আমি এক যাযাবর (সপ্তদশ পর্ব)/শৌভিক কুন্ডা
আমি এক যাযাবর (সপ্তদশ পর্ব)
শৌভিক কুন্ডা
সন্ধ্যের চায়ের কাপ নিয়ে পরিচয় হ'ল পাশের ঘরের প্রতিবেশীদের সাথে। এবং গানে-কবিতায় আড্ডা জমে উঠলো, টানা বারান্দাটিতে চেয়ার-টেবিল সাজিয়ে। সামনের লনে মেক্সিকান ঘাসের সবুজ, নানা রঙের ক্যাকটাস, এ্যাজেলিয়া, আর অর্কিডের ওপর স্তিমিত বিজলী বাতি। বাচ্চা মেয়েটি, স্নেহা, ক্লাস নাইন, কিন্তু কবিতার হাত বয়সের তুলনায় অনেকটাই বেশি পরিণত। ইংরেজি আর হিন্দিতেই লেখে। কিশোর বাবু, ভট্টাচার্য, খুব ভালো গান করেন, মূলত পুরনো দিনের হিন্দি গান। আড্ডার মাঝে আর এক দফা চা নিয়ে তারা দাজুও যোগ দিলেন। এবং, সঙ্গে গানের খাতা! গান ছাড়াও, তারাশঙ্কর থাপার গল্পের ভান্ডার অফুরন্ত। বিশেষ করে এতদঞ্চলের আর্থসামাজিক ক্রমবিবর্তনের ইতিহাস, গত ছ'দশক ধরে (ওঁর বয়স এখন ৭২), নিবিষ্ট দর্শীর সাক্ষ্য বয়ে আনে।
রাতের খাওয়া একসাথেই সারলাম, এবং এই ঘন্টা দুয়েকের যোগাযোগেই আমি যেন ওঁদেরই পরিবারের সদস্য হয়ে উঠেছি, সেভাবেই পরিবেশন (সাথে বকাঝকাও এমন কি!) করলেন শ্রীমতী ভট্টাচার্য। পরদিন সকালে অমৃত আবার আসবে, আমাকে ডিমার ধারে নিয়ে যাবে, এমনটাই ঠিক ছিলো। কিন্তু ভট্টাচার্য পরিবার সে প্রস্তুতিকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে কথা আদায় করে নিলেন, যাতে ওঁদেরই সঙ্গী হই!
সেইমতো পরদিন সকাল সকাল ব্রেকফাস্ট সেরে জয়ন্তীর দিকে রওনা। কিশোর নিজের গাড়ি চালিয়েই এসেছেন গুয়াহাটি থেকে। সে বাহনেই যাত্রা। জয়ন্তীতে গাড়ি থেকে নামতেই হাসি ছড়িয়ে এগিয়ে এলো মিলন, হাত জড়িয়ে ধরলো। ভুটিয়াবস্তিতে ক' মাস আগেই যখন আসি, মিলনই ছিলো আমাদের মহাকাল দর্শনের পথপ্রদর্শক। হ্যাঁ, ফরেস্ট ডিপার্টমেন্ট স্বীকৃত 'গাইড'। ভ্রমণতৃষ্ণা এ ভাবেই যে কত বন্ধু জুটিয়ে দিয়েছে আমাকে! কিন্তু এ যাত্রা মিলনকে সাথে পাই নি, বুকিং কাউন্টার থেকে যাঁদের টার্ন সেই গাড়িচালক এবং গাইড আমাদের নিয়ে চললেন পুখুরি পাহাড়। পোড়া গন্ধ আসছিলো নাকে, বুনো পাহাড়ি পথের দু পাশে পোড়া কাঠের কালোও দেখতে পাচ্ছিলাম। গাইড বললেন এ সব বস্তিবাসীদের কীর্তি! আর এ কারণেই নাকি 'সাইটিং'এর আদর্শ আবহাওয়া থাকা সত্ত্বেও তেমন কিছু চোখে পড়ছে না! আমার আক্ষেপ নেই তাতে, বুনোদের চাক্ষুষ করতেই হবে, এ মানসিকতা নিয়ে জঙ্গলে আসি না কখনো। দিনদুপুরেও ঝিঁঝির ডাক, পাতা ঝরার শব্দ, সবুজের সমারোহ আমার জন্য যথেষ্ট। সেভাবেই মুগ্ধতা পথের পাশে অলিভ গ্রীণ লেক দেখতে পেয়ে! আসলে, ঝোরা বদ্ধ, তার ওপরে কচি শ্যাওলার চাদর বেছানো! পুখুরি আমি অনেক বার ঘুরেছি, একবার বুদ্ধপূর্ণিমার রাতেও। ডিপার্টমেন্টাল ঝক্কি পোহাতে হয় নি সেবার, জয়ন্তী রেঞ্জ অফিসারের অতিথি হয়ে সে অপার্থিব সৌন্দর্য উপভোগ করতে পেরেছিলাম। যেমন ঐ যে ভুটিয়া বস্তির কথা, আমরাই সম্ভবত সেখানকার শেষ পর্যটক। ফিরে আসার ক'দিন পরেই কাগজে দেখেছি ভুটিয়াবস্তির অধিবাসীদের পুনর্বাসন দেওয়ার কথা। সে হোমস্টেতে থাকতে থাকতেই শুনেছিলাম অবশ্য এরকমই হতে চলেছে। এইসব কথাই ভাবছিলাম বসে বসে। গাড়ির দৌড় শেষে ভট্টাচার্য পরিবার গাইড নিয়ে পায়দল, পুখুরির দিকে। আমি আর উঠি নি। বরং কিছুটা গল্পগাছা চালক ভাইটির সাথে, কিছুক্ষণ স্মৃতি রোমন্থন। এইভাবে আধঘন্টা সময় কাটলো, ওঁরা ফিরে এলেন, গাড়ি ফের ঘুরলো জয়ন্তীর দিকে। ভট্টাচার্য পরিবার নদী অঞ্চল ঘুরলেন, আমি একবার অজয়ের বাড়ি, একবার রেঞ্জ অফিস চত্বরে পরিচিত জনের তালাশ নিয়ে ফিরলাম। আবার হোমস্টে। দুপুরের খাওয়া সেরে ফের গাড়ি। ওদেরকে বক্সা ভ্যালি হোমস্টে আমিই ঘুরিয়ে দেখালাম। সঞ্জীব ফেরে নি এখনো। সান্ত্রাঁবাড়ি মোড়ের দোকানে একটু বিশ্রাম। থুকপা। মোমো। এবারের ঠিকানা সিকিয়াঝোরা। শেষ বিকেলের নৌকাসফর। ক'দিন আগেও এসেছিলাম। এই সফরটি, যতবারই আসি, পুরনো হয় না আমার কাছে। ওঁরা প্রথমবার। স্বাভাবিক ভাবেই খুব রোমাঞ্চ ওঁদের। ডেরায় ফিরে বিশ্রাম নেবার আগে কিছুক্ষণ সময় স্টেশন চত্বরে। রাজাভাতখাওয়ার এই প্রত্যন্ত স্টেশনেও লাগোয়া রেল কোচ রেস্টুরেন্ট আছে! এবং পরিপার্শ্বের জন্যই বোধহয়, এ পর্যন্ত যতগুলো রেস্টুরেন্ট অন হুইল দেখেছি, তাদের মধ্যে দেখনশোভায় সেরা হয়ে রইলো এটি! চিকেন নাগেটস নেওয়া হ'ল। ঘরে ফিরে খাওয়া হবে। তৈরি করতে যে সময়টুকু, তারই মাঝে স্টেশনের উল্টো মুখের দোকান থেকে জানলাম গত ক'দিন ধরেই নাকি এ চত্বর, বস্তি (আমাদের হোমস্টে এলাকা) দিয়ে সন্ধ্যের দিকে হাতিরা ঘুরছে!
সন্ধ্যের আড্ডায় হঠাৎ কিশোর বলে উঠলেন, "দাদা, ডিমা যাবেন নাকি?" এবার আমার ডিমা যাওয়া হয় নি, আগেই জানিয়েছিলাম, অতএব এক পায়ে খাড়া। তার ওপর তারা দাজু বললেন উনিও যাবেন সাথে। ৮টা নাগাদ রওনা। দাজুও বললেন, গজদল ঘুরছে কাছাকাছিই, একটু সাবধানে চলতে! না, তাদের মুখোমুখি হতে হয় নি। ডিমা ব্রিজের ওপর আড্ডা যখন চলছে, আমার চোখ অবশ্য ইতিউতি ঘুরছিলো, আর একই সাথে মনে ফিরে আসছিলো কখনো চার্বাক, কখনো রূপণ-প্রদীপ, কখনো বাজু-বান্টিদের সাথে এতদঞ্চলে ঘোরাফেরার স্মৃতি! শেষ তক ঘড়িই জানান দিলো, কাল ভোর রাত্রে আমার ট্রেন, ফেরার। এ যাত্রা অতএব, বিদায় ডিমা, পাম্পুবস্তি, বিদায় গ্রেসি লিপস, বিদায় রাজাভাতখাওয়া!
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴