁপিয়ে পড়ে ঘরে। বাচ্চাগুলোও হৈ-হৈ করে ঢুকে পড়ে বেঞ্চিগুলোর দখল নেয়। সত্যপ্রিয়র নজরে পড়ে ভেতরটা তেমনই আছে। বিশেষ বদলায়নি কিছুই। একটি টেবিল, একটি চেয়ার। এই চেয়ারে বসেই কুমুদরঞ্জন পড়াতেন। এককোণে সেই বেঁটে কাঠের আলমারিটা এখনও আছে। তার ওপর দুটো মানচিত্র ছিল। সেগুলো এখন আর নেই। হয়ত নষ্ট হয়ে গেছে। তাছাড়া থেকেই বা কি হতো। হতভাগ্য দেশটার মানচিত্রই তো বদলে গেছে। নতুন মানচিত্র আনাতে হবে। ভাবতে ভাবতেই চোখে পড়ে এককোণে রাখা সরস্বতীর মূর্তিটায় ধুলো জমেছে। ধুলো জমেছে ব্ল্যাক বোর্ডের গায়েও। আলমারি খুলে দেখতে গিয়ে চোখে পড়ে চকের বাক্সে গোটা চারেক চক। ভাঙা চকগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে একটিমাত্র ডাস্টারকে ঘিরে। একটি বাঁশের ছড়ি। একটি পাতলা হাজিরাখাতা। পাতা ওল্টাতেই বাবার সুন্দর হাতের লেখায় ছাত্রছাত্রীদের নামগুলো চোখে পড়ে। মাস তিনেক আগে শেষবার হাজিরা লেখা হয়েছিল ওতে।
আলমারি থেকে খাতাটা বের করে জানালার দিকে তাকাতেই চোখে পড়ে বাগানের সহকারী ম্যানেজার মিঃ স্টিভেনসনকে। দীর্ঘদেহী স্কটিশ ভদ্রলোক, পরনে হাফপ্যান্ট, হাফহাতা সার্ট। ব্রেকফাস্ট-আওয়ারে হেঁটে চলে যাচ্ছিলেন অদূরে বাংলোর দিকে। যেতে যেতে হঠাৎ আজ স্কুলঘরটি খোলা দেখে থমকে দাঁড়ালেন। তারপর কি মনে করে এগিয়ে এলেন দরজার দিকে। সত্যপ্রিয়ও এগিয়ে গিয়ে তাকে নমস্কার জানিয়ে বলে, 'গুড মর্নিং স্যার। '
-' গুড মর্নিং ইয়াং ম্যান। ওয়াও, দেন ইউ আর দ্য নিউলি অ্যাপোয়ন্টেড টিচার অব দিস স্কুল।'
-' ইয়েস স্যার।' উত্তর দেয় সত্যপ্রিয়।
-' কনগ্রাচুলেশন।
- 'থ্যাংকু, স্যার।'
-' হাও ইস ইয়োর ফাদার নাউ?' স্টিভেনসন জানতে চান।
-' নট সো ওয়েল, স্যার।'
-' কনভে মাই বেস্ট উইশেস টু হিম, প্লিজ। হি ইজ আ নাইস জেন্টলম্যান।' স্টিভেনসনের মুখে বাবার প্রশংসা শুনে ভাল লাগে সত্যপ্রিয়র।
একটু হেসে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলে -'শিওর স্যার। থ্যাংক ইউ।'
-' ওক্কে ইয়াং ম্যান, বেস্ট অব লাক ফর ইউ' - বলে দু'হাত বাড়িয়ে করমর্দন করে স্টিভেনসন জানান, ' টুমরো আই উইল রিটার্ন টু মাই হোমল্যান্ড। টুডে ইজ মাই লাস্ট ডে ইন ইন্ডিয়া...' বলেই একটু হেসে বাচ্চাদের দিকে ঘুরে তাকান। তারপর বিদায় জানানোর ভঙ্গিতে হাত নেড়ে হেসে 'বাই' বলেই ঘুরে গেলেন। আর ফিরে তাকালেন না। বারান্দার অপর প্রান্ত দিয়ে গটগট করে হেঁটে ঘাসজমিটা পেরিয়ে চলে গেলেন বাংলোর দিকে।
মানুষটা চলে যেতেই মনটা সামান্য হলেও কেন যেন আর্দ্র হয়ে ওঠে সত্যপ্রিয়র। আসতে যেতে প্রায়দিন দেখা যেত যে শ্বেতাঙ্গ মানুষটাকে, কাল থেকে তাকে আর দেখা যাবে না। কখনও হেঁটে, কখনও সাইকেলে চেপে ঘুরে বেড়াতেন বাগানের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে। বাচ্চারা যাকে দেখলেই 'সেলাম সাব', 'নমস্তে সাব' বলে চেঁচাত। আর সাহেবও হাত নেড়ে তাদের ওয়েলকাম জানাতেন। কখনও পকেট থেকে টফি বের করে ধরিয়ে দিতেন ওদের হাতে। অনেকদিন কাজলিডাঙায় কাটিয়ে এই জায়গা, এখানকার মানুষজনকে অজ্ঞাতেই হয়ত ভালোবেসে ফেলেছিলেন সুদূর স্কটল্যান্ডবাসী এই মানুষটা। ভাল ফুটবল খেলতেন স্টিভেনসন। কাজলিডাঙার হয়ে অনেক টুর্নামেন্ট খেলেছেন অন্যান্য বাগানের সাথে। খেলার সুবাদে আশপাশের বাগানের লোকের কাছে স্টিভেনসন সাহেব ছিল একটি পরিচিত নাম। ইওরোপিয়ান হয়েও ইন্ডিয়ানদের সাথে সচরাচর দুর্ব্যবহার করেননি কোনোদিন। কুমুদরঞ্জন ফুটবলপ্রেমী মানুষ। হয়ত সেই কারণেই তার সাথে সখ্যতা গড়ে উঠেছিল এই ভদ্রলোকের।
হঠাৎ এলোমেলো হয়ে যাওয়া মনটা গুছিয়ে নিতে একটু সময় লাগে। তারপর টেবিলের সামনে এসে দাড়াঁয় সত্যপ্রিয়। আজ থেকে নতুন জীবন শুরু হচ্ছে তার। ছাত্রছাত্রীদের দিকে তাকিয়ে সত্যপ্রিয় জিজ্ঞেস করে, 'তোমরা জাতীয় সংগীত গাইতে জানো?'
সমস্বরে আওয়াজ ওঠে, 'হ্যাঁ-অ্যা-অ্যা-অ্যা..'
-' উঠে দাঁড়াও সকলে... ' সত্যপ্রিয় আদেশ করতেই সকলে উঠে দাঁড়ায়। গান শুরু করতেই সকলে গলা মেলায় তার সাথে। গান শেষ হতেই সত্যপ্রিয়র নজরে পরে দরজার বাইরে একটি লোক দাঁড়িয়ে। তার দিকে তাকিয়ে হাসছে। মাথায় উস্কোখুস্কো কাঁচা পাকা চুল । পরনে হাফপ্যান্ট। বুক খোলা সার্ট। হাতে একটা কলমছুরি। একটি পা শীর্ণ, বাঁকা। বারান্দার থাম ধরে দাঁড়িয়ে আছে। কাছে আসতেই অবাক হয় সত্যপ্রিয়,
-' আরে ছবিলাল,তুই...! '
-' চিনতে পারতেসিস?' হাসিটা আরো চওড়া হয় ছবিলালের।
-' চিনবো না তোকে! কেমন আছিস তুই? '
ছবিলাল বলে, ' ভাল। তুই কিমন আছিস? '
-' ভাল, কিন্তু তোর এরকম চেহারা হয়েছে কেন? দুব্-লা হয়ে গেছিস। কোনও অসুখ করেছে নাকি তোর? '
-' নেহি তো, কুনো আসুখ নাই। ঠিক আছি। তুই তব্ এই ইস্কুলের মাস্টর হয়ে গেলি রে সতু।'
-' হ্যাঁ রে, কী আর করব বল। বাবা অসুস্থ... '
কথাটা শুনে হাসি মিলিয়ে যায় ছবিলালের মুখে, ' কিমন আছে মাস্টরজি? বিমার আছে শুনতেছিলাম। '
-' ভাল নেই রে। চিকিৎসা হচ্ছে। তুই কেমন আছিস বল। কতদিন পর দেখা।'
ছবিলাল বাগানের স্কুল থেকে পাশ করার পর আর পড়াশুনা করতে পারেনি। চলে গেছিল ভুটানে মামার সাথে কাজ করতে। বাবা মারা গেলে আবার ফিরে এসে বাগানের কাজে যোগ দেয়। এখন অফিস কম্পাউন্ডের মালি। খবর পেয়ে বন্ধুকে দেখতে এসেছে। এ সেই ছবিলাল যে এই স্কুলেই সত্যপ্রিয়র সহপাঠী ছিল। 'মাস্টরজি-কর-বেটা' র ভক্ত ছবিলাল সবসময় ছায়ার মত সঙ্গে থাকত সত্যপ্রিয়র। আজ বড় অদ্ভুত ভাবে যোগাযোগ ঘটে গেল তার সাথে। স্কুল চত্বরের চারপাশে বড় বড় ঘাস জন্মেছে দেখে ছবিলাল জানায় একদিন এসে সে সব পরিস্কার করে দিয়ে যাবে।
চাকরি পেয়ে প্রথমদিন স্কুলে যাওয়ার জলছবি আজও বিবর্ণ হয়ে যায় নি সত্যপ্রিয়র মন থেকে। মনে হয় এই যেন সেদিনের কথা। মাত্র বছর তিনেকের শিক্ষকতা। অল্পদিনের প্রচেষ্টায় স্কুলের পরিবেশটা আমুল বদলে দিতে পারায় মনে একটা আনন্দ ছিল। বাচ্চা বাচ্চা ছেলেমেয়েগুলোও তাকে ভালবেসে আপন করে নিয়েছিল। তাদের সংস্কৃতি মনস্ক করে তোলার লক্ষ্যে পড়াশোনার সাথে সাথে তাদেরকে দিয়ে গান-বাজনা, নাটক, আবৃত্তি এসব করাতো সত্যপ্রিয়। ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে সত্যপ্রিয় ঠিক কেমন ছিলেন তা জানার খুব ইচ্ছে জেগেছিল সুবর্ণর মনে। সেই ইচ্ছেপূরণ ঘটে যায় সত্যপ্রিয়র কাছ থেকে অপর্ণার মোবাইল নম্বরটি পাওয়ায়। অপর্ণা অর্থাৎ সেই মেয়েটি যার সাথে প্রথমদিন স্কুলে যাওয়ার সময় দেখা হয়েছিল সত্যপ্রিয়র। সুবর্ণ জানতে পারে অপর্ণা এখনও তাঁর খোঁজ নেয়। দৃষ্টি শক্তি হারানোয় চোখে পড়তে পারেন না বলে কখনও সখনও সত্যপ্রিয়কে খবরের কাগজের কোনও বিশেষ সংবাদ কিংবা কবিতা পাঠ করে তাঁকে শোনায়। অপর্ণার স্বামী ছিলেন ডাক্তার, সদ্যপ্রয়াত হয়েছেন। ছেলেমেয়েরা দুজনেই প্রতিষ্ঠিত ডাক্তারি পেশায়। সে নিজে গান জানে। গৃহবধূ হয়েও সংসার সামলে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে সে গান গায়। এছাড়াও সে একজন বাচিক শিল্পীও বটে। এমন আরো কয়েকজন কাজলিডাঙার কৃতি সন্তান যারা সত্যপ্রিয়র কাছে লেখাপড়া শিখেছেন তাদের সাফল্যের কথা শুনলে মনটা বড্ড আনন্দে ভরে ওঠে অশীতিপর সত্যপ্রিয়র।
নিজের সম্পর্কে বিশদে কিছু বলতে চান না সত্যপ্রিয়। তাই অপর্ণার কাছ থেকে তাঁর মাস্টার-কাকু সম্পর্কে জানতে চেয়েছিল সুবর্ণ। মাস্টার মশায়ের কথা বলতে গিয়ে ছাত্রীর প্রতিটি কথায় ঝরে পড়েছিল গভীর শ্রদ্ধা,
-' দেখুন, কাকু আমাদের কাছে যে ঠিক কি ছিলেন বলে বোঝাতে পারব না। উনি আমার দেখা একজন শ্রেষ্ঠ আদর্শ পুরুষ। দেখতে যেমন সুদর্শন ছিলেন, তেমনি ছিল তাঁর ব্যক্তিত্ব। কখনও আমাদের সাথে জোরে কথা বলেননি। অথচ তাঁকে দেখলেই আমাদের সম্ভ্রম জাগত। ভয়ও পেতাম। আমি অঙ্কে কাঁচা ছিলাম। উনি এত সহজ করে বুঝিয়ে দিতেন যে সেই ভীতি আমার অচিরেই কেটে যায়। কাকুর সংস্পর্শে এসেই আমাদের প্রত্যেকের মধ্যে গড়ে উঠেছিল সাংস্কৃতিক বোধ। উনি আমাদের দিয়ে যেমন স্বাধীনতা দিবস পালন করাতেন, তেমনি একবার উনি আমাদের মত ছোট ছোট বাচ্চাদের দিয়ে মণিমেলাও করিয়েছিলেন।
-' মণিমেলা ! চা-বাগানের মত জায়গায়!'সুবর্ণ বিস্মিত হয়।
-'হ্যাঁ, একদম...উনি সেটা সম্ভব করেছিলেন। শুধু তাই নয় উনি আমাদের লেখায়,ছবি আঁকায় উৎসাহ দিতেন। আমাদের কিছু লেখা ও আঁকা ছবি কলকাতায় পাঠিয়েছিলেন, 'শুকতারা' 'সন্দেশ' ইত্যাদি পত্রিকায়। দু' একটি ছাপাও হয়েছিল। ওঁর কাছে আমরা আবৃত্তি শিখেছি। উনি আমাদের সঠিক উচ্চারণ শেখাতেন। আমাদের দিয়ে নাটক করিয়েছিলেন। 'বাসন্তিকা' কালিদাস' এরকম আরো অনেক নাটক যেগুলো এই মুহূর্তে ঠিক মনে পড়ছে না। সেসময় আমাদের বাসা লাইনের কোয়ার্টারের বারান্দায় মায়েদের শাড়ি উইংসের মতো টাঙিয়ে নাটক মঞ্চস্থ হতো। বেছে নেয়া হতো এমন সব বারান্দা যেখানে মুখোমুখি দুটি দরজা থাকবে। একদিকে প্রবেশ অন্যদিকে প্রস্থান। মাঝের জায়গাটি হত মঞ্চ।" বলেই হেসে ওঠেন অপর্ণা ।
নাটকের কথাগুলো শুনতে শুনতে সুবর্ণর মনের পর্দায় ভেসে উঠতে থাকে শৈশবের স্মৃতিময় সন্ধেগুলো। স্বপ্নপুরে বিনুকাকার কোয়ার্টারের বাইরের বারান্দায় সন্ধে হতেই বাতি জ্বলে উঠতো। ওটা ছিল 'রিহার্সাল শুরু হতে যাচ্ছে' সেই বার্তা জানানোর সিগন্যাল। অফিস থেকে ফিরে চা-জলখাবার খেয়ে বাবুরা সব গুটিগুটি পায়ে হাজির হতেন সেখানে। 'মাঈজি'রাও পেছন পেছন চলে আসতেন 'পাকঘরে'র পাট চুকিয়ে। তিন্নিদের ভেতরের বারান্দাতেও রিহার্সাল হতো নাটকের। নীলপাহাড়িতে আসার পর কোনোদিন নিজেদের অপরিসর বসার ঘরে, কোনোদিন অজিতদাদুর কোয়ার্টারের বিশাল ড্রয়িং রুমের টিমটিমে বাল্বের আলো আঁধারি ঘেরা সন্ধেগুলো যেন ডাক দিয়ে চলে যায় বুকের ভেতর। বিনুকাকার বারান্দাটা ছাড়া আর সবজায়গাতেই দুদিকে মুখোমুখি দরজা ছিল। সুবর্ণ ঘুরে তাকায় স্মৃতিতে কড়া নেড়ে ফিরে যাওয়া দিনগুলোর দিকে। বাবা দরজার আড়াল থেকে প্রম্পট করতে করতে নির্দেশনা দিচ্ছেন। আর একে একে বারান্দায় প্রবেশ করছেন কখনও অসিতদা-মিলিকাকিমা, কখনও নিরুকাকা, রুমিদি, কখনো মা, গোপাল কাকা, ভানুজ্যাঠা । আবার কখনো নিজের অংশটুকু এলে কাউকে প্রম্পটের জন্য বইটা ধরিয়ে বাবা নিজেই ঢুকে পড়ছেন এক দরজা দিয়ে। ডায়ালগ বলেই অন্য দরজা দিয়ে প্রস্থান। স্বপ্নপুরে থাকতে স্থায়ী প্রম্পটার ও নির্দেশক ছিলেন ডাক্তারদাদু। নাট্যমোদী মানুষ। বিনুকাকার প্রশস্ত বারান্দার এককোনে চেয়ারে বসে থাকতেন চিরকালীন দর্শক অপিসদাদু। যিনি শত অনুরোধেও কোনোদিন মঞ্চে ওঠেননি। পায়ের ওপর পা তুলে বসে পায়ের পাতা আয়েশ করে হাত বুলোতে বুলোতে কারো অভিনয় ভাল লাগলে মন্তব্য ছুঁড়ে দিন, ' বাঃ, বাঃ, চমৎকার'। আবার তেমন ভাল না লাগলে বলতেন, 'আরেকটু সরগর হলেই, ভাল হবে নে।' আরো আরো অজস্র স্মৃতির ঝাঁক ছুটে আসছিল ঝড়ের বেগে। অপর্ণা মিত্রর কথায় প্রতিহত হয় স্মৃতির ঢেউ।
অপর্ণা বলতে থাকেন, 'আমি একটি নাটকে সেজেছিলাম কাঞ্চির রাজপুত্র। রাজকন্যা রত্নাকে ইম্প্রেস করতে আমাকে একটি গান গাইতে হবে। গানটি দীপক রাগের ওপর। তখন তো আমি শিশু। ক্লাস থ্রি-ফোর এ পড়ি হবে। আমি কি আর তখন অত কিছু জানি, কোনটা 'দীপক' আর কোনটা 'ভৈরবী' রাগ। কাকু আমার মাকে বলে দিয়েছিলেন ঐ গানটি শিখিয়ে দিতে। মা শিখিয়ে দিয়েছিলেন। তো সেই গানটি গাইতে গাইতে আগুন জ্বলে উঠবে এমনই একটি দৃশ্য ছিল। সে আগুনও জ্বালানো হয়েছিল বারান্দা- মঞ্চের ওপর কাকুরই নির্দেশনায়। এই নাটকটি হয়েছিল ম্যানেজারের অফিসের বারান্দায়। সাহেব-মেমসাহেব সকলেই নাটক দেখাতে এসেছিলেন। কাকু ইংরেজিতে নাটকের সিনপসিস পাঠ করে শুনিয়েছিলেন নাটকের আগে। কি সুন্দর করে বলছিলেন তিনি। আজও মনে পড়ে।'
-' আজকের দিনে চা -বাগানের মতো প্রত্যন্ত অঞ্চলে সমস্ত সুযোগ সুবিধে থাকা সত্ত্বেও এতসব ভাবাই যায় না, তাই না।' সুবর্ণ বলে।
-' একদম, আসলে কি জানেন, ইট ডিপেন্ডস। মানুষ চাইলে কিনা পারে। আজও সম্ভব। কিন্তু শুধু চা বাগান কেন কোথাও কাকুর মত এরকম মানসিকতার মানুষ আজকের দিনে বিরল যিনি নিঃস্বার্থ ভাবে নীরবে শুধুমাত্র ভালবেসে কাজটা করে যাবেন। এখন তো আমরা সকলেই ভীষণ 'আমি' 'আমি' করে চলি সর্বক্ষণ। নিজেকে লাইম লাইটে আনার শুধু প্রাণান্ত প্রচেষ্টা।'
-' উল্লেখযোগ্য কিছু না করেই অনেক কিছু পাওয়ার প্রত্যাশা।' সুবর্ণ যোগ করে।
' একদম...ঠিক তাই। তবে শুধু সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডই নয়। উনি ঐ হতশ্রী স্কুলটার সৌন্দর্যও ফিরিয়ে এনেছিলেন। একজন লোককে দেখতাম প্রায়ই আসত হাতে দা, কোদাল এসব নিয়ে। পা-টা পোলিওয় আক্রান্ত । কষ্ট করে হাঁটতে হত তাকে। সে ছিল আবার কাকুর সহপাঠী... '
-' ছবিলাল...?'
-' হ্যাঁ, হ্যাঁ ঠিক...কাকু বলেছে তাহলে... কি সহজ সরল মানুষ ছিল সে...আমাদের সাথে হেসে কথা বলত, মজার মজার গল্প শোনাত। তো, সে এসে স্কুলের চারপাশটা পরিস্কার করে জমি কুপিয়ে বেড তৈরি করে দিয়ে যেত। কাকু নিজের পয়সা খরচ করে 'সাটন' কোম্পানির বীজ আনাতেন কলকাতা থেকে। সেই বীজ থেকে চারা তৈরি করে আমাদের দিয়ে লাগাতেন। আমরা সকলে মিলে ফুলের পরিচর্যা করতাম। ফুল ফুটলে আমাদের সেকি আনন্দ।'
-' উনি যেমন ফুলের বীজতলায় বীজ রোপণ করেছেন তেমনি আপনাদের মনে বীজতলাতেও হয়ত সেভাবেই আদর্শের বীজ বুঝেছিলেন।' সুবর্ণ বলে।
' খুব ভালো বললেন। একদম তাই। আসলে আগেই বলেছি কাকু ছিলেন একটি আদর্শ চরিত্র। যাঁকে আমরা অনুসরন করতাম। অনুকরণ করা বোধহয় অসাধ্য ছিল। কাকু ছিলেন প্রচন্ড উদ্যমী। একটি নির্দোষ চরিত্র। যাঁর প্রতি অভিভাবকদের ভরসা ছিল। বাড়িতে টিউশনি পড়ানো থেকে শুরু করে কখনও আমাদের দিদিদের কাউকে জলপাইগুড়ি কি কুচবিহারে নিয়ে যেতে হলে বাবা জেঠাদের একমাত্র ভরসা ছিলেন কাকু।'
দিন চলে যায়। বদলে যায় সবকিছু। বদলায় না শুধু স্মৃতি। স্মৃতির বয়স বাড়ে না। ধূসর হয়েও একেবারে মুছে যায়না কত কিছুই। যেমন মোছেনি সত্যপ্রিয়র মন থেকে। যেমন ভোলেনি অপর্ণা। শুধু দিনবদলের সাথে বদলে যায় পরিস্থিতি। সেদিনকার সেই উদ্যমী, জীবনমুখী, টগবগে মানুষটি আজ গৃহবন্দী। দৃষ্টি হারিয়েছেন। হারিয়েছেন আরো অনেক কিছু। আজ তার দিন কাটে নিঃসঙ্গতার মাঝে হাজারো তিক্ত মধুর স্মৃতির আনাগোনার ভেতর। এতকাল একা একাই স্মৃতিচারণ করতেন। হঠাৎ করে সুবর্ণ এসে হাত ধরেছে তার। তাকে নিয়েই এখন স্মৃতির সরণি বেয়ে সত্যপ্রিয়র নিত্যদিনের আসা যাওয়া
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴